বিষণ্ণ আলোয় এই বাংলাদেশ, এ আমারই সাড়ে তিন হাত ভূমি…

বহুদিন পর ব্লগানোর ছুটি পেয়েই সুনীলের কোবতে মনে পড়ল-

কুয়াশার মধ্যে এক শিশু যায় ভোরের ইস্কুলে
নিথর দিঘির পাড়ে বসে আছে বক
আমি কি ভুলেছি সব
স্মৃতি, তুমি এত প্রতারক?


 

 

১।

নূর হোসেন মারা গেছেন প্রায় ২৫ বছর আগে। কাকাতালীয়ভাবে অপ্রাসঙ্গিক জীবনানন্দের ভাষায় –

ফুটফুটে জোছনারাতে পথ চেনা যায়;
দেখা যায় কয়েকটা তারা
হিম আকাশের গায় — ইদুর পেঁচারা
ঘুরে যায় মাঠে মাঠে,

ক্ষুদ খেয়ে ওদের পিপাসা আজও মেটে,
পঁচিশ বছর তবু গেছে কবে কেটে

তারপর, নূর হোসেন একখণ্ড স্মৃতিফলক হয়ে চৌরাস্তার মোড়ে শুয়ে থাকেন নিশ্চুপ। ফুলের চাইতেও বেশি পোস্টারে ঢেকে যায় সমাধি। গেরিলা’র কবি বলেছিলেন- বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়। মুশকিল হল, কবিরা কখনও সত্যবাদী হননা, এক কবির স্মরণে দাবী করেছিলেন আরেক জন কবি।

 

 

২।

কোপাকুপি ইজ অন। কি চমৎকার একটা ব্যাপার, তাইনা? আমরা বেশ শান্তিতেই আছি। কোপাকুপি চলছে তাতে আমাদের কি? আসলেই তো। নিজের পশ্চাদ্দেশ যতক্ষণ অক্ষত থাকে ততক্ষণ আসলেই কিছু না। কিন্তু তারপর? সিসিবিতে যারা লিখেছি বা লিখি বা লিখব তারাও তো সবাই বোলগার ওরফে নাস্তিক। তাহলে একদিন কি সিসিবিয়ান কোপানোও জায়েজ হয়ে যাবে? জনমত কি বলে জানতে ইচ্ছে করে। তারেক রহিম (এফসিসি ৯৭-০৩) যখন কোপ খেয়ে আইসিউতে পড়ে থাকবেন ততক্ষণ আমরা চুউপ করে জপব: “আরে, এইডা তো ছহীহ ক্যাডেট না”। জামায়াতের বেতনভূক্ত কর্মচারী একজন বিতর্ক-ব্যাবসায়ী কাম উপস্থাপনা-ব্যাবসায়ী কাম ফেসবুক সেলিব্রিটি যখন সিলেটের একজন এক্স-ক্যাডেট ব্লগারের নামধাম (যেটা তার বইতে এমতিতেই আছে) জোর গলায় প্রকাশ করে দেন চাপাতিবাজেদের দৃষ্টি আকর্ষনের জন্য, তখনও আমরা গা মুচড়ে চোখ ঢেকে ভাবি: “ব্যাটা উদাস কোনও ছহীহ ক্যাডেট হইতেই পারে না”। বিসিসি প্রথম ব্যাচের আহসান কবির ভাই যখন কল্লা ফেলার হুমকি পান, আমরা কি তখন তাকেও হালাল উপায়ে একঘরে করে “ছহীহ ভাতৃত্ববোধ” সমুন্নত রাখব? তবে বেগ ভাই যখন এরেস্ট হবেন তখন আমরা সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠব এটি হতেই পারেনা, মানি না, মানব না ইত্যাদি ইত্যাদি। বেশ চমৎকার ভাতৃত্ববোধ তাই না। অবশ্য, দুঃখ পাবার কিছু নাই, দিনশেষে আমরাও ‘বৃহত্তর পপুলেশনের’ একটা ‘স্যাম্পল স্পেস’ মাত্র। মার্টিন নিয়েমলারকে জুনা’দা স্টাইলে লুঙ্গি পিন্ধে লঙ্গাপ করে রাখা দরকার।

সংশোধনীঃ আমিন ভাইয়ের বক্তব্য থেকে জানতে পারছি তারেক রহিম ক্যাডেট নন। তাতে এই পোস্টের মূল বক্তব্যে তেমন কোনও পরিবর্তন আসে না। ক্যাডেট হোন বা না হোন, তারেক রহিম একজন মানুষ। হিটলার কিংবা গোলাম আজম নন। তবে সেই মানুষটি এই মুহূর্তে একটি আইসিউতে অবস্থানরত। কেন, সেটা সবাই জানি। দেশের তেল-পানি-গেস-বিদ্যুতের নানান সংকট আছে। সেই সঙ্গে আরও আছে মানবতার সংকট। প্রথম সংকটের ব্যাপারে আমরা যদি সরব ও সচেতন হতে পারি, তবে দ্বিতীয়টির ব্যাপারেও কেন নয়? কেউ বলবেন? (এই অনুচ্ছেদ সংযোজনের সময়কালঃ  ১৩.১১.২০১৫, রাত ১১.০০ টা)

 

৩।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে উত্থাপিত অভিযোগে চোখ বুলিয়ে সর্বোচ্চ স্কোরের দিকে ফোকাস করলে আমরা দেখি সাকা চৌধুরী মাত্র অল্প কয়েক জনকে হত্যা করেছিলেন। কামারুজ্জামান হত্যা করেছিলেন ১২০ জন, সৃষ্টি করেছিলেন আস্ত একটি গ্রাম যার সবাই বিধবা। দেলাওয়ার হোসাইন সাইদীর নামে অভিযোগ ৩ সহস্রাধিক মানুষ হত্যার, অন্যান্য অপরাধ নাহয় বাদই গেল। আলী আহসান মুহম্মদ মুজাহীদ হত্যা করেছেন যে বুদ্ধিজীবিদের, তার পরিমাপ ঠিক সংখ্যায় করা কঠিন। মতিউর রহমান নিজামী হত্যা করেছেন ৪৫০ জনকে। যাদেরকে হত্যা করা হয়েছে তাঁদের মানবাধিকার ছিল বলে অনেকেই মনে করেন না। তবে, বিভিন্ন সময়ে অভিযুক্তদের ‘মানবাধিকার’ রক্ষা করতে উদ্বাহু হয়ে এগিয়ে এসেছেন ডেভিড বার্গম্যান। চিঠি দিয়েছেন আব্বাস ফয়েজ, নাভি পিল্লাই, সাইদা ওয়ার্সি সহ স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও আন্তর্জাতিক মানের অনেক মানবাধিকার ব্যাবসায়ীরাই। বিদেশের ঠাকুর ধরতে গিয়ে স্বদেশের কুকুর ধরতেই বা ভুলে যাব কেন? ডাঃ জাফরুল্লাহ থেকে ডঃ আসিফ নজরুল কিংবা ডঃ ইমতিয়াজ আহমদ থেকে আনুশেহ আনাদিল কারও কথাই ভোলা যায় না। এনারা না থাকলে কবেই মানবাধিকারের অপমৃত্যু হয়ে দাফন-কুলখানিও হয়ে যেত, ভাগ্যিস এনারা ছিলেন এদেশে। কি ভাগ্য আমাদের।

 

 

৪।

সিলেটে রাজন হত্যায় ফাঁসি হয়েছে ৪ জনের। খুলনায় রাকিব হত্যায় ফাঁসি হয়েছে ২ জনের। ময়মনসিংহে ফরহাদ হত্যায় ফাঁসি হয়েছে ৬ জনের। আব্বাস ফয়েজের কি চিঠি লেখার প্যাড ফুরিয়ে গেছে? ব্যারনেস সাঈদা ওয়ার্সির ফোনে কি ব্যাল্যান্স শেষ? ব্র্যাড এডামসের কি কলমের কালি সাদা হয়ে গেছে? গ্যাব্রিয়েলা নাউল কিংবা ক্রিস্তফ হেইন্স কি বোবা-কালা হয়ে গেছেন? নাভি পিল্লাই কি বোধশক্তি হারিয়ে ফেলে কোনও স্যানাটারিয়ামে অবসর কাটাচ্ছেন? নইলে, মাত্র ৩ জন মানুষ, তাও পুর্ণবয়স্ক মানুষ নয় শিশু মাত্র হত্যা হয়েছে। এজন্য য়্যাক ডজন মানুষের ফাঁসি হয়ে যাবে? এই কি মানবাধিকার? তাছাড়া, ঐ তিনজন শিশু নিশ্চয় কোনও উগ্রতা করেছিল কিংবা নিশ্চয় তাঁদের জামাকাপড় ঠিক ছিলনা কিংবা নিশ্চয় তারা খুনীদের অনুভূতিতে গুঁতোগুঁতি করেছিল, তাই না? নইলে ১২ জন মানুষ এই ভুল করতেই পারে না। বাই দ্য ওয়ে, মাত্র ৩ জন বাচ্চা খুন করে ফেলার অপরাধে ১২ জন জ্বলজ্যান্ত মানুষের যেখানে ফাঁসি হয়ে যাচ্ছে সেখানে ডাঃ জাফরুল্লাহ কেন চুপ করে বসে থাকবেন? আসিফ নজরুল কি কোনও প্রতিবাদ করবেন না? মতিউর রহমান তৃতীয়বারের মত তওবা না করুন, মানবাধিকার রক্ষার্থে অন্যান্য সম্পাদকদের নিয়ে একটা বিবৃতি-টিবৃতি দেবেন না?

 

 

৫।

আজকে দীপাবলীর ফুটুস-ফাটুস শুনে মনে পড়ল- আরে আজকে না জামায়াতের গোআ মারা গেছিল? গোলামহীন পৃথিবীতে আস্ত একটা বচ্ছর কেটে গেল। ক্লাস সেভেনে কলেজ মিলনায়তনে শোনা র‍্যালফ হজসনের কোবতে মনে পড়ে যায়- টাইম, ইউ ওল্ড জিপসি ম্যান, উইল ইউ নট স্টে? যাকগে, গণআদালতে গোলামের কৌঁসুলি ছিলেন ডঃ আসিফ নজরুল। তিনি আমাদের অনুরোধ করেছেন মৃত ব্যাক্তিকে নিয়ে যেন আমরা কিছু না বলি। আমরা যেন হিটলারের কর্মকান্ড চেপে যাই, কেননা তিনি মারা গেছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান কে যেন আমরা মাপ করে দিই জাপানে দুটো খেলনা পারমাণবিক বোমা ফেলার জন্য, কেননা ট্রুম্যান মারা গেছেন। ইয়াহিয়া আর টিক্কা খানকে তো আমরা মারা যাবার আগেই মাপ করে দিতে চাই, হাজার হলেও এককালে ভাই ভাই ছিলাম। আবু জেহেল কিংবা আবু লাহাবের নামে ভুলেও কেউ গালাগালি দেবেন না, কেননা দুই ভদ্রলোকই মারা গেছেন। আমরা যেন এরশাদ সিকদারকে মাপ করে দিই, মরে গিয়েছেন বলে। বিমূর্ত গোলামানুভূতির প্রতি শ্রদ্ধা রেখে, গোলামহীনতার বর্ষপুর্তিতে, মারা যাওয়া গোলামের জন্য- আমরা তাই সমবেদনা জানাই। আমরা দোয়া করি, পরপারে একেলা গোলামটির একাকীত্ব তাড়াতাড়ি ঘুচে যাক। প্রার্থনা করি, গোলামহীন পৃথিবীতে গোলামের ইয়াতীম সঙ্গী সাথীরাও সাত তাড়াতাড়ি যথাযথ মাধ্যম অনুসরন করে যেন তাঁর সঙ্গী হতে পারেন। রাজা লক্ষণ সেন স্টাইলে গোলামের মত পেছন দিয়ে পালালে কিন্তু হবে না। গোলামহারা এই পৃথিবীটা কেবলই মানুষের হয়ে উঠুক। আমেন।

 

১০.১১.২০১৫

১১ টি মন্তব্য : “বিষণ্ণ আলোয় এই বাংলাদেশ, এ আমারই সাড়ে তিন হাত ভূমি…”

  1. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    আসলেই বলার কিছু নাই।
    এতই অদ্ভুত আমাদের আমাদের ভ্রাতৃত্ববোধ --- জঙ্গি কাজকামের সাথে জড়িত থাকার অপরাধে/সন্দেহে ধরা পড়লে কতই না চিন্তিত হয়ে পড়ি! আর কোপ/কপের হুমকি খেলে স্পিকটি নট। আমাদের ভণ্ডামি আর ভীরুতার শেষ নেই আসলে।

    তারেক রহিম যে এফসিসির এটা জানতাম না। যাক, এসব ঘটনা অলরেডি আউট অফ ফোকাস। আমাদের ক্রিকেট এবং আরও এক গণ্ডা কাজ আছে। কী দরকার!

    জবাব দিন
    • আমিন (১৯৯৬-২০০২)

      নূপুরদা, তারেক রহিম এক্স ক্যাডেট না। এই ভুলটার ইনিশিয়েটর মনে হয় আমিই, তাই একটু ক্লেরিফাই করা দরকার। বুয়েটে (৯৭-০৩) তে দুইটা তারেক আছে, একটা তারেক রবিন আরেকটা তারেক রহিম। দুজনেই আমার পরিচিত এবং দুজনেই আমার পরিচিত ০৩ ব্যাচের সার্কেলের সাথে ক্লোজ এবং চেহারার ধাচেও হালকা মিল আছে। তারেক রবিন হলো এফসিসির এক্স ক্যাডেট। তো নিউজ পড়বার সময় ফেসবুকের ট্যাগ থেকে ক্লিক করে ছবি দেখে রবিন না রহিম খেয়াল না করেই ডিবেট ফোরামে এক্স ক্যাডেট বলেছিলাম। পরে অবশ্য নাবিল ভাই ভুলটা ধরিয়ে দিলে আমি ভালো মত খেয়াল করে ভুলটা ধরতে পারি, এবং সেই কমেন্টের নিচে উল্লেখও করি। তবে কমেন্টের রিপ্লাইয়ে থাকায় সংশোধিত ভুলটা হয়তো দৃষ্টি গোচর হয় না।

      যা হোক, রহিম বা রবিন তাতে পোস্টের মূল সুরের পরিবর্তন হয় না। এদেশের মানুষজন খুব বেশি রকমই কানা হয়ে উঠছে ইদানিং। পাবলিক ট্রেন্ডিংয়ে জনপ্রিয় ফেবু সেলিব্রেটিরাও (যাদের অনেকে আমার প্রগতিশীল ভাব ধরেন) কুপাকুপি নিয়ে কথা বলার সময়ে ভাসুরের নাম মুখে না আনার মত ঢং করেন। তারেক রহিমের বন্ধুই একজন আমার সামনে বলে ফেললো, তারেক তো কবিতা লেখে !! ভাবখানা এমন নাস্তিকতা নিয়ে লেখলে কোপ খেতেই পারে কবিতা লিখে কোপ কেন খাবে? তো কোপ খাবে আস্টে আস্তে সবাই। সহীহ নাস্তিক, অপ্রকৃত নাস্তিক, অমুসলিম, অপ্রকৃত মুসলিম সবাই কোপ খাইয়া সহীহ মুসলিমদের পাছায় যখন দু তিন ঘা পড়বে তখন হয়তো আমাদের আপামর জনতার উপলব্ধি হবে। আমি এখন সেই উপলব্ধির প্রতীক্ষা ছাড়া কোন উপায় দেখি না।

      জবাব দিন
      • ইশহাদ (১৯৯৯-২০০৫)

        ধন্যবাদ আমিন ভাই, সংশোধনীর খবরটা জানা ছিল না। প্রথমালোর শ্লোগান পোস্টে ব্যাবহার করলাম। তবে, তিনি ক্যাডেট না হলেও "তাতে পোস্টের মূল সুরের পরিবর্তন হয় না" এটাই মূল কথা। আমিও উপলব্ধির প্রতীক্ষা ছাড়া কোন উপায় দেখি না।



         

        এমন মানব জনম, আর কি হবে? মন যা কর, ত্বরায় কর এ ভবে...

        জবাব দিন
    • ইশহাদ (১৯৯৯-২০০৫)

      হু, ব্যাস্ত থাকতে চাইলে তো কাজের অভাব নাই,
      ঘোলা করতে চাইলে উজানের পানির অভাব নাই।
      এইসব অকাজের জিনিস নিয়া কে মাথা ঘামায়? 🙁



       

      এমন মানব জনম, আর কি হবে? মন যা কর, ত্বরায় কর এ ভবে...

      জবাব দিন
  2. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    বিষন্ন আলোয় বাংলাদেশ আমার কাছে একটি হৃদয় বিদারক কবিতা।
    সুনীলের কন্ঠে যখন প্রথম শুনি তখন অনুধাবন করলাম হায়রে ৪৭ আমাদের কি করেছে////
    আমরা আমাদের সন্তানদের দেশ থেকে কিভাবে তাড়িয়ে দিয়েছি।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।