হয়নি বলা- “ভালোবাসি”

সিফাত যেদিন প্রথম বুঝতে পারল, ও চৈতি-কে পছন্দ করে, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। কাল চৈতি-কে ছেলে পক্ষ দেখতে আসবে। চৈতি-র বাসার মহাগুরুজন গোছের যারা মানে- বড় চাচা, বড় ফুপি টাইপ পাবলিক (বাবা মা না হয় বাদই দিলাম)- তেনাদের মানসিকতার স্ট্যাটাস অতিমাত্রায় complicated আর কিছুটা মোঘলীয় হওয়ায় “Love Marriege” যে চৈতির ভাগ্যে নাই, তা ওর অজানা নাই। “Love Marriege” -এ Love-টা আগেই শেষ হয়ে যায়, Marriege-এর পরের লাইফের জন্য আর বিশেষ কিছুই অবশিষ্ট থাকে না- এই ধরণের কোনো এক বিশেষ দীক্ষায় হয়তো দীক্ষীতো সেই গুরুজন-গোষ্ঠী।
কাজেই “Love Marriege” কে সাধুবাদ জানানোর কোনও লোক ছিল না বললেই চলে।

ছেলে ঠিক করেছেন আরেক মহাগুরুজন – রশিদ খালু, রিটায়ার্ড আর্মি পার্সন। দেখে বোঝাই যায় না এই বৃদ্ধের বয়স এখন প্রায় ৬০ এর কাছাকাছি! কঠিন বদমেজাজি আর প্রচন্ড একরোখা লোক রশিদ সাহেব। Always “মুই কী ছিনু রে type একটা ভাব তার ঠোঁটের দু’ধার দিয়ে ঝুলে থাকা খানদানি মোছ-টা দেখলেই Idea করে নেওয়া যায়। তবে নিজের কোনও সন্তানাদি নাই বলেই হয়তো এ-বাড়ির একমাত্র মেয়ে চৈতিকে ভিষণ আদর করেন রশিদ সাহেব। যাহোক, কোনও এক অজ্ঞাত কারণে এই রিটায়ার্ড বৃদ্ধের এই বাসার মানুষগুলোর উপর একটা অদৃশ্য আধিপত্য আসে। So, এই লোক যে পাত্র ধরে আনবে, সঙ্গত কারণেই সেই ছেলেকে ফেলনা ভেবে গুরুত্ব না দেওয়ার কথা না (হয়ও যদি সে আস্তো একটা ষাঁড়!!)

‘ষাঁড়’-এর নাম আনিছ। ডঃ আনিছ সুবহান। ছেলের Biodata-এক কথায় শীরাআআআআআআ…ম। রংপুর মেডিকেল কলেজের-ই এক কালের Bright Student ছিলেন ডাক্তার সাহেব। শোনা গেছে- তেনাদের Batch-এর সেই সময়ের শ্রেষ্ঠ যে কয়জন আঁতেল ছিল, উনি তাদের-ই একজন। অল প্রফেশনাল পরীক্ষায় place-করা student আমাদের এই আনিছ আতেঁল। বর্তমানে রংপুরের-ই একটা Private Hospital -এ M.O.(Medical Officer) হিসেবে আছেন এই ভদ্রলোক। (প্রাইম না ক্রাইম কী যেন নাম হাসপাতাল-টার…এই মুহুর্তে মনে আসছে না সিফাতের)। In short বৃদ্ধ রশিদ সাহেব বেশ তোড়-জোড় করেই সম্পন্ন করেছেন এই পাত্র খোঁজ- the search. সিফাত কী মনে করে একবার লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতেও গিয়েছিল এই চিড়িয়াকে। পাত্রের সব-ই ঠিক…ই আছে, শুধু দেখতে একটু কালো, নাকটা একটু থ্যাবড়া… এই-ই যা আর কি। তাতে কী, সংসারের সুখ-স্বাচ্ছন্দের জন্য এই সব জরুরী না। বরং কালো ছেলেরা নাকি স্বামী হিসেবে ভাল হয়। (রশিদ সাহেবের ভাষ্য, আমার না।)
সিফাত-ও দেখতে শুনতে কোনভাবে আনিছের চেয়ে কম কীসে, মনে মনে ভাবে সিফাত। পড়ালেখায়-ও ভালো (আতেঁলের পর্যায়ে না যেতে পারলেও, খুব বেশি পেছনের না সে)। চেহারার মধ্যে একটা Lover boy টাইপ ভাব থাকায় অগত্যা ব্যাচের পোলাপাইন Lady Killer ভাবলেও, the fact is- ও এখন পর্যন্ত কোনও Lady-রে kill করে নাই। সিফাত-ও এই মেডিকেল কলেজেই পড়ে, চৈতি-র Group-এই। আনিছ ব্যাটা-র চেয়ে শুধু একটা ব্যাপারেই মার খেয়ে গেছে সিফাত। আর তা হলো, সিফাতের Establish হতে এখনো at least একবছর লেগে যাবে। সবে তো ইন্টার্নশীপ চলছে ওর। আনিছের সাথে অনেক্ষণ ধরে নিজের তুলনা করে এইটা ভাল করে বুঝেছে সিফাত যে, আনিছের পাল্লা এখনো ঢের ভারী। আর সবচেয়ে বড় মাইনাস (-) পয়েন্ট- সিফাতের ভেতরে চৈতি-কে নিয়ে জমে থাকা এসব কথার কিছুই জানে না চৈতি। কেন যেন সাহস করে কখনো চৈতি-কে বলা হয়ে ওঠেনি মনের ভিতরের লুকানো এই কথাগুলো। আর সিফাত কি জানতো যে, ও নিজেই একদিন ওর বেস্ট ফ্রেন্ড এই মেয়েটাকেই ভাবতে শুরু করবে বন্ধুর চেয়েও একটুখানি বেশি করে…!!! গত পরশু চৈতির বিয়ের খবরটা শোনার পর থেকেই সিফাত নিজেকে নতুন করে চিনেছে, জেনেছে চৈতি ওর হৃদয়ে কী বিশাল এক স্থান জুড়ে রয়েছে। চৈতি প্রায়ই ওকে বলতো, “আই, সিফফু, আমরা দুইজন বিয়ে করে ফেললে ক্যামন হয় বল তো!!!” সিফাত বরাবর-ই এইটা শুনে দম ফাটা হাসি দিয়ে চৈতিকে খেপাতে ভোলেনি একবারো। তার মানে কী এই না, যে চৈতি-র মধ্যেও সিফাতের জন্য একটা জায়গা আছে কিংবা কে জানে হয়তো আরো আগে থেকেই ছিল……!!
সিফাতের মাথা একেবারেই কাজ করছে না একদম। ও কি একবার যাবে কাল চৈতির ওখানে? ওর সাথে সামনা-সামনি একবার কথা বলাটা খুব জরুরি………,ভাবে সিফাত। সবুজ পাড়-এর ঐ নীল দিগন্তের রক্তিম যে সূর্যটা গতকাল-ও চমৎকার দেখাচ্ছিল, সেই এক-ই সূর্যকে আজ এতো বাজে লাগছে ক্যানো……উফফ… এত্ত বিভৎস কেনো সূর্যটা। কুৎসিত কালো ঐ সূর্যটা কি ওকে গ্রাস করে নিতে চায় অন্ধকারের সীমানার ভেতর…??

এইতো গত সপ্তাহেই তো। ব্যাচ পিকনিকে সবাই যাবার জন্য এক পায়ে খাড়া। হঠাত সিফাত গোঁ ধরে বসল, ও এইবার যাবে না। (না যেতে চাওয়ার কারণ টা অবশ্য আজও অজানা)। যাহোক, সবার তো মাথায় হাত। ব্যাচের নামিদামি singer হিসেবে সিফাতের ভালোই সুনাম। ও না গেলে কি হয়!!!! হাজার বলে কয়েও ওরে রাজি করাতে পারেনি কেউ। রাজি করিয়েছে ওই চৈতি। সিফাত ভেবেই পায় না, কী যেন একটা আছে এই অদ্ভুত মেয়েটার মধ্যে। আচ্ছা কীসের এতো মায়া ওর মুখটায়,ওর চোখের গভীরে… সিফাত ভেবে পায় না। নির্মল ওই মুখটার কোথায় যেন একটা কী কষ্ট লুকিয়ে থাকে সবসময়। অথচ সবার মুখে হাসি ফোটানোর জন্য যদি ever-ready কেউ থেকে থাকে, তাহলে তাও ঐ চৈতি-ই। লুকিয়ে থাকা সেই কষ্টটাকেই এখন খুঁজে বের করতে চায় সিফাত। কই, দু’দিন আগেও তো চৈতিকে নিয়ে এরকম খেয়াল আসেনি সিফাতের!! পাঁচ পাঁটা বছর ধরে কলেজের সবচেয়ে consistent আর সেরা বন্ধুত্বের যদি Rating করা যায়, শিফাত-চৈতি-র নাম সেই লিস্টে প্রথম কাতারে থাকবে-চোখ বন্ধ করে বলে দেয়া যায়। আর আজ ওকে নিয়েই নতুন জীবন শুরু করার স্বপ্ন দেখছে সিফাত। নাহ্, কাল অবশ্যই যাবো চৈতির সামনে, সবকিছু বলবো ওকে, অন্তত আমার সামনে দাঁড়িয়ে তো বলুক। কিন্তু যা করার ঐ আনিছ ব্যাটা কাল ওকে দেখতে আসার আগেই করতে হবে…ভাবতে থাকে সিফাত।

চৈতি সম্পর্কে পাঠকদের একটু জ্ঞান দেয়া যাক। Always হাসিখুশি, চঞ্চল, অনেক ফ্রেন্ডলি আর ফান লাভিং একটা মেয়ে চৈতি। ওই যে বলে না, ‘চুলবুলি’ টাইপের অনেকটা। নিজের শত কষ্ট আড়াল করে রেখে অন্যের মুখে হাসি এনে দেওয়ার জন্যেই যেন তারে এই পৃথিবীতে নাযিল করা হইছে। And the most important thing is—- She Loves Sifat. 🙂
সিফাত যে তার ধ্যান-জ্ঞ্যান-মনের ভেতরের কত বড় একটা অংশ জুড়ে আছে- প্রবলেম হলো তা আল্লাহ আর চৈতি নিজে ছাড়া এই দুনিয়ার আর কেউ জানে না। হয়তো চৈতিও জানতো না, ভিতরে ভিতরে কখন ওর মনের গভীরে সিফাতের জন্য তৈরি হয়েছে এই ভালোবাসার এই অদৃশ্য জাল…!
চৈতি এটা জানে- এই ক্লাসের এতোগুলো classmate-এর মধ্যে সিফাতের সবচেয়ে বড় শুভাকাঙ্খি যদি কেউ থাকে তো সেজন ও নিজে, কিন্তু জানে না- এরই নাম কি ভালোবাসা?
সিফাতকে নিয়ে কেউ দু’টা কটু comment করলে ওর ভিষণ রাগ হয়, চৈতি এটা জানে, জানে না শুধু, -এর-ই নাম কি ভালোবাসা?
ক্লাসের কর্ণারের ঐ ৫ নাম্বার বেঞ্চটা (সিফাত যেখানে প্রতিদিন বসে), একদিন ঐ সীটটা খালি দেখলেই চৈতির মন ছটফট করে phone করে ওর খোঁজ না নেওয়া পর্যন্ত, কিন্তু ও জানে না, এটাই ভালোবাসা তো, না কি অন্যকিছু? এভাবেই কেটে গ্যাছে পাঁচ পাঁচটা বছর। সব বলা হয়েছে, শুধু বলা হয়ে ওঠেনি একটি শব্দের সেই ছোট্ট কথা “ভালবাসি”। কোনওদিন বলার সুযোগ পাবে তো চৈতি…??? নাকি মনের কথা মনেই থেকে যাবে এভাবে!!!!

******************************************
I N T E R M I S S I O N
******************************************

পরের দিন, ভোর ৬ টা। গাড়িটা প্রচন্ড স্পীডে ছুটে এসে হার্ড ব্রেক করে থামলো Emergency Unit-এর মেইন গেট-টার সামনে। একগাদা নীল ড্রেস পড়া হসপিটাল বয় আর নার্স ছুটে যাচ্ছে গাড়িটার-টার দিকে। গতরাত থেকে unit-এ on duty-তে ছিলো সিফাত। সারারাত বেচারা ঘুমাতেও পারে নি ভালো করে। চৈতিকে কিভাবে সবকিছু খুলে বলবে, কখন বলবে, এমনকি বাবা-মা মেনে না নিলে পালিয়ে বিয়ে করার কথাও ভাবছিল সিফাত- এইসব কত ভাবনা, সাথে Hospital Patient admission….সব মিলিয়ে ওর মাথাটা ভিষণ ধরেছে। বাইরে চিৎকার-চেচামেচির শব্দ শুনে দো’তলার বারান্দটা দিয়ে মুখ বের করে দেখার চেষ্টা করল, কিন্তু লোকজনের ভিড়ে ভাল করে দেখাও যাচ্ছিলো না। সিড়ি দিয়ে নেমে আসার পর যএ দৃশ্যটা সিফাতের জন্য wait করছিলো, তার জন্য সিফাত মোটেই প্রস্তুত ছিলো না…! স্ট্রেচার-এ করে যাকে Ambulance থেকে নামানো হচ্ছে……সে আর কেউ না। হ্যা চৈতি……!!!!
নিচের জনতার ভিড় ছাপিয়ে শুধু একটা আওয়াজ এসেই কানে বাধছে- ভাই, আপনারা প্লীজ আমাদের একটু যাওয়ার জায়গা দিন………মেয়েটা বিষ খেয়েছে…… তাড়াতাড়ি OT-তে নিতে হবে…… আপ্নারা সরুন সামনে থেকে……… ছুটে চলা স্ট্রেচার-এর পাশ থেকে পাগলের মত অনবরত চিৎকার করে যাচ্ছে সিফাত……!!!

************************************

Operation Theater-এর দরজা এই মাত্র খুলেছে। চৈতিকে দেখতে আসা মানুষগুলও ছুটে যাচ্ছে রুমটার দিকে। হসপিটালের ধবধবে সাদা চাদরে ঢাকা বেড-টায় কি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে চৈতি। একরাশ অভিমান ভরা, অভিযোগহীন মায়াভরা সেই চেনা মুখটা…। পাশে ওর হাত-দু’টো চেপে ধরে অঝর ধারায় একটা ছেলে এতো কাঁদছে কেন?………
জানালায় লাগানো শিফনের সাদা পর্দাটা ভেদ করে ওর মাথার কাছে এসে পড়েছে বাইরের সূর্যের আলোটা। সিফাতের সেই যে কুৎসিত কালো সূর্য…………

৩,৪৪৫ বার দেখা হয়েছে

৩১ টি মন্তব্য : “হয়নি বলা- “ভালোবাসি””

  1. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    আচ্ছা যে মেয়ে আত্মহত্যা করার মত দুঃসাহস দেখাতে পারে সে তার মনের মানুষের কাছে একবারের জন্যও ভালবাসার কথা বলতে পারলো না!!!


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  2. হাসান (১৯৯৬-২০০২)
    introvert দের জায়গা নাই এই দুনিয়াতে

    কঠিন সহমত

    আচ্ছা যে মেয়ে আত্মহত্যা করার মত দুঃসাহস দেখাতে পারে সে তার মনের মানুষের কাছে একবারের জন্যও ভালবাসার কথা বলতে পারলো না!!!

    জটিল প্রশ্ন

    জবাব দিন
  3. লুবজানা (২০০৫-২০১১)

    দুঃসাহস আর বোকামীর মাঝে পার্থক্য এতো কম যে অনেকেই তা ধরতে পারেনা...এটা ছিলো বোকামী...অন্ততঃ আমি তাই মনে করি।
    বিঃদ্রঃ ভাইয়া আপুরা যদি কোন বড় মার্কা কথা বলে আপনাদের বিরক্তির কারন হয়ে থাকি... ছোট বোন টাকে ছেঁচা দিয়েন!! :chup: :chup:


    নিজে যেমন, নিজেকে তেমনি ভালবাসি!!!

    জবাব দিন
  4. কিবরিয়া (২০০৩-২০০৯)

    ইফতেখার ভাই ওয়েলকাম,ওয়েলকাম,ওয়েলকাম।


    যেমন রক্তের মধ্যে জন্ম নেয় সোনালি অসুখ-তারপর ফুটে ওঠে ত্বকে মাংসে বীভৎস ক্ষরতা।
    জাতির শরীরে আজ তেম্নি দ্যাখো দুরারোগ্য ব্যাধি - ধর্মান্ধ পিশাচ আর পরকাল ব্যবসায়ি রূপে
    - রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : আহসান আকাশ (৯৬ - ০২)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।