আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল (ICT) বিষয়ক হেগ-এর অধিবেশনে আলোচনা

নেদারল্যান্ডস-এর হেগ শহরে গত ২১ নভেম্বর রোম সংবিধি-এর আওতাধীন ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট (আইসিসি)-এর রাষ্ট্রপক্ষসমূহের সম্মেলনের (Assembly of States Parties) অংশ হিসেবে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল (আইসিটি)-এর ওপর বিশেষ একটি অধিবেশন আয়োজিত হয়। মূলত দেশীয় আইনের প্রক্রিয়ায় দেশীয় ট্রাইবুনালে আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচারের উদাহরণ হিসেবেই আইসিটি বিষয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এই আগ্রহ। এখানে উল্লেখ্য, রোম সংবিধি কেবল এ-ধরনের দেশীয় বিচারের উদ্যোগের অনুমোদনই করে না, উৎসাহিতও করে। রোমভিত্তিক সংগঠন “নো পিস উইদাউট জাস্টিস (NPWJ)”-এর উদ্যোগে আয়োজিত এই বিশেষ অধিবেশনে আইসিটি-র বিচার প্রক্রিয়া এবং এর সহায়ক কর্মকাণ্ডের সাথে সংশ্লিষ্ট আমন্ত্রিত পক্ষসমূহের মধ্যে নির্ধারিত বক্তা হিসেবে প্যানেলে উপস্থিত ছিলেন প্রসিকিউশনের প্রতিনিধি এডভোকেট সাইফুল ইসলাম তারেক, আসামী পক্ষের নিযুক্ত আন্তর্জাতিক প্রতিনিধি ব্যারিস্টার টোবি ক্যাডম্যান, ইংল্যান্ড এবং ওয়েলস বার কাউন্সিল মানবাধিকার কমিটির প্রতিনিধি মিস সোনা জলি, আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন বিশেষজ্ঞ ড. আহমেদ জিয়াউদ্দিন এবং বিচার প্রক্রিয়ার সহায়ক নাগরিক জোট ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্র্যাটেজি ফোরাম (আইসিএসএফ)-এর সদস্য রায়হান রশিদ। এছাড়াও এই বিচার বিষয়ে সচেতন বিশ্বের বিভিন্ন সংগঠন, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয় এবং পলিসি ইনস্টিটিউট-এর প্রতিনিধিগণ উপস্থিত ছিলেন। প্রথমবারের মতো আয়োজিত এধরনের মুখোমুখি আলোচনায় উপস্থিত সকল ডেলিগেটদের সাথে সরাসরি মত বিনিময়কারীদের মধ্যে আরও ছিলেন আরিফুর রহমান, নিঝুম মজুমদার এবং খান মুহম্মদ। ‘নো পিস উইদাউট জাস্টিস’ এর মহাসচিব নিকোলো ফিগা তালামানকা-র দক্ষ সঞ্চালনায় আয়োজিত এই মতবিনিময় অনুষ্ঠানে ট্রাইবুনালের বিচারের সাথে প্রাসঙ্গিক বিভিন্ন আইনগত ও তাত্ত্বিক বিষয়াদি, প্রচলিত বিভ্রান্তিগুলো, বিচারের বর্তমান পর্যায়ের অগ্রগতি ও ভবিষ্যৎ এবং বিচার প্রক্রিয়ার নানান দিক উঠে আসে প্রাণবন্ত এই আলোচনায়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন সংঘটিত অপরাধের আসল শিকার কে, কারা ক্ষতিগ্রস্ত এটি যখন আইসিএসএফ-এর পক্ষ থেকে মনে করিয়ে দেয়া হয়। মুখোমুখি এই আলোচনার সূচনাতেই ১৯৭১-এর সকল শহীদ এবং নির্যাতিতদের প্রতি শ্রদ্ধা ও স্মরণে উপস্থিত সকলে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করেন। এর পরপরই সভা চেয়ারম্যানের অনুরোধক্রমে আইসিটি-র প্রসিকিউটর জনাব সাইফুল ইসলাম তারেক এই বিচারের নানা দিক নিয়ে বলতে গিয়ে আইসিটি-র গঠন, আইন, এই আইনের নানা দিক, সাক্ষী সুরক্ষা, অভিযুক্তদের সুরক্ষা ও নানাবিধ সুবিধা, এই বিচারের স্বচ্ছতার দিকগুলো বিভিন্ন উদাহরণ ও আলোচনার মাধ্যমে সভাতে সকলকে জানান। এই সভাতে আসামি পক্ষের আইনজীবীর পক্ষে বলতে গিয়ে টোবি ক্যাডম্যান ১৯৭১ এর অপরাধসমূহের বিচারহীনতা নিরসনে সুষ্ঠু ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে তাঁর বক্তব্য তুলে ধরেন। এছাড়াও তিনি এই বিচারব্যবস্থার স্বচ্ছতা ও ডিউ প্রসেসের আরো কিছু দিক তুলে ধরে বলেন উক্ত উপাদানগুলো থাকলে এই বিচার প্রক্রিয়া একটি অনন্য ও আরো গ্রহণযোগ্য বিচার হিসেবেই স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এমন কিছু খুঁটিনাটি উপাদানের কথা বলতে গিয়ে তিনি বিদেশী আইনজীবীদের এই বিচারে আসার পক্ষে দাবি তুলে ধরেন, বর্তমান আইনটি রোম স্ট্যাটিউটের আদলে পাল্টে নেয়ার প্রয়োজনীয়তা এবং সাম্প্রতিক কালে সাক্ষী সুখরঞ্জন বালিকে খুঁজে না-পাওয়ার ঘটনাটি সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য তুলে ধরেন। ইংল্যান্ড এবং ওয়েলস বার কাউন্সিল মানবাধিকার কমিটির প্রতিনিধি জনাবা সোনা জলিও বালির বিষয়টি তুলে ধরেন। বিদেশী পরামর্শক ইস্যুর পরিপ্রেক্ষিতে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্র্যাটেজি ফোরামের পক্ষ থেকে টোবি ক্যাডম্যানের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বলা হয় যে কার্যবিধিতে স্পষ্ট বলা রয়েছে বিদেশী পরামর্শকদের কথা বার কাউন্সিলের অনুমতি সাপেক্ষে হতে হবে, সুতরাং, পুরো ব্যাপারটি নির্ভর করবে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ওপরে। তারা যদি অনুমতি না দেয় তাহলে ট্রাইবুনালের কিছুই করবার নেই, এছাড়াও বলা হয় যে বাংলাদেশে আইনজীবী হিসেবে প্র্যাক্টিস করতে হলে কিছু সুনির্দিষ্ট আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কার্যবিধির বিধানটি (বিধি-৪২) মূলত বিচারকগণই প্রণয়ন করেছেন, আর অন্যদিকে বার কাউন্সিলের মূল নিষেধাজ্ঞাটি সংসদের আইন দ্বারা প্রণীত। সুতরাং, বিচারকদের তৈরি করা বিধিতে যাই লেখা হোক না কেন তা সংসদে প্রণীত আইনের বেঁধে দেয়া সীমানা অতিক্রম করার ক্ষমতা নিশ্চয়ই রাখে না। বিচারকদের কাছে লেখা টোবি ক্যাডম্যানের চিঠির ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে রায়হান রশিদ বলেন যে পৃথিবীর ইতিহাসে এটি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর যে একজন বিচারপতিকে চিঠি দিয়ে উক্ত বিচার থেকে সরে যেতে বলা হয়েছে এবং সেটি অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে আদালতের অবমাননা। এই বক্তব্যের বিপরীতে টবি ক্যাডম্যান বলেন যে ইংল্যান্ডের বার কাউন্সিলের শৃঙ্খলা পর্ষদ তাকে সম্পূর্ণ অব্যাহতি দিয়েছে, তখন শৃঙ্খলা পর্ষদের মূল রায়টির বরাত দিয়ে আলোচিত হয় যে ইংল্যান্ড বার কাউন্সিলের শৃঙ্খলা পর্ষদ আসলে বাংলাদেশের ট্রাইবুনাল অবমাননার বিষয়টি অমীমাংসিতই রেখে দিয়েছে, সুতরাং এখানে দায় থেকে অব্যাহতি পাওয়ার বিষয়টি সত্য নয়। রোম স্ট্যাটিউট অনুযায়ী অপরাধের সংজ্ঞা ইত্যাদি গ্রহণের ব্যপাারে ক্যাডম্যানের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে আইসিএসএফ থেকেই জানানো হয় যে এই স্ট্যাটিউট শুধুমাত্র ২০০২-এর জুলাই এর পরে সংঘটিত বিচারের জন্যই মূলত তৈরি করা হয়েছে এবং এই স্ট্যাটিউটের সুনির্দিষ্ট অনুচ্ছেদেই ডোমেস্টিক আদালতের সাথে তাদের বিরোধহীনতার কথা তথা ডোমেস্টিক আদালতকেই স্বাগতই জানানো হয়েছে। অপরদিকে সাক্ষী বালির নিখোঁজ ঘটনায় সেই সভাস্থলেই তুলে ধরা হয় যে সাক্ষী বালি মূলত প্রায় ৯ মাস আগের থেকেই নিখোঁজই ছিলেন এবং তাকে খুঁজে না পাবার ব্যাপারে থানায় এসে জিডি করেন তাঁরই মেয়ে মনিকা রাণী মন্ডল । অথচ যখন প্রসিকিউশনের এই সাক্ষীকে খোঁজা হচ্ছিলো তখন আসামী পক্ষের আইনজীবীদের হেফাজতে এই সাক্ষী ছিলো। এসময় টোবির সাথে আসা অপর আইনজীবি জনাব আবুু বক্কর বিজ্ঞ প্রসিকিউটরের কাছে টোবি ক্যাডমেন ও তাঁদের অপর পরামর্শক লর্ড কার্লাইলের ভিসার নিশ্চয়তার দাবি তুললে বিজ্ঞ প্রসিকিউটর তাঁকে স্মরণ করিয়ে দেন যে তিনি একজন প্রসিকিউটর মাত্র, বাংলাদেশের ইমিগ্রেশনের কেউ নন। সভায় উপস্থিত ব্যক্তিবর্গ নানাবিধ প্রশ্ন উত্থাপন করে সভা প্রাণবন্ত করে তোলেন। ইন্সটিটিউট ফর গ্লোবাল জাস্টিসের সিনিয়ার প্রোজেক্ট অফিসার জনাব ডক্টর কেল এন্ডারসন জানতে চান কেন এই ট্রাইবুনালকে আন্তর্জাতিকতার মোড়কে সাজাতে হবে যেখানে বিচার হচ্ছে দেশীয় পদ্ধতিতে? উপস্থিত আরিফুর রহমান মতামত দেন যে যাঁরা একাত্তর সালে নিহত হয়েছেন পাকিস্তানের বর্বর অত্যাচারে তাঁরাই মূলত ভিক্টিম এবং তাঁদেরই অধিকার ক্ষুণ্ন হয়েছে এবং তাঁরা যাতে বিচার পান সেটিই মূল বিবেচ্য হতে হবে। সম্মেলনে উপস্থিত অনেকেই ৪১ বছর পর এমন বিচার শুরু করবার পদক্ষেপকে সাধুবাদ জানান এবং এতে করে আইনের শাসন ও মানুষের অধিকার নিশ্চিত হওয়ার পথে অগ্রগতি হবে বলে আশাবাদ পোষণ করেন। সভা শেষ হওয়ার আগে কয়েকটি বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে ও ঐকমত্যে পৌঁছানোর কথা ঘোষণা করা হয় সভার পক্ষ থেকে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল – বর্তমান বিচারে অভিযুক্ত ব্যক্তি ছাড়াও পাকিস্তানি অপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়ার প্রয়োজনীয়তা (এই ব্যাপারে টোবি ক্যাডম্যান অত্যন্ত আগ্রহী বলেও জানান), এই বিচারের মাধ্যমেই সুষ্ঠুভাবে দেরিতে হলেও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করা, এই বিচার আন্তর্জাতিক নয় বরং নিজস্ব দেশীয় আইনে পরিচালিত। এ-প্রসঙ্গে এই বিচারের ভবিষ্যত এবং তার ফলাফল অব্যাহত রাখার বিষয়ে আন্তর্জাতিক শক্তির ভূমিকার কথাও আলোচিত হয়। সভা শেষ হয় সভার চেয়ারম্যান জনাব নিকোলো ফিগা-তালামানকার সমাপনী বক্তব্যের মাধ্যমে।

এই লিংকে ক্লিক করে ফেসবুক এলবামটি দেখতে পারেন।

১,৫৭০ বার দেখা হয়েছে

৭ টি মন্তব্য : “আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল (ICT) বিষয়ক হেগ-এর অধিবেশনে আলোচনা”

  1. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    এ অধিবেশনের ঘটনাবলী সম্পর্কে প্রথম পড়েছিলাম ফেসবুকে, তারপর থেকে এটা নিয়ে কিছুমাত্র আপডেট অন্তর্জালের কোথাও খুঁজে পেলে সেটা গোগ্রাসে গেলাটা আমার কাছে অবসেশনের পর্যায়ে চলে গেছে।
    টোবি ক্যাডম্যানের মিথ্যাচার ফাঁস হয়ে যাওয়াতে জামাত মনে হচ্ছে আরো নোংরা খেলা শুরু করবে। শিবির নেতা বক্করের ব্যাকগ্রাউণ্ড সম্পর্কে আরো কিছু জানার ইচ্ছে প্রকাশ করছি।

    জবাব দিন
  2. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    আমি জন্মাই নি সে সময়, দেখিনি আমার মা বোনের কষ্ট, যুদ্ধে যেতে পারিনি আমার পিতা, পিতামহের সাথে।
    তাই আজ যখন দেখি সেই রাজাকার, আল বদর, আল শামস, শান্তি কমিটির সেই নারকীয় উল্লাস,
    যখন দেখি যেই পতাকার জন্য আমার এই বোনটি উৎসর্গ করলো তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ তার সম্ভ্রম,
    সেই পতাকা এই বাংলার আকাশে-বাতাসে পতপত করে উড়িয়ে আমারই ঘামের পয়সায় কেনা গাড়িতে করে পাছা ডুবিয়ে যায় নিজামী, মুজাহিদ, শাহ আজিজ, রহমান বিশ্বাস
    তখন চোখের দুকূল দিয়ে জল বয়ে যায়।
    কিন্তু না সময় নয় চোখের এক ফোঁটা জলও ফেলার।
    ৩০ লাখ শহীদ আমার জাতীয় পতাকা
    ২ লাখ ধর্ষিতা মা- বোন আমার জাতীয় পতাকা
    সকল বাস্তুহারা আমার জাতীয় পতাকা

    আসুন
    আর নীরবতা নয়,
    আর নয় অযথা ক্রন্দন,
    একসঙ্গে সব গর্জে উঠি
    সব যুদ্ধাপরাধীর বিচার নাই।
    রাজাকারের কোন অধিকার নেই এই বাংলার পবিত্র মাটিতে নিঃশ্বাস গ্রহণ করার।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।