বাঙালি মুসলমানের নাম বিভ্রাট

সতর্কীকরণঃআপনি কি আরবি নামকে ইসলামিক নাম মনে করেন?আপনার মতে কি মুসলমানের নাম অবশ্যই আরবি হতে হবে? আপনার কি মনে হয় বাংলা নাম মানে হিন্দুয়ানী নাম?তিনটি প্রশ্নের একটিরও উত্তর যদি হ্যা হয়ে থাকে তবে লেখাটি পড়বেননা।আপনি কোনভাবে আঘাত পেলে আমি দায়ী থাকবো না।

একদিন মুখে এল নূতন এ নাম–
চৈতালিপূর্ণিমা ব’লে কেন যে তোমারে ডাকিলাম
সে কথা শুধাও যবে মোরে
স্পষ্ট ক’রে
তোমারে বুঝাই
হেন সাধ্য নাই।

-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (নামকরণঃশান্তিনিকেতন, চৈত্রপূর্ণিমা [২১ চৈত্র ], ১৩৪৫)

কবিগুরু চৈত্রের পেট মোটা চাঁদের প্রেমে পড়ে প্রিয়কে ডাকলেন “চৈতালি পূর্ণিমা” নামে।আমাদের এই অঞ্চলে জ্যোৎস্না,পাখি,নদী,সবুজ,ফুল,কাশবনের কোন কমতি নেই।তারপরও বাঙালি মুসলমানেরা কেন জানি মরুর ধূলা,খেজুর গাছ,উট,দুম্বার প্রেমে প্রেমে পড়ে ছেলেপেলেদের আরবি নাম রাখতে শুরু করলেন।শুধু কি নাম?মিডল নেম,সারনেম এমনকি বাসায় আদর করে ডাকার নামটাও হতে হবে আরবি।প্রতিযোগিতা শুরু হলো কে কার চেয়ে কতটা সহিহ আরবি নাম রাখতে পারে।সৌদি আরবের খেজুর,খুর্মা আর উটের মাংসের সাথে সাথে ইমপোর্ট হতে থাকলো নামও।

প্রথম আঘাতটা শুরু হলো নামের আগে মোঃ/মুঃ/মোহাম্মদ আর ইংরেজিতে MD লাগানোর মাধ্যমে।পৃথিবীতে কোটি কোটি মুসলমান থাকলেও শুধুমাত্র আমাদের দেশেই প্রায় প্রতিটি পুরুষের নামের আগে এই অংশবিশেষ লাগানো হয়।খোদ আরব দেশেও সবার নামের আগে মোঃ/MD থাকে না।দেশে থাকলে তো সমস্যাটা টের পাওয়া যায়না কিন্তু দেশের বাইরে এলে জবাব দিতে হয় হাজার প্রশ্নের।আর কেউ যদি আমার মত ডাক্তারি পড়তে আসে তবে তো কথাই নেই।সমস্যাটা কোথায় তা বিস্তারিত না বলে শুধু এটুকু বলি ২ বছর পর আমার পুরো নাম হবে MD HUMAYUN KABIR M.D.।

প্রথমে একটু আলোচনা করা যাক “নাম” জিনিসটার গুরুত্ব ও তাৎপর্য নিয়ে।একটি নাম কি নিছকই একটি নাম?শুধুমাত্র আমাদের সম্বোধন করতেই কি নামের প্রয়োজন?নাম ছাড়াও তো সম্বোধন করা যায়,যেমনটি করে থাকে হাতি বা ডলফিন জাতীয় প্রাণীরা।

আমাদের সমাজ,সংস্কার,ঐতিহ্য,ইতিহাস প্রকাশ পায় এই নামের মাধ্যমে।গোঁড়ার খোঁজ পাওয়া যায় এই নাম থেকে।যেমন কারো নামের শেষে “এভ/এভা” থাকলে বুঝি সে রাশিয়ান, “ইচ/ইজ” থাকলে সে সারবিয়ান,আলবেনিয়ান অথবা জর্জিয়ান।এইসব দেশে কারো নাম শুনে বোঝার উপায় নেই সে খৃস্টান না মুসলমান।যেমন আমার কয়েকটা বন্ধুর নাম বলিঃ এরিয়ন,দ্রিতেরো,মেলিসা,পিয়ও,তেমও ইত্যাদি।এরা সবাই কিন্তু মুসলমান এবং কয়েকজন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া মুসলমান।তারা আরবি নামের পেছনে ছোটেনি আমাদের মত।বরং তারা তাদের নিজ ভাষা থেকে,নিজস্ব সংস্কৃতির আদলে নাম বেছে নিয়েছে।চীনে তো কড়া নিয়ম,তুমি যে ধর্মেরই হও না কেন তোমার নাম হতে হবে এদেশীয় সংস্কৃতির সাথে মানানসই।নামাজের সময় দোয়া দরুদ সবই কিন্তু চাইনিজ।

আমার প্রাক্তন মেয়েবন্ধুর বাড়ি আজারবাইজান।মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও ওর সারনেম ছিল “রোজায়েভা”।(আজারবাইজান একসময় সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে ছিল)আমি ওকে প্রায়ই বলতাম তুমি এত সাচ্চা মুসলমানগিরি দেখাও অথচ তোমার নামটা তো ইসলামিক না।ইসলামিক নাম বলতে আমি আরবি নামই বুঝতাম।ভাবতাম মুসলমান নারীর নাম হবে উম্মে আয়শা বিনতে মায়মুনা টাইপ।আমাদের দেশে তো এমনটাই হয়, তাই না?ও আমাকে বলতো মুসলমান হতে গেলে আরবি নাম হতে হবে এটা কে বলেছে তোমাকে?নাম হলো আমার ভাষা আর সংস্কৃতির অংশ,আমি কি আরব যে আমার আরবি নাম হবে?

এবার আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট নিয়ে একটু ভাবি।কলেজে আমার এক ক্লাসমেটের নাম ছিল “নির্ঝর”।পুরো নাম সাজিদ হাসান নির্ঝর।“নির্ঝর” নামটা নিঃসন্দেহে সবচেয়ে সুন্দর বাংলা নামগুলোর একটি।নামটা শুনলেই “নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ” কবিতাটার কথা মনে পড়তো।নির্ঝর আমাদের ফার্স্ট বয়,স্যাররা খুব পছন্দ করতেন ওকে।ক্যাডেট কলেজের নিয়ম অনুসারে সবাইকে ক্যাডেট নাম ধরেই ডাকতে হতো।একান্ত আপন না হলে কেউ কারো পুরো নামটাই জানতোনা।আমরা “নির্ঝর”কে নির্ঝরই ডাকতাম,অন্যান্য স্যার,ম্যাডাম,সিনিয়র,স্টাফ সবাই ওকে এই নামেই ডাকতো।বাধ সাধলেন আমাদের ইসলাম শিক্ষার ইমদাদ স্যার।“নির্ঝর” নামটা তার মোটেই পছন্দ না।বরং বলা যায় তিনি রীতিমত ঘৃণা করতেন।এটা নাকি হিন্দুদের নাম।এই কথাগুলো বলার সময় তার মুখের তাচ্ছিল্যের ভাবটা থাকতো প্রচণ্ড স্পষ্ট।স্যার নির্ঝরকে ডাকতেন ওর আসল নাম ধরে।“সাজিদ” বলতেন সুর করে মুখ বাঁকিয়ে।

শুধু এই নাম নিয়েই নয় অমুসলিম লেখকদের প্রতি তার ঘৃণা ছিল অপরিসীম।সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এই ধরনের নামগুলোকে তিনি ব্যাঙ্গ করে বলতেন “গাঙে পাদ দেয়”, “মুখে পাদ দেয়”।হ্যা ঠিক শুনেছেন,এই স্যার ক্লাস সেভেনের বয়ঃসন্ধি চলতে থাকা কিশোরদের সামনে সাবলীল ভাষায় বলে যেতেন এই কথাগুলো।(ধর্ম বিদ্বেষ কি জিনিস তখনও হয়ত বুঝে উঠিনি।কিন্তু বীজগুলো কিন্তু এভাবেই রোপণ হয়)

বাংলাদেশের মানুষ অনুকরণ প্রিয়।নামের ক্ষেত্রে অনুকরণে তো আমাদের জুরি মেলা ভার।উপসাগরীয় যুদ্ধের পর বাংলাদেশে যত শিশুর নাম “সাদ্দাম” রাখা হয়েছে,খোদ ইরাকেও এত “সাদ্দাম” নেই।ট্রেন ষ্টেশন,বাস স্ট্যান্ড বা ট্র্যাফিক জ্যামে যে পরিমাণ “শিশুর সুন্দর নাম” নামক বই বিক্রি হয়,আমি নিশ্চিত হুমায়ূন আহমেদের বইও এত বিক্রি হয় না।(আমাদের বাসায় এরকম ৩ টা বই আছে)এই নামগুলো কিন্তু শুধু সুন্দরই নয় সেগুলো “ইসলামিক”ও বটে।আর ইসলামিক নাম মানেই তো আরবি নাম।আমাদের বাবা মায়েরা আরবি নাম রেখে পুণ্য কামাই করতে চান।একটা শিশু ভূমিষ্ঠ হবার সাথে সাথেই দৌড়াদৌড়ি পড়ে যায় একটা ইসলামসম্মত নাম রাখতে।শুধু মাত্র নাম রেখেই যদি কিছু নেকী পাওয়া যায়,ক্ষতি কি তাতে?এইতো কয়েকদিন আগে আমার ঘনিষ্ঠ এক বন্ধু এক কন্যা সন্তানের পিতা হয়েছে।ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দিল,মেয়ের জন্য সহিহ আরবি নাম চাই।আমি বললাম বাংলা নামে সমস্যা কি?বন্ধু বলল ঐসব হিন্দুয়ানী নাম তার একেবারে পছন্দ না।শেষমেশ সে দাঁত ভাঙ্গা জবর জেরওয়ালা একটা নামই রাখলো।

আচ্ছা আমাদের সমস্যাটা কি?বাংলা নামের কি এতই অভাব?পৃথিবীতে যত ভাষা আর সংস্কৃতি দেখেছি তার মধ্যে বাংলা ভাষা অনেক সমৃদ্ধ,শ্রুতিমধুর।বাঙালি মুসলমানের যেহেতু আরবি নাম রাখার প্রবণতা প্রায় কয়েকশ বছরের।তাই একদিনে ঝেড়ে বাদ দেয়া প্রায় অসম্ভব।অন্তত নামের একটা অংশ তো বাংলা হতেই পারে,তাই না?চিন্তা করে দেখুন যে ছেলেটা বড় হয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়বে কিংবা লালনের গান গাইবে তার নামটা কি “সাফওয়ান ইবনে ফাত্তাহ” হতে পারে?

আরবি নাম রাখলেই কি ভাই আরব হওয়া যায়?আপনার নাম যতই হারুন আল খাত্তাব হোক না কেন,আপনি আরব দেশে গেলে সব আরব আপনাকে থার্ড ডিগ্রি ট্রিটমেন্টই দিবে।যে লোকটি আরব দেশে আরবদের লাত্থি গুঁতা খেয়ে কাজ করে দেশে আসার সময় নিজে মাথায় বাটিওয়ালা সাদা আলখাল্লা পড়ে আর বউকে কালো হাতমোজা পড়িয়ে প্লেনে ওঠে সে তো তার ছেলে মেয়ের নাম ঐসব বেদুঈনদের নামেই রাখবে, তাই না?আরবদের পায়ে যে মধু,চাটতে ভালোই লাগে।

৫,৩৭১ বার দেখা হয়েছে

৩৮ টি মন্তব্য : “বাঙালি মুসলমানের নাম বিভ্রাট”

  1. চল্‌ একটু পেছনে যাই। উয়ারি-বটেশ্বর অঞ্চলে ২০০৬ সালে প্রাপ্ত পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন অনুযায়ী বাংলাদেশ অঞ্চলে জনবসতি গড়ে উঠেছিলো প্রায় ৪ হাজার বছর আগে। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার কি জানিস্‌ বেশ প্রাচীন হলেও বাংলাদেশ অংশের জনসমাজ কোন পৃথক সভ্যতার জন্ম দিতে পারেনি। তুই যেসব দেশের উদাহরণ দিয়েছিস তারা কিন্তু সকলেই পৃথক সভ্যতার জন্মদাত্রী।
    এখন ভেবে দ্যাখ গুপ্ত কিংবা পাল রাজবংশ কিংবা শশাঙ্ক এর সময় বাঙলা অঞ্চলের মানুষের নাম ছিল একরকম (প্রাচীন পুঁথি সমূহ দ্রষ্টব্য) আবার দ্বাদশ শতকে সূফী সাধকদের কর্তৃক ইসলাম আসার পর কিংবা ইখতিয়ার খিলজী কর্তৃক সেন বংশের ভরাডুবির পর বাঙলার মানুষের অর্থাৎ এই ভূখণ্ডের মানুষের নাম আবার পরিবর্তিত হয়। এরপর খেয়াল করে দ্যাখবি ঔপনিবেশিক শাসন আমলে আবারো নামে খুব বড় এক্তা পরিবর্তন আসে।

    এর একমাত্র কারণ হল আমরা কোন পৃথক সভ্যতার জন্ম দিতে পারি নি। মালদ্বীপ এক্ষেত্রে উদাহরণ হিশেবে নিতে পারিস। তো সেই সব সূফী সাধকদের কল্যাণে আমাদের সংস্কৃতি তে বাঙালি নামে দুই ভাগ চলে এসেছে, এটা বোধহয় আমাদের দোষ না!!

    এখন তুই যে মতধারা থেকে নিরীক্ষাধর্মী এবং চিন্তাশীল এই চমৎকার লেখাটা লিখেছিস সেখানে ভূল নাই কিন্তু একেবারে বাঙ্গালি মুসলমানের গলায়ও ঘন্টা টা পড়িয়ে দেয়া উচিত হবে না।

    পরিশেষে খুব পরিচিত একটা লাইন বলি " নামে কি বা আসে যায় "

    জবাব দিন
    • হুমায়ুন (২০০২-০৮)

      Zia শোন,ভাষা তো বহমান তাই না?ভাষাকে যদি তুই বাঁধ দিয়ে আটকে দিস তাহলে সেই ভাষার বিলুপ্তি কেবলই সময়ের ব্যাপার।এক ভাষায় অন্য ভাষার শব্দ আসবে,মিলাবে মিলিবে এটাই নিয়ম।এতে সমস্যার কিছু নেই।আবার ধর তুই যদি শখ করে তোর ছেলের নাম "আয়হান" রাখিস তাহলেও কোন সমস্যা নেই।কিন্তু দোস্ত তোর কি মনে হয় না আরবি নাম রাখাটা ক্রনিক পর্যায়ে চলে গেছে?তোর কি মনে হয় না বাঙালি মুসলমান "আরবি" নাম রাখতেই হবে এমন একটা বাধ্যবাধকতায় চলে গেছে?আর এই লেখাটার লিখতে গিয়ে আমি একটু পড়াশুনা করেছি।সুনীলের "আমি কি বাঙালি" বইটা পড়ে দেখতে পারিস।


      তুমি গেছো
      স্পর্ধা গেছে
      বিনয় এসেছে।

      জবাব দিন
  2. নাফিস (২০০৪-১০)

    এই ব্যাপারটা নিয়ে লেখার জন্য ধন্যবাদ ভাই.. বিষয়টা নিয়ে ইদানিং ভাবছিলাম। এই সেমিস্টারে ফরেন ল্যাংন্গুএজ হিসেবে এরাবিক শুরু করেছি। অনেক অনেক বিষয়ে ভুল ভাঙ্গছে। ধারণা ছিল যে ছোটবেলায় আরবি শিখেছিলাম, তো এখন আর কোনো অসুবিধা হবেনা। ক্লাসে গিয়ে আবিষ্কার করলাম যে আমরা যে স্টাইলে আরবী শিখি সেটা মধ্যযুগীয় স্টাইল। ভাষাটা অনেক বদলে গেছে এরপর। সিম্পলি একটা ভাষা কে এত সম্মান দেওয়ার কোনো মানে নেই.. আর হ্যা, ফুটবলার ফ্র্যাঙ্ক রিবেরি , পাপিস সিসে ও মুসলমান। ওদের নাম শুনে কিন্তু বোঝার উপায় নেই.. 🙂

    জবাব দিন
  3. দিবস (২০০২-২০০৮)

    আমার নাম নিয়ে কিছু সময়ে সমস্যায় পরি। 'দিবস' শুনলে অনেকেই প্রথমে আমাকে হিন্দু মনে করে ফেলে। কথাটা সত্যি। কিন্তু নাম শুনেই আমাকে কোন এক ধর্মের মেম্বার বানিয়ে ফেলাটা আমার পছন্দ না। দ্বিতীয়ত আমার নামটা খাঁটি বাংলার একটা শব্দ, সাহিত্যের শব্দ এখানে হিন্দু'র কোন ছাপই নেই। হিন্দু ধর্ম নিয়ে যতটুকু পড়ালেখা করেছি বা পারিবারিক সূত্রে জানি সেখানেও কোন দেবতা বা অবতারের নামও দিবস পাই নাই। এক্ষেত্রে আমার নাম দেখেই হিন্দু মনে করে নিলে সে ক্ষেত্রে চরম বিব্রতবোধ করি।

    অফটপিকঃ আমার ফেইসবুক নাম দিবস কান্তি, এটাও আমার পুরো নামেরই অংশ। এই নাম দেখে অনেকেই মনে করে এটা আমার ছদ্ম নাম। :)) :)) :)) । যাদের সাথে ভার্চুয়ালি পরিচয় হয়েছে তাদের অনেকেই একটা সময় পরে জিজ্ঞেস করছে, তোমার আসল নাম কি? :grr: :grr: :grr:


    হেরে যাব বলে তো স্বপ্ন দেখি নি

    জবাব দিন
  4. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    আরবী নামকরণ নিয়ে গবেষণা হওয়া উচিত।আমার কিছু জানা নেই এব্যাপারে।
    এই ভিন্ন ভাষায় নামকরণটা(কখনো কখনো আরবী-বাংলা মেশানো) নিজেই একটা ঐতিহ্যে পরিণত হয়ে গেছে - কয়েকশ' বছর তো হয়ে গেলো নিশ্চয়ই।ধর্মকে বরণ করার বাইপ্রোডাক্ট হিসেবে ভাষা সংস্কৃতি পোষাক খানাপিনা এসবও আমদানি হয়ে যায় দেদারসে।পারলৌকিক মূলাটিকে এড়িয়ে যাওয়া সহজ কাজ না।

    জবাব দিন
  5. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)
    বাধ সাধলেন আমাদের ইসলাম শিক্ষার ইমদাদ স্যার।“নির্ঝর” নামটা তার মোটেই পছন্দ না।বরং বলা যায় তিনি রীতিমত ঘৃণা করতেন।এটা নাকি হিন্দুদের নাম।এই কথাগুলো বলার সময় তার মুখের তাচ্ছিল্যের ভাবটা থাকতো প্রচণ্ড স্পষ্ট।স্যার নির্ঝরকে ডাকতেন ওর আসল নাম ধরে।“সাজিদ” বলতেন সুর করে মুখ বাঁকিয়ে।

    নাম নিয়া সমস্যা মনে হয় ইসলামিয়াতের টিচারদের বেশি থাকে।
    যদিও আমরা আমাদের ছয় বছরের সিসি লাইফে ইসলামিয়াতের টিচার পাইছি ৩ জন।
    কামার উদ্দিন স্যার প্রথম ১ থেকে দেড় বছর ছিলেন। কখনো ক্লাসে কিছু পড়াতেন না। বলা ভালো পড়াতে পারতেন না। ক্লাসে এসে একটা চেয়ারে বসে থাকতেন।
    স্ট্রোক করেছিলেন বোধ হয়। এমনকি পরীক্ষার খাতাও দেখে দিতো তার ছেলে। সে অবশ্য অন্য কাহিনী।
    সে সময় মান্নান হুজুর আমাদের ইসলামিয়াতের ক্লাস নিতেন। ক্লাসে এসে কার নাম ভুল বা ঠিক এসব বলতেন। যেমন, মঈনুল না মাঈনুল, সাঈদ না সাঈয়েদ, ইত্যাদি।
    আমার নামের প্রথমে আর শেষে মোঃ আর আহমেদ থাকায় কিছু বলতেন কিনা ঠিক মনে করতে পারছি না।
    মোঃ রাজীব আহমেদ চৌধুরী >
    ঠিক বাঙলাদেশের মুসলমান কালচারে যায় না। মনে হয় আমি একদিন বড় মুসলমান হবো তাই এই ব্যাবস্থা।
    সমস্যা হতো আমাদের ববীনের নাম নিয়ে।
    সেলাই মেশিনের ববীন ছাড়া আর কোন ববীন আছে কিনা এই নিয়া তারে ভুগতে হইতো।

    এরপর ইসলামিয়াতের টিচার হিসাবে আসেন আবদুল কবীর স্যার, আর মুরতাহান বিল্লাহ স্যার।
    দুজনেই বেশ (খুব ভালো) মানুষ ছিলেন।

    আমার সমস্যা টা আর আমার মেয়েদের দিই নাই।
    রেনা তামারা
    রওযা তালিয়া।

    বৌএর নাম ও যা ছিলো তাই আছে।
    তাসলিমা খাতুন।

    এই বোধ মানুষের কি কইরা আসে যে বউরে নিজের সারনেম দিতে হইবো!
    মেয়েরা নেয় কি কইরা?
    ছেলেরাই কি কইরা এই কামডা করে!
    ভালোবাসা না দাসত্ব???

    আমার নিজের পুরা নামটা আমার পছন্দ না কিন্তু কিছুই করার নাই।
    মোঃ ভালো লাগে না।
    আহমেদ ভালো লাগে না।
    চৌধুরী তো ভুয়া।

    তবে রাজীব নামটা পছন্দ।
    কারণ এইটা হিন্দুও হইতে পারে, আবার মুসলমানও।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
      • মোকাব্বির (৯৮-০৪)

        ভার্সিটির এক বান্ধবীর মেয়ের নাম দিমিত্রি। আমি জানতাম এইটা ছেলেদের নাম। পুরা নাম জানি না! 🙂

        আমার ভাবীর নাম কুন্তলা শবনম পরমা, ছোটটার নাম সাবেরি শবনম লাবন্য, অগণিত শ্যালিকার মাঝে আছে নাগমা-ই-আন্দালিব অনন্যা, ইসমাম নাওয়ার উপমা, সামথিং সামথিং রাজন্যা, সামথিং সামথিং সুকন্যা ইত্যাদি! =))


        \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
        অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

        জবাব দিন
      • রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

        আরবি, হিব্রু, গ্রীক, বাঙলা সব মিলাইয়া।
        আলাদা আলাদা করে প্রত্যেক অংশের মানে আবার একত্র করেও মানে আছে।
        ব্যাফক অবস্থা।


        এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

        জবাব দিন
    • দিবস (২০০২-২০০৮)

      আমাদের কলেজের ইসলামিক স্টাডিজ এর দুইজন নজরুল স্যার এবং কবীর স্যার।জীবনে দেখা কয়েকজন ভাল মানুষের মধ্যে এই দুই জন স্যারের নামও আছে। নজরুল স্যার মাঝখানে কয়েকদিন আমাদের হাউস মাস্টার ছিলেন। হাউসে কাটানো বেস্ট সময়ের মধ্যে ওই সময়টা ছিল।


      হেরে যাব বলে তো স্বপ্ন দেখি নি

      জবাব দিন
  6. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)
    শুধু এই নাম নিয়েই নয় অমুসলিম লেখকদের প্রতি তার ঘৃণা ছিল অপরিসীম।সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এই ধরনের নামগুলোকে তিনি ব্যাঙ্গ করে বলতেন “গাঙে পাদ দেয়”, “মুখে পাদ দেয়”।হ্যা ঠিক শুনেছেন,এই স্যার ক্লাস সেভেনের বয়ঃসন্ধি চলতে থাকা কিশোরদের সামনে সাবলীল ভাষায় বলে যেতেন এই কথাগুলো।(ধর্ম বিদ্বেষ কি জিনিস তখনও হয়ত বুঝে উঠিনি।কিন্তু বীজগুলো কিন্তু এভাবেই রোপণ হয়)

    স্যারকে পেন্নাম।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
  7. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)
    আরবি নাম রাখলেই কি ভাই আরব হওয়া যায়?আপনার নাম যতই হারুন আল খাত্তাব হোক না কেন,আপনি আরব দেশে গেলে সব আরব আপনাকে থার্ড ডিগ্রি ট্রিটমেন্টই দিবে।যে লোকটি আরব দেশে আরবদের লাত্থি গুঁতা খেয়ে কাজ করে দেশে আসার সময় নিজে মাথায় বাটিওয়ালা সাদা আলখাল্লা পড়ে আর বউকে কালো হাতমোজা পড়িয়ে প্লেনে ওঠে সে তো তার ছেলে মেয়ের নাম ঐসব বেদুঈনদের নামেই রাখবে, তাই না?আরবদের পায়ে যে মধু,চাটতে ভালোই লাগে।

    :grr: :grr: :grr:


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
  8. ওয়াহিদা নূর আফজা (৮৫-৯১)

    খুবই একটা সুন্দর টপিক নিয়ে লিখেছ। মোটামুটি একটা দিক ভালভাবেই আলচনা করেছে।

    তুমি ইউরোপের যে দেশ গুলোর নাম উল্লেখ করেছে তা কম্যুউনিস্ট বলয়ের মধ্যে পড়ে। ওখানে একটা সময় প্রকাশে কোন ধর্ম পালন করা যেত না। স্বভাবতই ওরা অনেক বেশি সংস্কৃতিমনা। আবার ইসলাম যখন পার্সি (ইরান) বলয় দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতো তখন অনেক পার্সী শব্দ বাংলায় ঢুকে যায়। আমাদের এক সিনিয়র আপার নাম ছিল পার্সা সান্জানা। এই নামটা পুরোটাই পার্সি। এরকম আরেকটা নাম হচ্ছে আনাহিতা। আমার কাছে পার্সি নামগুলো খুব সুন্দর লাগতো। তাই এক পার্সিয়ান বান্ধবীকে বলেছিলাম আমার মেয়ের নাম দেওয়ার জন্য। সে দিল দরিয়া। আমার কাছে দরিয়া নামটা তো আর শহূরে লাগলো না। বর্তমান পৃথিবীতে যেই বিষয়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ তা হলো বিল্ংগিংনেস। এই বলয়টা যত বাড়ানো যায় তত ভাল। নাম এখানে একটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। চায়নীজরা যদি মনে করে তুমি চায়নীজ তাহলে ওদের বলয়ের সুবিধাগুলো পাবে, তেমনি ইন্ডিয়া, মুসলিম, ইহুদী, খ্রীস্টান বলয় তো আছেই। নাম আসলেই একটা বেশ গুরুত্ব্পূর্ণ ইস্যু।


    “Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
    ― Mahatma Gandhi

    জবাব দিন
    • হুমায়ুন (২০০২-০৮)

      আপা আপনার কমেন্টের জন্য ধন্যবাদ।আপনি আপনার মেয়ের নামের ব্যাপারে যে কথাটি বললেন আমি কিন্তু সেই কথাটা আমার প্রথম কমেন্টেই বলেছি।আপনি শখ করে "দরিয়া" নামটি রাখতেই পারেন এতে কোন সমস্যা না। আমি ৪ বছর ধরে তুরস্কে থাকি,হয়তো আরও ৪/৫ বছর থাকতে হবে।টার্কিশ ভাষার বেশ কয়েকটা নাম ভালো লেগেছে।হয়তো আমার সন্তানের নাম "টার্কিশ"ও হতে পারে।আপা সমস্যাটা হচ্ছে শখ করে নাম দেয়া আর আরবি নামকরণের বাধ্যবাধকতা কিন্তু এক জিনিস নয়।ছেলে হলেই নাম শুরু হবে "মোঃ" দিয়ে অথবা নামের ভেতরে "ইবনে/বিন" আর মেয়ে হলে "উম্মে" থাকবেই,এই ব্যাপারটা কিন্তু অসুস্থতার পর্যায়ে চলে জাচ্ছে।


      তুমি গেছো
      স্পর্ধা গেছে
      বিনয় এসেছে।

      জবাব দিন
  9. আমিন (১৯৯৬-২০০২)

    লেখাটা ভালো লাগলো। এইটা নিয়ে দিনের পর দিন বলা যাবে কিন্তু যাদের চুলকানি তাদের কখনও থামবে না। মজার কাহিনী বলি বরং।

    আমার ডাকনাম শিমুল। আমার চাচাত ভাইয়ের ডাকনাম তাপস। আমার ছোট ভাইয়ের ডাকনাম সৌমিক। আমরা তিনজন গিয়েছি আমার এক বন্ধুর বাসায়। ঠিক বেড়াতে যাওয়া না। ছোটখাটো কোন একটা কাজে। কাজটা ঠিক কি মনে করতে পারছি না। তো কাজ শেষ করে চলে আসব, ঐ বাসা থেকে খেতে দেওয়া হলো। আমার তাড়া ছিলো। বললাম ভাইয়া আজকে খাবো না, কিছু মনে করবেন না। আমাকে অবাক করে দিয়ে ভাইয়ার উত্তর, তোমাদের ধর্মে মুসলিমদের বাড়িতে খাওয়া কি নিষেধ? আমাদের কিন্তু এইরকম কোন ব্যাপার নাই। শুনে আমি হাসবো না কাঁদবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। 🙂

    জবাব দিন
  10. শাহরিয়ার (০৬-১২)

    নাম রাখায় সৃজনশীলতার বড়ই অভাব বাঙ্গালীর। আমার নিজের নাম লইয়া বড় আফসোস আছে। :(( :((


    • জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব - শিখা (মুসলিম সাহিত্য সমাজ) •

    জবাব দিন
    • রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

      ক্যান শাহরিয়ার তো সুন্দর নাম।
      বাট কমন এই যা।

      কলেজে প্রায় প্রতিটা ব্যাচে অন্তত এক্জন করে থাকতো।
      আমাদের ২ ব্যাচ সিনিয়রদের তিন শাহরিয়ার ছিলো।

      মুজতবা আলীর খুব সম্ভবত শহর-ইয়ার নামে গল্প ছিলো।
      নাকি আরব্য রজনীর সেই বাদশার নাম শহর-ইয়ার !


      এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

      জবাব দিন
  11. আসিফ খান (১৯৯৪-২০০০)

    "যার মানার দায় নেই তার বাহার বেশী,
    যার করার মুরোদ নেই তার ঢং বেশী।"
    বাঙ্গালী সন্তানের নাম নিয়ে যে পরিমান শ্রম দেয়, তার কানাকড়িও যদি তাকে উপযুক্ত মানুষ বানাবার পিছনে দিত; দেশের চেহারাটাই পালটে যেত!
    দুর্দান্ত বিষয়ে অসামান্য লেখা!!

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মোকাব্বির (১৯৯৮-২০০৪)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।