ট্রেন

হাতের ঘড়িটার দিকে বারবার তাকাচ্ছে লোকটা। লোক না বলে যুবক বলাই ভাল। দশ বছর আগে আমি-ত এমনই ছিলাম, চোখে কিসের যেন তাড়না, ছটফটে, এক জায়গায় বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারি না। কিসের এত তাড়া তার? জেএমবি নয় ত? যে সময় চলছে, সেদিন সন্ধ্যায় শোরগোল শুনে বের হয়ে দেখি পাড়ার সবাই মহা উল্লাসে মধ্যবয়সী এক লোককে বেদম মারছে। পাশে দাঁড়ানো পোকায় খাওয়া দাঁত বের করে হাসতে থাকা বাসার দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করলাম ব্যাপার কি।
-”আর বইলেন না স্যার, জেএমবি ধরা খাইছে। ব্যাটার খবর আছে…”
-”কিভাবে বুঝল যে এ জেএমবি-র লোক?”
আমি যেন খুব অবাক করা প্রশ্ন করলাম এমন ভাব করে মোবারক কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বলল,
“স্যার… ইয়ে…মানে… এটাত এমনেই বুঝা যায়”।
আমার আর বুঝতে দেরি হল না। পুলিস এসে উদ্ধার করার আগে লোকগুলোকে সামলাতে চেষ্টা করলাম।

ট্রেন আসতে এখনও আধ ঘন্টার মত দেরি আছে। বসা থেকে উঠে দাড়াল যুবকটি, প্লাটফরমের ভিড়ে কাকে যেন খুঁজল। তাকে যে পায়নি তা তার নিরাশ হওয়ার ভংগি দেখেই বুঝা গেল। একবার ক্ষণিকের জন্য চোখাচোখি হল তার সাথে। কি যেন আছে তার চোখে, অনেক পরিচিত। নাহ.. তার সাথে কথা বলতে হবে। হাতটা বাড়িয়ে বললাম,
-”আমি ড. ইকবাল।”
হাত মিলিয়ে যুবকের উত্তর,
-”আমি অসীম।”
কথা শুরু করতে নিজে থেকেই উত্তর দেয়া প্রশ্ন করলাম, মাঝে মাঝে কাজে দেয়। এখানেও চেষ্টা করে দেখলাম,
-”ট্রেন মনে হয় আজকে অনেক লেট করবে।”
অসীমঃ “হু। কেন যে এত লেট করে” বলে আরেকবার ঘড়ি দেখে ভিড়ের মধ্যে চোখ বোলাল অসীম।
-”কারও জন্য অপেক্ষা করছেন?”
অসীমঃ “জ্বী…ইয়ে মানে…”
-”চলে আসবে। বোধহয় জ্যামে-ট্যামে পড়েছে।”
অসীমঃ “না…ওকে ত আমি অনেক আগে আসতে বলেছি। আপনি কোথায় যাচ্ছেন?”
-”আমি চট্টগ্রাম যাচ্ছি।”
অসীমঃ “আচ্ছা ওখানে কমদামে ভাল হোটেল কোথায় পাব জানেন?”
-”ব্যাচেলরদের জন্য-ত সব হোটেলই ভাল পাবেন, সমস্যা হবে ফ্যামিলি নিয়ে গেলে।”
অসীমঃ “জ্বী…ফ্যামিলির জন্য হলে ভাল হয়।”
-”আপনি মনে হয় আগে কখনও চট্টগ্রাম যাননি।”
অসীমঃ “জ্বী না যাইনি, হঠাৎ করেই যেতে হচ্ছে। মিলি যদি গতকালকেও বলত তাহলে একটা ব্যবস্থা করতে পারতাম।”
এমন সময় লাউড স্পীকারে ষ্টেশন মাস্টারের গলা শোনা গেল, “ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের সুবর্ণ এক্সপ্রেসের সম্মানিত যাত্রীদের অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে রেল লাইন ত্রুটির কারণে ট্রেন ছাড়তে আরও দেড় ঘন্টা বিলম্ব হবে। এ সময় যাত্রীদের ধৈর্য্য সহকারে অপেক্ষা করার জন্য বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি, ধন্যবাদ।”
-”আবার দেরি হয়ে গেল, বাংলাদেশের ট্রেনগুলোর যে কি হ্ল? নয়-দশ বছর আগেও-ত এমন ছিল না।”
অসীমঃ “আপনার কোন তাড়া আছে নাকি?”
-”তেমন কিছু না, আগে যেতে পারলে ভাল হত।”
অসীমঃ “মিলি এতক্ষন দেরি করছে কেন বুঝতে পারছি না।”
-”ভালবাসা মামলা?”
অসীম কিছু বলে না। শুধু এক চিলতে হাসি দেয়।
-”এখনই ত সময়, আমার স্টেজে আসেন দেখবেন জীবনের রং ফ্যাকাসে হতে শুরু করেছে।”
অসীমঃ “আপনি আসলে যা মনে করছেন ব্যাপারটা সেরকম কিছু না।”
-”ও… তাহলে আপনারা এডভেনচারে যাচ্ছেন।”
অসীমঃ “বলতে পারেন…অনেকটা বাধ্য হয়ে।”
-”বাবা-মা রাজি না?”
অসীমের আবারও এক চিলতে হাসি। হাসিটার অর্থ বোধহয় জানা হয়ে গেছে আমার।
অসীমঃ “আসলে মিলির জন্য তার বাবা-মা বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে, আজকেই ওর বিয়ে। গতকাল হঠাৎ ফোন করে বলে যে সে আমার সাথে যাবে। তাই তাকে রেলষ্টেশনে আসতে বললাম। সে যদি না আসে তাহলে আমি আর কোন দিন তার খবর নিব না সেও নিবে না, এমনটাই কথা হয়েছে।”
আবার ষ্টেশন মাস্টারের গলা শোনা গেল,
“ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের সুবর্ণ এক্সপ্রেসের সম্মানিত যাত্রীদের নিজ নিজ আসন গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি। আগামী ১৫ মিনিটের মধ্যে ট্রেন চট্টগ্রাম উদ্দেশ্যে ঢাকা ছেড়ে যাবে…।।”
অসীমের অস্থিরতা বেড়ে গেল। আমি উঠে দাড়ালাম,
-”আপনি যাবেন না?”
অসীম ভিড়ের দিকে তাকিয়ে আছে। আস্তে আস্তে উজ্জ্বল হয়ে গেল তার মুখ। তার দৃষ্টি অনুসরন করে তাকিয়ে দেখলাম ২৩-২৪ বছরের যুবতী আমাদের দিকেই এগিয়ে আসছে।
অসীমঃ “অনেক দেরি করলা”
মিলিঃ “কি করব? অনেক লুকিয়ে ছোট ভাইটাকে ভাল মত বুঝিয়ে তারপর আসতে হ্ল……আর রাস্তায় যা জ্যাম………”
অসীমঃ “চল… তাড়াতাড়ি উঠ ট্রেনে…এখনই ছেড়ে দিবে।”
ট্রেনের দরজায় দাঁড়িয়ে পিছন ফিরে,
অসীমঃ “আপনি যাবেন না?”
মুখে এক চিলতে হাসি দিয়ে একটা কার্ড বের করে অসীমের হাতে দিলাম,
“আমার রেষ্ট হাউসের ঠিকানা, আমার কথা বলবেন। আমি ফোন করে দিব, কোন অসুবিধা হবে না। আজকে বোধহয় আমার যাওয়া হবে না। একটা অসমাপ্ত কাজের কথা মনে পড়ে গেল…..।”
উল্টা ঘুরে হাঁটতে শুরু করলাম। শুনতে পাচ্ছি মিলি বলছে,”লোকটা কে?”
অসীমঃ “কেউ না…আমার এক শুভাকাঙ্খী…চল ভিতরে গিয়ে বসি।”

পকেট থেকে মোবাইল বের করলাম। গত দশটি বছর যে নাম্বারটি বারবার দেখেছি কিন্তু ডায়াল করার সাহস হয়নি আজ সে নাম্বারে ডায়াল করলাম। প্রতিটা রিং হচ্ছে আর আমি এক এক বছর করে পিছিয়ে যাচ্ছি…।আমার সময় ট্রেন দেরি করেনি কেন? দেরি করলে কি হত আমাকে যে আজ জানতেই হবে।
ওপাশ থেকে বহু আকাঙ্খিত নারী কন্ঠ শুনতে পেলাম,
-”হ্যালো…”
-”আচ্ছা তুমি কি সেদিন রেলষ্টেশনে এসেছিলে?”

১,৭১৪ বার দেখা হয়েছে

২৩ টি মন্তব্য : “ট্রেন”

  1. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    এ লেখাটা কোথায় লুকিয়ে ছিল?

    ফাটাফাটি :gulli: :gulli: :gulli:


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : হাসনাইন (৯৯-০৫)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।