ফটুক

১.
অভির ইচ্ছে ফটোগ্রাফার হবে। যেনতেন নয়; ফ্যাশন ফটোগ্রাফার। ফ্যাশনের লাল-নীল দুনিয়া তাকে মোহে ফেলে,
পাগলের মত টানে। হেইডি ক্লাম, টাইরা ব্যাংস, আদ্রিয়ানা আর কেট মসদের সাথে প্রেম তার সেই কলেজ থেকেই।
লুকিয়ে কত যে পোস্টার জোগাড় করেছে, তখন অবশ্য মায়ের কাছে ধরা পড়ার ভয় ছিল। আর বিশ্ববিদ্যালয় হলে এখন তার ঘরের চার দেয়ালে শুধুই ফ্যাশন দুনিয়ার রানীদের হাট। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার এই এক মজা, স্বপ্নগুলোকে বাজিয়ে দেখার সুযোগ! ভগ, জিকিউ, কসমপলিটনের পাতা উল্টাতে উল্টাতে কত বারই সে হারিয়ে গেছে সিন্ডি ক্রাফোর্ডের সাথে তার ইয়াত্তা নেই। আড়ালে অবশ্য মাঝে মাঝে পুরোনো ক্যামেরাটা নিয়ে ফটোগ্রাফার সেজে দাঁড়িয়ে যায়, আর মডেল হয়ে যায় সামনে স্তূপ করা বই খাতাগুলো। এই-ত সেদিনও সে নওমি ক্যাম্পবেলকে বলছিল, “দেখি… ডানে সরে বামে তাকাও, শরীরে চারটা বাঁক থাকবে”। ভাল কথায় কাজ না হয়ে শেষে রাগের মাথায় বলেই ফেলল “আই ওয়ান্ট দেট লুক, হোয়াই ক্যানট য়ু…” নওমির চেহারাটা দেখার মত হয়েছিল। সাথে জানালার ওপাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখা রাসেলের চেহারাটাও, হাসির বিস্ফোরণ ছিল তাতে। হাসতে হাসতে ঘরে ঢুকে সে,

– কিরে কতদূর ছবি তুললি?
গা জ্বালানী হাসি এটা; অভি ভাল করেই জানে। কিন্তু এটাও জানে ছবির সাথে তার মত রাসেলেরও প্রেম।
অভিঃ আরে ধূর। এই এমনি কিছু না…। তোর জন্যই অপক্ষা করছিলাম। মনে করলাম ভুলে গেছিস হয়ত আজকে মামার কাছে যাবার কথা। চল বের হই, আর দেরি করলে পাওয়া যাবে না তাকে।

সবাই তাকে আকতার মামা বলেই ডাকে, কাছের মানুষ দূরের মানুষ সবাই। অভির অবশ্য আপন মামা হয়। কিশোর
বয়সে নাকি নজরুল হতে চেয়েছিলেন কিন্তু হলেন ফটোসাংবাদিক। নজরুলের মত ঝাকড়া চুল আছে, মোঁচও আছে। শুধু ঐ ভুঁড়িটায় গিয়ে মার খেয়ে গেলেন। গলায় নিকনের কালো ফিতে জড়িয়ে যখন ছেড়ে দেন; ক্যামেরাটা ভুঁড়ির উপরে এসে বসে থাকে। যেন বিশ্রাম করছে। কোথায় নজরুল আর কোথায় ফটোসাংবাদিক! মামাকে জিজ্ঞেস করলে অবশ্য ক্যামেরাটা দেখিয়ে বলেন, “এটা আমার কলম, আর ছবিগুলো আমার কবিতা”। অভি মুখ টিপে হাসে মামার কথা শুনে।

মামার বাসায় পৌছুতে বিকেল গড়িয়ে আসে। আভি-রাসেল আশাই ছেড়ে দিয়েছিল তার দেখা পাবার। ভাগ্য সাথে;
সিঁড়িপথে দেখা হয়ে যায় তাদের, সেই চিরাচরিত রূপ গলায় ঝুলানো ক্যামেরা।
অভিঃ কোথায় যাও? আমাদের-না আজকে আসার কথা?
– আয় আমার সাথে…।
মামাকে এরকম গম্ভীর দেখেনি আগে। ঠিকমত দেখলও না ওদের, হনহন করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল। অভি-রাসেল মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। দুইজনের কেউ কিছু বলে না; আধুনিক যুগের স্বঘোষিত নজরুলের পিছু নেয় তারা।

রাস্তায় জ্যাম, মানুষগুলোর অস্থির অপেক্ষা। তার মাঝে এক দল মানুষ গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যেন কি এক আশ্চর্য
যাদুবলের মায়ায় পড়েছে তারা। ঠোঁট নড়ছে না, চোখের পলকও। মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে আছে শিল্পকর্মের দিকে। যেন শিল্পীর ক্যানভাস থেকে উড়ে এসে পড়েছে রাস্তায়, জীবন্ত। তাই কি? অভিরাও মিশে যায় আপ্লুত দলটির সাথে। কেউ ছুঁয়ে দেখতে চাইছে না, যদি নষ্ট করে ফেলে। ইস… শিল্পীর দেখা যদি পেত একবার! ধন্যবাদ যে দেওয়া হল না!! কিন্তু একজন ঠিকই ছুঁয়ে ফেলে তার মেয়েকে, ভন্ডুল করে দেয় সব যাদু। থেঁতলে যাওয়া মাথাটা কোলে নিলে গোঙানীর মত শব্দ বের হয়। ঘোর কেঁটে গেলে পাশে দাঁড়ানো একজন বলে উঠে,
-আহা… বেচারী।
মামাঃ ওর নাম ববিতা। মেয়ের বাবার পছন্দের নায়িকা ছিল, শখ করে নাম দিয়েছিল তাই।
অভির দিকে ক্যামেরাটা বাড়িয়ে দিয়ে বলেন,
মামাঃ ধর… ছবি তোলা শিখতে চেয়েছিলি না। ছবি তোল। এমন মডেল আর পাবি না!
ক্যামেরাটা ফসকে যেতে যেতে সামলে নেয় অভি, ভারী আছে-ত! এর আগে ক্যামেরাতে কখনই হাত দিতে দেয়নি মামা, অবাক হয় সৌরভ। যেদিক দিয়ে এসেছিল তারা সেদিকে হাঁটা শুরু করেন আকতার মামা; হঠাৎ করেই পথ হারা পথিক বলে ভ্রম হ্য় তাদের।

২.
বাড়ীর নিচ থেকে দেখা যাচ্ছে মামার ফ্লাট অন্ধকার। নেই নাকি আছে বুঝে না অভি-রাসেল দুজনের কেউই। ক্যামেরাটা ফেরত দিতেই আসা। অবশ্য টের পাবার কোন উপায়ও নেই, মামা একাই থাকেন। একা মানুষ আর কতই বা শোরগোল করতে পারেন। একবার দেখার জন্য উপরে উঠে যায় তারা। নিরাশ হতে হয় না তাদেরকে। মামা দরজা খুলে দেন।

-আয়..। ছবি তুলেছিস?
কোন উত্তরের আশা করেন না আকতার মামা, অভি-রাসেলও চুপ।
-ইলেকট্রিসিটি নেই বিকেল থেকেই, মোমবাতি কোথায় রেখেছে বুয়া তাও জানি না। খুঁজে দেখ-ত।
অভি-রাসেল কাজে লেগে যায় সাথে মামাও। কিন্তু মামা বোধহয় অন্য কিছু খুঁজছেন। মোমবাতি জ্বালানো হয়।
কিছু রঙিন-সাদাকালো ছবি নিয়ে বসে পড়ে তারা তিনজন।
– দেখ-ত চিনতে পারিস কিনা?
রাসেলঃ না…।।
অভি কিছু বলে না।
– বিকেলে রাস্তায় এই মেয়েটাকেই দেখে আসলি, চিনতে পারলি না? আচ্ছা দেখত দুইটা ছবির মধ্যে পার্থক্য কোথায়?
অভিঃ একটাতে ময়লা কাপড় পড়ে আছে আরেকটাতে নতুন।
– এটা তুই দেখছিস… এই যে দেখ এই ময়লা কাপড়ের ছবিটা… হাসিটা দেখ। এখানে মেয়েটাকে হাসতে বলতে হয়নি কিন্তু পরে যখন নতুন জামা পড়ানো হল কৃত্রিম হাসি ছিল মুখে। ছবিটা পথশিশুদের নিয়ে ক্যাম্পেইন করার
সময়কার। ছবিটা তোলার পর জামাটা নিয়ে ফেলা হয়। তখন যদি দেখতি…! আর এই ছবিটা গত বৈশাখের সময়,
একটা ফ্রক দিয়েছিলাম আমি। দেখ ছবিটা দেখ… হাসিটা দেখ…। লাল ফ্রকটা দেখলি না কি সুন্দর মিল খেয়ে গেল
রক্তের সাথে ঐটা আমারই দেওয়া।

কেউ কারও চোখের দিকে তাকায় না, এক অদৃশ্য নিষেধাজ্ঞা। হাতের ছবিটার ভিতরে ঢুকে যেতে চাইছে যেন সবাই, পালাতে বোধহয় নাকি ধরা দিতে!
– ছবি তুললেই খুশি ছিল। টাকা দিতে চাইলে হাতের ফুলের মালা এগিয়ে দিত। বাধ্য হয়ে মালা কিনতে হত।
গতকালকের মালাটা এখনও মরেনি, পানিতে ভিজিয়ে রেখেছি। কিন্তু মেয়েটা…
অফিস থেকে আদেশ এসেছিল বুঝলি… ওরা একটা এক্সক্লুসিভ ছবি চায় ববিতার। আমি ভাবলাম আমার সাথে মশকরা করছে বোধহয়, ববিতার ছবির অভাব আছে নাকি! কিন্তু তারা আমার ববিতার ছবি চায়… থেতলে যাওয়া বীভৎস ববিতার…।ওদের সাহস কত?
আচ্ছা তোরাই বল তোরা কোন ছবিটা মনে রাখতে চাইবি? এই বৈশাখের ছবিটা নাকি রাস্তায় যেটা দেখে আসলি সেটা।

বিদ্যুত চলে আসে। অনুভূতিতে ছেদ পরে, কথা আর এগোয় না। আকতার মামার কাছ থেকে সেদিনের মত বিদায়
নিয়ে আসে তারা। যাবার বেলায় রাসেল জিজ্ঞেস করেছিল,
-মামা কালকে কখন সময় দিবেন…
আর কিছু বলতে পারেনি অভির গুঁতো খেয়ে।
মামাঃ তোরা এখনো ছবি তোলা শিখতে চাস!!

অভি হয়ত কয়েকদিন ছবির পাগলামি থেকে দূরে থাকবে, তারপর আবার মামার কাছে ছুটে আসবে। বেদনার ছবিগুলো না হোক আনন্দের ছবি তোলা-ত তাকে শিখতে হবে। কিছুক্ষণ আগের কথাগুলো ভুলে যাবে হয়ত তারা তখন। রাস্তার রক্তের দাগ মুছে যাবে, গন্ধও মানুষের গন্ধে ঢেকে যাবে। ববিতার বাবা হয়ত সে রাস্তার ধারে কাছে যাবে না আর কোনদিন। পথ চলতে চলতে অনেকেই সেদিনের ঘটনা মনে করে ক্ষনিকের জন্য থমকে দাঁড়াবে, পিছু ফিরে তাকাবে।অভির গলায় ঝুলানো ক্যামেরা দেখে হয়ত ফুলের মালা হাতে কোন মেয়ে বলবে, “মামা… ফটুক তোল”। চমকে যেয়ে ছবি তুলবে সে, ফুলের মালা হাতে হাস্যোজ্জ্বল বালিকার ছবি।

(শেষ)
……………………………………………………………………………………………………………………………
গ্রেনেড হামলায় নিহত নির্লিপ্ত চাহনির আইভি রহমানের বসে থাকা কিংবা শহীদ অফিসারদের ছবি দেখে এর পিছনের
মানুষদের নিয়ে উপলব্ধি। কাউকে ছোট বা বড় করার কোন উদ্দেশ্য নেই, নিছক ছোটগল্প।
সবাইকে ঈদ মোবারক।

১,৪৬৮ বার দেখা হয়েছে

১৪ টি মন্তব্য : “ফটুক”

    • হাসনাইন (৯৯-০৫)

      একটা মেসেজ দেওয়ার চেষ্টা করছিলাম। সেদিকে নজর বেশি ছিল, তাই গল্পে 'পক্কতা' কম থাকতে পারে। মেসেজটা বুঝতে পারলে ভাল লাগবে। ভবিষ্যতে গল্পের দিকে আরও বেশি খেয়াল রাখব। ধন্যবাদ ফয়েজ ভাই কষ্ট করে পড়ার জন্য, উপরের সবাইকে ধন্যবাদ।

      জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : দিহান (অতিথি)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।