রূপবিলাস- ৩,৪

এখানে(১,২)

৩.
এই মানুষটার মাথায় শিং, লেজও আছে একটা। মুখে ভুবনভোলানো হাসি। কিন্তু সে জানে লোকটা তার জন্যই অপেক্ষা করছে বছর ধরে, যুগ যুগ ধরে। হাসির মোহে আর পরবে না সে, উল্টা ঘুরে দৌড় দেয়। কিন্তু একি পায়ের নিচে মাটি কোথায়?!! সব ষড়যন্ত্র ঐ বুড়ো বদমাসটার। নিচে তাকায় না সে, যদি হাল ছেড়ে দেয় শরীরটা। হাল ছাড়া যাবে না, হারা যাবে না। দরকার হলে বাতাসের মধ্যেই হাত-পা ছুড়ে দৌড়াবে সে। সব বন্ধন মুক্ত করে, সবকিছু ছিন্ন করে। পারতেই হবে… পারতেই হবে……
-এই…সৌরভ উঠ… আরে উঠ ব্যাটা ফোন আসছে তোর…বাইরে যেতে হবে…আর কতক্ষণ ঘুমাবি?!! উঠ…উঠ…উঠ।
আসলাম ভাইয়ের চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙ্গে যায় সৌরভের।
– ধর…কথা শেষ করে তাড়াতাড়ি ফোন দে। বাইরে যেতে হবে।
সৌরভঃ কে ফোন করেছে আসলাম ভাই?
-কি জানি নাম বলল… খান এপারেলস মনে হয়।
সৌরভঃ হ্যালো… স্লামুয়ালাইকুম।
ওপাশে মেয়েলি রিনরিনে গলায় কেউ বলে উঠে,
-সৌরভ সাহেব বলছেন?
সৌরভঃ জ্বী বলছি।
-আপনাকে সাক্ষাৎকারে ডাকা হয়েছে, কিছুদিন আগে সিভি ড্রপ করেছিলেন।
সৌরভঃ হ্যা… আচ্ছা। কবে আসতে হবে বলুন?
-কালকে চলে আসুন।
সৌরভঃ জ্বী ঠিক আছে।
মোবাইলটা আসলাম ভাইয়ের হাতে দিলে তিমি মাথা নাড়তে নাড়তে বলেন,
-কি? আরেকটা ইন্টারভিউ?!
সৌরভঃ হুম…আসলাম ভাই।
আসলাম ভাই মুখে বিরক্তির ভাব নিয়ে বলেন,
-তোকে-ত কোন ইন্টারভিউতেই নিবে না। বলি একটু ঠিকঠাক মত যা… তা না।
সৌরভঃ আমি যা; সেভাবেই যাই। সমস্যা-ত আমার না। সমস্যা উনাদের।
-যাহ…আর কি করবি… কথা-ত শুনবি না।

ঢাকাতে সৌরভের আপন বলতে এই আসলাম ভাই। কোন সম্পর্কের ভাই না, আগে কোনদিন পরিচয়ও ছিলনা। সম্পর্কের ডালপালা না মেনে সৌরভের মত মানুষদের জন্য বিধাতার উপহার এই আসলাম ভাইয়েরা। ফার্মগেটের ঘোপড়ি মেসে যখন উঠে সে এই বড় ভাইটাকেই রুমমেট হিসেবে পেয়েছিল। সৌরভ অনেকটা পরগাছার মতন আসলাম ভাইয়ের। পরগাছা যেমন যৌবনরসের জন্য গাছে আশ্রয় নেয় তেমনি ঘটনায়-দুর্ঘটনায় আশ্রয় বলতে এই আসলাম ভাই। ভাল বেতনের চাকুরী করেন, তাও কেন জানি এই ভাঙ্গাচোরা মেস ছেড়ে যেতে চান না। মায়ার বাঁধন অস্বীকার করা সম্ভব হয়নি। কবে এসে উঠেছিলেন মেসে জিজ্ঞেস করলে অনেকক্ষণ ভেবেও বের করতে পারবেন না আসলাম ভাই, সৌরভের তাই ধারণা।

৪.
খান এপারেলসের সামনে দাঁড়িয়ে বহুতল ভবনটাকে দেখে অনিচ্ছা জাগে মনে সৌরভের। আবার সেই শীতল বাতাস-গা জ্বলুনি, নাকি অপ্সরী আর টিপ তরুণী। অবশেষে শেষটাকেই বেছে নিয়ে ভিতরে ঢুকে পরে। দীঘি কপালে টিপ পড়েনি আজ, সৌরভকে চিনল বলেও মনে হ্লনা। খুব ব্যস্ত এমন ভাব নিয়ে বলল,
-বলুন কি করতে পারি?
সৌরভঃ আজকে আমার ইন্টারভিউ ছিল।
-ও আচ্ছা… সৌরভ সাহেব ওয়েটিং রুমে গিয়ে বসুন আমি নীলিমা ম্যাডামকে বলছি।
শীতল অপেক্ষা আর ছ্যাবড়া ম্যাগাজিনের কথা ভেবে সে বলে বসে,
-বেশী দেরী হবে?
প্রশ্ন করেই ভুল করে ফেলেছে বুঝতে পারে সৌরভ, সাক্ষাৎকারের প্রথম ইমপ্রেসনটাই খারাপ হয়ে গেল। হুম… ঠিক হল না। উত্তরের আশা না করে ওয়েটিং রুমের দিকে পা বাড়ায় সে। টেলিফোনের মেয়েটা কি দীঘিই ছিল? বুঝতে পারেনি কেন? যন্ত্র কি মানুষকে এতটাই বদলে দিতে পারে? এসব হাবিজাবি চিন্তা করতে করতে ডাক পড়ে এক সময়।

দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে অবাক হয়ে যায় সৌরভ। এটাকে কে অফিস বলবে। বিশাল টেবিলের এক কোণায় অল্প কটা ফাইল, দেখলেই বুঝা যায় বেশি ব্যবহার করা হয়নি। অফিস বাদে আর যা যা দরকার একটা পরিবারের তার প্রায় সবই আছে রুমে; কম্পিউটার, টিভি, ফ্রিজ, এক কোনায় ছোট একটা স্টোভ। ভুল করেনি-ত। ভ্রম ভাঙ্গে অপ্সরীর কথায়,
-আসুন সৌরভ সাহেব, বসুন।
তাহলে ইনিই নীলিমা। প্রস্তুত হয়ে,
সৌরভঃ ধন্যবাদ।
বহুদিন আগের একটা খবরের কাগজ সামনে বাড়িয়ে নীলিমা বলে উঠে,
-এটা আপনি?
সৌরভঃ জ্বী আমি।
-আপনার সাহসের প্রসংশা করতে হয়। জেল থেকে কবে ছাড়া পেলেন?
সৌরভঃ প্রায় দু-বছর হয়ে গেল।
-অন্য কোন জায়গায় চাকুরীর চেষ্টা করেননি?
সৌরভঃ জ্বী না।
-তাহলে এখন হঠাৎ কি দরকার পড়ল?
সুন্দরীদের মিথ্যা বলতে পারে না সৌরভ,
-বোনের……
আর এগুতে দেয় না নীলিমা,
-আপনার-ত অনেক টাকা পয়সা পাবার কথা। রাজনীতিতে চেষ্টা করতেন। কেউ প্রস্তাব করেনি?
নীলিমার কথায় তাচ্ছিল্যের আভাস পায় সৌরভ। সামলে নিয়ে বলে,
-করেছে। কিন্তু আমি যাইনি। অন্যায় কিছু-ত করিনি। যে গার্মেন্টসের সুপারভাইজার ছিলাম তারা শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি মেনে নেয়নি। আমি শুধু প্রতিবাদ করেছিলাম। পরে সেখানেও রাজনীতি ঢুকে পরে, গার্মেন্টস ভাঙচুর হয়। তাই জেল থেকে বের হয়ে কিছুদিন সবকিছু থেকে দূরে ছিলাম।
নীলিমাঃ আপনি যে এখানেও তা শুরু করবেন না তার গ্যারান্টি কে দিবে?
সৌরভঃ বলুন কি করতে হবে?
-আমাদের এখানে অপাতত কোন পদ খালি নেই। কিন্তু কয়েকদিন ধরে বাবাকে কিছু বখাটে ফোন করে চাদা দাবি করছে। বাবার জন্য প্রটেকশনের ব্যবস্থা করেছি, আপনি শুধু তার সাথে থাকবেন সবসময় আর টুকটাক সাহায্য করবেন। মাস শেষে আপনাকে ভাল এমাউন্ট দেওয়া হবে।
সৌরভ আর না করে না। টাকার চেয়ে পরিচয়টাই বেশি দরকার এখন তার।
সৌরভঃ আচ্ছা…।
-ঠিক আছে সৌরভ সাহেব তাহলে কালকেই জয়েন করুন। দীঘিকে বলে দিচ্ছি একটা এপয়নমেন্ট লেটার তৈরী করতে। আজকে তাহলে আসতে পারেন, ধন্যবাদ।

সৌরভও ধন্যবাদ দিয়ে ঊঠে পড়ে। ঘর থেকে বের হতে যাবে এমন সময় নীলিমা বলে ঊঠে,
-শুনুন। এটা কোন ধরনের পোষাক? ফুলশার্ট ইন করে কেউ পায়ে স্যান্ডেল পড়ে নাকি? যাওয়ার সময় একাউন্ট সেকশন থেকে টাকা তুলে নিয়ে যাবেন। কাল থেকে জুতো পড়ে আসবেন অফিসে।

যা ভয় করেছিল সৌরভ তাই হল। অবাক করার বিষয় হচ্ছে এতদিন অনেকেই একথা বলেছে তাকে, কিন্তু এই প্রথম সে যেন কিছুটা লজ্জা পায়। কথা বাড়ায় না, মানুষের খেয়াল-মর্জি বদলাতে সময় লাগে না। আর ইনি-ত স্বয়ং নারী।একাঊন্ট থেকে টাকা তুলে, কিছু কাগজ পত্র সাইন করে বের হয়ে পড়ে সে। বাইরে কড়া রোদ পড়েছে, পড়ূক। তাও আজকে অনেকক্ষণ হাঁটবে সৌরভ। কাল থেকে পায়ের স্বাধীনতার সাথে চিত্তের স্বাধীনতাও যে পরাধীন হবে। এখন ইট-পাথরে গড়া মানূষগুলোর মত সেও একজন। আজকে তাই সবকিছু মুক্ত করে রাখবে। বাড়িতেও খবরটা দিতে হবে। বাবা বেঁচে থাকলে হয়ত এ চাকুরী করতে দিতেন না, মাও বাবার সাথে তাল মিলাতেন। কিন্তু বুড়িটাকে যে আর ঘরে রাখা যাচ্ছে না। বাড়ি যেতে হবে, শেষবারের বুড়ির অভিমানভরা মুখ আর মায়ের অশ্রুভরা চোখ ভেসে উঠে। নাহ মায়াটা সৃষ্টি না করলে কি এমন ক্ষতি হত তাঁর!!

(চলবে)

৫,১১৯ বার দেখা হয়েছে

৫৯ টি মন্তব্য : “রূপবিলাস- ৩,৪”

  1. দোস্ত, তোর লেখায় এত সাবলীলতা কোথ্থেকে পাস? সাধারণত সিরিজগল্প গুলা আমার অতটা ভাল লাগে না, কিন্তু তোরটা পড়ার পরে, এরপরে কি হবে, সেটা জানার জন্য আগ্রহ বাড়তে থাকে।

    লাস্ট লাইনটায় তো পুরাই গুল্লি মাইরা দিছিস।

    নাহ মায়াটা সৃষ্টি না করলে কি এমন ক্ষতি হত তাঁর!!

    :hatsoff:

    জবাব দিন
  2. সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

    যাক পরের পর্ব এলো। ভালো লাগছে। কিন্তু এবারেও শেষ হলো না! আবার অপেক্ষা!! কোনো সমস্যা নেই। অপেক্ষায় থাকছি।


    "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

    জবাব দিন
  3. সায়েদ (১৯৯২-১৯৯৮)

    মৌলিক গল্প কবিতায় আমার বিস্ময়, ভালোলাগা আর মুগ্ধতার পরিমাণ এতই বেশি যে মন্তব্যের ভাষা হারিয়ে ফেলি। এখনও সেই অবস্থা।
    অসামান্য :clap: :clap: :clap: ।


    Life is Mad.

    জবাব দিন
  4. তাইফুর (৯২-৯৮)
    কাল থেকে পায়ের স্বাধীনতার সাথে চিত্তের স্বাধীনতাও যে পরাধীন হবে
    নাহ মায়াটা সৃষ্টি না করলে কি এমন ক্ষতি হত তাঁর!!

    প্লট সাজানো, ডিটেইলস গুলো সুন্দর করে ফুটিয়ে তোলা, উপরের লাইন গুলো'র মত অসম্ভব সুন্দর চয়ন ...

    হাস্না, তুই আমার প্রিয় লেখকদের একজন।


    পথ ভাবে 'আমি দেব', রথ ভাবে 'আমি',
    মূর্তি ভাবে 'আমি দেব', হাসে অন্তর্যামী॥

    জবাব দিন
  5. মুহাম্মদ (৯৯-০৫)
    কাল থেকে পায়ের স্বাধীনতার সাথে চিত্তের স্বাধীনতাও যে পরাধীন হবে।

    বুঝলি তো, পায়ের স্বাধীনতার বিষয়টা চরম লাগছে। জুতা পরলে পায়ের স্বাধীনতা খর্ব হয়, এই সহজ সত্যটা এর আগে কেউ ধরায়া দিতে পারে নাই। অতীব সুন্দর আবিষ্কার। চালায় যা। পড়ছি...

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : কুচ্ছিত হাঁসের ছানা

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।