নিরুদ্দেশ

১.
অনেকক্ষণ ধরে পজিশন নিয়ে আছে অপু। জানালার ফাঁক গলে এয়ারগানের নলটা বাড়ির পাশেরই এক গাছে তাক করা। গাছে চড়ুই পাখির বাসা আর জানালার এপাশে বিছানার উপর অপু। নতুন বাঁচ্চা ফুটেছে চড়ুইটার, দুটো ছানা। মা চড়ুইটা বাসায় আসলেই বাচচাগুলো কিচির মিচির করে মায়ের মুখ থেকে খাবার কেড়ে খায়, অপুর দেখতে ভাল লাগে। মা-টা আশেপাশেই আছে হয়ত, খাবার খুঁজতে ব্যস্ত। কিন্তু আজ মা চড়ুইটার নিস্তার নেই অপুর হাত থেকে, শিকারের নেশায় পেয়েছে অপুকে। ঐত এসে গেছে শিকার। ট্রিগারটা টেনে দিলেই হল, মা চড়ুইটা ধপাস করে মাটিতে পড়বে। নিশানা ভুল হওয়ার সম্ভাবনা নেই…ক্রুর হাসি হাসে অপু। এক, দুই, তিন… ট্রিগার টানতে গিয়েও থেমে যায় অপু। দেখতে পায়, মা চড়ুইটা বাচচাদের খাবার দিচ্ছে। এয়ারগানটা পাশে ফেলে রেখে হাতে দূরবীন তুলে নেয় অপু। এমন সময় মায়ের ডাক,
-“অপু খেতে আয়।”
অপুঃ “আসছি মা…।”
নাহ চড়ুইটা আজকেও বেঁচে গেল, মনে মনে বলে অপু।

তের কি চৌদ্দ বছরের অপু। কেউ জিজ্ঞেস করলে অবশ্য বাড়িয়েই বলে। খুব তাড়াতাড়ি বড় হওয়ার ইচ্ছে তার। মায়ের সাথে নানা বাড়িতেই
থাকে, আর আছেন একজন মামা। তার ধারনা মামার আদর সবচেয়ে বেশি পায় সে, এয়ারগানটা যে মামারই দেওয়া। বাবার স্মৃতি বলতে একটা মলিন হয়ে যাওয়া সাদাকালো ফটো, চৌধুরী সাহেবের এক হাতে দুনলা বন্দুক আর অন্য হাত কোমরে। বেশ হামবড়া ভাব। অপু প্রায়ই আয়নার সামনে এয়ারগানটা নিয়ে দাঁড়ায়, ছবির সাথে মিলিয়ে দেখে। মনে মনে বলে,

-“নাহ বাবার মত গোঁফ রাখতে হবে একটা, দশাসই!! ঐটা উঠলেই মাকে আলমারি থেকে বাবার দুনলা বন্দুকটা বের করে দিতে বলব।”

অপুর মা আড়াল থেকে নীরবে সব দেখেন, দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। অপুর সব আবদার তার মামার কাছে, মাকে একটু ভয় পায় সে। অপু দুষ্টুমি করলে মা গিয়ে নানার কাছে নালিশ করে। নানা অবশ্য কিছুই বলেন না অপুকে, বুড়ো হয়ে গেছেন। তাও মায়ের চোখে তাকাতে পারে না অপু। সবাই বলে বাবার চোখ পেয়েছে সে। অপুরও তাই ধারণা, শিকারী চোখ । বসার ঘরে একটা হরিণের চামড়া আছে, বাবার শিকার করা হরিণের চামড়া। মাঝেমাঝে তাতে হাত বুলায় অপু আর কল্পনায় শিকার করে বেড়ায়। ঠিক করে রেখেছে গোঁফটা উঠে গেলেই বেরিয়ে পড়বে বাবার খুঁজে, বাবার সাথে শিকার করবে। গোপনে একটা ব্যাগও গুছিয়ে রেখেছে, মা জানে না। দূরবীন, টর্চলাইট, ম্যাচ, মোমবাতি সব আছে তাতে। শুধু সময়মত কাপড় ঢুকালেই হবে। এসবই মামার কাছ থেকে জেনেছে সে। এখন একটা ক্যাপ পেলেই হল। সেটাও ঠিক আছে, এবারের জন্মদিনে মামার কাছে চাইবে সে। আর একটা হান্টিং নাইফ, ব্যস!!

২.
গতকাল সতেরতম জন্মদিন গেল অপুর, হান্টিং নাইফটা বোধহয় পেয়েই যাবে। আজকেও আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল অপু, হাতে এয়ারগান। নিজের কাছেই বেমানান লাগে তার। আয়নার কাছে যায় আরও। খুশিতে চিক চিক করে উঠে দুচোখ, নাকের নিচে গোঁফের আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে। বাবার বন্দুক নেয়ার সময় হয়ে আসছে। এয়ারগান রেখে মায়ের ঘরে যায় অপু।

অপুঃ “মা… বাবার বন্দুকটা বের করে দাও ত।”
আঠার বছর আগের চৌধুরী সাহেবকেই যেন দেখতে পান অপুর মা। চোখে শিকারের নেশা, খুনির চোখ। হঠাৎ সন্তান হারানোর বেদনা পেয়ে বসে তাকে। চড় বসিয়ে দেন ছেলের গালে। চিৎকার করে উঠেন,
-“কি?? বাবার মত খুনি হবি?…খুনির ছেলে?…তারপর দেশ-সংসার ছেড়ে পালাবি? পালানোর আগে বাবার শেষ না করে যাওয়া কাজটাও শেষ করে যাস। আমাকেও শিকার করে যাস।”
চিৎকার শুনে মামা আসেন।
মামাঃ “আরে… ছোট ছেলে…অত কিছু বোঝে না। আয় অপু আমার সাথে আয়।”
মাঃ “দাদা… তুমিই ত ছেলেটাকে লাই দিতে দিতে মাথায় তুলেছ। একদিন ওর বাবার মতই আরেকটা চৌধুরী হবে।”
কান্না জুড়ে দেন অপুর মা। সন্তান হারানোর আশংকায় নাকি স্বামী হারানোর বেদনায়, ঠিক বুঝা যায় না।

মাকে এত রাগতে দেখেনি আগে অপু, গালে হাত দিয়ে অবাক হয়। নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। হাতে তুলে নেয় এয়ারগান আর দূরবীনটা। জানালার ফাঁক দিয়ে এয়ারগানের নল বের করে দেয়। দূরবীনের চোখ দিয়ে গাছের ডালে ডালে খুঁজে বেরায় শিকার। আজকে কাউকে ছাড় দিবে না সে। একটা শিকারও পেয়ে যায়। পাখিটার নাম কি? মনে করার চেষ্টা করে। ধুর…নাম দিয়ে কি হবে, জীবনের প্রথম শিকার করেই ফেলবে আজ। নিশানা করে ঠিক মাথা বরাবর। মাথাতেই লাগাবে সে, প্রথম শিকার। ট্রিগারে হাত চলে যায়। পাখিটা জানতেও পারবে না…ক্রুর হাসি হাসে অপু।

পাখিটা মনের আনন্দে ডেকেই যাচ্ছে, খুব সুখী মনে হয়। অনেকক্ষণ হয়ে গেল অপু ট্রিগারে হাত দিয়ে বসে আছে, কেন যেন পারছে না। পাখিটার কাজ কারবার দেখতেই ভাল লাগছে তার। হাত থেকে এয়ারগান নেমে যায়, বাবার ফটোটা তুলে নেয় সে। নাহ বাবার সাথে অনেক অমিল তার। বাবা হয়ত এরকম কত পাখি-ই শিকার করেছে, কিন্তু সে এখনো একটাও না!! শিকারের ব্যাগটা বের করে অপু। ফটোটার দিকে এক ঝলক দেখে ব্যাগের ভিতর ঢুকিয়ে রাখে। এক হাতে ব্যাগ অন্য হাতে এয়ারগানটা নিয়ে মায়ের সামনে দাঁড়ায়।

অপুঃ “মা…এগুলো আলমারিতে তুলে রাখ ত।”
অপুর মাঃ “ব্যাগে কি?”
অপুঃ “শিকারের জিনিষপত্র…টুকিটাকি…”
এই প্রথম মায়ের চোখে তাকাতে তার ভয় লাগে না। অপুর মা হাসি মুখে বুকে জড়িয়ে ধরেন অপুকে। শেষ কবে হেসেছিল কিংবা এভাবে বুকে জড়িয়ে ধরেছিল মা, ঠিক মনে করতে পারে না অপু। অনেক দিন পর মাকে নতুনভাবে আবিষ্কার করে সে। আড়াল থেকে অপুর মামা অশ্রু সজল হাসি দিয়ে মা-ছেলেকে দেখেন। অপু ঠিক করে রেখেছে বাবার সাথে দেখা হলে একটা কথা অবশ্যই জিজ্ঞেস করবে ,

-“আচ্ছা বাবা…নিশানা ঠিক করে কখনই কি মন খারাপ হয়নি তোমার?”

৩,৪৪৮ বার দেখা হয়েছে

৩৬ টি মন্তব্য : “নিরুদ্দেশ”

  1. তাইফুর (৯২-৯৮)

    হাসনাইন, সুন্দর একটা মৌলিক গল্প হইছে। ভাল লাগলো।

    অনেকক্ষণ হয়ে গেল অপু ট্রিগারে হাত দিয়ে বসে আছে, কেন যেন পারছে না। পাখিটার কাজ কারবার দেখতেই ভাল লাগছে তার।

    অপু মিয়া আর যাই হউক, র‌্যাব হোতি পারবিনানে।


    পথ ভাবে 'আমি দেব', রথ ভাবে 'আমি',
    মূর্তি ভাবে 'আমি দেব', হাসে অন্তর্যামী॥

    জবাব দিন
  2. রায়হান আবীর (৯৯-০৫)

    খুবি সুন্দর হইছে। আমি ভাবছিলাম অপু মিয়া নিরুদ্দেশ যাত্রা করবে শিকার করার লোভে। কিন্তু দেখা গেল সে খুবই ভালো ছেলে (আমার চেয়ে কম অবশ্য 😀 ).

    অপুরে তো ক্যাপ কিন্না দেওয়া যাইবো না, তোরে একটা দিমুনি। তখন তুই পাখি 😉 😉 শিকার করে বেড়াইস।

    জবাব দিন
  3. জিহাদ (৯৯-০৫)

    আমার ক্যান জানি আগের গুলার চেয়ে এইটা আরো বেশি ভাল্লাগলো। কোন সমালোচনায় যাচ্ছিনা। তবে এইটুকু বলি, তোর লেখায় চরিত্রের অনুভুতিগুলো খুব সুন্দর ফুটে ওঠে। একটু যত্নবান হ। টাইম নিয়ে গল্প লেখ। দিন দিন আরো ভাল হবে। :grr:


    সাতেও নাই, পাঁচেও নাই

    জবাব দিন
  4. তানভীর (৯৪-০০)

    হাসনাইন, তোমার এই লেখাটা খুব ভালো লেগেছে। অপুকে এই সুন্দর মানবিক গুণাবলী দেয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
    আশা করি ভবিষ্যতেও তোমার কাছ থেকে এই ধরনের লেখা পাব। :clap: :clap:

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : হাসনাইন (৯৯-০৫)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।