পাতা ঝরার গান

স্কুল জীবনের একটু সিনিয়র পর্যায়ে ঠিক কতদিন যে এসেমব্লির পর ক্লাস করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়েছে সেটা আমি হাতে গুনে বলে দিতে পারব। এসেম্বলি হত থার্ড পিরিয়ডের পর। রংপুরে লায়ন্স দিয়ে আমার স্কুলিং শুরু। সে সময় আমি আবার তদানীন্তন কেজি শ্রেনীর বেশ উদিয়মান তারকা ছিলাম। প্রথম ক্লাস টিচার ছিলেন মধুছন্দা ম্যাডাম।ম্যডাম বেশ যত্ন করে আমাদের হ্যান্ড রাইটিং শেখাতেন। সে সময় আমাদের স্কুলে আমরা প্যাচানো হাতের ইংরেজী লেখা শিখতাম। ইদানিং এর চল কমে গেছে, নাকি এখনকার কেজি শ্রেনির ক্লাস টিচার রা কোন এক বিশেষ কারনে তা শেখান না , জানি না। আমরা ক্লাসে বসে মুখ গোল গোল করে যখন –অয়াই ও ইউ– ইউ , অয়াই ও ইউ– ইউ মুখস্থ করতাম তখন মধুছন্দা ম্যাডামের প্রথম শ্রেনি পড়ুয়া ছেলে, আমাদের বাবাই দা ( তার ন্যাম ট্যাগ এ লেখা ছিল– বাবাইসোনা) আপন মনে আমাদের ক্লাসের কোণায় বসে ছানা সাবাড় করতেন। এই পর্যায় ছিল আমার বিদ্যালয় জীবনের স্বর্ণযুগ। যার মানে হল আমি প্রায়শঃ টার্ম ফাইনাল পরীক্ষায় ১ থেকে ৩ এর মধ্যে একটা ফলাফল এনে বাবা মার মুখ উজ্জ্বল করে ফেলতাম।

রংপুর জিলা স্কুল আর খুলনা জিলা স্কুল পর্যায় টা অনেক টা একই রকম। মার খেতে খেতেই আমার সময় কেটে গেছে। আর এ জন্য স্কুলের সামনের বিস্তীর্ণ মাঠই মূলত দায়ী ছিল। টিফিনের পর আমরা কখনই ঠিক সময় মত ক্লাসে ঢুকতে পারতাম না। যার ফলশ্রুতিতে শিক্ষককে কিছু নজরানা দেওয়াই লাগতো। রংপুরে স্কুলের চারপাশে প্রচুর ডুমুর গাছ ছিল। ডুমুর এর ফল খেয়ে আমরা সাফ করে ফেলতাম। এখন হয়তো অনেকে জানেই না ডুমুর খাওয়া যায়, অথবা অনেকেই জানে কিন্তু খাওয়া হয় নি। এখানেই আমার দাড়িয়াবান্ধা আর বোম্ববাস্টিং খেলার ডেব্যু, যেটা কিনা লায়ন্স এ বরফ পানি , সাত চারা আর চোর পুলিশ খেলায় সীমাবদ্ধ ছিল। একটা কথা বলাই হয়নি, লায়ন্স ছিল কো এডুকেশন। এখন এমন আকাল পড়বে জানলে, সেই সময়ই একটা বাগিয়ে রাখতাম। কিন্তু তখন আমি লক্ষী ছিলাম।

খুলনা ছিল রংপুরের মতই। খালি যোগ হল স্কুলের মাঠের পাশাপাশি ওই সার্কিট হাউসের মাথ।টেপ টেনিস, ঠকাশ আর রবার ডিউসের জয় জয় কার তখন । কিছুদিন প্যাড গ্লাভস লাগিয়ে ওই মাঠে এক জুনিয়র টিমে কাঠের বলে দীক্ষাও নিলাম। এই সময় ক্লাসের ভেতরে ক্রিকেট এবং ফুটবলের আবিষ্কার হলো। যার ফলশ্রুতিতে অধিকাংশ ক্লাসই আমাদের কয়েকজনকে ক্লাসের বাইরে নী ডাউন হয়ে কান ধরে করতে হত এবং চিকন চিকন গাছের ডালের শপাং শপাং শব্দ আমাদের কানের পাশে অপূর্ব দ্যোতনার উন্মেষ ঘটাতো। আমি মাঝে মাঝে গিয়েই স্যারের রুমে ঢুকে ব্লেড দিয়ে ডাল গুলোর মাঝখানে অল্প করে কেটে দিয়ে আসতাম। এতে করে ঠাকুর অল্প মারেই ভেঙ্গে যেত। আসার পথে ল্যাব এ ঝুলিয়ে রাখা কঙ্কাল বাবাজীর দু তিনটে আঙ্গুল ভেঙ্গে আনতাম এবং চড়া দামে কিছু সন্ধিতসুর কাছে বেচে দিয়ে গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আলু মাখা খেতাম।

কাঞ্চন নগরে এলাম যখন তখন ক্লাস ফোরের মাঝামাঝি। এখানে আসার পর কিছু এমন ছেলেপেলের সাথে দেখা হলও যাদের যন্ত্রণায় এবং ফাদে পড়ে আমার ক্লাসই আর করা হলও না জীবনে। আর যদি করেও থাকি সেটা বড় জোর এসেম্বলী পর্যন্ত।শিখলাম যে ক্লাসে স্কুলের শার্ট এর পাশাপাশি আর একটা টি শার্ট আনতে হয়, যেটা গায়ে দিয়ে স্কুল পালাতে হয়, নইলে স্কুলের বদনাম হয়। স্কুলের মান সম্মানের ব্যাপারে আমরা খুবই সচেতন ছিলাম।সারা জীবন “বিশেষ কারনে ক্লাস করতে না পারায় বা শারীরিক অসুস্থতার জন্য ছুটি চেয়ে আবেদনপত্র” লেখার বাস্তব প্রয়োগ ও এখানেই শেখা। মন খারাপ হলে বা কোন কারনে প্যাচে পড়ে ক্লাস পালাতে না পারলে ডাইরেক্ট লিগাল রাস্তা মাপতাম। হাতে আবেদন পত্র ধরিয়ে দিতাম যার কিনা কোনটার নিচে আম্মুর সই ও থাকতো ।সই কে করত সেটা থাক না গোপন। রাব্বির বাসায় বসে অঞ্জন দত্ত শুনতাম, কখনো মহিনের ঘোড়া গুলি। গানের আগা মাথা বুঝতাম না, তবে বুঝতাম একটু উচু পর্যায়ের গান।গান বাজতো গানের গতিতে, আর আমরা কল ব্রীজ খেলা শিখতাম, মেরেজ শিখতাম,ট্রাম করা শিখতাম। কোনদিন সাইকেল নিয়ে অনেক দূরে কোথাও চলে যেতাম, একদম নিরুদ্দেশ যাত্রা, সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরলেই হ্য়।স্কুলের পাশে জম জমাট প্রেক্ষাগৃহ প্রিয়া সিনেমা হল। এক বৃহস্পতিবার , তখন ক্লাস সিক্সে আমরা, ভাবলাম সারা স্কুলের চার পাচটা ছেলে একদিন ক্লাস না করে একটা শো মেরে দিলে পৃথিবীর এমন কোন ক্ষতি হবে না। আমাদের স্কুলে শার্ট ছিল সাদা আর প্যান্ট ছিল সবুজ। ওইদিন সেটা পরেই ঢুকে পড়েছিলাম।ফারস্ট হাফ শেষে যখন বাতি জ্বলে উঠলো , খোদার কসম দেখলাম সারাটা সিনেমা হল সাদা আর সবুজ, সাদা আর সবুজ, সাদা আর সবুজ।সেদিন কেবল হেড স্যার আর কয়েকজন শিক্ষক আসলে আমরা ওইদিনের এসেম্বলীটা সিনেমা দেখতে দেখতেই করতে পারতাম।

………………
……………

খুলনা বাইতি পাড়ায় ঢুকতেই হাতের ডানে একটা ভিডিও গেমসএর দোকান ছিলো। ২০ টাকায় মোস্তফা গেম ওভার করা যেত । কয়দিন পর এল “কিং অফ ফাইটারস” । আমাদের জিলা স্কুলের সামনের ভিডিও গেমসের দোকানে ছিল থ্রি মোস্তফা , তিনটাই মোস্তফা নিয়ে খেলা যেত, “বিশ গুলি” নামে আজব অপশনে বিভিন্ন মডেলের অস্ত্র পাওয়া যেত , যার গুলি ইহজীবনে ফুরাতোনা। আমি ওই বয়সে হাত খরচ বলে তেমন কিছু পেতাম না। তাই আমি ঘরের মাটির একটা ভাঙ্গা ব্যাঙ্ক ছিল ( আগে থেকেই ভাঙ্গা) ওখান থেকে পয়সা মারতাম ভিডিও গেমস খেলার জন্য। বোঝারও জ্ঞান তখন হয়নি যে এভাবে রোজ ৬/৮/১০ টাকার কয়েন নিতে নিতে একদিন অনেক পয়সাও কমে দৃষ্টিকটু পর্যায়ে চলে যাবে। একদিন দুপুরে আমি যখন তন্দ্রাচ্ছন্ন, আম্মু আমাকে আস্তে করে জিজ্ঞেস করলেন ” ব্যাঙ্ক থেকে কি তুই পয়সা নিস আব্বু?” আমি হালকা হালকা ঘুমে ঘুমে বললাম ” হুম”। ঘুম ভাঙ্গার পর মনে হল হয়তো আব্বু আসার পর আজ অনেক ঝড় পার হতে হবে আমাকে। কিন্তু কিছুই হোলো না। আমি পরদিন থেকে ব্যাঙ্কের পয়সা নেওয়া বন্ধ করে দিলাম। স্কুলে রিকশায় যাওয়া আসা বন্ধ করে হেটে যাওয়া আসা শুরু করলাম। রিকশার ভাড়া দিয়ে মনের সুখ মেটানো শুরু করলাম, আর মনের লিস্টে ঢুকালাম, যেদিন আমার অনেক টাকা হবে আমি সেদিন একটা ঠিক এই রকম সাইজের , ঠিক এইরকম মডেলের ভিডিও গেমস কিনবো।

স্কুলের সামনের আইসক্রিমের গাড়ি থেকে আটানার পাইপ আইসক্রিম কিনে চুষতে চুষতে জিভ লাল, সবুজ বানাতে বানাতে চিন্তা করতাম একটা আইসক্রিম ফ্যাক্টরি হবে আমার। ইগলু, পোলার না… সেখানে খালি পাইপ আইসক্রিম বানানো হবে। আমি ফ্রি ফ্রি পাইপ আইসক্রিম খাবো।

এখন আমি ৪০০/৫০০/১০০০ টাকা দিয়ে সিনেপ্লেক্স এ মুভি দেখতে যাই, আমার মনে হয় না ” আমার যেদিন টাকা হবে আমি এমন একটা সিনেপ্লেক্স বানাবো”……… ক্রীম এন্ড ফায কিম্বা নিউজিল্যন্ড আইসক্রিম খেতে গিয়ে আমার মনে হয় না ” আমার এমন একটা আইসক্রিম কোম্পানি হবে”।

ভিডিও গেমস কেনার বা পাইপ আইসক্রিম ফ্যাক্টরির স্বপ্ন আমাকে আজো হাসায়। আমি জানি সিনেপ্লেক্স কিম্বা অমন বড় আইসক্রিম কোম্পানির স্বপ্নের কথা আর দশ কি বিশ বছর পর মনে হলে আমি হাসবো না।
…………

……………..

১৯৯৩ সালের দিকে গুপ্তপাড়া থেকে লায়ন্স স্কুলে দুই টাকা রিকশা ভাড়া দিয়ে ঘাড়ে ব্যাগ আর এক কাঁধে JAMBO লেখা পানির পট ঝুলিয়ে চলে যাওয়া যেত। দুই টাকা দিয়ে টিফিন পিরিয়ডে কিম্বা ছুটির পর খালেক ভাইয়ের ঝালমুড়ি খাওয়া যেত।স্কুলের প্রিন্সিপাল স্যার ধবধবে সাদা চুলওয়ালা ছিলেন। ব্যাকব্রাশ ক্রতেন।চোখে মোটা কালো ফ্রেমের চশ্মা।বয়স ওনার কত ছিল বলা মুশকিল, শুধু বলতে পারি যে বয়সে মানুষের সুপারি দিয়ে পান খাবার মত দাত থাকেনা, বাটা পান খেতে হয়, উনি ঠিক সেই বয়সী ছিলেন আমার এবং আমাদের যখন প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার ভিত্তি রচনা হচ্ছে। স্যারের সুন্দর একটা রুপালী রঙ্গের কিম্বা রূপার বাটা পানের বাক্স ছিল। সেখান থেকে টুকটুক করে বাটা পান মুখে দিতেন আর অফিসের সামনের রেলিং এ দাড়িয়ে দেখতেন আমাদের খালেক ভাইয়ের ঝালমুড়ি খাওয়া অথবা, বোম্বাস্টিং কিম্বা সাত চারা খেলার নামে টেনিস বল ছুড়ে একে অপরের হাত পিঠ লাল করে দেওয়া। আমরা এবং স্যার সবাই সে সময় রাজকপালে ছিলাম।

দুপুরের খাঁ খাঁ রোদের আমরা দাড়িয়াবান্ধা কিম্বা বরফ পানি খেলতাম আর হা হা করে হাপাতাম। ঘেমে চুপসে যেতাম। দৌড়ে কলপাড়ে গিয়ে পানি খেতাম। নিজেই কল চেপে পানি খাওয়ার সামর্থ্য তখনো আমাদের হয়নি। এমনকি একজন সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে যে কল চাপবে সেই সময়ও আসেনি। একজন কলের যে দিকে পানি বের হয় সেখানে দু পাত পেতে বসে হা করে থাকতো আর আরেক জন কলের ডান্টাটা ধরে ঝুলে পড়তো। এই ঝোলাঝুলিতেও অন্য রকম মজা ছিল। স্যার অফিস থেকে বেরিয়ে বোম্বাস্টিং, দাড়িয়াবান্ধা, বরফ পানি খেলোয়াড়দের মাঝখান দিয়ে হেটে চারপাশ দেখতে দেখতে, খেলোয়াড়দের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে অন্য বিল্ডিং এ চলে যেতেন। আমরা এবং স্যার সবাই সে সময় রাজকপালে ছিলাম।

আমরা দুইটাকা দিয়ে খালেক ভাইয়ের ঝালমুড়ি খেতে পারতাম, রোদে বোম্বাস্টিং খেলতে পারতাম, বল দিয়ে মেরে একজন আরেকজনের হাত পিঠ লাল করে দিতে পারতাম। বরফ পানি, দাড়িয়াবান্ধা খেলে ঘেমে, হাপিয়ে কল থেকে আঁজলা ভঁরে পানি খেতে পারতাম। আমাদের প্রিন্সিপাল স্যার আমাদের ওই বয়সেই বেঁচে থাকার স্বাধীনতা দিয়ে দিয়েছিলেন। আমরা রাজকপালে ছিলাম।

১৯৯২-৯৩ সালেও অনেক হোমরা চোমরা বাবার ছেলে ছিল আমাদের স্কুলে। তারাও ঝালমুড়ি খেত, তাদেরও হাত পিঠ লাল হত, তারাও কল চেপে প্রচন্ড গরমে পানি খেত। তখনকার কোন বাবা মা ই কোন এক সকালে স্কুলে গিয়ে প্রিন্সিপাল স্যারকে জিজ্ঞেস করেন নি “ আপনি থাকতে আমার ছেলে কিভাবে জাঙ্ক ফুড খায়? আপনি থাকতে এরা কিভাবে টেনিস বল দিয়ে মেরে একে অন্যের হাত পিঠ লাল করে? আপনি থাকতে এরা কিভাবে এই রোদে মাঠে দৌড়ায়…… স্কুলে পানির ফিল্টার নেই কেনো… কলের পানি খেয়ে আমার ছেলে অসুস্থ হলে কে জবাবদিহি করবে ?”………… স্যার ও রাজকপালে ছিলেন ।

স্যার আমাদের মত রাজকপালে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে কতটুকু গর্বিত ছিলেন জানিনা, তবে আমরা ওনার মত একজন রাজকপালে প্রিন্সিপাল পেয়ে আজও গর্বিত। আমাদের স্যার যেখানেই থাকুক, এতটুকু জানুক যে তার মত রাজকপাল নিয়ে ২০১৪ সালের কোন অভিজাত বা ভালো মানের স্কুলের প্রিন্সিপাল জন্ম নেননি, আর হয়তো নেবেনও না।
……………

…………….
…………….
অজপাড়া গা মংলা থেকে প্রায় এক বছর পর ঢাকা শহরে আসলো বন্ধু লেইশাম খোইরম। এই এক বছরে নিজের লেজ কেটেছে এবং অন্যকে লেজ কাটার পরামর্শ দিচ্ছে। হালের ক্রেইজ ফাস্ট এন্ড ফিউরিয়াস সাত দেখবো দেখবো করেও দেখা হচ্ছিলো না। গত রাতে লেই এর ফোন পেয়ে এবং ও ঢাকাতে শুনে মনে হোলো ওকে নিয়ে দেখে আসি। বান্দা তো একবারেই রাজী। বিকাল সাড়ে চারটার শো। পপ কর্ণ, পেপসি আর চিকেন কর্ণ নিয়ে আয়েশ করে দেখতে বসলাম। দেখলাম আমি মাঝে মাঝে দুই একটা কথা বললেও ( মন্তব্য) ও বেশ মনোযোগ দিয়ে মুভি দেখছে। দেখা শেষ হোলো। বের হবার সময় লেইশাম জিজ্ঞেস করলো,
“দোস্ত, আমাকে যদি কেউ জিজ্ঞেস করে এই মুভিতে আসলে আমি কি দেখলাম কি উত্তর দিব?”
আমি ভাবলাম হয়তো কোন কোন জায়গা বোঝেনি। বিজ্ঞের মত বললাম,
“হান মারা গেলো মনে আছে?”
লেই—“হান টা কে?”
আমি—“ টোকিও ড্রিফট আর ছয় এ ছিলো যে। তোর মত দেখতে অনেকটা”
লেই—“দোস্ত এই গুলা কি? মুভি”?
আমি-“তুই এর আগের ছয়টা দেখিস নাই?
লেই—“ ছয়য়য়য়য়য়য়য়য়য় টা আছে এর আগে??? (ক্যালাতে ক্যালাতে) দোস্ত আমি একটাও দেখি নি”
আমি – “যা বা… তুই বলবি না? তাইলে অন্য কিছু দেখতাম”
লেই – “দোস্ত, তুই দেখতে চাইলি তাই তোর সাথে চলে এলাম :ডি”

জীবনের কিছু বন্ধুত্ব এমনি হয়। যেগুলো সারাদিন আর যাই হোক তাই হোক, যাই দেখা হোক… শেষ পর্যন্ত কোন ছোট ছাপড়ায়, কিম্বা ভাতের হোটেলে অথবা বড় কোন রেস্টুরেন্টে এক পেট খেয়ে ঢেকুর তুলে আর হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে সেই দিনের ইতি টেনে দেয় এবং আরো সুন্দর একটা আগামীকালের স্বপ্ন দেখায়।……

……………………………………………………

……………………………………………………

আমরা চুপাচুপ ললিপপ খেতাম, চুপাচুপ মেলোডী পপ খেতাম। লোত্তে চুইঙ্গাম খেয়ে হাতের কব্জির একটু উপরে ট্যাটু লাগাতাম আর স্কুলে সেই ট্যাটুর কারনে বেধড়ক মার খেতাম। স্যার বলতেন ” এক্ষুনি ঘষে তুলে বাইরে গিয়ে নী ডাউন হয়ে থাক ” আমরা ঘষে তুলে নী ডাউন হতাম। পরদিন হাতে আরেকটা লাগিয়ে এসে আবার নির্লজ্জের মত মার খেতাম। প্রথম প্রথম আমরা” ছেড়ে দেন স্যার” বলে আকুতি করতাম, পরে দাত কেলিয়ে হাসতাম। লম্বা বেঞ্চে চার জন মিলে কলম ফাইট খেলতাম, খেলে ধরা পড়ে মার খেতাম। জিলা স্কুলের বড় ক্লাস রুমে খাতা চক দিয়ে ক্রিকেট খেলতাম , ক্রিকেট খেলে ধরা পড়ে আবার মার খেতাম। সারাদিন মার খেয়েই যেতাম। আমরা কোনদিন যে মার খাইনি, সেটা আসলে হিসেব করে বের করাটা খুব মুস্কিল। আমাদের সমসাময়িক সবাই মার খেয়েই দিন পার করে এসেছে, মার খাবার পর দাত কেলিয়ে হেসেছে, শরীর ভর্তি বেতের বাড়ির দাগ নিয়ে এসে , গায়ের জোরে চোখের পানি আটকে বলেছে ” ধুর, স্যার আমাকে মারতেই পারলো না ঠিক মত”।

এখনকার স্কুলগুলো অনেক কড়াকড়ি। স্যাররা সহজে মারতে কেনো বকতেও পারেন না। কিছু করলে বাবা মা কে ডেকে কথা শোনানো হয়, অথবা জরিমানা করা হয়। আমাদের মত মার খেতে হয় না কাউকে।

যাক , আমাদের মত স্কুল ছাড়ার বছর পনেরো পর হটাত কোন স্যারের সাথে দেখা হলে গলা জড়িয়ে ধরবার পর স্যার এর কান্না ভেজা কণ্ঠে ” মনে আছে তোকে একদিন অনেক মেরেছিলাম, অনেক বড় হয়ে গেছিস তুই” …………………… এমন হতবিহবল অনুভূতিও হয়তো তাদের হবে না ।

৫,৩৫৫ বার দেখা হয়েছে

১৮ টি মন্তব্য : “পাতা ঝরার গান”

  1. পারভেজ (৭৮-৮৪)

    মার দেওয়া/খাওয়াটাকে কি একটু গ্লোরীফাই করা হয়ে গেল?

    আমার ধারনা, আমাদের সময় টিচাররা এই মারধরটা করতেন, কারন এর বাইরে একটি ছাত্রের বিহেভিয়ার ইনফ্লুয়েন্স করার আরও যে কোন পন্থা, থাকতে পারে, তা হয়তো তাদের জানা ছিল না।
    আর জানা থাকলেও তারা সেগুলো ব্যবহারে অত উৎসাহ বা ধৈর্য্য রাখতেন না।
    কারনটা সহজবোধ্য, তাদের বেশীরভাগই পেশাট বাই চয়েস নেন নাই, নিয়েছেন বাধ্য হয়ে।

    আমরা এসব মারকুটে টিচার এত মারধরের পরেও সফল হওয়া সেসব ছাত্রদের গালভরা গল্প শুনি, কিন্তু তাদের গল্প কি শুনি যারা ছিল একটু পিছিয়ে পড়া?
    মারের চোটে যাঁদের স্কুল ছাড়তে হয়েছে চিরতরে?
    তাদের কেউ কেউ পরে মেস ওয়েটার বা মুদি দোকানদার (আমার দেখা দুটো সত্যি উদাহরন) হয়ে জীবন কাটাচ্ছেন ঐ শিক্ষকদের মারের কারনে, সেটা কি তারা জানেন?
    আমার জানতে ইচ্ছা হয়, তাদের সাথে যখন ঐসব মারকুটে শিক্ষকদের দেখা হয়, কী বলেন তারা?
    ছাত্ররাই বা কেমন প্রতিক্রিয়া করে তাতে?


    Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

    জবাব দিন
  2. মুজিব (১৯৮৬-৯২)

    পুরোটাই দারুন চমৎকার লেগেছে। একেবারে নস্টালজিয়া জাগানো লেখা। শুধু একেবারে শেষে কেমন যেন মনে হল শিক্ষকদের কারনে অকারনে ছাত্র পেটানোর সেই বাজে প্রবনতাটাকে অহেতুক মহিমান্বিত করা হয়েছে। এটুকু ছাড়া বাকিটা এককথায় - দারুন!


    গৌড় দেশে জন্ম মোর – নিখাঁদ বাঙ্গাল, তত্ত্ব আর অর্থশাস্ত্রের আজন্ম কাঙ্গাল। জাত-বংশ নাহি মানি – অন্তরে-প্রকাশে, সদাই নিজেতে খুঁজি, না খুঁজি আকাশে।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।