পারিজাত

” শিউলি ফুল, শিউলি ফুল, কেমন ভুল, এমন ভুল॥
রাতের বায় কোন্ মায়ায় আনিল হায় বনছায়ায়,
ভোরবেলায় বারে বারেই ফিরিবারে হলি ব্যাকুল॥
কেন রে তুই উন্মনা! নয়নে তোর হিমকণা।
কোন্ ভাষায় চাস বিদায়, গন্ধ তোর কী জানায়–
সঙ্গে হায় পলে পলেই দলে দলে যায় বকুল”

পারিজাতের গল্প বলবো।পারিজাতের সাথে আমার পরিচয় বছর দুয়েক। এইতো সেদিনের কথা। আলিয়াস ফসে’স এর ক্যাফেটেরিয়ায় পড়ন্ত এক বিকেলে বসে কফির পেয়ালায় কেবল এক কি দুই চুমুক দিয়েছি। হটাত কানের পাশে রেশমি চুড়ির রিনিঝিনি শব্দের মত কণ্ঠে কে যেন বলে উঠলো “এই চেয়ারে আমার ব্যাগ রাখা ছিল”। আমি বললাম “জ্বি ছিলো, ব্যাগ চেয়ার থেকে টেবিলের উপর উঠেছে এবং আমি এখনো কফি খাচ্ছি, খাওয়া শেষ হলেই ব্যাগটা নিয়ে হাওয়া হয়ে যাবো ভাবছিলাম”।মেয়েটা আমার দিকে কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে পরক্ষণেই একটা মিষ্টি হাসি হেসে দিলো।আমি আবার বললাম
“আমি কফি শেষ না করা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থেকে মনে মনে আমাকে অশ্রাব্য কুশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করতে পারেন, অথবা আমার উল্টোদিকের চেয়ারে বসে আমার সাথে কফি খেতে পারেন”।
মেয়েটা চেয়ারটা টেনে সুন্দর করে বসলো।এতক্ষন আসলে মেয়েটাকে আমি ভালো করে খেয়ালই করি নি।বসার পর খেয়াল করলাম ছিপছিপে একহারা গড়নের মেয়েটার লম্বাটে মুখে একটা আশ্চর্য রকমের স্নিগ্ধতা রয়েছে।কবিদের ভাষায় আলু, পটল , উচ্ছে ইত্যাদি চেরা চোখ না হোক, বাশির মত নাক না হোক, পান পাতার মত মুখ না হোক, একবারের দেখাতেই এই মেয়েকে সুন্দরি বলবে যে কেউ।সাহসের মাত্রা বেড়ে গেলো।কাউন্টারে তাকিয়ে চোখের ইশারায় এক কাপ কফি দিয়ে যেতে বললাম।দেখলাম মেয়েটা এই ব্যপারে কোন প্রতিবাদ করলো না।আমি নিজেই আগ বাড়িয়ে বললাম
“আপনার ব্যাগ চেয়ার থেকে টেবিলে তোলার ক্ষতিপূরন স্বরূপ এক কাপ কফি।কাঁকতলিয় ঘটনা একবারই হয়।একদিন অচেনা লোকের কাছে কফি খেলে কিছু হবে না”।

মেয়েটা জিজ্ঞেস করলো “কিসের ক্লাস করেন”?

“করিনা, আগে করতাম, বন্ধু আছে, রুদ্র, ক্লাস করায়, দেখা করতে এসেছি। আপনি?ও আচ্ছা ভায়োলিন শেখেন নাকি? বাহ বাহ”।

“হুম চার মাস হল শুরু করেছি।অনেকদিন ধরেই শিখবো শিখবো ভাবছিলাম, হয়ে উঠছিল না। পড়াশুনার চাপ তো থাকেই”

“তো কিসে পড়েন?”

“জেন্ডার এন্ড উইম্যান স্টাডিজ, ঢাবি তে, ফাইনাল ইয়ার। আপনি?”

“আমি একটা চাকরি করি, সাথে বুড়ো বয়সে একটু লেখাপড়ার চেষ্টাও করি। কিন্তু আসলে হয় না।আমার নাম তানভীর”।

“আমি পারিজাত”।

নামটা শোনার সাথে সাথে এই মেয়েকে আমার আগের চেয়েও আরো বেশি সুন্দরী মনে হতে লাগলো।পারিজাত শেফালি ফুলের সংস্কৃ্ত নাম বলেই মনে হয় আমি কেমন একটা অবচেতন মনেই চারপাশে একটা স্নিগ্ধ গন্ধ অনুভব করতে লাগলাম।পারিজাত নিয়ে বেশ সুন্দর পৌরাণিক গল্প আছে। কৃষ্ণের দুই স্ত্রী- সত্যভামা ও রুক্মিণীর খুব ইচ্ছে তাদের বাগানও পারিজাতের ঘ্রাণে আমোদিত হোক। কিন্তু পারিজাত তো স্বর্গের শোভা! কৃষ্ণ স্ত্রীদের খুশি করতে চান। তাই লুকিয়ে স্বর্গের পারিজাত গাছের থেকে একটি ডাল ভেঙ্গে এনে সত্যভামার বাগানে রোপণ করেন, যার ফুল রুক্মিণীর বাগানেও ঝরে পরে সুগন্ধ ছড়ায়।
আমার কাছে আলিয়াসের ক্যাফেটেরিয়া তখন সত্যভামার বাগান মনে হতে শুরু করলো। ততক্ষণে পারিজাত কফির পেয়েলায় চুমুক দিতে শুরু করেছে।আমি নিজেকে যতটা সম্ভব চেপে ধরে রেখে ওর চুমুক দেওয়া দেখছি আর মনে মনে প্রার্থনা করছি যাতে এই এক কাপ কফি ইহজন্মে শেষ না হয়। বিধিবাম, কফি শেষ হয়ে গেলো। পারিজাত মুচকি একটা হাসি দিয়ে বলল “কফির জন্য ধন্যবাদ।আজ আসি, আমাকে নিউ মার্কেট যেতে হবে”।

আমি মনে মনে বললাম
“তুমি চাইলে নিউ মার্কেট আমি তোমার কাছে এনে দেব, যেও না, তুমি বসে থাকো। নিউমার্কেটের সব দোকানি এসে তোমার সামনে পসরা সাজাবে”।
এই কথা গুলো যেহেতু বাকযন্ত্রের মাধ্যমে, বাতাস কে কাজে লাগিয়ে মুখ দিয়ে নিঃসৃত করতে পারলাম না, সুতরাং সেটা তার যোগ্যতা, আকাঙ্খা, আসত্তি কিছুই পেলো না। খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললাম “আচ্ছা, আসুন। হয়তো কোনদিন আবার দেখা হবে”।
ঘাড়ে ভায়োলিনের ব্যাগ ঝুলিয়ে, হাতে ঝোলানো ব্যাগ নিয়ে পারিজাত সত্যভামার বাগান ত্যাগ করলো। আমি দৌড়ে রুদ্রের অফিসে গেলাম। গিয়ে বললাম “বন্ধু উপকার করতে হবে,ভায়োলিনের নতুন কোর্সের স্টুডেন্টদের তথ্য কি আমাকে জোগাড় করে দিতে পারবি?”

রুদ্র একটা উদ্দেশ্যমূলক হাসি দিয়ে বলল “আমার লাভ?”।

“আমার সুখেই কি তুই খুশি না? যা খাওয়াবো তোকে আফতাবে, উটের বিরিয়ানি”।

ঘটনার দুইদিন পর রুদ্রের খুদে বার্তা পেলাম। লেখা, মারশিয়া পারিজাত আহমেদ, ০১৭১…… , কুয়েত মৈত্রি হল। ফোন নাম্বার খালি দুইদিন টিপে গেলাম। কিন্তু কল করার সাহস পেলাম না। পাচ দিন গেলো, সপ্তাহ গেলো। একদিন সাহস করে ফোন করেই ফেললাম। কিন্তু ওই পাশ থেকে অপারেটরের সিস্টেমের সুন্দর কন্ঠের মহিলা নির্দয় ভাবে আমাকে দুঃখিত বললেন। সপ্তাহ দুয়েক দুঃখিত বলবার পর হুট করে একদিন ওইপাশে ফোন বেজে উঠলো।
“হ্যালো”… হম এই তো সেই কন্ঠ। আমি হ্যালোর জবাব দিতে গিয়ে দুইবার আগে ঢোক গিলে নিলাম।
“জি, কে বলছেন?”
“আমি তানভীর, মনে আছে? আলিয়াস, বিকেল বেলা, ব্যাগ, কফি?”
“জি মনে আছে। থাকবে না কেনো? আপনি একটা আশ্চর্যরকমের মানুষ”
বুঝলাম ওই পাশে স্মিত একটা হাসি হয়ে গেছে।

“আপনাকে কয়েকদিন ধরেই চেষ্টা করছিলাম। নাম্বার কীভাবে জোগাড় করলাম সেটা নিশ্চয় বুঝেছেন। কিন্তু বন্ধ পাচ্ছিলাম”
এবার একটা খিলখিল শব্দে হাসি হোলো।
“হুম বুঝেছি। আসলে আমি খুব ব্যস্ত ছিলাম।কীভাবে বলি, নিজেরই লজ্জা লাগে। আসলে আমার বিয়ে ছিলো। হুট করেই হয়ে গেলো। বাবার বন্ধুর ছেলে।ইউ এস এ থাকে।খুব তাড়াহুড়োর মধ্যেই হোলো। বাবার পছন্দের ছেলে। বাবার শরীরটাও ভালো না। আমি আর সময় নিতে পারলাম না”।

সেই মুহূর্তে আমার ঘরের বাইরের আকাশ একদম রোদেলা থাকলেও আমার মনের আকাশে খানিকটা মেঘ এসে জড়ো হয়ে গেলো।আমি আবারো নিজেকে চেপে ধরে বললাম,
“ওমা, তাই নাকি?! খুশির খবর তো। দাওয়াত কবে পাচ্ছি আমি?”
“পেয়ে যাবেন।ও তো চলে গেছে। মাস ছয়েক পর এসে অনুষ্ঠান করব। নাম্বার সেভ করে রাখছি, দাওয়াত অবশ্যই পাবেন”।

আমি মনে মনে বললাম “পারিজাত, এত নিষ্ঠুর তুমি হোয়োনা। লাগবে না আমার দাওয়াত। প্লীজ পারিজাত আমাকে দাওয়াত দিও না”। মুখে বললাম,

“আচ্ছা তবে সেই কথাই থাকলো।অপেক্ষাই রইলাম। রাখি তবে”।

ফোন রেখে আমি জোরে জোরে দুইবার শ্বাস নিলাম।একটু পর লম্বা লম্বা শ্বাস নিলাম। যোগ ব্যায়ামের বইয়ে পড়েছিলাম, লম্বা শ্বাস নইলে স্নায়বিক উত্তেজনা প্রশমিত হয়।
যাই হোক, পারিজাত মনের খবর বুঝেছিল। আমাকে দাওয়াত দেয় নি।আমি বছরখানেক খুব ভয়ে ছিলাম, কবে দাওয়াত দিয়ে বসে। দিন সাতেক আগে ধানমন্ডির এক ক্যাফেতে পারিজাতের সাথে দেখা। সাথে ওর জামাই আর দুই মাসের ছেলে। আমাকে দেখে একবারেই চিনে ফেলে নিজেই কথা বলতে এলো। জামাই ভদ্রলোক এক কথায় জেন্টেল্ম্যান। ছেলেটা পারিজাতের মতই হয়েছে। এবার পারিজাত আমাকে কফি খাওয়ালো। ক্যাফে থেকে বেরিয়ে আমি আকাশে দেখলাম মেঘ আছে কিনা, না নেই। মনে? না তাও নেই। তবুও কয়েকবার লম্বা লম্বা শ্বাস নিলাম, ধীরে ধীরে ছাড়লাম।

পাঠক ভাবছেন যে একটা ব্যর্থ প্রেমের ছোট্ট গল্প হয়ে গেলো? মোটেও না।মাঝখানে পারিজাত নিয়ে একটা পৌরানিক গল্প শুরু করেছিলাম। তার কিছুটা বাকি আছে।কৃষ্ণ পারিজাতের ডাল চুরির পর স্বর্গের রাজা ইন্দ্র ঘটনাটা জেনে খুব রেগে যান! তিনি বিষ্ণু অবতারের উপর গোপনে ক্রুদ্ধ ছিলেন। এই কারনে তিনি কৃষ্ণকে শাপ দেন কৃষ্ণের বাগানের পারিজাত বৃক্ষ ফুল দেবে ঠিকই কিন্তু ফল কোনদিন আসবে না, তার বীজে কখনও নতুন প্রাণের সঞ্চার হবে না।এই ফুল শরৎকালে ফোটে। এর ফুলগুলি রাতে ফোটে এবং সকালে ঝরে যায়। শরৎ ও হেমন্ত কালের শিশির ভেজা সকালে ঝরে থাকা পারিজাত অসম্ভব সুন্দর দৃশ্য তৈরি করে।
জীবনে অধিকাংশ সময়ই পারিজাতের কেবল ফুলের গন্ধেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। তাতেই অনাবিল আনন্দ পাওয়া যায়, রেশ লেগে থাকে রন্ধ্রে রন্ধ্রে।ফল আশা করতে নেই, নতুন স্বপ্নের সঞ্চার আশা করতে নেই।কিছু ভালো লাগা সবসময়ই অপার্থিব।

১৩,১৯০ বার দেখা হয়েছে

১৯ টি মন্তব্য : “পারিজাত”

  1. টিটো মোস্তাফিজ
    জীবনে অধিকাংশ সময়ই পারিজাতের কেবল ফুলের গন্ধেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। তাতেই অনাবিল আনন্দ পাওয়া যায়, রেশ লেগে থাকে রন্ধ্রে রন্ধ্রে।ফল আশা করতে নেই, নতুন স্বপ্নের সঞ্চার আশা করতে নেই।কিছু ভালো লাগা সবসময়ই অপার্থিব।

    :boss: :boss:


    পুরাদস্তুর বাঙ্গাল

    জবাব দিন
  2. মোস্তফা (১৯৮০-১৯৮৬)
    জীবনে অধিকাংশ সময়ই পারিজাতের কেবল ফুলের গন্ধেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। তাতেই অনাবিল আনন্দ পাওয়া যায়, রেশ লেগে থাকে রন্ধ্রে রন্ধ্রে। ফল আশা করতে নেই, নতুন স্বপ্নের সঞ্চার আশা করতে নেই। কিছু ভালো লাগা সবসময়ই অপার্থিব।

    হুম! জীবন যে প্রতিমুহূর্তেই আমাদের কত প্রকার বিস্ময়কর জিজ্ঞাসার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়, তার কতটুকুরই বা উত্তর মেলে। এই সব জীবন-জিজ্ঞাসাও এক রকমের পারিজাত ফুল। গন্ধ ভাসিয়ে দিয়ে যায় হাওয়ায় হাওয়ায়, সঠিক উত্তর-প্রাপ্তির সম্ভাবনাকে ক্ষীণ, ক্ষীণতর করে!

    গল্প ভালো লেগেছে! 🙂


    দেখেছি সবুজ পাতা অঘ্রানের অন্ধকারে হতেছে হলুদ

    জবাব দিন
  3. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    কী যে ভালো লাগলো হা-মীম। রোমান্স আছে, রস আছে, পরিমিতিও আছে। এককথায় দুর্দান্ত। তুমি এত কম লেখো কেন?

    সুতরাং সেটা তার যোগ্যতা, আকাঙ্খা, আসক্তি কিছুই পেলো না।

    যদি বাংলা ব্যাকরণের প্রসঙ্গ তুলে থাকো তবে সঠিক শব্দটা হবে 'আসত্তি' , ক এ ত নয়। (সম্পাদিত)

    জবাব দিন
    • হা-মীম(২০০০-২০০৬)

      ধন্যবাদ নূপুর দা। মন চাইলে লিখি। আর দাদা আমি কল্পনা করে একদম লিখতে পারিনা।আমি যা লিখি হয় নিজের জীবনে দেখা, হওয়া, ঘটে যাওয়া, অথবা খুব কাছের কারো, যাকে আমি খুব কাছ থেকে দেখি। 🙂 বানান ঠিক করে দিয়েছি 😛 😀


      \\\"।নিউট্রন বোমা বোঝ. মানুষ বোঝ না ! ।\\\"

      জবাব দিন
  4. :)) " নামটা শোনার সাথে সাথে এই মেয়েকে আমার আগের চেয়েও আরো বেশি সুন্দরী মনে হতে লাগলো"
    লাইনটা তো কদিন আগে আমাদের এক কথোপকথন এর কথা মনে করিয়ে দিল বন্ধু........................ অসাধারন ফিনিশিং ::salute::

    জবাব দিন
  5. সোয়া, আধা, এক, দেড় বছর পরপর হুটহাট করে এমন জিনিসপত্র প্রসব করে আবার কোথায় হারায় যাস আল্লাহ ই জানে। ছেড়ে দিস না মামা। আবেগী লেখা অনেক হয়, "মন ভালো করে দেওয়া" লেখা খুব কম। তুই মন ভালো করে দে।

    জবাব দিন
  6. ফারাবী (২০০০-২০০৬)

    দোস্ত...
    কাহিনী পড়ে পেট ফাঁকা ফাঁকা লাগতেছে। যে পুরুষ বলে তার জীবনে কোন পারিজাতীয় অভিজ্ঞতা নাই, সে মিথ্যাবাদী। চল কফি খাই একদিন। পারিজাতীয় গল্পগুজব হবে।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।