মানুষ, মহল্লা আর কিছু মানবীয়

গলির মাথায় দাঁড়িয়ে পরম যত্নে কানের ভেতর কানি আঙ্গুলটা ঢুকিয়ে দিয়ে কান চুল্কাচ্ছিল ফরিদ। কি জানি কি এক প্রবল আরামে তার ডান চোখটা বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল বারবার। আরামটাকে আরো তীব্র থেকে তীব্রতর করবার উদ্দ্যশ্যে দেয়ালটায় যেই একটু ঠেস দিয়ে দাড়িয়েছে ঠিক সেই মুহূর্তেই রজব আলি বাজারের থলেটা হাতে নিয়ে গলির মুখে এসে দাঁড়ালো। ষাটোর্ধ রজব আলি, লম্বা দাঁড়ি, বার্ধক্যের ছাপ এড়াতে চুল দাঁড়ি মেহেদি দিয়ে কমলাভো, চোখে তার খানদান এর রেওয়াজ সুরমা। কান থেকে আঙ্গুল টা বের করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত আবেগ এবং শ্রদ্ধা মাখামাখি কন্ঠে সালাম দিল ফরিদ।

স্লামালিকুম চাচাজান।।

সালাম শুনে রজব আলি দাড়িয়ে গেল। ফরিদকে দেখে তার ভ্রু কুঞ্চিত হল। চোখে মুখে একটা বিরক্তির ছাপ নিয়ে ফরিদের আপাদমস্তক একবার পর্যবেক্ষণ করে নিল।

“অলাইকুম সালাম, তুমারে দিন নাই রাইত নাই , আল্লার চব্বিশটা ঘনটা দেহি এইখানে খাড়ায়া আছো, কুনো কাজকাম নাই তুমার? কি করো সারাটাদিন এইহানে এম্বায় বেক্কলের লাহান খাঁড়ায়ে ?””

” দেহি আরকি, আপনারা যান এইহান দিয়া, মুরুব্বিরা যায়, ছেলাম টেলাম দেই, সুক দুঃখের দুই চাইরটা কথা বার্তা কই।””

জবাব দিয়ে একটা স্মিত হাসি টানলো ফরিদ। তার হাসি যেন রজবের বিরক্তিকে আরো দ্বিগুন করে দিল। এমনিতেই এই ছোকরাকে দু চোখে দেখতে পারে না সে। একেতে তো সারাটাদিন তার বাড়ির গলির মাথায় নিলে মহল্লার আজিজের চার দোকানে সারাটিদিন ফাউ দাঁড়িয়ে থাকে। বাপের একটা ছোট মুদিখানার দোকান আছে দক্ষিন মহল্লাতে, সেখানে গিয়ে একটু বাপ কে সাহায্য করলেও তো পারে। তার উপর রজব আলির নিজের তিন তিনটি কিশোরী কন্যা এই পথ ধরেই দিনের মধ্যে চার পাচ বার যাওয়া আসা করে।

এই মহল্লায় খিটখিটে স্বভাবের মেজাজের লোক হিসেবে রজব আলির দারুন সুখ্যাতি আছে। তার উপর সব ব্যপারে একটা কর্তৃত্ব ফলাবার দুর্দান্ত অভ্যাস আছে তার। ফলাবেই বা না কেন ? মহল্লায় বেশ টাকা ওয়ালা লোকের মাঝে সে একজন। এই মহল্লাতে যে দুইটি পান যোগ্য পানির নলকূপ আছে তার একটি তার ভেতর বাড়িতে। সুতরাং পানির জন্য হলেও মানুষ তাকে কিছুটা সমীহ করেই চলে, রোজ বিকালে আজিজ তাকে ফ্রি চা খাওয়ায় এক কাপ। সেই চায়ের দোকানেই কিনা একদিন ফরিদ তাকে এভাবে অপমান করল তাও আবার দক্ষিন মহল্লার তার কিছু বখে যাওয়া বন্ধুদের সামনে ??

সেদিন কিবার ছিল কত তারিখ ছিল সে হিসাব নাই বা করলাম। দুপুরে দোকান থেকে ফিরবার পথে রজব ভাবল আজিজের দোকানে এক কাপ ফ্রি চা খেয়ে যাওয়া যাক। সে যখন এই চিন্তা করছিল তার বহুকাল আগ থেকেই ফরিদ তার দক্ষিনের কিছু বন্ধুদের নিয়ে সেই দোকানের পেছনে যে ফাকা জায়গাটা আছে সেখানে ক্যারাম খেলায় মত্ত। চা খেতে খেতে রজব দোকানের পেছনের হইহুল্লোড় শুনতে পাচ্ছিল। হটাত কানে এল-

” ফরিদ্যা, তোগো মহ্ললাত লইয়া আইলি, বাড়িত নিবি না?”

” জাইস আরেক দিন, মরতাছস নাকিরে হালার পোলা”

” মরি নাইক্যা, মাগার মরবার ও তো পারি, বাড়ি কোন ডা তগো ?”

” বাল পাকার বাড়ি চিনস না, বাল পাকার বাড়ির ঠিক পেছুন দিয়া যে গলি ডা গ্যাছা অইডার তিন নম্বর ডা”

রজব কিছুক্ষন স্থির দাড়িয়ে মনে মনে হিসাব কষলো। হটাত তার খেয়াল হলও তার বাড়ির পেছনের যে গলি সেই গলিরই তিন নম্বর বাড়িটা ফরিদদের। তবে কি ফরিদ তাকেই বাল পাকা বলল?? রেশ কেটে উঠতেই সে তার হাতের ছাতা টা বাগিয়ে দোকানের পিছে ধেয়ে গেল।

” চুত্মারানির পোলা , হালার আজন্মা, খুন ই করুম তোরে আজ, শালা চুতমারানির পোলা ”

হাতের ছাতাটা দিয়ে যত্রতত্র ভাবে বাড়ি মারতে মারতেই ফরিদ ও তার বন্ধুরা কোথায় যেন হাওয়া হয়ে গেল। ঘটনার পরপরই রজব দক্ষিন মহল্লাতে গিয়ে সলিমুদ্দির কাছে তার পুত্রের কৃতকর্মের ব্যপারে নালিশ করল, এবং তার কোন বিহিত না করলে সে সলিমুদ্দি কে এক হাত দেখে নেবে বলে জানাল। ঘটনার পরবর্তী আবেশ হিসেবে রজবের অন্দর মহলের নলকূপের হাতল সেই রাতেই কে বা কারা যেন চুরি করলো এবং কেন যেন ফরিদকেও ২ দিন মহল্লার আশেপাশে দেখা গেল না। ফলশ্রুতিতে রজব সবাই কে বলে বেড়াল

” হালার পুতেই চুরি করছে, হালা ফকিন্নির জাত”।

মাস চারেক পর…

গলির মাথায় দাঁড়িয়ে পরম যত্নে কানের ভেতর কানি আঙ্গুলটা ঢুকিয়ে দিয়ে কান চুল্কাচ্ছিল ফরিদ। কি জানি কি এক প্রবল আরামে তার ডান চোখটা বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল বারবার। আরামটাকে আরো তীব্র থেকে তীব্রতর করবার উদ্দ্যশ্যে দেয়ালটায় যেই একটু ঠেস দিয়ে দাড়িয়েছে ঠিক সেই মুহূর্তেই রজব আলি বাজারের থলেটা হাতে নিয়ে গলির মুখে এসে দাঁড়ালো। কান থেকে আঙ্গুল টা বের করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত আবেগ এবং শ্রদ্ধা মাখামাখি কন্ঠে সালাম দিল ফরিদ।

স্লামালিকুম চাচাজান।।

বিরক্তি নিয়ে তার দিকে তাকালো রজব।

” সারাডা দিন এইখানে খাড়ায় না থাইক্যা তো কিছু করবার পারো”

“কর তা ছি তো চাচাজান, এই যে মহল্লা ইজারা লইছি, আপনের গলি পাহারা দিতাছি আর আপনেরে আইতে জাইতে সালাম দিতাছি”

নিজের জবাবে নিজেই যেন খুবই আপ্লুত এমন ভঙ্গি করে হেসে ফেলল সে।

রাগে কট কট করে উঠলো রজবের হাত পা। মুখ দিয়ে একটা কথা বের করেই সে হন হন করে হাটা দিল,

” বেশরম পোলাপাইন”।

ফরিদ পুনরায় কানে আঙ্গুল ঢুকিয়ে কান চুলকাতে শুরু করল।

এর মাস দুয়েক পর…

দোকানের ক্যাশ এ বসে ভাংতি গুনছিল রজব। হটাত কাচা বাজারের সব্জীর দোকানদার শফিক এসে খবর দিল ফরিদের মৃত দেহ পাওয়া গেছে গলির মুখ থেকে একটু সামনে। আর রজবের মেজোকন্যা এখন থানায়। তার বউ এবং বাড়ির বাকিরা থানায় পোউছে গেছে। রজব কিছুক্ষন খেই হারালো। ফরিদের মৃত্যুর জন্য তার কন্যাকে কেন থানায় নেওয়া হয়েছে এই ব্যাপার নিয়ে বেশ কিছুক্ষন খিস্তি করল বাজারে। তারপর ছাতাটা হাতে থানার দিকে রওনা হল।

থানায় পৌঁছে সে যা শুনলো তা অত্যন্ত রোহমরষক। বেশ কয়েক বছর আগে নিউমোনিয়ায় ফরিদের ছোট বোন টা মারা যায়। হটাত একদিন গলির মুখে রজবের মেজো মেয়ের মাঝে সে তার বোন কে খুঁজে পায়। এবং পরম আদরে বলে…

” আইজ থেইক্যা তুমি হইলা গিয়া আমার বোইন ”

ভাইয়ের ভালোবাসা বঞ্চিত রজবের কন্যার এই ভাইয়ের ভালোবাসা ভালোই লাগতে শুরু করে। স্কুল থেকে ফিরবার পথে দক্ষিন এর কিছু বখাটে যুবক তাকে প্রায়শই গলির মুখে উত্যক্ত করত। এই ঘটনা জানবার পর থেকে স্কুল থেকে ফরিদ তার পিছে ছায়ার মত লেগে থাকতো এবং তাকে গলির মুখে ঢুকিয়ে দিয়ে সেখানে অনেকক্ষন দাঁড়িয়ে থাকতো যাতে বখাটে রা গলিতে ঢুকবার সাহস না করে। সে তার দক্ষিন এর কিছু বন্ধুকে নিয়ে মাঝে মধ্যে ওদের শাসিয়েও আসতো। আজ দুপুরে ফরিদের বাপের দোকানে কিছু নতুন মালামাল আসায় এবং বাপের শরীর খারাপ থাকায় সে দোকানে বসেছিল। এই সংবাদ পেয়ে বখাটেরা স্কুল থেকে বের হবার পথেই তার মেজো কন্যাকে তুলে নেবার চেষ্টা করে, এবং প্রায় সফল হয়েই যেত যদিনা, ফরিদের সেই ক্যারাম খেলা দক্ষিন মহল্লার কোন বন্ধু ছুটে গিয়ে ফরিদকে খবর টা না দিত।

খবর পেয়ে ফরিদ ছুটে যায় এবং দক্ষিন মহল্লার মুখে তাদের সাথে ফরিদ ও তার বন্ধুর বড়সড় ধস্তাধস্তি হয়। এক পর্যায়ে নিরস্ত্র ফরিদ ছুরিকাহত হয় এবং সেই অবস্থাতেই রজবের মেজো কন্যাকে নিয়ে নিজ মহল্লার দিকে পালাতে থাকে এবং বন্ধুকে পুলিশে খবর দিতে বলে। গলি পর্যন্ত এসে সে থমকে যায় এবং রজবের কন্যাকে গলিতে ঢুকিয়ে বলে,

” বোইন আমি গলির মুখে খাড়াই, তুমি বাড়িত না ঢোকা পর্যন্ত এই হানেই খাড়াই থাকি ”

কন্যা বাড়ির দিকে ধাবিত হয় এবং রক্তক্ষরণে, এবং বন্ধু থানায় যাবার পর অসি সাহেব তার এক বন্ধুর সহিত চা পানে ব্যাস্ত থাকায় সেখানেই মরে পড়ে থাকে কিছুক্ষন, ঠিক যেমন আজন্মা, বেশরম, ফকিন্নির পোলারা রাস্তায় মরে পড়ে থাকে আমাদের চারপাশে।

এর মাস খানেক পর………

দুপুরের ঠাঠা রোদে বাড়ি ফিরছিল রজব। গলির মুখে ঢুকতেই কেন যেন সে দেখতে পেল…

গলির মাথায় দাঁড়িয়ে পরম যত্নে কানের ভেতর কানি আঙ্গুলটা ঢুকিয়ে দিয়ে কান চুল্কাচ্ছে ফরিদ। কি জানি কি এক প্রবল আরামে তার ডান চোখটা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বারবার। আরামটাকে আরো তীব্র থেকে তীব্রতর করবার উদ্দ্যশ্যে দেয়ালটায় একটু ঠেস দিয়ে দাড়িয়েছে,তাকে দেখে

কান থেকে আঙ্গুল টা বের করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত আবেগ এবং শ্রদ্ধা মাখামাখি কন্ঠে সালাম দিল ফরিদ।

স্লামালিকুম চাচাজান।

রজব আলি খুশি হবে না বিরক্ত হবে বুঝে উঠতে পারলো না আজ।

১,১৮৩ বার দেখা হয়েছে

৮ টি মন্তব্য : “মানুষ, মহল্লা আর কিছু মানবীয়”

মওন্তব্য করুন : রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।