ভূমিকম্প : আমরা কী করতে পারি

[কয়েকদিন আগেই বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হয়ে গেল ভূমিকম্প। যদিও এতে তেমন কোন দৃশ্যমান ক্ষয়-ক্ষতি হয়নি। তবুও মনে হয় সময় এসেছে আমাদের চিন্তা ভাব অনা করার। এই ভূমিকম্পের বেশ কয়েকদিন আগে একটা আর্টিকেল পড়েছিলাম বাংলাদেশের ভূমিকম্প বিষয়ক ঝুকিঁর ব্যাপারে। গুরুত্বপূর্ণ মনে হওয়ার এখানে অনুবাদটা তুলে দিলাম। অনুবাদটি করে দেওয়ার জন্য কয়েকজন বন্ধুকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। কিছুটা সংক্ষেপিত।]

সম্প্রতি জাপান, হাইতি এবং সুমাত্রার গুরুতর ভূমিকম্পগুলোর পর বিজ্ঞানীরা নজর দিয়েছেন এমন একটি দেশের দিকে, এইক্ষেত্রে যার ঝুঁকি সবাইকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। আর দেশটা হল বাংলাদেশ। সম্প্রতি আর্থ ইন্সটিটিউটের করা এই ডকুমেন্টারিতে দেখা যায়, ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা এখানে মাটির অনেক গভীরে থাকা সক্রিয় ভূ-চ্যুতি(active faults), অতীতে নীচের প্লেটগুলোর অবস্থানের পরিবর্তন এবং নদীর আকস্মিক, বড় ধরণের গতিপথ পরিবর্তনের চিহ্নের সন্ধান পেয়েছেন।

বাংলাদেশ বর্তমানে ১৬ কোটি জনসংখ্যার একটি দেশ এবং পৃথিবীর সবচেয়ে দরিদ্র ও জনসংখ্যাবহুল দেশগুলোর একটি। আর এই অবস্থারও দ্রুত অবনতি ঘটছে। এটি পৃথিবীর বৃহত্তম বদ্বীপে অবস্থিত এবং উপকূল পার্শ্ববর্তী। ফলে ভূমিকম্পের সময় সুনামি এবং নদীর উপকূল প্লাবিত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। এছাড়াও এদেশে অনবরত অসংখ্য সেতু ও বহুতল ভবন তোলা হচ্ছে যা ক্ষতির সম্ভবনাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। বিজ্ঞানীরা বাংলাদেশের নীচে বিভিন্ন টেক্টনিক প্লেট এর সমন্বয় সনাক্ত করেছেন। টেক্টনিক প্লেট হল ভূপৃষ্ঠের নীচে অবস্থিত বিশাল বিশাল পাথরের ফলক। সাধারণত এই টেক্টনিক প্লেটগুলো তাদের নীচে থাকা লাভা বা ম্যাগমার ধীর প্রবাহের কারণে নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করতে থাকে। যেকোনো দুটি প্লেটনিজেদের মাঝে সংঘর্ষ করলে সৃষ্টি হয় ভুমিকম্প। আর বাংলাদেশের নীচ থাকা বিভিন্ন টেক্টনিক প্লেট এর মধ্যে সেই প্লেটটিরও শেষপ্রান্ত রয়েছে যেটি ২০০৪ সনের সুনামি সৃষ্টি করে প্রায় ২ লাখ মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ ইন্সটিটিউটের ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ূন আক্তার সতর্ক করে দেন যে, জনবহুল রাজধানী ঢাকার নিকটবর্তী কোন ভূমিকম্প সম্প্রতি সংঘটিত ভূমিকম্পগুলোর ভয়াবহতাকেও অনেক দূর ছাড়িয়ে যেতে পারে।

লিওনার্দো সিবার

এ বছর ইউএস ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশন ভূমিকম্পের ক্ষতিগুলোকে সারনিবদ্ধ করার জন্য একটি পাঁচ মিলিয়ন ডলারের পাঁচ বছরের প্রকল্প হাতে নেয়। এই প্রকল্পের অংশ হিসেবে বিজ্ঞানীরা সিসমোমিটার যন্ত্রের একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করেছেন যাতে মাটির অনেক গভীরের ছোট ছোট কম্পনগুলো সনাক্ত করা যায়। এর ফলে মাটির ১২ মাইল পর্যন্ত নীচের প্রোথিত সক্রিয় ফাটল বা চ্যুতিগুলোর সন্ধান পাওয়া যাবে। এছাড়াও বিজ্ঞানীরা পলির নমুনা পরীক্ষা করার জন্য নদীগর্ভের পাশে প্রায় ২৫০টি কুয়া খনন করাছছেন। তাদের আশানুসারে এর মাধ্যমে বাংলাদেশে আগে সংঘটিত ভূমিকম্পগুলোর এলাকা ও সময় সনাক্ত করা যাবে। তাদের প্রধান উদ্দেশ্য হল বাংলাদেশী বিজ্ঞানীদের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম প্রদান করা এবং যতদূর সম্ভব ঝুঁকি কমানো। “আমরা নিজেদের মৃত্তিকাবিজ্ঞান, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের এক ত্রিমুখী মিলনস্থলে দেখতে পাচ্ছি। অনেকটা বাংলাদেশ যেই ব-দ্বীপের উপর অবস্থিত, এর মতই।” মন্তব্য করেছেন লিওনার্দো সিবার, যিনি প্রজেক্টটিতে একজন ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করছেন।

[অনুবাদ শেষ]

অনুবাদের পর এবার আমার নিজের কিছু কথা বলি। কিছুদিন আগের ঐ ভূমিকম্পের অভিজ্ঞতা থেকে। ওটা ছিল মনে আমার জীবনের প্রথম অনুভব করা ভূমিকম্প। এর আগে শুনেছি কিন্তু কখনও বুঝতে পারিনি। একটু পরেই দেখলাম(ফেসবুকে মনে হয়) ভূমিকম্পটা ছিল ৬.৮ মাত্রার। একটু ভয় পেলাম সংখ্যাটা দেখে। এর বড় ভূমিকম্প হয়ে গেল? আবার একটু ভালও লাগল যে এত বড় মাত্রার ভূমিকম্পেও তেমন কোন ক্ষতি হয়নি। সব ঠিকঠাকই আছে। তারপরও মনে একটু সন্দেহ ছিল যে ভূমিকম্পের মাত্রাটা মনে হয় ঠিক না। পরে দেখলাম যে ভূমিকম্পের মূল কেন্দ্র ঢাকা থেকে কয়েকশ মাইল দূরে নেপালে। আর সেখানে মাত্রাটা ছিল ৬.৮। যেটা ঢাকায় কমে হয়েছে ৪.৫ এর মত । অনেক কম। কতখানি কম সেটা একটু বুঝিয়ে বলি। ভূমিকম্প মাপা হয় লগারিদমিক স্কেলে। সোজা কথায় এখানে মাত্রা অন্যান্য জিনিসের মত যোগ হয়ে হয়ে বাড়ে না, গুণ হয়ে হয়ে বাড়ে। যেমন ভূমিকম্প মাপার স্কেল অনুসারে, মাত্রা ১ বৃদ্ধি পাওয়া মানে ভূমিকম্পের শক্তি প্রায় ৩২ গুণ বেশি হওয়া, ২ মানে ১০০০ গুণ! মানে চিন্তাই করা যায় না ৬.৮ মাত্রার একটা ভূমিকম্প হলে আসলে কতটা শক্তিশালী।

শিরোনাম দিয়েছি “আমরা কী করতে পারি”। ঐ ভূমিকম্পটা হওয়ার পরে বিভিন্ন মিডিয়ায় এ বিষয়ে অনেক কিছু দেখানো হয়েছে। লেখালেখিও হয়েছে প্রচুর। এখন আমরা মোটামুটি সবাই জানি ভূমিকম্প শুরু হলে কী করতে হবে। কিন্তু আরও একটা দিক অনেকটাই বাদ পড়ে গেছে। কিংবা অতখানি গুরুত্বের সাথে মিডিয়াতে আসেনি। বা আসলেও আমার নজরে পড়েনি। সেটা হল এই এখন, তেমন খারাপ কিছু এখনও হয়নি,(আমি মনে প্রাণে চাই না হোক) এখন আমরা কী করতে পারি। আমরা মানে শুধু সরকার না। আমরা মানে আমি, আপনি, সবাই।

ধরুন এখন যদি একটা একটু বড় ধরণের ভূমিকম্প হল(আবারও বলি, আমি মনে প্রাণে চাই না হোক)। আর আমাদের ভূমিকম্প বিষয়ক ব্যাপক গণসচেতনতার জোরে খাট বা টেবিলের নীচে ঢুকে, বা দৌড় দিয়ে নীচে নেমে বা অন্য কোন ভাবে, সবাই বেঁচে গেলাম। কারো কিছু হল না। এতেও ঢাকা শহরের কী অবস্থা হবে একটু ভাবতে পারেন? আমাদের দেশটার কী হবে চিন্তা করতে পারেন একটু? ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে আমরা স্রেফ একটা পঙ্গু জাতিতে পরিণত হব। মুক্তিযুদ্ধের পর আমাদের দেশের যেই অবস্থা ছিল, অনেকটা সেখানেই চলে যাব আমরা। কিন্তু সেটা ছিল ৯ মাস আর এখানে ৩০ সেকেন্ড। কেন? কারণ, ঢাকা। ঢাকার অবস্থা আমরা সবাই জানি। এখানে একটার পর একটা বিল্ডিং বানানো হয়েছে। বিল্ডিং কোড তো বেশ জটিল ব্যাপার। আমরা খালি চোখেই দেখতে পাচ্ছি এগুলোর মধ্যে কোন ফাঁক নাই। একটার যদি কিছু হয় সেটা পড়বে আরেকটার উপর। সেটা আবার আরেকটার উপর। অনেকগুলো ইট পরপর সাজিয়ে একটাকে ধাক্কা দিলে যা হয় আর কি। পুরাতনগুলোর অবস্থা খারাপ। নতুনগুলোর অবস্থাও ভাল না। আর যদি ঢাকা ফাঁকা হয়ে যায়, তাহলে এই দেশটার কী হবে? আমাদের সবকিছুই তো ঢাকায়। পৃথিবীতে আর কোন দেশ একটা নগরীর উপর এতখানি নির্ভরশীল কিনা জানি না।

সব মানুষ ঢাকামুখী। এজন্য সবকিছুই ঢাকায়। আবার সবকিছু ঢাকায় হওয়ার কারণেই সবাই ঢাকামুখী। এই চক্রে পড়ে ঢাকা দিনে দিনে আরও জনবহুল হচ্ছে। বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে। আমাদের এই চক্র ভাঙতে হবে। নাহলে এর মূল্য কত বেশি হতে পারে, তা আমাদের ধারণাতেই নাই। এজন্য দরকার বিকেন্দ্রীকরণ। সবক্ষেত্রে। প্রশাসন, শিল্প, শিক্ষা, আবাসন, অন্যান্য সব ক্ষেত্রে। পরিকল্পনামাফিক। এতে অনেকের সামান্য ক্ষতি হতে পারে। অনেক প্রতিষ্ঠানের অনেক বড় অঙ্কের ক্ষতিও হয়ে যেতে পারে। বিশেষ করে আবাসন বা গার্মেন্টস শিল্পের মত ক্ষেত্রগুলো এর অন্তর্ভুক্ত। তবে এই ক্ষতি সাময়িক। পুষিয়ে নেয়া যাবে। নাহলে অনেক বড় মূল্য আমাদের দিতে হতে পারে। সবাইকে।

আমরা জাতি হিসেবে অনেক বিষয়েই সমস্যার মুখোমুখি। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, প্রাকৃতিক, আন্তর্জাতিক। কিন্তু এত কিছুর মধ্যে যেন ব্যাপারটা চাপা পড়ে না যায়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। আশা করি সবাই একটু ভেবে দেখব যে- আমরা কী করতে পারি।

৪ টি মন্তব্য : “ভূমিকম্প : আমরা কী করতে পারি”

  1. খুবই ভালো লেখা। আসলে আমাদের দেশের মানুষের চিন্তা করার ইস্যু এত বেশি যে মানুষের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবার সময় নাই। বর্তমান নিয়ে ভেবেই কুল পায়না... আবার ভবিষ্যৎ! গ্লোবার ওয়ার্মিং এর কারনে সগরের পানি বাড়বে এবং ২০২০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের অনেক্টুকুই পানির নিচে তলিয়ে যাবে বলে ধারনা করা হচ্ছে। এসব বিষয় মোকাবেলা করার মত টেকনোলজি আমাদের আছে বলে মনে হয়না।

    জবাব দিন
  2. ভূমিকম্প নিয়ে কোন লেখা যখন পড়ি তখন ঢাকা শহরের কথা মনে করি, আমাদের বাড়িটার কথা মনে করি। ভূমিকম্প হলে কি কি হতে পারে, মনে মনে তার একটা সিমুলেশন করি এবং প্রচন্ড ভীত হয়ে পড়ি। এই লেখাটা পড়েও যথারীতি অনেক ভয় লাগল। আমাদের সবারই অনতিবিলম্বে সচেতন হওয়া দরকার। আর আল্লাহর কাছে দোয়া করি, যে টাইম বোমার কথা বিজ্ঞানীরা বলেছেন, সেটা যেন মিথ্যা হয়...

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : গুলশান (১৯৯৯-২০০৫)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।