বিগ ক্রাঞ্চ ও মহাবিশ্বের অজানা অন্ধকার

“বিগ ক্রাঞ্চ”(Big Crunch)-এর নাম শুনেছেন? একে “বিগ ব্যাং(Big Bang)”-এর প্রতিবিম্ব বলা যেতে পারে। বিগ ব্যাং-এর কথা আমরা মোটামুটি সবাই জানি- একটা বিস্ফোরণ, যা থেকে আমাদের মহাবিশ্বের শুরু হয়েছিল। এমনকি শুধু মহাবিশ্ব না, আমরা যেই সময়ের মধ্যে আছি সেই সময়ও শুরু হয়েছে বিগ ব্যাং থেকে। যাহোক। বিগ ব্যাং বিস্ফোরণ, আর এর উল্টা বিগ ক্রাঞ্চ হল, সবকিছু আবার এক বিন্দুতে মিলিত হওয়া। মাত্র কয়েক বছর আগেও, এই বিগ ক্রাঞ্চ বিজ্ঞানে মোটামুটি গ্রহণযোগ্য একটি ধারণা ছিল। চলুন আরেকটু বোঝার চেষ্টা করা যাক ব্যাপারটাকে।

নিউটনের সূত্র মনে আছে আপনাদের? ঐযে- কোন বল প্রয়োগ করা না হলে, স্থির বস্তু স্থির থাকবে, গতিশীল বস্তু সমগতিতে চলতে থাকবে? আর যদি বল প্রয়োগ করা হয়? তাহলে বস্তুর ভর অনুপাতে এর ত্বরণ হবে অর্থাৎ গতি বাড়বে কিংবা কমবে। কমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটাকে মন্দণ বলে। আর খুব অল্প সময়ের মধ্যে অনেক বল প্রয়োগ করা হলে তাকে বলা হয় ধাক্কা(thrust)। এখন যেকোন একটা বিস্ফোরণের কথা চিন্তা করুন। বিস্ফোরণে যা হয়, তা হল, একটা বড় ধরণের ধাক্কা তৈরি হয়। সেই ধাক্কার কারণে বিস্ফোরণস্থল থেকে সবকিছু চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। আসেন এখানে নিউটনের সূত্র প্রয়োগ করি- বিস্ফোরণের ধাক্কাটা থাকে খুব অল্প সময়। এই অল্প সময়ের পর ধাক্কার মূল বলটা আর কাজ করে না। যেহেতু বলটা আর কাজ করছে না, শুরুতে বিস্ফোরণস্থলের বস্তুগুলোর মধ্যে যেই গতিবেগ চলে এসেছে, সেই গতিতেই চলতে থাকার কথা ছিল। কিন্তু আমরা জানি, বিস্ফোরণের একটু পরেই মোটামুটি সব থেমে যায়। কেন থেমে যায়? কারণ এখানে অন্য একটা বল কাজ করছে- অভিকর্ষ অর্থাৎ যেকোন বস্তুর প্রতি পৃথিবীর টান। পৃথিবীর এই অভিকর্ষ সেই বস্তু বা বস্তুকণাগুলোর বেগকে পরিবর্তন করে। এর সাথে ঘর্ষণের কিছু কাজকারবার আছে, যার মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত বিস্ফোরিত বস্তু বা বস্তুকণাগুলো আমাদের হিসাবে কিংবা ভূপৃষ্ঠের হিসাবে থেমে যায়। বিস্ফোরণ নিয়ে এত আলোচনা করছি। আজকাল এসব নিয়ে কথা বলাও ঝুঁকিপূর্ণ। কোন সমস্যা না হলেই হয়!

আশা করি ভুলে যাননি, আমরা বিগ ক্রাঞ্চ নিয়ে কথা শুরু করেছিলাম। বিগ ক্রাঞ্চের ব্যাপারটাও ছিল অনেকটা এই বিস্ফোরণের ফলাফলের মতই। বিগ ব্যাং নামক মহাবিস্ফোরণ হল, মহাবিশ্বের সবকিছু চারপাশে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল। (ভাল কথা বলে রাখি, সত্যিকারের পদার্থবিজ্ঞানী যদি জানে যে আমি বিগ ব্যাং-এর উপর নিউটনের সূত্র আরোপ করছি, তাহলে খবর আছে। বিগ ব্যাং ঠিক নিউটনের সূত্রের জায়গা না। তবে মূল আইডিয়াটা বোঝানোর জন্য নিউটনের সূত্র নিয়ে আসলাম আর কি।) তো সবকিছু ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল। বিগ ব্যাং-এর সময় কোন পৃথিবী নাই, সুতরাং পৃথিবীর টান অর্থাৎ অভিকর্ষও নাই, কিন্তু আরেকটা ব্যাপার আছে- অভিকর্ষের বড় ভাই মহাকর্ষ। মহাকর্ষের জন্য কোন পৃথিবী থাকা লাগবে না, এর কারণে সবকিছুই সবকিছুকে আকর্ষণ করে। একারণে তখন মহাকর্ষের টান শুরু হবে। এতে সবকিছুর চারপাশে ছড়িয়ে পড়ার প্রচন্ড গতি ধীরে ধীরে কমে আসবে। কিন্তু মহাকর্ষ যেহেতু রয়েই যাবে, গতি কমতে কমতে এক সময় শূন্য হয়ে তারপর গতি উল্টোদিকে কাজ করবে। অর্থাৎ সবকিছু ছড়িয়ে পড়ার পরিবর্তে নিজেদের মধ্যকার আকর্ষণে আবার কাছাকাছি আসা শুরু করবে। শুরু হবে সংকোচন। যত কাছাকাছি আসবে, মহাকর্ষও তত বেশি কাজ করবে। তাতে কাছাকাছি আসার গতি আরও বাড়বে। এভাবে কাছাকাছি আসতে আসতে একসময় সবকিছু আবার একবিন্দুতে মিলিত হবে। এই এক বিন্দুতে মিলিত হওয়ার ঘটনাটাকেই বলা হয় “বিগ ক্রাঞ্চ”। আর সেই বিন্দুটাকে বলে “সিংগুলারিটি”। তারপর? তারপার আবার “বুম”। আবার বিগ ব্যাং। আবার নতুন মহাবিশ্ব। তারপর ক্রমাণ্বয়ে আবার বিগ ক্রাঞ্চ। আবার বিগ ব্যাং। এভাবে চলতেই থাকবে। থিওরিটা ছিল এরকম। মজার ব্যাপার হল, প্রাচীন ভারতের হিন্দু এবং বৌদ্ধ ধর্ম দর্শনে কাছাকাছি একটা ধারণা আছে- কালচক্র। অর্থাৎ সময় বা মহাকাল এভাবে ধ্বংস-সৃষ্টির চক্রে আবর্তিত হয়।

শেষ পর্যন্ত এই বিগ ক্রাঞ্চের থিওরিটা টেকেনি। কারণ বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, মহাবিশ্বের সবকিছু যে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে, সেই ছড়িয়ে পড়ার গতি কমছে না। এমনকি একও থাকছে না। এই গতি ক্রমশ বাড়ছে। (২০১১ সালের পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল প্রাইজ এই মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের ত্বরণ আবিষ্কারের জন্যই দেয়া হয়েছিল।) ছড়িয়ে পড়ার গতি যদি বাড়তেই থাকে, তাহলে আর বিগ ক্রাঞ্চ কোথা থেকে হবে। কিন্তু একটা বড় প্রশ্ন আছে এখনও বিজ্ঞানীদের সামনে- ছড়িয়ে পড়ার গতি বাড়ছে কেন। আপাতত বিজ্ঞানীরা বলছেন, এক বিশেষ ধরণের শক্তি বা এনার্জির প্রভাবে এই ত্বরণ হচ্ছে- বাড়ছে ছড়িয়ে পড়ার গতি। সেই শক্তির নাম উনারা দিয়েছেন “ডার্ক এনার্জি”। নামের মধ্যে ডার্ক বা অন্ধকার থাকার কারণ হল, ডার্ক এনার্জির প্রকৃতি সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত মোটামুটি অন্ধকারেই আছেন। এই ডার্ক এনার্জি অন্যক্ষেত্রে খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু এই ক্ষেত্রে অভিকর্ষের বিপরীতে আরও ত্বরণ ঘটাচ্ছে। সবকিছু ছড়িয়ে পড়ার গতির ত্বরণের হার থেকে এই ডার্ক এনার্জির পরিমাণ কেমন হওয়া উচিত, সেটা অবশ্য বিজ্ঞানীরা হিসাব করে বের করে ফেলেছেন। পদার্থবিজ্ঞানের হিসাবে মহাবিশ্বে দুই ধরণের জিনিস আছে- পদার্থ আর শক্তি। সবকিছু মানে সমস্ত ছায়াপথ, নীহারিকা, গ্রহ, নক্ষত্র, ব্ল্যাকহোল ইত্যাদি সব মিলিয়ে, মাহবিশ্বে জানা পদার্থ হল ৪.৫% এর মত। আর ডার্ক এনার্জি হল ৬৮.৩%। আর বাকী ২৬.৮% হল আরেক অমীমাংসিত জিনিস- “ডার্ক ম্যাটার”।

চলেই যখন আসল, “ডার্ক ম্যাটার” নিয়েও কিছু কথা বলি। আমরা দেখলাম, মহাবিশ্বে সংকোচন-সম্প্রসারণ হওয়ার জন্য বিগ ব্যাং-এর সময়কার ধাক্কার সাথে মহাকর্ষের টানাটানি চলছে। এতে মহাকর্ষেরই জিতে যাওয়ার কথা ছিল- হওয়ার কথা ছিল “বিগ ক্রাঞ্চ”। কিন্তু “ডার্ক এনার্জি”-র জন্য মহাকর্ষ পারছে না। মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হচ্ছে, তাও ত্বরণ-সহ। অর্থাৎ সম্প্রসারণের হার বাড়ছে। কিন্তু যদিও সব মিলিয়ে ডার্ক এনার্জি জিতে গেছে, যদি অপেক্ষাকৃত ছোট ছোট মাপকাঠিতে চিন্তা করা যায়, তাহলে কিন্তু মহাকর্ষই জিতে গেছে। কীভাবে? মহাবিশ্বে সবকিছু একবারে সুষমভাবে ছড়িয়ে নেই- কিছু গুচ্ছ বেঁধে বেঁধে আছে। এসব গুচ্ছের মাঝে মাঝে অনেক বড় বড় ফাঁকা জায়গা। গ্রহরা নক্ষত্রের কাছাকাছি গুচ্ছ তৈরি করে, নক্ষত্ররা তৈরি করে গ্যালাক্সি, গ্যালাক্সিরা তৈরি করে গ্যালাক্সি-গুচ্ছ, এভাবে আরও কয়েক স্তর পর্যন্ত গুচ্ছের কাঠামো আবিষ্কার করা গেছে। সুতরাং, এই গুচ্ছগুলোর মধ্যকার মহাকর্ষ এত বেশি, যে কাঠামোগুলো টিকে আছে। এরপর হিসাবে করে দেখা গেল, এই গুচ্ছ কাঠামোগুলোর টিকে থাকার জন্য যতখানি মহাকর্ষ দরকার, ততখানে মহাকর্ষ গুচ্ছের মধ্যকার পদার্থের ভর হিসাব করে পাওয়া যায় না। তাহলে? এইখানে আসল “ডার্ক ম্যাটার”। ডার্ক ম্যাটার এই হিসাব না মেলা মহাকর্ষের জন্য ভরের প্রয়োজন পূরণ করে। কিন্তু মুশকিল কী জানেন? এই ডার্ক ম্যাটারের অন্য কোন বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায় না। এটি কোন পদার্থ, কণা, রশ্মি কিছুর সাথেই কোনকিছু করে না। এজন্য ডার্ক ম্যাটারের কোন প্রমাণ এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। এজন্যই অনেক বিজ্ঞানী চেষ্টা করছেন বিকল্প কোন তত্ত্ব দাঁড় করাতে, যেটাতে এই ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকা ভৌতিক ডার্ক ম্যাটার আমদানী করতে হবে না।

কথায় কথায় অনেক কিছু বলে ফেললাম। তবে বিজ্ঞানের হিসাবে এটা নিতান্তই সামান্য। আরও বেশি জানতে চাইলে যেতে পারেন উইকিপিডিয়াতে। কিংবা গুগল করতে পারেন।

১৬ টি মন্তব্য : “বিগ ক্রাঞ্চ ও মহাবিশ্বের অজানা অন্ধকার”

  1. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    সহজ ভাষায় বেশ তথ্যমূলক লেখা, ভাল লাগলো। :thumbup:

    আরো লেখা চাই গুলশান।


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  2. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    গুলশান,
    আমি তোমার পাঠক হবার ঠিক যোগ্য নই। তবু এমন ঝরঝরে ভাষায় লিখলে না পড়ে কি থাকা যায়?
    বিষয়গুলোর প্রতি আগ্রহ জাগানো কি কম কথা?
    অনেকদিন পর তোমার লেখা পেলাম। ভালো আছো?

    জবাব দিন
  3. ড. রমিত আজাদ (৮২-৮৮)

    সুন্দর লেখা গুলশান। মাস্টার্স-এ আমার গবেষণা ছিলো কসমোলজিতে। এই বিগ ব্যাং-বিগ ক্রাঞ্চ নিয়ে কাজ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিলো। এই বিষয়ে আমার একাধিক প্রকাশনাও রয়েছে। সময় হলে সিসিবি-তে কিছু পোস্ট দিবো ভাবছি।

    জবাব দিন
  4. দিবস (২০০২-২০০৮)

    মহাবিশ্ব নিয়ে চিন্তা ভাবনা করতে গেলে মাথা নষ্ট হবার জোগাড় হয়। একটা কথা প্রায়ই ভাবি, এই যে একতা বিগ ব্যাং হল, এমন কি আরও দুই একটা বিগ ব্যাং হওয়ার পসিবিলিটি আছে? 😀


    হেরে যাব বলে তো স্বপ্ন দেখি নি

    জবাব দিন
  5. খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

    বিজ্ঞানের বিষয়বস্তু নিয়ে এত সুন্দর এই ঝরঝরে লেখাটা গল্পের মত পড়ে গেলাম। ছাত্রকালে তথাকথিত 'ভালো ছাত্র' হবার সুবাদে বিজ্ঞান বিভাগ নিয়ে পড়তে হয়েছিলো, কিন্তু বিজ্ঞানের বিষয়সমূহে বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিলোনা। তখন কঠিন বিষয়ের উপর এমন সরল ব্যাখ্যা পেলে হয়তো আগ্রহটা অন্যদিকে মোড় নিতো।
    চমৎকার লেখা।

    জবাব দিন
  6. পারভেজ (৭৮-৮৪)

    খুবই ঝরঝরে ভাষায় এই যে "বড়দের খাবার" গুলা সবার জন্য এমনভাবে পরিবেশন করলে, দেখে জিভের জল বা চোখের জল কোনটাই আটকে রাখতে পারলাম না।
    আমি সবসময়ই ভাবি। বিজ্ঞান কেন কুলিনের জ্ঞান হবে?
    মানুষ হিসাবে আমরা সবাই বিজ্ঞান-মনষ্ক হবো - এটা মানবাধিকার হিসাবেই মানতে হবে।
    এই লিখাটা একজনের মনেও যে বিগ ব্যাং, বিগ ক্রাঞ্চ, ডার্ক মাটার, ডার্ক এনার্জি নিয়ে জানার আগ্রহ তৈরী করে থাকে, আমি তাকেই বিরাট একটা সাফলত হিসাবে মেনে করতাম।
    আমার ধারনা এটা একজন না, অনেকের মনেই তা করবে।
    অনেক শুভেচ্ছা.........


    Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

    জবাব দিন
  7. গুলশান (১৯৯৯-২০০৫)

    ডার্ক এনার্জি নিয়ে আজকে প্রকাশিত প্রবন্ধ, যেখানে বলা হয়েছে, এর প্রকৃতি সম্পর্কে ২০২০ সালে আমরা আরও জানতে পারব-
    http://www.newscientist.com/article/mg22630164.600-looking-into-the-voids-could-help-explain-dark-energy.html

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : গুলশান (১৯৯৯-২০০৫)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।