স্বাধীনতা তুমি

না, আমি কোন কবিতা লিখতে বসিনি। কোন গল্প-উপন্যাসও নয়। বা আবেগপ্রবণ দেশপ্রেমের কোন প্রবন্ধও নয়। আমার এই লেখার উদ্দেশ্য ‘স্বাধীনতা’ শব্দটির অর্থ খোঁজা। যেই শব্দটির জন্য আমরা এবং পৃথিবীর আরো অনেক মানুষ অনেক বড় বড় ত্যাগ স্বীকার করেছে, জীবন বিসর্জন দিয়েছে, তার মর্মার্থ কী? আসলে আমি শব্দটিকে বোঝার চেষ্টা করে যা পেয়েছি, সেটাই এখানে সবার সাথে শেয়ার করতে চাই।

অনেক আগেই প্রশ্নটা মনে এসেছিল- ‘স্বাধীনতা’ আসলে কী? প্রথমে মোটামুটি যে উত্তরটা মনে এসেছিল তা হল- “প্রত্যেক জাতির জন্য আলাদা এক একটা দেশ”। এর মানেই স্বাধীনতা। আর ভিন্ন কোন দেশ বা জাতি যখন একটা জাতিকে শাসন করে, তাহলে সেটা হল পরাধীনতা। খুব সহজ-সরল উত্তর। কিন্তু এতে যেই অস্পষ্টতাটা থেকে যায়, সেটা হল- ‘জাতি’ শব্দটা। এই যেমন আমরা যদি নিজেদের জাতি হিসেবে বাংলাদেশী বলি, তাহলে বলায় যায় এই জাতির সৃষ্টিই হয়েছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভিত্তিতে। তার আগে তো আর ‘বাংলাদেশী’ জাতি ছিল না। সুতরাং ‘প্রত্যেক জাতির জন্য আলাদা দেশ’ – স্বাধীনতা এই সংজ্ঞা এখানে খাটে না। আবার যদি নিজেদের বাঙালি বলি, তাহলে দেখা যায় যে, বাংলাদেশের বাইরেও অনেক বাঙালি আছেন। শুধু কলকাতা বা পশ্চিম বঙ্গে না, অন্যান্য দেশেও আছেন। এবং তারা সবাই যে অভিবাসী তা কিন্তু না। অনেকেরই বাইরেই জন্ম, সেখানেই বেড়ে ওঠা। (আমি কিন্তু শুধু ভাষার ভিত্তিতে বাঙালি বলছি না, আমাদের সংস্কৃতির ভিত্তিতে বলছি। আর বাঙালি-বাংলাদেশী বিতর্কও আমার উদ্দেশ্য নয়।) অন্য দেশে থাকা সত্ত্বেও তারা কিন্তু নিজেদের পরাধীন মনে করছেন না। আবার অনেক দেশেই(বিশেষ করে বড় দেশগুলোতে) ভিন্ন ভিন্ন জাতি একই রাষ্ট্রে বাস করছে এবং নিজেদের স্বাধীনও মনে করছে।

আবার অনেক দেশ, হয়ত যারা নিজেরাই অন্যের কাছ থেকে সংগ্রাম করে স্বাধীনতা অর্জন করেছে, তাদের নিজেদের ভিতরেও নতুন করে স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম আর সংঘাত চলছে। যারা সংগ্রাম করছে, তারা নিজেদেরকে বলে ‘স্বাধীনতাকামী’। এক পক্ষের কাছে তারা হিরো। আবার অন্যপক্ষের কাছে তারা নিছক ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী’ ছাড়া আর কিছু নয়। এসব সন্ত্রাসীর হাত থেকে দেশের অখন্ডতা রক্ষার জন্য লড়াই করা হচ্ছে। অর্থাৎ হিরো হয়ে গেল ভিলেন। অর্থাৎ এখানে স্বাধীনতার সংজ্ঞা অনেকটাই আপেক্ষিক। এমনকি জাতিসত্তার সংজ্ঞাও তাই। সেজন্য স্বাধীনতাকে শুধু জাতিসত্তার সাথে মিলানো হলে মনে হয় সঠিক সংজ্ঞাটা পাওয়া যাবে না। তাহলে কী হতে পারে স্বাধীনতার মর্মার্থ?

প্রশ্নটা মনের মধ্যেই রেখে দিয়েছিলাম। একদিন হঠাৎ করেই যেন একটা জবাব পেয়ে গেলাম। ঠিক বইয়ের পাতায় পড়া আক্ষরিক জবাব না, প্রত্যক্ষও না, পরোক্ষ। কিন্তু বেশ সম্পূর্ণ। জবাবটা পেয়েছি অরুন্ধতী রায়ের কাছে থেকে। সবাই উনাকে মূলত লেখিকা(“গড অব দ্য স্মল থিংস”-এর জন্য) হিসেবে চিনলেও অনেকেই জানেন উনি একই সাথে একজন প্রখ্যাত সমাজকর্মী। আর ভারতের বিভিন্ন স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠীর সাথে উনি কাজ করেছেন, তাদের কথা সবার সামনে এনেছেন। কিছুদিন আগের আলোচিত ‘নকশাল’ নামে পরিচিত স্বাধীনতাকামী(বা ভারতে সরকারী ভাষ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী) আন্দোলন চলাকালেও তিনি তাদের অনেক কাছে, একেবারে যুদ্ধের ক্যাম্প পর্যন্ত যেতে পেরেছিলেন, যেটা অনেকের পক্ষেই অসম্ভব। যাই হোক আসল কথায় ফিরে আসি। একবার উনি কাশ্মীরে গিয়েছিলেন। তাদের সাথে কথা বলার সময় উনি একবার জিজ্ঞাসা করলেন, তারা কেন আজাদী(স্বাধীনতা) চায়। উত্তরটা ছিল অনেকটা এরকম- “ভারতের কাছ থেকে আমাদের ‘ইনসাফ’ পাওয়ার আশা শেষ হয়ে গেছে, তাই আমরা ‘আজাদী’ চাই।” খুব ছোট্ট আর সরল একটা কথা। কিন্তু এর ভিতরেই আমি যেন আমার খুঁজতে থাকা স্বাধীনতার সংজ্ঞাটা পেয়ে গেলাম।

আরও একটু ভাঙার চেষ্টা করি কথাটাকে। ‘ইনসাফ’ অর্থাৎ ন্যায়বিচার। ন্যায়বিচার তো সবাই চায়। সব বিষয়েই চায়। কিন্তু অনেক সময়ই সবাই পায় না। আমাদের বাংলাদেশের কথাই এখন ধরা যাক। গত কয়েকদিনের ঘটনা মনে করে দেখুন। অনেক অনাচার আর অবিচার মূহুর্তেই চোখের সামনে চলে আসবে। সবাই কিন্তু ন্যায়বিচার পাচ্ছে না। অনেকের ক্ষেত্রেই “ইনসাফ পাওয়ার আশা শেষ হয়ে গেছে”-ব্যাপারটা সত্য। কিন্তু এতে করেই যে সবাই স্বাধীনতার দাবী করছে, এমনও না। তার মানে এই অবিচারের সাথে স্বাধীনতার সম্পর্কে আরও কিছু অতিরিক্ত শর্ত আছে। আমার মনে হয়েছে- শর্তটা হচ্ছে রেসিজম বা বর্ণবাদ।

স্বাধীনতার দাবী কিন্তু কোন ব্যক্তির একার হয় না, হয় গোষ্ঠীর। একজন ব্যক্তি এককভাবে স্বাধীনতা চায় না। গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে স্বাধীনতা চায়। কখন চায়? যখন ঐ গোষ্ঠীর উপর অবিচার করা হয়। যখন তারা ন্যায়বিচার পায় না। এবং এই অবিচার বিশেষভাবে ঐ গোষ্ঠীর জন্য। তাদের ভৌগলিক, সাংস্কৃতিক বা অন্য কোন পরিচয়ের জন্য। এজন্য যেকথা বলছিলাম, আমাদের দেশেও অনেকে অবিচারের শিকার। কিন্তু তারা এজন্য স্বাধীনতা চাচ্ছেন না যে, এই অবিচার বা অনাচার কোন গোষ্ঠীর উপর নয় আর এর কারণও বর্ণবাদী মনোভাব নয়। অথবা এমন কিছু হলেও রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তাদের ন্যায়বিচার পাওয়ার আশা শেষ হয়ে যায়নি। অর্থাৎ বলা যায়, একটা স্বাধীন দেশের মানে হল, সেখানে কারও ন্যায়বিচার পাওয়ার আশা শেষ হয়ে যায় না।

‘ন্যায়বিচার’ শব্দটাকে আরেকটু বিশ্লেষণ করা যাক। ‘বিচার’ কথাটা কখন আসে? যখন কারও উপর কোন অন্যায় করা হয়। কারও সাথে অন্যায় করার অর্থ হল- তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা। সুতরাং মানুষ ন্যায়বিচার চায়, তারও আগের কথা হল সে তার অধিকারের নিশ্চয়তা চায়। সে তার অধিকারের স্বীকৃতি চায়। যখন বৈষম্য করে কোন গোষ্ঠীর অধিকারকে খর্ব করা হয় তখন শুরু হয় সংগ্রাম। প্রথমে অধিকার আদায়ের জন্য। আর যদি সেই আশা একেবারেই শেষ হয়ে যায়, তখন শুরু হয় স্বাধীনতার সংগ্রাম। আমাদের ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে দেখুন। আর আমাদের পার্বত্য জনগোষ্ঠীর কথাও চিন্তা করে দেখতে পারেন।

পৃথিবীতে যত স্বাধীনতার সংগ্রাম হয়েছে, মূলত এই অধিকার আদায়ের জন্যই হয়েছে। তবে কোন মুক্তিযোদ্ধাকে(যেকোন দেশের) যদি জিজ্ঞাসা করেন, কেন যুদ্ধ করেছিলেন? সবাই বলবেন, একটা স্বাধীন দেশের জন্য। হয়ত কেউ বলবেন, একটা নতুন পতাকার জন্য। অত্যাচারী নিপীড়কদের হাত থেকে জাতিকে রক্ষা করার জন্য। কেউই হয়ত সরাসরি অধিকারের কথা বলবেন না। আসলে যেসব জিনিসের কথা বলা হয়, তার সবই ঐ গোষ্ঠী বা জাতির অধিকারের প্রতীক। একটা নাম, একটা পতাকা, একটা মানচিত্র, একজন মানুষ, কিছু স্লোগান, কিছু কবিতা, কিছু গান, কিছু ছবি এবং এমন আরও নানা প্রতীক। এই সবকিছু মানুষের অধিকারেরই প্রকাশ। সবাই মনে করে, ঐ প্রতীকগুলোর জন্যই সংগ্রাম। কিন্তু আসলে মানুষের সংগ্রাম তার অধিকারের জন্য। তার সাথে করা অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়বিচারের জন্য। আর ‘স্বাধীনতা’? ‘স্বাধীনতা’ হয়ত মানুষের অধিকারের চিরন্তন দাবীর এমন সব বিভিন্ন প্রতীকেরই একটা সম্মিলিত আর বিমূর্ত নাম।

[কিছুটা আপডেটেড। পরবর্তীতে ‘জাতিসত্তা’ আর ‘অধিকার’ নিয়ে আরও লেখার ইচ্ছা আছে।]

১,৫২৬ বার দেখা হয়েছে

৬ টি মন্তব্য : “স্বাধীনতা তুমি”

  1. আসিফ খান (১৯৯৪-২০০০)

    গুলশান। ভাই-
    "কিছুদিন আগের আলোচিত ‘নকশাল’ নামে পরিচিত স্বাধীনতাকামী(বা ভারতে সরকারী ভাষ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী) আন্দোলন চলাকালেও তিনি তাদের অনেক কাছে, একেবারে যুদ্ধের ক্যাম্প পর্যন্ত যেতে পেরেছিলেন,"
    নকশালরা স্বাধীনতাকামী নয়। তারা শ্রেনীহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার যোদ্ধা। বিশেষ করে জঙ্গলমহলের বিস্তী্র্ণ বনাঞ্চলের মানুষের উপর রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন ও ঐ অঞ্চলের প্রাকৃতিক সমপদের উপর জনগনের অধিকার রক্ষায় সংগ্রামরত।
    তোমার লেখা ভাল লাগছে,আমিও খুব শীঘ্রই যোগ দিব।

    জবাব দিন
    • গুলশান (১৯৯৯-২০০৫)

      যে অংশটুকু তুলে ধরেছেন, সত্যি কথা বলতে সেটা সম্পর্কে আমার খুব বেশি জানা-শোনা নেই। আর আমার এই পোস্টের মূল বক্তব্যের সাথেও এই তথ্যের সম্পর্ক খুব কম। আচ্ছা, নকশালরা যে 'শ্রেনীহীন সমাজ' প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করছে, সেটা কি পুরো ভারতের জন্য? নাকি নিজেদের আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্রে? ডাউট দিচ্ছি না, জানতে চাচ্ছি শুধু।

      মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ। অন্যরা যোগ দিলে অর্থাৎ এই বিষয়গুলো নিয়ে লিখলে সবার মতামতগুলো জানা যাবে। আপনার মতামতের জন্য অপেক্ষায় থাকব।

      জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : গুলশান (১৯৯৯-২০০৫)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।