অর্থনীতি বিষয়ক কিছু ভাবনা – ১

আমি মনে হয় ভাবতে ভালবাসি। কোন ব্যাপার আমার কাছে একটু আগ্রহ জাগানিয়া মনে হলেই হল। সেটা নিয়ে মাথায় নানা চিন্তা-ভাবনা ঘোরাঘুরি করে। সেটা যাই হোক না কেন। এতদিন সেসব ভাবনা প্রকাশ করা হত না। সিসিবিকে অনেক অনেক ধন্যবাদ এইজন্য যে, এগুলো এখন কিছু আলোর মুখ দেখে(নাকি অনেক আলোকিত মুখ এদের দেখে?)। শুধু এই মনের কোণেই গুমরে মরে না। আর লিখতে গেলে ভাবনাগুলোও গোছানো একটা কাঠামোতে দাঁড়িয়ে যায়। এজন্যই সিসিবিতে আজকাল যা মনে আসে তা নিয়েই কিছু একটা লিখতে চেষ্টা করি। তো আমার আজকের লেখার বিষয়বস্তু- অর্থনীতি।

অর্থনীতি বিষয়ক ব্লগর ব্লগর শুরু করার আগে আমার কোন বিষয় নিয়ে ভাবনার এগুনোর ধরণটা একটু বলি। ছোটবেলায় অনেক বই পড়তাম। যদিও নিজের সংগ্রহ তেমন বেশি ছিল না। কিন্তু যেখানেই সুযোগ পেতাম, পড়তাম। আক্ষেপের বিষয় হল, আমার বই পড়ার এই অভ্যাসটা অনেকটাই বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। এখন যা পড়া হয়, তার বেশির ভাগই এই ইন্টারনেটে বসেই। বই বা নেটেও একটু বড় কিছু পড়তে গেলে এখন কেন জানি এক ধরণের অলসতা কাজ করে। অনেক সময়ই হয়ত বই বা কোন বড় লেখার উপর শুধু চোখ বুলিয়ে যাওয়া হয়। এজন্য আমি যেসব নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করি, তার অনেকগুলোতেই আমার তাত্ত্বিক জ্ঞান প্রায় শূন্যের কোঠায়। শুধু ঐ চিন্তাটুকু শুরু করার জন্য যে এক চিলতে জ্ঞান প্রয়োজন, হয়ত শুধু ততটুকুই আছে এই ঝুলিতে।

তবে আমার এই অলসতা আর খুব অল্প কিছু ধারণা থেকে ভাবতে শুরু করার মধ্যে আমার নিজস্ব একটা ধরণ আমি তৈরি করে নিয়েছি। সেটা হল, কোন কিছু নিয়ে একেবারে পুরোপুরি নিজের মত করে চিন্তা করা। কারণ আমার আগে যতটুকু জ্ঞান ঐ বিষয়ে সঞ্চিত হয়েছে, তা তো এমন অনেকগুলো মানুষের চিন্তারই ফসল। এখানে আমি অবশ্য ঐসব বিষয়গুলোর কথা বলছি না, যেসবের জন্য নির্দিষ্ট নিয়মে ছকবাঁধা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমেই এগুতে হবে। যেমন বিজ্ঞানের(প্রাকৃতিক বিজ্ঞান) বিষয়গুলো। অর্থাৎ আমার চিন্তার ডোমেইনে মূলতঃ পড়ে- সামাজিক বিজ্ঞান, দর্শন আর আমার নিজের পাঠ্য বিষয়, কম্প্যুটার সায়েন্স। সাথে গাণিতিক, বিশেষ করে জ্যামিতিক কিছু কিছু ব্যাপার। যেগুলোর জন্য কোন আলাদা গবেষণাগার লাগে না আর কি। (এইটা লেইখা নিজেরে বিশাল গিয়ানী মনে হইতেছে।)

এখন কথা হল, অন্যদের চিন্তা-ভাবনা না জেনে, একেবারে গোড়া থেকে নিজের মত করে শুরু করে কী লাভ? তাতে কি অনেকটা পথ পিছিয়ে যাওয়া হল না? আর “আবার নতুন করে চাকা আবিষ্কার” করার দরকারটা কী? যেটা রেডিমেইড পাওয়া যাচ্ছে, সেটা নিলেই তো হয়? আমার উত্তর হল, নতুন করে চাকা আবিষ্কার করলেও সেই আবিষ্কারটা একান্তই আমার। অন্যেরা আগেই আবিষ্কার করেছে তাতে কী? আমিও তো আবিষ্কারই করলাম! এই আবিষ্কার করার মধ্যে আলাদা এক ধরণের আনন্দ আছে। যেমনটা আছে গল্প, কবিতা লেখার মধ্যে(এসব আমি একেবারেই পারি না)। আর কেউ বাহবা না দিক, ঐ আনন্দটাই আমার পাওয়া। কম্প্যুটার সায়েন্সের কোন সমস্যার নিজের মত করে সমাধান করে যখন দেখেছি, সেটা কোন বিখ্যাত ব্যক্তির বিখ্যাত সমাধানের সাথে মিলে গিয়েছে, নিজের মধ্যে অন্য রকম একটা ভাল লাগা তৈরি হয়। আর আত্মবিশ্বাসও বাড়ে।

আরেকটা লাভ হল, অন্যের চিন্তা-ভাবনা দ্বারা প্রভাবিত না হওয়া। কোন বিষয় নিয়ে অন্যেরা কী বলে গেছে, সেটা যদি আমি আগেই পড়ে ফেলি, তবে অবশ্যই সেটা দ্বারা আমি কোন না কোন ভাবে প্রভাবিত হব। সেটার পক্ষেই যাই, আর বিপক্ষেই কথা বলি, একটা প্রভাব কিন্তু থেকেই যাবে। গণিতে বা কম্প্যুটার সায়েন্সে এমনটা খুবই স্বাভাবিক যে, এই প্রভাবিত হওয়ার কারণে কোন সমস্যার অনেক বিকল্প সমাধান আমাদের নজরে আসেনি এখনও। তার চেয়ে দেখি না একটু নিজের মত করে চিন্তা করে। আমি তো আর এমন কেউ না, যার সামান্য কথায় বিশাল কিছু ঘটে যাবে। এই পৃথিবীর নগণ্য এক মানুষ আমি। এই একজন মানুষের আলাদা চিন্তা-ভাবনায় কারো কোন ক্ষতি তো আর হচ্ছে না। আরেকটা কথা হল, আমি যে একেবারেই অন্যদের চিন্তা-ভাবনা-কথাগুলো জানার চেষ্টা করি না, তেমনও নয়। তবে শুরুতেই না। আর আমার চিন্তাগুলোও যাঁরা জানেন তাঁদের দেখিয়ে নেওয়ারও একটা চেষ্টা থাকে। তবে সব-সময় হয়ে ওঠে না সেটা।

এখন অর্থনীতির কথায় আসি। যতটুকু জানি, মানুষের জীবনে অর্থের উদ্ভব বিনিময় ব্যবস্থাকে সহজ করবার জন্য। যদিও অর্থের আরও অনেক সুবিধা আছে, মূল কারণ কিন্তু ঐ সহজ লেনদেন। অর্থ বিনিময় বা লেনদেনের ক্ষেত্রে এমন একটা মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হবে, যেটা সবার জন্যই পুনঃব্যবহার করা সহজ এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য। যেটাকে বলা হয় অর্থের তারল্য। অর্থাৎ পুরো বিনিময় ব্যবস্থায় অর্থের চলাচল বা প্রবাহ হবে সবচেয়ে সহজ। অর্থের তারল্য হবে অন্য যেকোন বস্তুর থেকে বেশি। অর্থের মূল উপযোগিতাই হল প্রবাহিত হওয়ার মধ্যে।

আমার মনে হয়, পৃথিবীর বা কোন দেশের বা কোন অঞ্চলের অর্থনীতি বা লেনদেন ঠিকঠাক চলার জন্য একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রবাহমান অবস্থায় থাকা প্রয়োজন। যদি অর্থের সরবরাহ ঐ পরিমাণের চেয়ে বেড়ে যায়, তাহলে অর্থের প্রকৃত মান কমে যাবে। এভাবে এই বাড়তি অর্থও প্রকৃত মূল্যের দিক থেকে ঐ “নির্দিষ্ট পরিমাণ” অর্থের সমান হয়ে যাবে। যেটাকে বলা হয় অর্থের অবমূল্যায়ন। তবে যদি প্রবাহমান অর্থের পরিমাণ যদি কমে যায়, এমন না যে অর্থের প্রকৃত মান কমে যাবে। কারণ অবমূল্যায়ন যতটা স্বতঃস্ফূর্ত প্রক্রিয়া, অতিমূল্যায়ন ততটা নয়। আরও সহজ ভাষায় বললে, দাম বাড়া যত সহজ, কমা তত সহজ না। তাহলে প্রবাহমান অর্থ কমার ফলাফল কি হবে? এতে বিনিময় বা লেনদেন প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে। বাজারে দ্রব্য থাকবে, কিন্তু ঐ দ্রব্য বিনিময়ের মাধ্যেমে হাত-বদল হতে যে অর্থের প্রয়োজন ছিল, তা না থাকায় সংকট সৃষ্টি হবে। আর প্রবাহমান অর্থের এই সংকট অর্থ-সঞ্চয়কে উৎসাহিত করবে, প্রবাহকে করবে ব্যাহত। প্রবাহমান অর্থের পরিমাণ আরও কমে যাবে। ফলে সংকট আরও বৃদ্ধি পাবে। এখানে একটা কথা বলে রাখি- আমি কিন্তু এখানে বাজারে দ্রব্যের যোগান নিয়ে কথা বলছি না। কথা হচ্ছে অর্থের যোগান নিয়ে। পদার্থবিজ্ঞানের অনেক সূত্রের মত পাঠকেরা এক্ষেত্রে পণ্য বা দ্রব্যের যোগানকে স্থির বা ধ্রুবক ধরে নিতে পারেন।

[চলবে…]

৮ টি মন্তব্য : “অর্থনীতি বিষয়ক কিছু ভাবনা – ১”

  1. ওয়াহিদা নূর আফজা (৮৫-৯১)

    তোমার পোষ্টগুলো পড়ি। তোমাকে একজন চিন্তাশীল ব্লগার হিসেবেই জেনে এসেছি। তোমার লেখার ভূমিকাটুকু ভাল লাগলো - আমার নিজের ভাবনাও অনেকটা এরকম।

    চালিয়ে যাও।


    “Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
    ― Mahatma Gandhi

    জবাব দিন
  2. ইফতেখার (৯৫-০১)

    (বাংলায় কিছু পরিভাষা বের করা কঠিন, কাজেই সেখানে ইংরেজিটাই লিখছি)

    অর্থ প্রবাহ বিষয়টা পরিষ্কার করে ব্যাখ্যা করলে ভালো করতে। কারন এই টার্মটা অনেকটাই রিলেটিভ। কারেন্সি যেমন অর্থের প্রবাহ-এর একটা অংশ (মূল অংশই বলা যায়), ব্যাবহারের উপর ভিত্তি করে অনেক ভার্চুয়াল কারেন্সিই ব্যবহার হয়। আর ফ্র্যাকশনাল রিসার্ভের কারনে 'নির্দিষ্ট পরিমান' অর্থ প্রবাহমান থাকতে পারছে না। এক্সচেন্জ ইক্যুয়েশন (কোয়েন্টিটি ইক্যুয়েশন, M*V = P*Y) অনুযায়ী "V" নিয়ন্ত্রণ করতে পারছো না। প্রবাহমান অর্থ বলতে যদি M (মানি সাপ্লাই) টা বুঝিয়ে থাকো, তাহলে তুমি M নিয়ন্ত্রণ করলেও 'চেন্জ ইন প্রাইস লেভেল' (ΔP) বা চেন্জ ইন জিডিপি (সহজ ভাষায় - আউটপুট - মোট উৎপাদিত পন্য, ΔY) এর মাধ্যমে আইডেন্টিটিটা বজায় থাকবে। যদি বাজারে পর্যাপ্ত অর্থের যোগান না থাকে (Ms), তাহলে ভার্চুয়াল মানি (বা ব্ল্যাক মানি) তৈরি হবে (যেমন রোমানিয়ায় কেন্ট সিগেরেট) । অর্থের অবমুল্যায়ন বা অতিমুল্যায়ন অর্থের যোগানের কারনে হবে না, হবে যোগানের সাপেক্ষে দ্রব্য (আউটপুট) না থাকলে (Inflation = too much money chasing too few goods)। এর মূল কারনই হলো অর্থের 'মুল্য' (Value of money) নির্ধারিত হয় তা কি পরিমান দ্রব্য কিনতে পারবে তার উপর ভিত্তি করে। কারেন্সিতো প্রকারন্তরে ভ্যালুলেস, এর মূল ভ্যালুই হলো এর এক্সচেন্জ ভ্যালু - একটা নির্দিষ্ট পরিমান অর্থ কি পরিমান দ্রব্য কিনতে পারছে।

    জবাব দিন
    • গুলশান (১৯৯৯-২০০৫)

      আমি যেটা চাচ্ছিলাম সেটা মনে হয় পেয়ে গেছি। সেটা হল, অর্থনীতির কেউ লেখাটা পড়বেন। আমি তো শুরুতেই আমার চিন্তার ধরণ বলে নিয়েছি। সুতরাং বলতে দ্বিধা নেই, আপনার কথার অনেক কিছুই বুঝিনি। মনে হচ্ছে আপনার দেওয়া উইকিপিডিয়ার লিংকটা পড়তে হবে।

      জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : গুলশান (১৯৯৯-২০০৫)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।