ধর্ম নিয়ে আমার ভাবনা – ১

অনেকে শিরোনাম দেখে হয়ত আঁতকে উঠতে পারেন- আবার শুরু হইল! সেজন্য প্রথমেই এই পোস্টে ‘ধর্ম’ শব্দটার ‘মর্ম’ বলে নেয়া ভাল। কলেজে থাকতে মল্লিক স্যারের কাছে শোনা- ‘ধর্ম’ শব্দটি এসেছে ‘ধৃ’ থেকে। অর্থ- ধারণ করা। সুতরাং এভাবে দেখলে আমরা যা ধারণ করি(বস্তুগতভাবে বা Physically না অবশ্যই) তা-ই ধর্ম। আর সেজন্যই ইংরেজি ‘Religion’ শব্দের তুলনায় বাংলা ‘ধর্ম’-এর অর্থও অনেক ব্যাপক। যেমন আমরা মানুষ ছাড়াও অন্যান্য বস্তুর ক্ষেত্রেও ধর্ম শব্দটা ব্যবহার করি। যেমন ‘পানির ধর্ম’, ‘আলোর ধর্ম’ ইত্যাদি। এখানে ‘ধর্ম’ মানে ‘Property’ বা বৈশিষ্ট্য। আর আমি এই পোস্টে ধর্মের এই ব্যাপক অর্থ নিয়েই নিজের ভাবনাগুলো বলতে চাই। তবে এটি শুধুমাত্র মানুষের ধর্মের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। অন্য কোন কিছুর ধর্ম এখানে আসবে না। আর একটা কথা তো অবশ্যই বলে নিতে হয়। এই পোস্টের শিরোনামের কপিরাইট – মাহমুদ ভাই।

আমি এখানে যে জিনিসটাকে ধর্ম বলতে চাচ্ছি, অর্থাৎ আমাদের নিজেদের আচার-আচরণ, চিন্তা-ভাবনা, আবেগ ইত্যাদি, সেটা আমাদের চারপাশের বস্তুগত এবং সামাজিক নানা ফ্যাক্টরের উপর নির্ভরশীল। অন্যদিকে এসব আবার আমাদের শারীরিক ব্যাপার এমনকি জিনের উপরেও নির্ভর করে। সুতরাং আমরা যদি অ্যাবস্ট্রাকশান লেভেল কমিয়ে একটু সূক্ষ্মভাবে খেয়াল করি, তাহলে দেখা যাবে যে আমাদের যেকোন দুজন ব্যক্তির ‘ধর্ম’ কিন্তু পুরোপুরি এক হয় না। কয়েকজনেরটা অনেকখানি কাছাকাছি হতে পারে অবশ্য। এজন্য আমি এখান থেকে বিভ্রান্তি এড়াতে ‘ধর্ম’-এর পরিবর্তে ‘ব্যক্তিধর্ম’ শব্দটি ব্যবহার করব। আর ‘Religion’ এর কথা বলতে ব্যবহার করব ‘প্রচলিত ধর্ম’ কথাটি।

যদিও আমি বলছি যে, এই ব্যাক্তিধর্ম প্রত্যেক ব্যক্তির ক্ষেত্রেই আলাদা, একে বিশ্লেষণ করতে গেলে কিছুটা সাধারণীকরণ(Generalization) তো করতেই হবে। আসুন সে চেষ্টা করা যাক। একটু খেয়াল করলেই দেখা যায়, এই আলাদা আলাদা ব্যক্তি-ধর্মগুলোও সাধারণ(Common) কিছু উপাদান নিয়েই গঠিত। এই উপাদানগুলোকে কিন্তু আবার কেউ উপরে বলা ফ্যাক্টরের সাথে মিলিয়ে ফেলবেন না যেন। এসব উপাদানগুলোর মধ্যে পড়বে প্রচলিত ধর্মগুলো, সামাজিক প্রথা বা রীতি-নীতি, বিভিন্ন মতাদর্শগুলো, স্বজাত্যবোধ এবং এর বিভিন্ন স্তর, পেশাভিত্তিক বিভিন্ন মানসিকতা ইত্যাদি। এমনকি বিশেষ কোন প্রতিষ্ঠানে পড়া বা কাজ করা অথবা খেলাধুলায় বিশেষ কোন দল বা ক্লাবকে সাপোর্ট করাও এসব উপাদানের মধ্যে পড়তে পারে। আর এই সব উপাদান নিয়েই তৈরি হয় একজন ব্যক্তির ব্যক্তিধর্ম। তবে কোন বিশেষ একটা উপাদানের প্রাধান্য তো অবশ্যই থাকে। এই প্রাধান্যও ব্যক্তিভেদে বিভিন্ন হতে পারে। কারো জন্য হয়ত জাতীয়তাবাদ, কারো জন্য কোন প্রচলিত ধর্ম, আবার কারো জন্য হয়তবা কোন মতাদর্শ। আমি এসব উপাদানগুলোকে অনেকটা একই মাপকাঠিতে এনে, এদের বৈশিষ্ট্যগুলো খুঁজে বের করে, ব্যক্তিধর্মকে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছি। যদিও স্বাভাবিকভাবেই, এই মাপকাঠি সবসময় কঠোরভাবে(strictly) বজায় নাও থাকতে পারে। এটা তো আর পদার্থবিজ্ঞানের বস্তুর ধর্ম নয়।

প্রথমেই আমি বলব এই উপাদানগুলির দুটি প্রধান দিক আছে- বিশেষ ধরণের মানসিকতা এবং বিশেষ ধরণের জীবনাচরণ। বিভিন্ন উপাদানের বিশেষ ধরণের মানসিকতা নিয়ে গঠিত হয় ব্যক্তিমানসিকতা আর বিভিন্ন জীবনাচরণ মিলে হয় ব্যক্তির জীবনাচরণ। এই দুইয়ে মিলেই পুরো ব্যক্তিধর্ম। এই মানসিকতা এবং জীবনাচরণের মধ্যে বেশ খানিকটা পারষ্পরিক নির্ভরশীলতাও আছে। অনেকটা চক্রের মত। পরে কথা হবে এ নিয়ে। এই পর্বে আপাতত শুধু বিভিন্ন উপাদানের মানসিকতাগুলোকেই একই মাপকাঠিতে বিশ্লেষণ করতে চাচ্ছি। আমার মতে, এই একেকটা মানসিকতার মধ্যেও দুটি উপাদান আছে- আদর্শ এবং লক্ষ্য। আসুন দেখা যাক এই আদর্শ এবং লক্ষ্য বলতে আমি কি বুঝাতে চাচ্ছি।

আদর্শ- যদিও সব মানসিকতার মধ্যে আদর্শ নাও চোখে পড়তে পারে, অনেক মানসিকতায় আদর্শই মূল চাবিকাঠি। এই আদর্শই ঠিক করে দেয় ঐ উপাদানের বাকী দিকগুলি। এখানে আদর্শ বলতে আমি বুঝি, কিছু নীতি বা তত্ত্ব- যার উপর ব্যক্তির আস্থা তৈরি হয়েছে। একে হয়ত বিশ্বাসও বলা যেতে পারে। এই আদর্শ একেবারে ধরা-বাঁধা, লিখিত সুনির্দিষ্ট হতে পারে। আবার অলিখিত কিছু বোধের সমষ্টিও হতে পারে। এই আস্থা বা বিশ্বাসের কারণে ব্যক্তি ঐ আদর্শ অনুসারে চলার চেষ্টা করে। চেষ্টা করে এর বিপরীত কিছু না করার। আর ব্যক্তির ভিতরে থাকা আস্থার কারণে কখনও কোনভাবে আদর্শের বিপরীত কিছুর সম্মুখীন হলে সে চেষ্টা করে সেটাকে রক্ষা(defend) করতে। হতে পারে সেটা প্রকাশ্যে, বা মনে মনে নিজের সাথেই।

লক্ষ্য- এই লক্ষ্যকে আমি বলব মানসিকতার আরেকটি প্রভাবশালী উপাদান। ব্যক্তি সবসময় কোন একটা লক্ষ্য অর্জন করার জন্য কাজ করে যায়। আমরা সবাই যেহেতু ছাত্র ছিলাম, বলা যায় আমাদের তখন লক্ষ্য ছিল ভাল ফলাফল। আবার আমাদের শিক্ষকদেরও লক্ষ্য ছিল ঐ একই- ভাল ফলাফল। যদিও একটু ভিন্নভাবে- একজন ছাত্রের না, পুরো প্রতিষ্ঠানের ফলাফল। এই লক্ষ্য হতে পারে ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগত। অনেক সময় একটা বড় চূড়ান্ত লক্ষ্যের জন্য অনেক ছোট ছোট সাময়িক লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য থাকে নির্দিষ্ট পরিমাণ মুনাফা অর্জন। রাজনৈতিক দলের লক্ষ্য রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা অর্জন। ব্যক্তিধর্মের এমন নানা উপাদানের নানামুখী লক্ষ্য ব্যক্তির মানসিকতায় গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে।

আমার মনে হয়, ব্যক্তিধর্মের কিছু উপাদানের ক্ষেত্রে মানসিকতায় আদর্শের ভূমিকা বেশী(Ideology oriented)। এই আদর্শকে ঠিক রাখতেই নানা লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। আর কিছু কিছু ক্ষেত্রে লক্ষ্য অর্জনই মূল কথা(Target oriented)। তাতে যদি আদর্শকে(যদি থাকে, নাও থাকতে পারে। যেমন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে) কিছুটা ছাড়ও দিতে হয়, সমস্যা নেই। আমি অবশ্য আদর্শভিত্তিক মানসিকতার পক্ষে। তবে সাথে কিছু লক্ষ্যও থাকা প্রয়োজন বোধ হয়। কারণ ‘লক্ষ্য’ অ্যাবস্ট্রাকশান লেভেলকে বেশ খানিকটা বাড়িয়ে দেয় বলে আমার ধারণা। তাতে একটা মত অনেক সহজবোধ্য হয় এবং আরো বেশী মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারে। তবে আদর্শ ছাড়া লক্ষ্য কেন জানি আমার কাছে তেমন একটা পছন্দ হয় না।

পরের পর্বে চেষ্টা করব ব্যক্তিধর্মের আরেকটি দিক ‘জীবনাচরণ’ নিয়ে কিছু বলতে।

(কিছুটা সম্পাদিত)

২,১৫০ বার দেখা হয়েছে

১৫ টি মন্তব্য : “ধর্ম নিয়ে আমার ভাবনা – ১”

  1. মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)

    ব্লগে ধর্ম সম্পর্কে আলোচনা করা প্রায় সময়ই খুব কঠিন। কারণ, আমরা ধর্ম বলতে সাধারণতঃ ইসলাম, ক্রিশ্চিয়ানীটি, হিন্দুইজম, এইগুলা বুঝি। একপক্ষ এইসব ধর্মের গুণগাণ করি, আরেকপক্ষ এদেরকে অপ্রয়োজনীয়, উপরন্তু ক্ষতিকর প্রমাণ করতে চেষ্টা করি। আর এই বিতর্কে চাপা পড়ে যায় 'মানব ধর্ম'।

    গুলশান, তোমার লেখার বিষয়বস্তু আমার খুবই ভালো লেগেছে। যেভাবে ব্যক্তিধর্মকে বিশ্লেষণ করছে, সেটাও বেশ সহজ এবং আকর্ষনীয় মনে হচ্ছে। আশা করি পরের পর্বে তোমার পুরো বক্তব্য আসবে।


    There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

    জবাব দিন
  2. তৌফিক (৯৬-০২)

    আমার ব্যক্তিগত ধারণা ধর্ম মানুষকে কমফোর্ট দেয়। ব্যক্তিমানুষ খুব ক্ষুদ্র না, মইরা গেলেই সব নাইট্রোজেন চক্রে ঢুকে যাওয়ার মত তুচ্ছ সে না, তার আত্না (সেইটা কি জিনিস জানি না) অবিনশ্বর, তার উপর অন্যায় হইলে সেইটার বিচার এক সময় না একসময় হবে- এই ধরনের নানা কমফোর্ট ধর্ম আমাদের দেয়। আমি যেটা পছন্দ করি না সেইটা হল- এই কমফোর্ট যখন কেউ জোর করে সরায়ে নিতে চায়, বা জোর করে দিতে চায়।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : শিশির (১৯৯৬-২০০২)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।