অন্য নায়কেরা

নিশুতি নিঃশব্দ রাত, গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন কান্দাই শহর। হঠাৎ রাতের আঁধার চীরে ভেসে আসে তেজী ঘোড়ার খুরের শব্দ। ঘুমে টুটে যায় যত অত্যাচারী শোষক ক্ষমতাধর বদ লোকের, তাদের বুকে জাগে ভয়ের কাঁপন। কারন এই ঘোড়ার সওয়ার আর কেউ নন, স্বয়ং দস্যু বনহুর- গরীবের বন্ধু, অত্যাচারী মাথায় উদ্যত গড়্গ। জমকালো পোষাকে অস্ত্র হাতে প্রিয় ঘোড়া তাজের পিঠে চেপে বের হয়েছেন নৈশ অভিযানে। কে জানে আজ রাতে কোন মানবতার দুশমনের হবে শেষ বিচার! ওদিকে পুলিশের চোখেও ঘুম নেই। বার বার পুলিশের জাল কেটে ঠিক বের হয়ে যান তিনি।

সাহিত্যে দস্যুদের আনাগোনা সেই কবে থেকে কে জানে! রত্নাকর কি রবিনহুড- যখন প্রচলিত ধারার নায়ক, সে রাখাল কি রাজপুত্র যাই হোক, পেরে ওঠেন না, তখন আসরে নামেন এঁরা। যাদের মন্ত্র একটাই- দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন, তাতে যদি দেশের আইন ভাঙতে হয় তাও সই। তাই লেখক সাহিত্যিকদের কল্পনাকে যেমন নাড়া দিয়েছে তেমনই পাঠকেরও মনও জয় করেছে এই ভিন্ন ধারার নায়কেরা। এটা আসলে বীর পূজারই অন্যরকমের বহিঃপ্রকাশ।

স্বয়ং সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র সৃষ্টি করেছিলেন দেবী চৌধুরানী, বাংলা সাহিত্যের প্রথম দস্যু চরিত্র বলাটা বোধহয় ভুল হবে না। এবং আরো লক্ষ্য করার বিষয়- ইনি একজন নারী। শশুড়বাড়ীর অত্যাচারে বিপন্না সাধারন এক গৃহবধু একদিন হয়ে ওঠেন একদল দূর্ধর্ষ অথচ আদর্শবাদী ডাকাত দলের নেত্রী। সেই সময়ের ভারত শাষক খোদ ইংরেজের বিরুদ্ধে অভিযান করতেও যিনি পিছপা হন নি। দেবী চৌধুরানী পাঠকের ভালবাসা পেয়েছেন। তবু কেন জানিনা লেখকরা যদিও কখনো সখনো ডানপিটে সব চরিত্র এনেছেন, কিন্তু পুরোদস্তুর দস্যুদের বরাবরই এড়িয়ে গেছেন।

তাই হয়তো এই “অন্য রকম নায়ক” ধারাটি তুলে নেন কিছুটা কম খ্যাতিমান লেখকরা। এবং দস্যু গোয়েন্দা ইত্যাদি রোমহর্ষক ঘরানার লেখা তাঁদের কাউকে এনে দেয় বিপুল জনপ্রিয়তা ও খ্যাতি। যদিও ঠিক “সাহিত্যিক” নামের বরমাল্য এঁরা পাননি। ব্যাতিক্রম বোধ হয় ব্যোমকেশ বক্সীর লেখক শরদিন্দু মখোপাধ্যায়। হেমেন্দ্রকুমার রায়, নীহার রঞ্জন গুপ্ত, অদ্রীশ বর্ধন, শশধর দত্ত, রোমেনা আফাজ, আবুল কাসেম, কাজী আনোয়ার হোসেন সহ আরো অনেকেই ঐ ধারায় লিখেছেন। আরেকটা কথা এখানে অপ্রসঙ্গিক হবেনা। বই গুলো সবই ছাপা হতো সস্তার নিউজপ্রিন্ট কাগজে। তাই বইপত্রের এই ধারাটিকে বাংলা পাল্প ফিকশনের যুগ বলা বলা যায়।

দস্যু মোহন সম্ভবত প্রথম ও স্বার্থক সিরিজ। পঞ্চাশ-ষাটের দশকে এটি বের হতো। মলাটের উপর মুখোশ পরা নায়কের ছবি, হাতে “ন্যায়দন্ড”। ইনি বাংলার রবীনহুড। লাল বাজারের পুলিশ প্রধান বেকার সাহেব তাঁকে ধরার অনেক চেষ্টা করেছেন, কিন্তু পুলিশের কি সাধ্য তাঁকে ধরা! পুলিশের হাত এড়িয়ে একের পর এক যত অত্যাচারী মহাজন, জমিদার আর চোরা কারবারীকে শায়েস্তা করে চলেন মোহন। খুবই কৌতুহল জনক ব্যাপার যে, মোহনের কর্মকান্ড শুধু কোলকাতা বা ভারতের চৌহদ্দীতেই সীমাবদ্ধ ছিলনা। “বার্লিনে মোহন” ও “গেস্টাপো যুদ্ধে মোহন” বই দুটিতে দেখা যায়, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের মূল রঙ্গমঞ্চ ইয়োরোপে, এমনকি খোদ জর্মনীতেও মোহনের নানা দুঃসাহসিক কর্মকান্ড। বহুকাল পরে মাসুদ রানার আবির্ভাব অবধি আর কেউ বিশ্ব বাজারে এমন দৌড়ঝাঁপ দেখিয়েছিলেন বলে মনে হয় না। সময়ের তুলনায় লেখক অনেক এগিয়ে ছিলেন বোঝা যায়। মোহন সিরিজের মোট কটা বই বের হয়েছিল সঠিক জানিনা, তবে এক বিজ্ঞাপনে পড়েছিলাম দুশো! ইদানীং সবগুলো একসাথে করে আবারো বের করা হচ্ছে। হয়তো আগের মত পাঠক প্রিয়তা নেই তবে বাংলা পাল্প ফিকশনের যুগের প্রামান্য হিসাবে এধরনের উদ্যোগ অবশ্যই সাধুবাদ পাবার যোগ্য।

সত্তুর দশকে বাংলাদেশের লক্ষ পাঠকের মন জয় করেছিলেন লেখিকা রোমেনা আফাজ তাঁর অবিস্মরনীয় সৃষ্টি দস্যু বনহুরের মাধ্যমে- যার উল্লেখ শুরুতেই করেছি। কান্দাই শহরটা ঠিক কোন দেশে তা স্পস্ট নয়, তবে শহরের ধারে কাছেই ছিল পাহাড় ও ঘন জঙ্গল। সেই পাহাড়ের গোপন গুহায় ছিল বনহুরের আস্তানা। ভদ্র ঘরের ছেলে- ছোটবেলায় হারিয়ে গিয়েছিলেন আর ভাগ্যের বিচিত্র খেলায় তাঁকে গড়ে পিটে তুলেছিলেন একজন দস্যু সর্দার! বনহুরের কর্মক্ষেত্র কান্দাই শহর, তবে একবার তাঁকে চীন দেশে যেতে দেখা গেছে। এমনকি, যাবতীয় দস্যু ও গোয়েন্দাদের মধ্যে একমাত্র উনিই, খোদ মঙ্গল গ্রহ পর্যন্ত ঘুরে এসেছেন।

জনপ্রিয়তার আশায় কিংবা শুধু লেখার নেশায়- আরো অনেকেই এ লাইনে লেখালেখি করেছেন। সবাই যে সফল হয়েছিলেন তা বলা যাবে না। আবুল কাসেমের লেখা দস্যু বাহরাম বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। বাহরামের কর্মকান্ডও মোটামুটি স্ট্যান্ডার্ড দস্যুদের মতনই ছিল। মোহন সিরিজের মত এটাও লেখা হোত সাধু ভাষায়। অন্যদিকে দস্যু বনহুর ছিল সাবলীল চলিত ভাষায় লেখা। প্রসঙ্গে আরো কয়েক জন দস্যুর নাম মনে পড়ছে, দুঃখের বিষয় লেখকদের নাম বলতে পারছি না। ছিল দস্যু পাঞ্জা, দস্যু ধুমকেতু, দস্যু মুনলাইট, দস্যু বাবর পাশা- আরো অনেকে। এদের কাজকর্মে তেমন নতুনত্ব বা চমক ছিল না, সবাই মোটামুটি শাস্ত্রমতো দস্যুতা করতেন। সেই বদ লোকের শায়েস্তা, প্রতিপক্ষের সাথে রক্তারক্তি সংঘাত, বিপন্নার উদ্ধার, আর পুলিশের সাথে লুকোচুরি।

ছেলেবেলায় ভৈরব বাজারে বেড়াতে গিয়ে এক মাঝ বয়েসি ভদ্রলোককে দেখেছিলাম। কয়েকজনের সাথে বসে আড্ডা দিচ্ছেন। আর কজন ছেলে ছোকরা আশে পাশে ঘুর ঘুর করছে। শুনলাম উনি দস্যু ফরহাদ নামে একটা সিরিজের লেখক। ওই সিরিজের একখানা বই সত্যি দেখেছিলাম, সুতরাং মুর্তিমান একজন দস্যু সিরিজের লেখককে সামনাসামনি দেখে বেশ ভক্তি হয়েছিল। তবে সে বই আর পড়া হয়নি।

আশির দশক থেকে দস্যু সিরিজের ভাটার টান। এসেছে নতুন জোয়ার- কাজী আনোয়ার হোসেনের ‘কুয়াশা’ ও ‘মাসুদ রানা’- আর তাতে মহা আনন্দে গা ভাসিয়েছেন রোমাঞ্চ রসিক পাঠক সমাজ। একেবারে অন্যস্বাদ, ভিন্ন গল্প, যা পাঠকের রুচিই পালটে দিয়েছিল। বলা যায় বাংলা পাল্প ফিকশনের শীর্ষস্থানটি তখন থেকেই সেবা প্রকাশনীর দখলে।
কুয়াশা মাসুদ রানা কেউই কিন্তু মোহনের মত দস্যু বা ব্যোমকেশের মত গোয়েন্দা নন। কুয়াশা মহা প্রতিভাধর বিজ্ঞানী, কিন্তু আইনের হাত এড়িয়ে কাজ করেন। লেসার গান, আল্ট্রাসনিক যন্ত্র, রোবট, ডুবোজাহাজ- এসব অত্যাধুনিক ব্যাপার স্যাপারের সাথে অনেকেরই পরিচয় কুয়াশার কল্যাণে। গোয়েন্দা কাহিনী আর কল্পবিজ্ঞানের এক অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছিল এই সিরিজে। এঁর কর্মকান্ড এতই বিচিত্র যে তার পাশে বাদবাকী দস্যুদের সব কীর্তি কেমন যেন পানসে হয়ে যায়। এই সিরিজে আরো কজন গুরত্ত্বপূর্ন চরিত্র ছিল যেমন শখের গোয়েন্দা শহীদ খান, এবং সেই অমোঘ পুলিশ কর্তা সিম্পসন সাহেব। পৃথবীর সম্ভব আসম্ভব সব রকম জায়গাতে তো বটেই, এমন কি সৌর জগতে পৃথিবীর ঠিক উল্টোদিকে পৃথিবীর জুড়ি গ্রহ ‘আনতারা’তেও তিনি ঘুরে এসেছেন।

মাসুদ রানা একেবারেই অন্য ব্যাপার- বাংলার জেমস বন্ড। এমন চরিত্র বাংলায় আর আছে বলে জানিনা। ইনি দস্যুও না, গোয়েন্দা কিংবা পুলিশ- কোনটাই না। একেবারে বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের দুর্ধর্ষ স্পাই। স্পাই শব্দের কোন যুতসই বাংলা জানিনা। চর বা গুপ্তচর শব্দ গুলো আছে বটে, কিন্তু জেমস বন্ডদের সাথে কি আর ওসব বিশেষন চলে? দেশে বিদেশে নানা দুঃসাহসিক মিশনে প্রান হাতে ঘুরে বেড়ানো তাঁদের কাজ। পশ্চিমা দেশে এধরনের বইয়ের রমরমা বাজার আছে, অনেক লেখক বিস্তর লিখেছেন, সিনেমাও হয়েছে প্রচুর। মাসুদ রানার অনেক বইয়ে ওসব কাহিনীর ছায়া আছে, যা লেখক নিজেই স্বীকার করেছেন।

লেখাটা দস্যুদের নিয়ে, রানা এখানে বেমানান। তবু মাসুদ রানা কে এখানে নিয়ে এলাম শুধু পাঠকের রুচি বদলের ব্যাপারটা দেখানোর জন্য। সময় বদলায়, সাথে পাঠকের রুচি। বিশেষ আজ অন্ত্জালের কৃপায় পশ্চিমের বেস্ট সেলার রাতারাতি পৌঁছে যায় এদেশের পাঠকের হাতে। সাথে আরো আছে সিনেমা। চমকের পর চমক। এসব দেখার পর ঘোড়ায় চড়া দস্যুদের অভিযান আজকের পাঠকের কাছে হয়তো নিতান্ত পানসে লাগবে। কিংবা রাজবাড়ীর দামী হীরে চুরি, সাথে গোটা চারেক হত্যা রহস্য ভেদকারী তীক্ষ্ণ বুদ্ধি গোয়েন্দার কীর্তিতে কেউ আর মুগ্ধ হয় না। তারপরো, একসময় এই দস্যু সিরিজ গুলি অগুন্তি পাঠকের মন জয় করেছিলো- তার মূল্য বড়ো কম নয়। আনুসন্ধানী কোন গবেষক হয়তো একদিন ওইসবের মধ্যেই খুঁজে পাবেন সেই সময়ের পাঠক রুচির আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটের কোন মূল্যবান সূত্র। সেকালের মানুষের চাওয়া পাওয়া ইচ্ছাপূরন আর আনন্দ বেদনার চালচিত্র। তাই এই লেখাগুলো যেন চিরকালের জন্য হারিয়ে না যায়।

৩,৬১৯ বার দেখা হয়েছে

২ টি মন্তব্য : “অন্য নায়কেরা”

  1. খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

    হায়! সিসিবি'র আজ এ কি দশা! এত সুন্দর একটি আলোচনা, ১৭৯৭ বার পঠিত, অথচ একটাও মন্তব্য নেই!
    যাক, কেউ কিছু বলুক আর না বলুক, আমার বলতে দ্বিধা নেই মাহবুব, তোমার এই আলোচনাটা পড়ার সময় ক্ষণে ক্ষণে সেসব দস্যুদের কথা আমার স্মৃতিপটে ভেসে উঠেছে, খুব ভাল লেগেছে সেসব দিনের কথা স্মরণ করে। বই এর উপর খবরের কাগজের মলাট বাঁধিয়ে স্কুলেও নিয়ে যেতাম সেসব বই, ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে পড়ে নিতাম শ্বাসরুদ্ধকর সেসব কাহিনীগুলো। আর কোন শিক্ষক অনুপস্থিত থাকলে তো পোয়া বারো!

    জবাব দিন
  2. মাহবুব (৭৮-৮৪)

    প্রিয় খায়রুল ভাই, আপনার মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। আসলেই ২০১৪-১৬ সালের সময়টাতে যে জমজমাট সিসিবি সেটা যেন হারিয়ে গেছে। তখনকার নিয়মিত অনেকেই এখন আর আসে না, আমিও একেবারেই অনিয়মিত হয়ে গেছি। পাঠক অবশ্য আসে, কিন্তু মন্তব্য আলোচনা এসব নেই বলা যায়। ফেসবুক কেন্দ্রিক কটা ফোরাম হয়েছে- সেগুলোর অবস্থাও এরকম। এই দুর্দিনে আপনার মত কাউকে দেখলে ভরসা হয়।
    লেখাটা আপনার ভালো লেগেছে যেনে বিশেষ সম্মানিত বোধ করছি। মলাটে বাঁধানো মাসুদ রানা নিয়ে কলেজের প্রেপ টাইমে ধরা পড়েছিলাম...স্যারের উদার দৃষ্টির কল্যাণে সেযাত্রা বেঁচে যাই।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মাহবুব (৭৮-৮৪)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।