ঘন্টা কাহিনী

ঘন্টার ইতিহাস প্রাচীন। কবে কোথায় এর উৎপত্তি জানিনা। তবে সব দেশে সব কালেই যেন এর ব্যবহার ছিল। গীর্জা মন্দির থেকে রেল ইষ্টিশান হয়ে বেড়ালের গলা – কোথায় নেই! ইশকুল এবং জেলখানাতে ওটা থাকবেই। শেষোক্ত প্রতিষ্ঠান দুটোর মধ্যে কি একটা অন্তঃমিল আছে যেন।

আকার প্রকারে ঘন্টা সমাজে দুই গোত্র- একটা মোচার খোলের মতো, ভেতরে হাতুড়ি ঝুলছে। উঁচু ঘন্টাঘরে কায়দা করে জিনিসটা ঝোলানো। দড়িদড়ার সাহায্যে ওটাকে এদিক ওদিক দুলিয়ে বাজাতে হয়। তার আওয়াজের ব্যাপ্তি সঙ্গীত শাত্রের মতই বিশাল। প্রত্যেকের আলাদা মেজাজ, আলাদা তান, আলাদা আবেদন। অন্য গোত্র চ্যাপ্টা থালা, ওর গায়ে হাতুড়ি বা ওই জাতীয় কিছু দিয়ে আঘাত করলে মিঠে ঠুন ঠুন শব্দ ওঠে। আরেকটা ঘর অবশ্য আছে যাকে সাধারনতঃ রেল ইস্টিশানে দেখা যায়। হাত তিনেক লম্বা রেল লাইনের এক টুকরো, ওটাকে আরেকটা লোহার ডান্ডা দিয়ে পেটালেই জোরালো আওয়াজ ওঠে। বহূদিন একই জায়গায় পেটানোর ফলে মাঝখানটা তার কোমরের মত সরু।

ঘন্টা বানানো উচ্চ মার্গের শিল্প। যেনতেন ভাবে লোহা তামা ঢালাই করলেই হয় না। ফেটে যায়, শব্দ সুন্দর হয় না- এমনি হাজারটা খুঁত থেকে যায়। চীন দেশের উপাখ্যানে আছে- বাবার মান বাঁচাতে রাজকন্যা নিজেই গলন্ত ধাতুর পাত্রে ঝাঁপ দিয়েছিল। একজন তাঁকে বাঁচাতে গিয়ে শুধু একপাটি জুতো ধরতে পেরেছিল। সেই থেকে নাকি ঘন্টার আওয়াজ হয় ‘কোই শিয়ে! কোই শিয়ে!”- আমার জুতো কই? মন ভেঙ্গে দেয়া করুন কাহিনী, তাই হয়তো ঘন্টার শব্দের সঙ্গে কেমন এক বিষন্নতা মিশে থাকে। মধ্যযুগে পৃথিবীর সাতটি আশ্চর্য জিনিষের মধ্যে একটি মস্কোর ঘন্টা। মহা পরাক্রমশালী রুশী জার অনেক খরচ করে এটা বানিয়েছিলেন। আমেরিকার ফিলাডেলফিয়া শহরেও ‘লিবার্টি বেল’ নামে একটা ঐতিহাসিক ঘন্টা আছে। এছাড়া সারা পৃথিবী জুড়ে অগুন্তি ঘন্টা ছড়িয়ে রয়েছে এদের নির্মাতাদের শৈল্পিক ও কারীগরি দক্ষতার প্রমান হয়ে।

ছোট স্নিগ্ধ জেলা শহর ফরিদপুরে যখন ছিলাম সে সত্তুর দশকের কথা। রাতে জেলখানার ঘন্টায় সময় জানানো হতো। ছায়াঘেরা ঘুমন্ত শহর, বিজলী বাতির অভাবে ঘোর অন্ধকার, আশে পাশেই যেন অশরীরিদের আসাযাওয়া। ঠিক ঐ সময় দূর থেকে ভেসে আসা ঘন্টার শব্দ যেন কোন রহস্যলোকের বার্তা। পরিবেশের সাথে শব্দের নিখুঁত মেলবন্ধন।

ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ। এখানে জীবন ছকে বাঁধা, ঘড়ির কাঁটায় চলে সারাদিনের কর্মকান্ড। ঘণ্টা ছাড়া চলবে কিভাবে? সুতরাং আমাদের সেই বিশাল খেলার মাঠের এক কোনে গোলাকার বাঁধানো বেদীতে ঘন্টাপ্রবরের অধিষ্ঠান। ইনি দ্বীতিয় গোত্রের- পূর্নিমা চাঁদের মতো গোল চকচকে পেতলের চ্যাপ্টা থালা, পাশেই চীর সহচর কাঠের হাতুড়ি। এঁর নিত্য সেবাইত হলেন ডিউটি ক্যাডেট। কলেজের অতি গুরুত্ত্বপূর্ন চরিত্র। অবশ্য এই চরিত্রে প্রতিদিন একজন নুতন করে নামে। এর প্রধান কাজ সারাদিনের সব কর্মকান্ডের ফিরিস্তি মিলিয়ে সময় মতো ঘন্টা বাজানো এবং যুগপৎ বাঁশিতে ফুৎকার ও চীৎকারে সবাইকে সেই সময়ের কর্তব্য জানান দেয়া।

তো, আমাদের সেই প্রিয় ঘন্টা কতকাল ধরে বেজে চলেছেন জানিনা, তবে বস্তুর ধর্ম বলেও একটা ব্যাপার আছে। সেই ধর্ম মেনেই, বহুদিনের কাষ্ঠপ্রহারের ফলে, একদিন ওর দেহে চিড় ধরলো। কদিন থেকেই যেন শব্দটা কেমন সর্দি লাগা শোনাচ্ছিল। এমনি এক দিনে ডিউটি ক্যাডেট হয়েছে আমার বন্ধু, যার নাম বিখ্যাত বিজ্ঞানীর নামে,তড়িৎ প্রবাহের সাথে যার সম্পর্ক। তো, তার তড়িৎ স্পর্শেই কিনা কে জানে, আমাদের এতোদিনের আমলনামার সঙ্গী সেই ঘণ্টা ভেঙ্গে দু টুকরো! মহা সর্বনাশ, এখন কি হবে! সবাই স্তম্ভিত হতভম্ব!

সবার আগে হুঁশ ফিরলো কলেজ কর্তৃপক্ষের- এবং কলেজীয় দক্ষতার সাথে জরুরী বিচার সভায় ওই ক্যাডেটকে দোষী সাব্যস্ত করা হল। অপরাধ গুরুতর, তাই উদার ভাবে তাকে এক্সট্রা ড্রিল এবং অর্থদন্ড দেয়া হলো। বেচারা মন খারাপ করে ঘুরছে, কবে থেকে সাজা শুরু হবে সেটা তখনো অজানা। তবে কিনা, দোষীকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সু্যোগ দেয়ার রীতি সব সভ্য দেশেই থাকে। এখানেও তার ব্যাতিক্রম হলো না। দোষীর পাশে দাঁড়ালেন আমাদের অতিশয় বিচক্ষন হাউস মাষ্টার, জনাব এবার উদ্দিন আহমেদ। তিনি তাঁর স্বাভাবিক বুদ্ধিতে আগেই বুঝেছিলেন যে, কারো একার পক্ষে একটা পেতলের ঘণ্টা পিটিয়ে ভেঙ্গে ফেলা নেহায়েৎ অসম্ভব ব্যাপার। তাঁর পরামর্শ হলো, পুরো ব্যাপারটা ব্যখ্যা করে এবং ক্ষমা চেয়ে একখানি দরখাস্ত করা। ওটা লেখার ভার দিলেন আমাকে!

এই গুরু দায়িত্ব পেয়ে আমিও বেশ ঘাবড়ে গেছি। তিনি অভয় দিয়ে বললেন যা সত্যি তাই লিখতে। বেশ খেটে খুটে একখানা লেখা দাঁড় করানো গেল, যেখানে ইনিয়ে বিনিয়ে ঘটনার পূর্বাপর বিশদ বয়ানের চেষ্ঠা ছিল। শেষে কলেজ কর্তৃপক্ষ মত বদলে, নাকি সেই দরখাস্তের বয়ান বিশ্বাস করেই কে জানে, পুরো সাজাই মাফ করে দেন। নতুন ঘন্টা আনার আগে কয়েক দিনের জন্য ল্যাম্প পোষ্টে বাড়ি মেরে কাজ চালানো হলো।

অনেক বছর পরে কলেজে রিইউনিয়নে গিয়েছি। দেখি খেলার মাঠের পাশে সেই গোলাকার বেদীতে একেবারে ধ্রুপদী মোচার খোলার মত একখানি ঘন্টা অবস্থান করছে- সূর্যের আলোয় ওর ঝকঝকে শরীর যেন আগুনের মত জ্বলছে।

৩,২০৬ বার দেখা হয়েছে

২ টি মন্তব্য : “ঘন্টা কাহিনী”

  1. খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

    চমৎকার স্মৃতিচারণ এবং সেই সাথে একটা অত্যন্ত মজার কাহিনী বর্ণনা করার জন্য ধন্যবাদ। এখন পড়তে মজা লাগলেও তখনকার সেই 'তড়িৎ প্রবাহের সাথে সম্পর্কযুক্ত বিজ্ঞানী'র কথা ভেবে মনটা কেমন করে উঠলো। তৎকালীন সেই সদাশয় হাউসমাস্টার মহাশয়কে ধন্যবাদ, তিনি তার কোমল হৃদয় দিয়ে 'ডিউটি ক্যাডেট' এর উপর নিপতিত বিপদটির কথা হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছিলেন এবং তার প্রতিকারের একটা ব্যবস্থারও বিহিত করেছিলেন। এই সৎকর্মের জন্য হাউস মাস্টারের নামটা উল্লেখ করলে ভাল হতো। ভাল কাজ চির প্রশংসনীয়।
    তোমার মত আমাকেও কলেজে অনেকের পক্ষ থেকে দরখাস্ত লিখে দিতে হতো।

    জবাব দিন
  2. মাহবুব (৭৮-৮৪)

    প্রিয় খায়রুল ভাই, আপনার মন্তব্যে অত্যন্ত সম্মানিত বোধ করছি। আপনি যথার্থ বলেছেন, ভাল কাজ চির প্রশংসনীয়। তাই লেখাটাতে স্যারের নাম উল্লেখ করে দিলাম। উনি জনাব এবার উদ্দিন আহমেদ। উনার কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার ছিল, কারন উনি সেই যুগেই অন্য একটা বৃহত্তর জগতে বাস করতেন। রেডিওতে যত বিদেশি ষ্টেশন গুলোর খবর শোনা, এবং কলেজের লাইব্রেরীতে আসা টাইমস ও নিউজ উইয়িক ম্যাগজিন দুটো খুঁটিয়ে পড়া ছিল উনার নেশা। উনার মাধ্যমেই আমরা, সেই প্রাক ইন্টারনেট যুগেই, বাইরের পৃথিবীর আভাস পেয়েছিলাম।
    আজ স্যার আমাদের মাঝে নেই, তাঁর আত্মার শান্তি প্রার্থনা করি।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মাহবুব (৭৮-৮৪)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।