বার বার তিন বার

কথায় বলে বার বার তিন বার, ইংরেজিতে দে কাম ইন থ্রিজ। বিশেষ করে ফাঁড়া গর্দিশে ইত্যাদি। তেমনি এক তিন ফাঁড়ার গল্প বলছি।

সেদিন হিউষ্টনের বিরাট চীনা বাজারে গিয়েছি। কেনাকাটা সেরে কিউতে দাঁড়িয়ে আছি। আমার আগের খদ্দের গোটা চারেক দুরিয়ান কিনেছেন। সেগুলো কাউন্টারের উপরে ডাঁই করে রাখা। এই বিশেষ ফল সম্পর্কে দুটো কথা আগে বলে রাখা দরকার। কাঁঠালের মত চেহারার এই ফল প্রাচ্যদেশীয়দের কাছে খুবই পছন্দের জিনিষ। এর গন্ধ বড্ড কড়া, তাই আমরা একে সযত্নে এড়িয়েই চলি। মালয়েশিয়ায়তো একে ফলের রাজা বলা হয়। এর গায়ের কাঁটা গুলি কাঁঠালের কাঁটার মত ভোতা নয়, বরং যথেষ্ট চোখা এবং শক্ত। লাঠির মাথায় কায়দা করে বাঁধতে পারলে গদার মত ভয়ঙ্কর যুদ্ধাস্ত্র হিসাবে বোধহয় ব্যবহার করা যাবে। যাহোক, আমার আগে দাঁড়ানো ক্রেতাটির অলুক্ষনে হাতের ধাক্কায় একটা আস্ত দুরিয়ান কাউন্টারের উপর থেকে গড়িয়ে পড়লো সোজা আমার পায়ের উপরে। স্যান্ডেল পরা পা, খোলস ছাড়া শামুকের মতই অরক্ষিত। কাঁটার খোঁচায় দু’জায়গা থেকে রক্ত বেরিয়ে এল, ব্যাথার কথা আর নাই বললাম। অঘটনের ঘটক ক্রেতাটি অবশ্যি খুবই বিব্রত হলেন, আমিও প্রানপনে মুখে ভদ্রতার হাসি এঁটে বেরিয়ে এলাম। প্রকান্ড পার্কিং লটের দূরতম কোনে গাড়ি রাখা আমার অভ্যাস। অগত্যা বহু লোকের বিস্মিত চাহনি উপেক্ষা লেংচে লেংচে সেদিকে যেতে হল। ঘরে ফিরে ব্যান্ডেইড।

পরদিন সাত সকালে আমাকে যেতে হবে ক্যালিফোর্নিয়া। রাতেই ব্যাগ গুছিয়ে রাখা উচিত হবে ভেবে সেই কাজে হাত দিয়েছি। মনে হল কদিন আগে কেনা নতুন শার্টটা এইবেলা বের করি। তা নতুন জিনিসের বায়নাক্কা অনেক। এখানে পিচবোর্ড, ওখানে প্লাস্টিক, আর ভাঁজে ভাঁজে আলপিন। মোড়কের চক্রব্যূহ ভেদ করে জামাটি উদ্ধার করে এনেছি প্রায়, এমন সময় একেবারে গুপ্ত ঘাতকের মত কোন এক চোরাই ভাঁজের ভেতর থেকে একটা আলপিন আচমকা হামলা চালাল আমার আংগুলে। ব্যাথায় কিছুক্ষন চোখে অন্ধকার দেখি। আবারো ব্যান্ডেইড। তারপর তখনকার মত ক্ষ্যান্ত দেই।

পরদিন কাক ডাকা ভোরে আমার পুরোনো গাড়িটি নিয়ে যাত্রা করি। গন্তব্য হিউষ্টন হবি এয়ারপোর্ট। যথারীতি টোল বুথে পয়সা ফেলে বেল্টওয়ে ৮ এর উপর তীরবেগে আমার পক্ষীরাজ ছোটাই। এত জোরে ছোটা বুড়ো পক্ষীরাজের বেশীক্ষন সইল না। খানিক পরই কেমন মৃগী রোগির মত থরথরিয়ে কাঁপাকাঁপি শুরু করলো। অগত্যা গতি বেশ অনেকটা কমিয়ে আনি, এবং ঠিক তখন ধুম করে একটা জোরালো শব্দ হয়। এরপরই চটিজুতোর মত ফটর ফটর শব্দ আসতে থাকে সামনে থেকে। বুঝলাম সামনের চাকা একটা ফেঁসেছে। এই অবস্থায় তো আর এগোনো যায় না। হতভম্ব ভাবটা কাটতে না কাটতে দেখি আমি বাঁ ধারের শোল্ডারে উঠে গেছি। তাই সেখানেই থেমে গেলাম। গাড়ি থেকে নেমে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্ঠা করি। দেখি আমি থেমেছি ভুল জায়গায়। মার্কিন দেশে রাস্তায় চলাচলের কায়দা কানুন আমাদের ঠিক উলটো। এখানে বাঁদিকে ফাস্ট লেন, ডানে স্লো লেন। আমি থেমেছি ফাস্ট লেনের পাশে, উচিত ছিল ডান পাশের শোল্ডারে থামা। যাহোক, এখন আর কিছু করার নেই, বরাত জোরে খুব বেঁছে গেছি। অমন কাঁপাকাঁপি করে আমাকে সাবধান না করে যদি আগেই চাকা ফাটতো তবে কি হোত বলা যায় না। সবাই মানবেন, দ্রুত গতিতে ছোটা গাড়ির সামনের চাকা ফাটা আসলেই বিপদজনক ব্যাপার। টাল হারিয়ে গাড়ি যেকোন দিকে ছুটে যেতে পারে, চাইকি ডিগবাজি খাওয়াও বিচিত্র নয়। আরেক বিপদ হল এই টোল ওয়ে, এখানে গাড়ি ছোটে সত্তর আশি নব্বই মেইল বেগে। ভাগ্যিস ওই সময় রাস্তা বেশ ফাঁকা ছিল, নইলে পেছন থেকে ছুটে আসা কারো ধাক্কায় আমার দশা হতে পারত মেসি বাবার পেনাল্টি কিক খাওয়া বলের মত।

ভোরের বাতাসে মাথা কিছুটা ঠান্ডা হল। এবারে প্রথম কর্তব্য, এদেশের সকল মুশকিল আসান ৯১১ তে ফোন করে আমার দুর্দশা জানানো। সব শুনে ওরা বললেন, টোল ওয়ের ব্যাপার স্যাপার দেখার জন্য আলাদা একটা প্রতিষ্ঠান আছে, আমি যেন তাদের সাথে যোগাযোগ করি। নাম্বর নিয়ে সেখানে ফোন করলাম। এরপর সাউথ ওয়েস্ট এয়ার লাইন্সে ফোন করে জানাই যে অমুক ফ্লাইট আমি ধরতে পারছি না। ওরা বড়ই চমৎকার, বৃত্তান্ত শুনে সাথে সাথে ঘন্টা দুই পরের এক ফ্লাইটে ব্যাবস্থা করে দিল।

বেশকিছুক্ষন অপেক্ষার পর টোল ওয়ে বিভাগের এক কর্মী মস্ত এক পিক আপে চেপে হাজির হল। ইয়া লম্বা চওড়া, পুরুষ্ঠ গোঁফধারী খাঁটি টেক্সান, দেখলেই ভক্তি হয়। বিপদে পড়া নিরীহ বাঙ্গালকে উদ্ধার করতে পেরে যেন খুশিই হয়েছে। প্রথমেই আমার গাড়ির ট্রাঙ্ক থেকে পঞ্চম চাকাটা টেনে বের করল। ওটাকে টিপে টুপে দেখা গেল হাওয়াই নেই। এরপর পিক আপের ভেতর থেকে বের হল আস্ত একটা কম্প্রেশার। চাকায় হাওয়া ভরে দক্ষ হাতে সেটাকে সামনে লাগিয়ে দেয়া হল। আমি তো যারপরনাই কৃতজ্ঞ হয়ে বখশিস দিতে গেছি। সবিনয়ে সেটা প্রতাখ্যান করে আমার হাতে একটা লিফলেট ধরিয়ে দিল। ওদের একটা কর্মচারী কল্যান সমিতি আছে, আমি যদি নিতান্ত কিছু দিতেই চাই তবে সেখানে দিতে পারি। আর পই পই করে বলল পঞ্চম চাকা নিয়ে যেন পঁয়ত্রিশ মাইলের বেশি গতিতে না চালাই।

যাক, গাড়ি তো তৈরি, কিন্তু ততক্ষনে রাস্তায় চলাচল বেড়ে গেছে। দৈতায়কার লরি থেকে নিরীহ সেডান, সবাই উর্ধঃশ্বাসে ধেয়ে আসছে। এই অবস্থায় বাম শোল্ডার থেকে তিন তিনটি লেন ডিঙ্গিয়ে সর্বডানে আসা সহজ ব্যাপার নয়। লোকটি তার প্রকান্ড পিক আপ নিয়ে পেছনে থেকে আমাকে কভার দিতে লাগল, আর আমিও একটু একটু করে ডানে সরে এলাম, এভাবে লোকটা যেন একেবারে হাত ধরে আমাকে সেই বৈতরনী পার করে দিল।

খানিকদূর গিয়েই এগজিট পেলাম। সেই ভয়াবহ টোল ওয়ে ছেড়ে এবার সাধারন রাস্তা ধরে গুটি গুটি এয়ারপোর্টের দিকে চলেছি। একসময় মনে হল নাহ, এভাবে যাবার দরকার নেই। বরং অপিসে ফিরে যাই। সেখানে গাড়ি রেখে অন্য কোন উপায়ে এয়ারপোর্টে যাওয়া যাবে। সমস্যার কথা এরইমধ্যে অপিসে জানিয়ে দিয়েছি। সেখানে ফিরতেই সহকর্মীরা ঘিরে ধরলো। আমি টোল ওয়েতে এক্সিডেন্ট করেছি এভাবে কথাটা চাউর হয়ে গেছে। আমি অক্ষত ফিরে এসেছি দেখে সবাই যেন খুব খুশি, অনেকেই ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানালেন। তাদের আন্তরিক ব্যাবহারে আমি বেশ আপ্লুত। একজন তো রীতিমত রাগ করেই বললেন, কেন আমি অমন ঝুঁকি নিতে গেছি- একটা ট্যক্সি ডাকলেই তো হত। তাঁর সেই উপদেশ আমি এখনো মেনে চলি।

যাহোক, কথায় কথায় আগের দিনের দুটো ঘটনা অর্থাৎ দুরিয়ান ও আলপিন কান্ডের কথা জানালাম। একজন তখন বেশ টেবিল চাপড়ে উল্লাস প্রকাশ করে বললেন, যাক আর ভয় নেই, ফাঁড়া কেটে গেছে। জান তো, দে কাম ইন থ্রিজ!

৪,৯৪৬ বার দেখা হয়েছে

১৮ টি মন্তব্য : “বার বার তিন বার”

  1. অরূপ (৮১-৮৭)

    প্রকৃতি কি আমাদের ক্রমাগত সতর্ক করে, আসছে সময়ের ঘটনাবলী নিয়ে। টোল রোডে কি ভয়াবহ হতে পারত অবস্থা, ভাবলেও তো ভয় লাগে।
    লেখাটা ভালো লাগলো মাহবুব ভাই।
    দানে দানে তিন দান ...


    নিজে কানা পথ চেনে না
    পরকে ডাকে বার বার

    জবাব দিন
  2. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    যাক ফাড়া কেটে গেছে।

    আপনার প্রথম দুইটা পড়ে হাসছিলাম।
    আর ভাবছিলাম আমি এতো নির্মম ক্যানো///
    তিন নম্বর টা পড়ে খারাপ লেগেছে।

    আমারো সামনের চাকা ফেসেছিলো কিনা///
    তাও আবার একাধিকবার।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
  3. লুৎফুল (৭৮-৮৪)

    ফাঁড়া কেটেছে। রক্তপাত !
    বরাবরের মতোন করুন কষ্টের বিষয় নিয়ে হাসিয়ে ছাড়লো লেখার কারুকাজ।
    আরো লেখা পড়বার তেষ্টাটা উস্কে দেয়াও হলো বেশ।
    কিন্তু নিবারন !!!

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মাহবুব (৭৮-৮৪)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।