ধরিব মৎস খাইব সুখে

নিদারুন খরায় পুড়ছে সারা দেশ। আষাঢ় শেষে শ্রাবন এসেছে, মেঘের তবু দেখা নেই। সূর্যটা যেন সারাদিন এক জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে জ্বলতে থাকে প্রচন্ড তেজে। প্রখর রোদে বাইরে কেমন ঘোলাটে দেখায়। প্রকৃতির এমন রুদ্ররূপ আমাদের অচেনা।

গরমের হাত থেকে বাঁচতে ঘরের জানালাগুলি ভারী চাদরে ঢেকে রাখা হয়েছে । চাদরে আর মেঝেতে খানিক পর পর পানি ছিটোনো হয়, তাতে ঘরের ভেততরটা মোটামুটি সহনীয় থাকে। ফারাক্কা বাঁধ চালু হবার পর থেকেই শোনা যাচ্ছিল যে দেশটা মরূভূমি হয়ে যাবে। তার উপর এই খরা যেন আসন্ন বিপর্যয়ের অশনি সংকেত। এমন ভয়ানক ব্যাপারও অবশ্য সবাইকে সমান নাড়া দেয় না। কেউ আবার উলটে আশার কথা শোনান- তা ভালই তো, আমাদের দেশেও তখন তেল পাওয়া যাবে, আমরাও সবাই ধনী হয়ে যাব। আমি অবশ্য আশাবাদী হতে পারি না, মনের ভেতরে ভয়ের কালোমেঘ জমতে থাকে। এক বিকেলে দেখি, কলেজের সীমানা পাঁচিলের পাশেই একটা খেজুর গাছ আগুনে পুড়ছে। খরার সাথে এর কোন যোগ ছিল কিনা জানিনা, তবে দৃশ্যটা অনেকেরই মনে ভয় ধরিয়েছিল। সরবে নীরবে আকাশপানে মানুষের আর্তি উঠে আল্লাহ মেঘ দে পানি দে…

অনেক দিন পর, যেনবা এক যুগ পর, অবশেষে আকাশে মেঘের ভেলা ভেসে আসে। প্রথমে বিচ্ছিন্ন ছেড়া ছেড়া ভাবে, নীচের ঐ বিরান তৃষ্ণার্ত মাটির দিকে চেয়ে যেন লজ্জায় পালিয়ে যায়। আবার ফিরে আসে, এবারে দুরন্ত অশ্বারোহীর মত দলেবলে, এবং সমস্ত আকাশটাকে অনায়সে ছেয়ে ফেলে। প্রবল পুরুষের মত ঝাঁপিয়ে পড়ে বিরহীনি ধরিত্রীর বুকে, উজাড় করে দেয় বয়ে আনা জলদ সম্ভার। বর্ষন সঙ্গীতে ডুবে যায় চরাচর। অনন্তকাল ধরে যে মহাসঙ্গীত বেজে চলেছে প্রকৃতিতে, তারই সামান্য আভাস যেন পেয়েছিলাম তখন। তাই হয়তো বর্ষাঘোর আমার আর কখনোই কাটেনি।
কিছুকাল পরের কথা, যখন সবকিছু প্রায় স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। কলেজের সাপ্তাহিক ডিডিপি তে উপস্থিত বক্তৃতার পালা। জনৈক সিনিয়র ভাইয়ের ভাগ্যে বক্তৃতার বিষয় পড়ল “খরা”। তিনি বক্তব্য শুরু করলেন অনেকটা এভাবে- “সেবার ট্রেনে চড়ে বাড়ী যাচ্ছি। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে হঠাৎ দেখি খোরা”। ত্যাঁদড় জুনিয়রেরা শুনল “কোরা”, এবং এই উদ্ভট শব্দটি জয়টিকার মত তার নামের শোভা বর্ধন করতে থাকল বহুকাল ধরে।

খরার পরে সারা দেশে খাল কাটার ধুম। খায়বার হাউসের পেছনে ছিল একটা পুকুর, অনেক দিনের অবহেলায় হেজে মজে গেছে। কলেজ কর্তৃপক্ষ স্থির করলেন ওটাকে আবার কাটাতে হবে। এক শুভদিনে সাড়ম্বরে শুরু হল পুকুর কাটার পালা। ক্যাডেট, শিক্ষক, কর্মচারী সবাই কোদাল আর ঝুড়ি হাতে হই হই করে লেগে গেলেন সেই কাজে। মাইকে উদ্দীপনাময় সঙ্গীত, মাঝে মাঝে বিবৃতি, হাস্যকৌতুক, বিরতিকালে উত্তম ভোজের ব্যাবস্থা- সব মিলিয়ে বেশ উৎসবের আমেজ। আমরাও দেশের কাজ করছি জেনে প্রানপনে কোদাল চালাচ্ছি। কতক্ষন এই উৎসব চলেছিল মনে নেই, তবে দিন শেষে অনেকেই হাতে ফোস্কা নিয়ে ঘরে ফিরেছে। কিন্তু এভাবে তো বেশিদিন চালানো যায় না। কলেজ কর্তৃপক্ষ অচিরেই এটাকে আরো একটা আন্তঃ হাউস প্রতিযোগীতার রূপ দিয়ে ফেললেন, যার নাম হল “ইন্টার হাউস পন্ড ডিগিং কম্পিটিশন”।

এবার বিষয়টা হল হাউস মাষ্টার আর হাউস লিডারদের মাথা ব্যাথা। তাঁদের সযত্ন পাহারায় রোজই কোন না কোন ক্লাসের ছেলেদেরকে বিকালের খেলাধুলা বাদ দিয়ে পাঠানো হতে লাগলো ওই কাজে। বলাই বাহুল্য ব্যাপারটা মোটেই আনন্দের ছিল না। কাজে ফাঁকি দেবার জন্য কেউ কেউ সাজাও পেতে লাগল। আমি বিরক্ত হয়ে নাম দিলাম “ইন্টার হাউস গ্রেভ ডিগিং কপমিটিশন”। ব্যাপারটা ঠিক কিভাবে শেষ হয়েছিল তা মনে নেই। আমাদের এত ঘাম ঝরানোর পরও পুকুরের চেহারায় তেমন বিরাট কোন পরিবর্তন দেখা গেল না। মনে হয় এক পর্যায়ে শ্রমিক নিয়োগ করা হয়েছিল। যাহোক, এক সময়ে সত্যি সত্যিই একটা পকুর তৈরি হল।

জলে ভরা আস্ত একটি পকুর, সুতরাং মাছের চাষও এসে গেল। পোনা ছাড়া হল, সেগুলো ধীরে ধীরে বেড়ে উঠতে লাগল। আর আমাদের মাথায় ওই মাছে চড়ুইভাতি করার দুর্বুদ্ধি খেলা করতে লাগল। অবশেষে এক সন্ধ্যায়, যখন সবাই গেছে মাগরেবের নামাজে, তখন “ধরিব মৎস খাইব সুখে” এই দূর্জয় চেতনা বুকে ধারন করে পাঁচ-ছ’ জনের এক দুঃসাহসী দল অভিযানে নেমে পড়ল। এরা সবাই সাঁতারে পটু, মাছ শিকারের অভিজ্ঞতাও নাকি যথেষ্ঠ। হাউস লীডার, ডিউটি মাষ্টার প্রমুখদের শ্যেন দৃষ্টি ফাঁকি দিয়ে, এবং নামাজ থেকে সবাই ফিরে আসার আগেই অভিযান শেষ করতে হবে। কাজটায় রোমাঞ্চ যত, ঝুঁকি তার চেয়ে বেশি। ধরা পড়লে এক্সট্রা ড্রিল তো বাঁধা, বহিষ্কারও বিচিত্র নয়। বড়শী ফেলার মত সময় তো নেই, তাই জালের বিকল্প মশারী হাতেই ওরা কাজে নেমে পড়ে। আমরা যারা এই অভিযানের কথা জানি তারাও বেশ উত্তেজনা বোধ করছি, কিছুটা স্নায়ু চাপেও আছি। মসজিদে ইমাম সাহেবের সুমধুর তেলাওয়াত কানে ঢুকছে না। নামাজ শেষে এক ছুটে সবাই যে যার হাউসে।

হাউসে গিয়ে দেখি ব্যাপার চমৎকার। দুঃসাহসী বন্ধুরা ততক্ষনে কাপড় চোপড় পরে নাইট প্রেপের জন্য তৈরি। কিন্তু পানিতে ডোবাডুবি করে সবার চোখ লাল। এবং অভিযান সম্পূর্ন ব্যার্থ। একটা পুঁটিমাছও জালে ধরা পড়েনি। বিমর্ষ হয়ে সবাই ভাবছে কেন এমন হল! ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে রহস্যজনক। অবশেষে সেই দলেরই একজনের কথায় রহস্যভেদ হয়। হঠাৎ করেই তার স্মরনে আসে, ধন্য তার স্মৃতিশক্তি, ঠিক একদিন আগেই জেলেরা এসেছিল। বেড়জাল ফেলে পুকুরের সব মাছ নাকি ওরাই ধরে নিয়ে গেছে। এই তথ্যটি বেশ হাসিমুখেই সে পরিবেশন করে। অভিযানে ওর ভুমিকা ছিল পাহারাদারীর, পানিতে ডুবে ডুবে হয়রান হয়েছে বাকি কয়জন। বলাই বাহুল্য এই “ইণ্টেলিজেন্স ডিজাষ্টারের” উপযুক্ত পুরষ্কার, যেমন অকৃপন মুষ্ঠিযোগ, ওর পাওনা হয়ে যায়। তবে সুখের কথা, আমার বন্ধুরা সবাই পাঁড় জ্যেন্টলমেন। স্পোর্টসমেন স্পিরিট ছিল তাদের জীবন দর্শন। তাই, দু’চারটে মোলায়েম গালাগালিতেই ব্যাপারটা শেষ হয়। আর আমরাও বিস্তর হাস্যকৌতুকের রসদ পেয়ে যাই।

৫,৮৫৮ বার দেখা হয়েছে

৩৪ টি মন্তব্য : “ধরিব মৎস খাইব সুখে”

      • পারভেজ (৭৮-৮৪)

        গতকাল ক্লাবে বসে এই লিখাটা যখন পড়ছিলাম, ইকরাম ছিল সামনে।
        মশারিগুলোর সোর্স সম্পর্কে তখন ওর কাছ থেকে জানলাম।
        তখন নাকি এইচএসসি ক্যান্ডিডেটরা মানে আমাদের ইমিডিয়েট সিনিয়ার ব্যাচ পরীক্ষা-পূর্ব দীর্ঘমেয়াদি প্রিপারেটরি লিভ-এ ছিলেন।
        তাদের মশারিগুলোই এই মাছ ধরার কাজে ব্যার্থ ব্যবহার হয়েছিল।
        যাঁদের মশারি নেয়া হয়েছিল তারা হলেন: শামিম ভাই, তানভির ভাই, আনোয়ার কামাল ভাই ইত্যাদি ইত্যাদি......

        কী। ঠিক নাকি???


        Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

        জবাব দিন
  1. তানভীর (২০০১-২০০৭)

    জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে হঠাৎ দেখি খোরা”। ত্যাঁদড় জুনিয়রেরা শুনল “কোরা”, এবং এই উদ্ভট শব্দটি জয়টিকার মত তার নামের শোভা বর্ধন করতে থাকল বহুকাল ধরে।
    :)) :)) :))
    মজা পেলাম।
    “ইন্টার হাউস পন্ড ডিগিং কম্পিটিশন”- ব্যাপারটা অবাক করারমত!!!! ভাবতেই পারছিনা এমন একটা কম্পিটিশনের কথা কার মাথাথেকে আসলো... 😕
    কিন্তু আপনার স্মৃতিচারণ করার একটা খোরাক কিন্ত এই আজব ব্যাপারটাই ঘটিয়েছে।
    আমাদের জন্য সবচেয়ে লোভনীয় ছিলো প্রিন্সিপ্যাল স্যারের, গার্ডেনের পেয়ারা। কলেজে এতগুলান পেয়ারবাগান থাকতে ওই বাগানের পেয়ার না খেলে আমাদের মন ভরতো না।
    প্রিন্সিপ্যাল স্যারের অফিস আর টেনিস গ্রাউন্ডের মাঝের আম বাগানও আমাদেরকে প্রিয়তে ছিলো।যদিও ওই আম বাগান আমাকে কাচা আম ও ইডি দু'হাত ভরে দিয়েছে...... :brick:


    তানভীর আহমেদ

    জবাব দিন
    • পারভেজ (৭৮-৮৪)

      একটু পরিচয় করিয়ে দেই...
      সর্ববামে,ডান হাতে ঝুড়ি ধরা পেডিয়েট্রিশিয়ান ডাঃ আরিফুর রহমান!!!
      আরিফের ডানে যে দুজন ঝুড়িতে করে মাটি নিয়ে আসছে তাদের বামের জন ডঃ এএসএম মমিনুজ্জামান, প্রফেসর, ইইই, বুয়েট।
      ডানের জন মেজর (অবঃ) শরিফুল ইসলাম।
      ওঁদের একটু সামনে মাটি ভর্তি ঝুড়ি হাতে হাসিমুখে জনাব আবুল কাশেম মহিউদ্দিন, বিসিএস (এডমিন), শীঘ্রই সাতক্ষিরার ডিসি হিসাবে যোগদান করবেন।
      পিছন ফিরে যিনি তা দেখছেন: ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোঃ কামরুজ্জামান
      তাঁর পাশে বাম হাতে কোদাল ধরা: ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবঃ) শফিক শামিম, ডিএমডি সেনাকল্যান ইনশিওরেন্স।
      শামিমের পাশে কুজো হয়ে ঝুড়ি তুলছে, আমাদের বন্ধু মিকাইল শিকদার, এসএসসির পর যার পক্ষে ফিরে আসা আর সম্ভব হয় নাই।
      জানা যায়, গ্রাম্য পারিবারিক কোন্দলে ঐ ভ্যাকেশনে তাকে খুন করা হয়েছিল... 🙁 🙁 🙁 🙁 🙁


      Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

      জবাব দিন
      • পারভেজ (৭৮-৮৪)

        পুলকিত!!!
        😀 😀 😀
        বাই দ্যা ওয়ে, আরেকজনের সাথে পরিচয় না করালেই নয়।
        এই ছবির সর্বডানেরজন, বামে মুখ করে আছে যে, সে হলো আমার বন্ধু ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাজ্জাদ।
        একসময় আমাদের কলেজের প্রিন্সিপালও ছিল সে। এখন সাভারে আছে.........


        Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

        জবাব দিন
        • তানভীর (২০০১-২০০৭)

          সহমত পোষণ করছি, মোস্তাফিজ ভাই আপনার মন্তব্যের সাথে।
          ক্যামনে পারেন পারভেজ ভাই......????!!!!!
          ছবিটির কালেকশন দেখে খুব অবাক হয়েছি কারণ আমি আমার মন্তব্যে মাহবুব ভাইকে বলেছিলাম এমন একটি অজব ব্যাপার কি ভাবে বা কার মাথাথেকে এসেছিল.... এখনতো ছবি দেখে পুরাই আমি তাজ্জব।
          সকলের পরিচিত পর্বটাও দারুণ!!!
          অফটপিক : এবার দেশে আসলে ডিসি ভাই এর সাথে দেখা করুমনে যতই হোক আমার শহরের অভিবাবক বলে কথা। আবার গতকয়েক বছরে এই শান্ত মফস্বলটিই নানান কারনে বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠায় একটু ভয় ভয় লাগছে।আশাকরি তার অবস্থান সুখকর হবে। (সম্পাদিত)


          তানভীর আহমেদ

          জবাব দিন
  2. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

    হা হা...পড়ে দারুণ মজা পেলাম, মাহবুব ভাই! :))
    আমাদের ভাগ্য ভাল শুধু ভেজিটেবল+ফ্লাওয়ার গার্ডেনিং করতে হয়েছে, কোন পন্ডিং করতে হয় নি... 😀


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন
  3. লুৎফুল (৭৮-৮৪)

    গল্পের শেষ নাই। সুদূর অতীতের সবগুলো দিন এক নয় একাধিক গল্প।
    অনবদ্য। পড়াতেই তো শেষ নয়। তারপর অন্তহীন সময় ধরে চলমান থাকে জাবর কাটা।
    ম্যুভি ট্রেলারের মতোন মনের পর্দায় চকিতে ভেসে ওঠে কতো কি !

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : তানভীর (২০০১-২০০৭)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।