সাদা বাড়ীর রহস্য

ইউনিভার্সিটি এভেন্যুর এক ধারে বিরাট ক্যাম্পাস, অন্য ধারে গরিব মহল্লা। লোকে বলে টেক গেটো। কথাটা একেবারে উড়িয়ে দেবার মত নয়। সারা এলাকা জুড়ে সারি সারি আপরিচ্ছন্ন জরাজীর্ণ বাড়ি, সামনে পেছনে জং ধরা তারের কি রংচটা কাঠের বেড়া, আর কাঁটা ঝোপের জঙ্গল। সাথে মানানসই পুরোনো ঢাউস গাড়ি, লোম উঠা কুকুর, ভাঙ্গাচোরা যন্ত্রপাতি। মার্কিন দেশের ঝাঁ চকচকে চেহারাটা এখানে খুঁজে পাওয়া যাবে না। এখানে থাকে যত বিদেশী ছাত্রছাত্রী। আর থাকে নিম্ন আয়ের স্থানীয় লোকজন, যাদের বেশীরভাগই হচ্ছেন কালো ও বাদামী অর্থাৎ কিনা হিস্পানিক। আমার ছাত্রজীবন কেটেছে এই গেটোতে, আভিজ্ঞতাও হয়েছে বিচিত্র। আস্তে ধীরে বলার আশা রাখি।
৭নং সড়ক আর ইউনিভার্সিটি এভেন্যুর মোড়ে একটা সাদা বাড়ি। সেখানে থাকে দুই আরব দেশী ছাত্র- একজনের দেশ লিবিয়া, অন্য জনের জর্দান। ওইপথে যথেষ্ট হাঁটাচলা ছিল। একদিন দেখি বাড়ীর সামনে ছোটখাট একটা ভীড়। গোটা দুই পুলিশের গাড়ি আর জনা চারেক অফিসার। বিশাল চেহারা, জমকালো ইউনিফর্ম, কোমরে গোঁজা পিস্তল, হাতে ওয়াকিটকি- সব মিলিয়ে বেশ সমীহ জাগানো ব্যাপার। লিবিয়ার লোকটা একে ভূতাত্ত্বিক, নানা বিদঘুটে যায়গায় ঘুরে বেড়ানোই ওর কাজ। তার উপর আবার আমারিকা থেকে দেশে যাবারও তেমন সুবন্দোবস্ত নেই। তার চালচলনও তাই কেমন গোলমেলে- মাঝে মাঝেই যেন কোথায় গায়েব হয়ে যায়। আর জর্দানী ছাত্রটি আরেক কাঠি সরেস। বিয়ে করেছিলেন স্থানীয় এক মহিলাকে, একটি ফুটফুটে মেয়েও হয়েছে। এরপরে টানাপোড়েন ঝঞ্ঝাট শুরু। এক সুন্দর সকালে, অর্থাৎ কিনা ওয়ান ফাইন মর্নিং, মেয়েটিকে বগলদাবা করে নিজ দেশে দে চম্পট। ওদিকে মেয়ের মা শুরু করেছে তোলপাড়। পুলিস এফবিআই হয়ে শেষে মিডিয়াতেও খবর এলো। এক সন্ধ্যায় টেলিভিশনে হঠাৎ দেখি “মোষ্ট ওয়ান্টেড” শিরোনামে ভাইজানের ছবি। ছোট শহরের জন্য যথেষ্ট উত্তেজক ব্যাপার। তো, এমন দুই বিশিষ্ঠ ব্যাক্তি যেই বাড়ীর বাসিন্দা, সেই বাড়ীর সামনে পুলিশের গাড়ি দেখলে নানা বিচিত্র সন্দেহ ও কৌতুহল হতেই পারে। শাস্ত্রে বলে অতি কৌতুহল বিপদজনক। তবু ব্যাপার কি দেখার জন্য ভিড়ে মিশে দাঁড়াই। বিশেষ ওই বাড়িতে কিছুদিন ধরে আরো দুজন উঠেছে, তার মধ্যে একজন আবার বাঙ্গালী।
খানিক দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা যেন আঁচ করতে পারলাম। বাড়ির জানালায় অসংক্ষ্য মাছি ভন ভন করছে। ভেতর থেকে ভেসে আসছে ভয়াবহ পঁচা দূর্গন্ধ। ব্যাপার দেখে পাড়া প্রতিবেশিদের কেউ পুলিশে জানিয়েছে। কে জানে কি ব্যাপার- খুন টুন বা আত্মহত্যাও অসম্ভব না। এদেশে পুলিশ অতিশয় কর্তব্য পরায়ন, আর এই ছোট শহরে সচারচর তেমন সাঙ্ঘাতিক কিছু ঘটেও না। অফিসার ক’জন বাড়ির চারদিক ঘুরে ঘুরে দেখছে আর ভীড়ে দাঁড়ানো লোকজনকে নানান প্রশ্ন করছে। এ বাড়িতে কে কে থাকে? শেষবার ওদের কোথায় দেখা গেছে? যাকে দেখা গেছে তার মনের অবস্থা কেমন ছিল? ইত্যাদি। পুলিশের খাতায় এ বাড়ির কথা নিশ্চয়ই কিছু ছিল, তাই তদন্তটাও বেশ ঘটা করেই চলছে। বাড়ী তালা দেয়া, মালিককে খবর দেয়া হয়েছে।
তা সেই লিবীয় বা জর্দানী তো বেশ ক’দিন যাবত তল্লাটেই নেই। আছে এক বাঙ্গালী ও এক ভারতীয় ছাত্র। জানা গেল ওরা এলাকাতেই আছে, মানে ছিল আরকি। কিন্তু এই মুহুর্তে যে ওরা কোথায় তা কেউ বলতে পারছে না। ভীড়ে দু’একটা ছাত্রও ছিল। পুলিশ পড়লো তাদের নিয়ে। জেরা করে নিখোঁজ ছাত্র দুটির হদিস পাওয়া গেল। সেই যুগে মুঠোফোনের ব্যাপক চল হয়নি। ওরা যে ডিপার্টমেন্টের ছাত্র সেখানে ফোন করা হোল। বেশ কিছুক্ষন অপেক্ষার পর ওধার থেকে জবাব এল, যে ওরা ক্লাশে নেই। ডিপার্টমেন্টের কোথাও ওদের দেখা যাচ্ছে না। আর যে বিরাট ক্যাম্পাস সেখানে কাউকে খুঁজে বার করাও চাট্টিখানি কথা না।
অফিসারদের চাউনি ধারালো হয়ে উঠে। এবার কি করা। নিজেদের মধ্যে পরামর্শ, হেড অপিসে যোগাযোগ চলে আরো কিছুক্ষন। বাড়ীর মালিক এসে গেছেন, ব্যাপার দেখে তিনিও ভ্যাবাচেকা। চাবি বোধ হয় তার কাছে ছিল না। অবশেষে দরজা ভেঙ্গে ভেতরে ঢোকা সাব্যস্ত হলো। সামনের দরজা ভাঙ্গা কঠিন, পেছনে রান্নাঘর লাগোয়া দরজাটা শুধু ভেতর থেকে শেকল দিয়ে আটকানো। কাজেই সেদিক দিয়েই ঢোকা সহজ হবে। পুলিশের একেবারে লাইভ একশন দেখার লোভে আমরাও পেছনে জুটেছি।
ঠিক যেমন ছবিতে দেখা যায়, কায়দা মাফিক পিস্তল ধরা হাত দুটো নব্বই ডিগ্রিতে উপরে তোলা, দরজার আড়ালে পজিশন নেয়া, তারপর সাঁই করে ঘুরে প্রচন্ড লাথি। পটাং করে শেকল ছিঁড়ে গেল। এবার সোজা সামনে পিস্তল বাগিয়ে সাবধানে প্রবেশ। দু’জন ভেতরে, দুজন বাইরে। আম জনতা বাইরে একবারে রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছি।
একটু পরেই বিরক্তমুখে অফিসার দু’জন বের হলেন, এবং খাঁটি টেক্সাসীয় ঘরানায় (নির্লিপ্ততা, কৌতুক ও ভাষার টানের অপরূপ মিশ্রন) ঘোষনা করলেন- “ইট’স আ ডেড চিকেন!”
ব্যাপার কি খুলে বলা যাক। ভাইজানেরা ওই বাড়ীতে একটা ছোট খাট ব্যাবসাও চালাতেন। এই যেমন চাল ডাল আটা ময়দা খেজুর বাক্লাভা ইত্যাদি, এবং হালাল মীট। ঘরে একটা প্রকান্ড ডিপ ফ্রিজ, তার ভেতরে কাটা কিংবা আস্ত মুরগি, ভেড়া, খাসী ইত্যাদি রাখা হত। ক’দিন আগে নতুন চালান এসেছিল। ফ্রীজে ভরার সময় কিভাবে যেন একটা আস্ত মুরগী বাইরে পড়ে যায়। মারফির সুত্র মেনেই সেটা আশ্রয় নেয় ফ্রিজ ও দেয়ালের মাঝখানের সরু গলিতে। সবার অলক্ষ্যে সেটা পঁচতে থাকে, এবং যথাসময়ে মছি ও পড়শীদের নায্য মনোযোগ আকর্ষন করে।
ঘটনার মধ্যে তেমন অসাধারন কিছুই নেই। তারপরো, প্রশ্ন একটা থেকেই যায়। যেই দুর্গন্ধে পাড়া পড়শী কিনা অতিষ্ঠ হয়ে পুলিশ ডাকে, সেই দূর্গন্ধ ওই বাড়ীর দু দু’জন জলজ্যান্ত বাসিন্দা টেরও পেল না- তা কি করে হয়! বিশেষ ওই দুজনের একজন আবার বাংলাদেশের অতিশয় সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে। বলতে কি, তার উচ্চ বনেদীয়ানার ঠেলায় আমরা আম জনতা সবাই অল্পবিস্তর কাতর ছিলাম। ক্লাশ থেকে ফিরে যখন সে ঘটনা শুনলো, তার প্রতিক্রিয়া হয়েছিল অবিশ্বাসের অট্টহাসি!

১,৫২৮ বার দেখা হয়েছে

৮ টি মন্তব্য : “সাদা বাড়ীর রহস্য”

  1. লুৎফুল (৭৮-৮৪)

    দারুন ।
    এমনিতেই এমন একটা জায়গায় গিয়ে কিছুদিন নিরুদ্দেশ বসবাসের একটা সুপ্ত ইচ্ছা বহু বহু দিনের ।
    শুরুতেই সেই রকম এক খান ছোটো শহর রংচটা ফেন্সিং-এর বাড়ী ঘর এসবের আভাস পেয়ে জিভ চুক চুক অবস্থা ।
    লেখার ঢংয়ে ফুরুত করে একটানে পড়া হয়ে গেলো শেষ ।
    অবস্থাটা এখন রাতের শেষ প্রহরে প্রচন্ড ক্ষুধার্ত অবস্থায় এটা আবিস্কার করার মতো যে, বাড়ীতে রান্না করা কোনো খাবার তো দুরের কথা টিন ফূড ও নেই তেমন অন্তত চাল-ডালও নেই যে ফুটিয়ে গিলবো ...
    ভুখার অপেক্ষায় ডুব দিলাম আপাতত ...

    জবাব দিন
  2. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    :khekz: :khekz:
    ঘটনা যা না মজার, আপনার বর্ণনার গুনে তার থেকে বেশি মজা পেয়েছি


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : সাইদুল (৭৬-৮২)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।