মাছ বিভ্রাট

বিশাল হিউষ্টন, বিশালতর টেক্সাস। এখানে এলোপাতাড়ি ঘোরাঘুরি সোজা নয়। হুটহাট বেরিয়ে যাওয়া চলে না, রীতিমত প্ল্যান প্রোগ্রাম করতে হয়। লাগে প্রচুর সময়, এবং বেশ শক্ত পোক্ত একখানা গাড়ি। সঙ্গীসাথী জোটানো আরো কঠিন- এর চাকুরি তো ওর সর্দি, বাচ্চাকাচ্চাদের ব্যাপার তো লেগেই আছে সারা বছর। অগত্যা কবির বাণী ভরসা- একলা চলো রে। একে সময় কম, তায় পুরনো গাড়ী। তাই বিকেল-সন্ধ্যে-উইকএন্ডের ঘোরাঘুরি সীমিত রাখি ক্লিয়ারলেক, কেমা, গ্যালভাষ্টন, কেটি, উডল্যান্ড এসব কাছে ধারের জায়গা গুলোতেই।
গ্যালভাষ্টন বে থেকে একটু ভেতরে ক্লিয়ারলেক বলে ভারি সুন্দর একটা লেক আছে। অমন জায়গায় যা হয় সচারচর- ছবির মত ছিমছাম ছোট শহর, জেটিতে বাঁধা সারি সারি ইয়ট, থিম পার্কে কাচ্চাবাচ্চা সহ মানুষের ভীড়- সব মিলিয়ে বেশ মেলা মেলা ভাব। বিস্তীর্ন এলাকা জুড়ে লেক, আনাচে কানাচেও জলময় হাত বাড়িয়ে রেখেছে। ফলে উড়ালপুলের নীচে, রেস্তোরাঁর পৈঠায়, পার্কিং লটের পাশে সব জলে জলময়। আনাচে কানাচে বড়শি ফেলে মাছ ধরে অনেকে। ছাতা, ফোল্ডিং চেয়ার, আর পোঁটলার বহর দেখে বোঝা যায় বেশ তৈরী হয়েই এরা এসেছে- সারাদিন থাকবে বলে। লেকের কিনারা ঘেঁসে কাঠের পাটাতন বিছানো হাঁটা পথ অর্থাৎ কিনা বোর্ডওয়াক। বিকেলের দিকে সেখানে হাঁটতে বেশ লাগে। একদিকে লেকের উদার বিস্তার, উল্টো দিকে সারি সারি রেস্তোরাঁ। কোথাও আবার বিরাট বৈয়ামে রাখা মাছের খাবার। বাচ্চারা সেই খাবার কিনে পানিতে ছুঁড়ে দেয়। অগুন্তি মাছের হুটোপুটি লেগে যায় তখন। বাচ্চারা চোখ বড় বড় করে সেই দৃশ্য দেখে আর আনন্দে উত্তেজনায় চীৎকার করে। খেলনা রেলগাড়িটা বাচ্চা বুড়ো সব নিয়ে খানিক পর পর চক্কর দিচ্ছে। ওদিকে রেস্তোরাঁগুলো লোকে গিজ গিজ, ভেসে আসছে হাল্কা বাজনার শব্দ, হাসির হররা, আনন্দ কোলাহল, আর জিভে জল আনা ভাজাভুজির ঘ্রান। সন্ধ্যায় আলো জ্বেলে দিলে পুরো জায়গাটার চেহারাই পালটে যায়। তার উপরে যদিবা উঠে চাঁদ- কেন জানিনা টেক্সাসে চাঁদটাকে যেন একটু বড়ই দেখায়, সাধু সাবধান!
আর আছে মাছের বাজার। পরিবেশ উপভোগ করার সাথে উপরি পাওনা। কোন মৎসবিলাসী বঙ্গসন্তান তা উপেক্ষা করতে পারে! তাই সু্যোগ পেলেই ওদিক পানে বেরিয়ে পড়ি। এদিকটায় বালিয়াড়ি সৈকত নেই, সব ঘেসো জমি বলে ধূলোবালির যন্ত্রনাও নেই। জায়গা মত গাড়ি রেখে চক্কর মারি আশেপাশে। মাছের বাজারে যাই বেশ ঘটা করে। ছোটবড় চিংড়ী, তাজা ক্যাটফিশ, বাফেলো, স্মেল্ট, কার্প থেকে স্কুইড অক্টোপাস- আয়োজন বিচিত্রই বটে। মাছ দেখলে আবার আমাদের কারো কারো বাহ্যজ্ঞান লোপ পায়। ঝাঁপ খেয়ে পড়ি আর কিনতে থাকি, ক’দিনে ওগুলো শেষ করা যাবে, ঘরে আরো আছে কিনা- এসব আর মনে আসে না। শোলার বাক্সে বরফ দিয়ে তাতে মাছ ভরে নিয়ে আসি। তারপর কাটা বাছা রান্না বান্না আর হই হই করে খাওয়া। বাকিটা যায় ফ্রিজে, আর ফ্রিজের পুরোনা মাছ যায় ময়লার ঝুড়িতে।
এই চক্করে বেশ ভালোই দিন যায়। একবার অবশ্য সামান্য একটা বিভ্রাট হয়েছিল। সেদিন যথারীতি ঘোরাঘুরি সেরে ফিরছি। ট্রাঙ্কে বাক্স বোঝাই মাছ। আই-১০ থেকে এগজিট নেবার পর পরই নব্বই ডিগ্রি বাকঁ, সেটা ঘোরার সময় পেছনে ধুরুম শব্দ। বুঝলাম বাক্স উল্টেছে, তবে এর মর্ম তখন ঠিক বুঝিনি। বাড়ি গিয়ে মাছেদের সদগতি করা হল। ট্রাঙ্কের ভেতরটা ভেসে গেছে। তবে বরফ গলা জল আর কি ক্ষতি করবে ভেবে তখন কিছু করলাম না। পরদিন অপিসে যাবার জন্য গাড়িতে চেপেই খেলাম বিকট গন্ধের ধাক্কা। নিরীহ বরফ গলা জলে মিশেছে মাছের নানা উপাদান। সেই অর্গানিক পাঁচনের শক্তি এবার ভালো রকম টের পেলাম। কিছু করার সময় নেই তখন, পরে দেখা যাবে ভেবে কোন রকমে সেদিনের মত কাজে গিয়েছি। সহকর্মিদের কেউ এক বিশেষ স্প্রে ব্যাবহার করার বুদ্ধি দিলেন। ফেরার পথে সেই টোটকা জোগাড় করলাম। গাড়ির ভেতরে বাইরে ভালোমত তা ছিটিয়ে সেদিনের মত ক্ষান্ত।
প্রথম দিন যদি খাই ধাক্কা, পরদিন খেলাম আছাড়। জৈব-রাসায়নিক কোন জটিল বিক্রিয়ার ফলে আমার গাড়ির ভেতরে বাইরে এক অপূর্ব গন্ধ হয়েছে। বিজ্ঞানে এর কোন নাম নেই, মৌলিক আবিষ্কারও হতে পারে- প্যাটেন্ট করার যোগ্য। তো সেই গন্ধবাহন চালিয়ে গেলাম সবচেয়ে কাছের পেট্রল পাম্পে। এক কোনে জল-হাওয়ার ব্যাবস্থা আছে। ট্রাঙ্ক খুলে ভেতররটা সাবান জলে ভালো মত ধোয়ার চেষ্ঠা করছি। কড়া রোদ সেদিন। দোকানের কৌতুহলী কর্মচারি দু’এক জন এসে সান্তনা দিচ্ছে। যাহোক ঘন্টা কয় সাধনায় অবস্থার বেশ উন্নতি হলো। তখনকার মত চললাম অপিসে। বিকেলে ফেরার পথে দেখি নতুন বিড়ম্বনা। আগের সেই সৌরভের সামান্য রেশ তখনো ছিল, তার সাথে যোগ হয়েছে চরম ভ্যাপসা ভাব। এখন মোল্ড ধরবে না জং সেই ভাবনায় পড়লাম।
দশতলা অপিস বিল্ডিং, তার পাশে ছ’তলা পার্কিং। পরদিন পার্কিং লটের এক্কেবারে ছাদে গিয়ে উঠলাম। চার দরজা ও ট্রাঙ্ক হাট করে খুলে রেখেই কাজে চলে এলাম। রোদে কাপড় মেলার মত গাড়ি মেলা আরকি। বিভিন্ন তলার বাসিন্দারা মাঝে মাঝে বিস্মিত হয়ে জানালায় উঁকি দিচ্ছে। সেই কালে নিরাপত্তা নিয়ে তেমন সাংঘাতিক মাথাব্যথা ছিল না। তাই ছ’তলার ছাতে ভগ্নদূতের মত একটা গাড়ি রোদ পোয়াচ্ছে দেখে বেশ মজা পেল অনেকে- এর বেশি কিছু না। আজকাল হলে বোধকরি পুলিশে খবর দেয়া হত। যাহোক এভাবে দিন দুই ভাল রকম রোদ পোহানোর পরে গাড়ি আবার চড়নসই হলো।
ব্যাপারটা সেখানেই শেষ হলে ভাল ছিল, কিন্তু হয়েও হইল না শেষ। মাস খানেক পরে দেখি, ট্রাঙ্কের ভেতরে যে ক’খানা খুচরো কলকব্জা ছিল সেগুলি জং লেগে জবরজং!

২,৪১২ বার দেখা হয়েছে

১৮ টি মন্তব্য : “মাছ বিভ্রাট”

  1. লুৎফুল (৭৮-৮৪)

    আহা ! আস্ত সেই সব মছ ভাজি আর নানান পদের কারি !
    কি করে যে কি করি ... মেছো ভুতে ডাকছে আমাকে ...
    তবে গাড়ী বেচারা ... মনটা থেকে থেকে খারাপই করে দিচ্ছিলো ...

    রেশ টেনে যেতে হবে আরো বহু দিন ...

    জবাব দিন
  2. সাবিনা চৌধুরী (৮৩-৮৮)

    আমি মাছ ধরতে খুব ভালবাসি। সামার এলে দু'একবার তো মাছ ধরতে যাওয়া চাইই। বছর তিনেক আগের কথা। বড়শীতে মাছের পাশাপাশি একখানা শিশু কচ্ছপ ধরা পরেছে। আমার কন্যা আহা উহু করে সেটিকে বাড়ি নিয়ে এলো। ঘরের ছোট একুইরিয়ামে তার থাকার ব্যবস্থা হলো। পেট সুপারমার্কেট থেকে খাবার কিনে নিয়ে এলাম। তিনদিন পর ঘুম ভাংতেই বিকট একটা গন্ধ নাকে লাগলো। মা-মেয়ে পুরো বাড়ি খুঁজছি সম্ভাব্য প্রেডিটরটিকে। কিছুই খুঁজে না পেয়ে ঘরের কোণে গিয়ে বুঝতে পারলাম ব্যাপারখানা কি।

    পানি সহ একটা ব্যাগে ভরে অতঃপর কচ্ছপটিকে বাড়ির কাছের লেকে ছেড়ে দিয়ে আসি। পুরো বাড়ির দরজা জানালা খুলে দিয়ে রজনীগন্ধার স্প্রে করেছিলাম, সুগন্ধি মোম জ্বালিয়ে রেখেছিলাম ক'দিন।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।