স্বর্গের কিনারায়

১. গড়ুড়

গড়ুড়ের পিঠ নয়, পেটের ভেতর থেকে আমরা জনা শ’য়েক মানব সন্তান যখন যোগজাকার্তার ভেজা কংক্রিটে ভূমিষ্ঠ হই, বেলা গড়িয়ে তখন দুপুর। কলিকালের গড়ুড়- এর দেহ ধাতব, খাদ্য তরল জ্বালানি। মহাকায় মহাবল পৌরাণিক আদিপুরুষের মত তেজবীর্য এর নেই, ইনি ঈন্দ্রের বজ্রাঘাতে মৃদু হেসে একটি পালক উপহার দেন না, বরং পূরো দেহটাই বিসর্জন দেবার সম্ভবনাই বেশি। তবু হাজার হাজার যাত্রী নিয়ে এরা বিশ্বময় উড়ে বেড়াচ্ছে প্রতিদিন। প্রাচীন যবদ্বীপ- আজকের জাভা, পূর্ব-পশ্চিম বরাবর বিষুব রেখার কাছাকাছি যার অবস্থান, তারই পশ্চিম মাথায় মুকুট মনির মতো মহানগরী জাকার্তা, আজকের ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী। সেখান থেকে সোজা পূবে উড়ালপথে মাত্র এক ঘন্টায় এই নগরীতে আমাদের নিয়ে এলেন এই বিহঙ্গ প্রবর।

ঢাকায় তখন ফাল্গুন মাস, বসন্তের বাতাসে নানান ভাবের উচ্ছাস- ভাষা আন্দোলন, বইমেলা, ভ্যালেন্তাইন দিবস। এবং বৃষ্টিহীন শুষ্কতায় উপরি পাওনা সদা নির্মিয়মান দালান কোঠা ও খোঁড়াখুঁড়ির শিকার রাস্তার ধূলোবালি।  ঋতুরাজ বসন্ত থাকতে কিনা বর্ষাকাল প্রিয়– এই রচনা লিখে ইশকুলে ভর্ৎসনা শুনেছি। বর্ষা মানেই নাগরিকের কষ্ট- জলকাদা জলাবদ্ধতা রোগবালাই ও মশককূলের বিক্রম, এতে আবার ভাল লাগার কি আছে!। বর্ষাপ্রীতি বোধ করি অলস লোকের ট্রেডমার্ক। ইংরেজীতে ক্রেভিং বলে একটা কথা আছে। বৃষ্টি বাদল কম হয় এমন দেশে কিছুকাল থেকেছিলাম। বৃষ্টির জন্যও যে ক্রেভিং হতে পারে তা বেশ বুঝেছি তখন।

যবদ্বীপে এখনি বর্ষাকাল শুরু হয়েছে। বৃষ্টিভেজা মাটিতে নেমে মনটা তাই বর্ষার ব্যাঙের মত খুশীতে ডেকে উঠে। ধীর পায়ে এগোই আর চারদিকে চোখ ফেলে দেশটা দেখি। চোখ আটকে যায় একদিকে- দূরে দিগন্ত ফুঁড়ে ঊঠেছে নিখুঁত জ্যামিতিক আকারের এক পাহাড়, তারি কালো কোল ঘেঁষে চলছে কালো মেঘের জমায়েত। যেনো জমজমাট কোন কনসার্টের প্রস্তুতি। পরে জেনেছি ওটি একটি বিখ্যাত অগ্নিগিরি- মাউন্ট মেরাপি। এটি এখনো সজীব, এই ২০১০ সালেও আগুন উদ্গার করেছিল। ইন্দোনেশিয়া বহু দ্বীপের দেশ, এখানে বেশ কটি অগ্নিগিরি আছে। পৃথিবীর এই প্রান্তে কেনো এদের সমাবেশ তা বিজ্ঞানীরা ভালো বলতে পারবেন। আমি শুধু বালকের বিস্ময় নিয়ে দেখি।

২. অচিন দেশ

দক্ষিন পূর্ব এশিয়ার বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ইয়োরোপের অন্যতম ধনী দেশ নরওয়ের সহযোগিতা মূলক কার্যক্রম চলছে। তারি মূল্যায়ন ও ভবিষ্যত নিয়ে সেমিনার। এই অঞ্চলের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কিভাবে হাত ধরাধরি করে এগিয়ে যেতে পারে তাও আলোচ্য বিষয়। সেমিনারের আয়োজক গাজামাদা বিশ্ববিদ্যালয় (UGM)। এই নামকরন হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা, নিবেদিত প্রান শিক্ষাবিদের নামে, যিনি কিছুকাল আগে বিমান দূর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। থাকার জায়গা হল বিশ্ববিদ্যালয়েরই ভেতরে ক্লাব হোটেলে, সেমিনারের নির্ধারিত স্থানও সেখানেই। নূতন কোথাও গিয়ে ঘুমানো মানে সময় নষ্ট, তবু শরীরের দাবির কাছে কয়েক ঘন্টার জন্য পরাস্ত হই। ঢাকা থেকে যাত্রা শুরু করেছিলাম আগের দিন রাত দশটায়। সাথে ছিলেন বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের আরো চারজন। ঘুম সেরে সন্ধ্যে নাগাদ হোটেলের বৈঠকি ঘরে যাই। সেখানে নানা দেশ থেকে আসা ব্যক্তিদের সাথে আলাপ পরিচয় হয়- এঁদের প্রায় সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। এই অত্যন্ত সজ্জন ও গুনী ব্যক্তিদের সংগ পেয়ে নিজকে সৌভাগ্যবান মনে হয়।

আমরা বাংলাদেশী ক’জন একসাথে বের হই- উদ্দেশ্য আশপাশটা দেখা এবং রাতের আহার। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে কিছু রিক্সা জাতীয় যান দাঁড়িয়ে, কিন্তু ভাষা বিভ্রাটে আমাদের পরিকল্পনা হোঁচট খায়। অগত্যা অনেকটা দৈবচয়নেই একদিকে হাঁটতে থাকি। অল্প দুরেই ফুটপাতের উপর সারি সারি খাবারের দোকান দেখি। এমন কিছু রেস্তোঁরা না, বরং আমাদের ইতালী হোটেলের স্বজাতি। কাপড়ের ঘেরাটোপ দেয়া, প্রবেশমুখে ছবি সহ খাবারের ফিরিস্তি। ফুটপাথে মাদুর বিছিয়ে খাওয়া হচ্ছে, ছোট টেবিল চেয়ারের ব্যাবস্থাও আছে। বেশির ভাগ খদ্দেরই বয়সে তরুন, মনে হল বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্র ছাত্রী। ছবি দেখে একটাতে ঢুকে পড়ি, সাঙ্কেতিক ভাষায় খাবারের ফরমাশ হয়। ভিন্ন সংস্কৃতি, ভিন্ন স্বাদের খাবার, বেশ ভালোই লাগে। বড় দুটি পার্থক্য তখনি চোখে পড়ে- একটি পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা। অন্যটি মানুষের শান্ত মার্জিত ব্যাবহার। আরেকটা নতুন ব্যাপার দেখি, একদল ছোট ছেলেমেয়ে দোকানে দোকানে ঘুরছে, হাতে গীটার ও খঞ্জনী। গান শুনিয়ে সামান্য রোজগারের চেষ্ঠা।

৩. প্রথম প্রভাত

পরদিন একটু আগেই ঘুম ভাঙ্গে, জানালায় অচেনা দেশের প্রথম সূর্যোদয় দেখি। জাভার কফি তো বিশ্ববিখ্যাত, তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করি। হাতে কিছু সময় ছিল, সেই সুযোগে ক্যাম্পাসটা দেখতে বের হই। ক্লাবের সামনেই ক’টি রিক্সা দাঁড়িয়ে, একটায় চেপে বের হয়ে পড়ি।  এখানকার রিক্সা ও চালক দু’ই ভিন্ন প্রকৃতির। চালক বসে পেছনে, যাত্রি সামনে, অনেকটা আইসক্রীমের গাড়ীর মত। আমাদের রিক্সাগুলোর মত দ্রুতগামী নয়, ওই রকম চটপট ডানে বায়ে ঘুরতেও পারে না। চালক ও বাহন গুলোর মাঝে যেন স্বভাবগত মিল আছে। চালকেরা উদাস মুখে বসে সস্তা সিগারেট টানে, সম্ভাব্য যাত্রী দেখলে আকর্ণ হেসে ইশারায় ডাকে, কিন্তু কোন ব্যস্ত ত্রস্ত ভাব নেই। যে অল্প ক’দিন এদের দেখেছি তাতে আমার মনে হয়েছে এরা খুব অল্পে তুষ্ট এবং ভাগ্যের হাতে পুরোপুরি সমর্পিত। মাত্র দু’তিনটি রিক্সা দিনমান হোটেলের সামনে গাছের ছায়ায় বসে থাকে, দিনে ক’টা যাত্রী পায় জানিনা, বেশী হবার কথা নয়। কিভাবে এদের সংসার চলে সে এক রহস্য। চালক তার স্বভাবসুলভ ধীরস্থির ভাবে এগোয়, কোনটা কি তা বোঝাবার চেষ্ঠা করে। বিশাল বিস্তীর্ন পরিপাটি সাজানো ক্যাম্পাস, কোন তেমন উঁচু ভবন নেই। প্রায় ভবনেরই লাল টালি দেয়া ঢালু ছাত- প্রাচ্য স্তাপত্য রীতির সাথে এযুগের চাহিদার সুন্দর সমন্বয়। এখানে বিষুবীয় অঞ্চলের আবহাওয়া, গাঢ় সবুজের সমারোহ। আমার বুভুক্ষ মন ও চোখ সব যেন শুষে নিতে চায়। আরেকটা ব্যাপার লক্ষ্য করি। সিক্যুরিটি শব্দটায় আমাদের মনে ভেসে উঠে বিশেষ উর্দি পরা গম্ভীর মুখে একদল মানুষ, যাদের পোষাক আশাক চলন বলন সবই যেন ভয় জাগানোর জন্য সৃষ্ট। এখানে দেখি ভিন্ন ব্যপার। নীল প্যান্ট সাদা শার্টে এদের ছাত্র ছাত্রী বলেই মনে হয়, দিব্যি হাসিখুশি ও সদালাপী।

ঘোরাঘুরির এক পর্যায়ে একটা অদ্ভূত অনুভুতি, অনেকটা অজানা ব্যথার মতই, ভেতর থেকে নাড়া দিতে থাকে। শুধু সবুজের সমারোহ বা স্থাপত্যের সৌন্দর্য বা ক্যাম্পাসের বিরাট পরিসর নয়- অন্য কিছু একটা। একসময় আচমকাই মনের পুরোনো একটা জানালা যেন খুলে যায়, এবং ব্যাপারটা ধরতে পারি। এটাতো সেই হারিয়ে যাওয়া গন্ধ- যা ছেলেবেলায় মাঠে ময়দানে পেয়েছি। নাগরিক আগ্রাসনে আর পরিবেশের দূষনে যা হয়তো এখন আর পাওয়া যাবে না। এটা হচ্ছে অনূঢ়া প্রকৃতির নিজস্ব গন্ধ- এর নেশায় বিভোর হয়ে প্রত্যেক রাতে আমি ক্যাম্পাসময় হেঁটে বেড়িয়েছি।

সেমিনারের বিবরন দেয়ার প্রয়োজন মনে করি না। তবে এটুকু বলতেই হবে, আগতদের সবার মধ্যেই নিজ প্রতিষ্ঠানের প্রতি দরদ ও আন্তরিকতা দেখে দক্ষিন পূর্ব এশিয়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী হতেই হয়। দিনের একটা বড় সময় সেমিনারেই কাটে। তবে প্রাচ্য আতিথেয়তার কারনে ব্যপারটা নিছক রসকষহীন আলোচনা না হয়ে বরং বেশ উপভোগ্যই হয়ে উঠে।

বিকেলে UGM এর পক্ষ থেকে একটা সংবর্ধনা অনুষ্ঠান করা হয়। প্রথমে দশ বারোটি ঘোড়ার গাড়ীতে সবাইকে ক্যাম্পাস দেখানো, বিভিন্ন জায়গায় নেমে ঘোরাঘুরি ও ছবি তোলা। এরপর মূল ভবনের লবিতে সাংষ্কৃতিক অনুষ্ঠান ও নৈশভোজ। এই ভবনটি বেশ দৃষ্টিনন্দন। ওলন্দাজ আমলে নির্মিত, স্থাপত্যে সেই কালের বৈশিষ্ট, যেমন ঢাকায় কার্জন হল। ছাত্রছাত্রীরা নাচ গান ও বাদ্যযন্ত্রের মাধ্যমে ইন্দোনেশিয়ার বিভিন্ন এলাকার সাংষ্কৃতিক ঐতিহ্য সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তোলে। । বাদ্যযন্ত্রের বেশির ভাগই ঘন্টা জাতীয়। আমার কান বা সঙ্গীতরুচি অভ্যস্থ নয় বলে তেমন উপভোগ করতে পারলাম না। আমার মনে হয় তার বা বায়ু যন্ত্র যেমন সেতার গীটার হারমোনিয়ম বাঁশী এসবের বাজনা যেমন অনেকক্ষন ধরে শোনা যায় ঘন্টার শব্দ অতটা সময় ভালো লাগে না। আমাদের দেশে কি ভারতবর্ষেই ঘন্টা জাতীয় বাদ্যযন্ত্র খুব কম। আনুষ্ঠানের এক পর্বে ‘রামায়ন ব্যালে’ নৃত্যনাট্যটি বেশ ভালো লাগে। কাহিনী আমাদের পরিচিত। বনবাসে রাম লক্ষন সীতা। দূষ্ট রাক্ষস সোনার হরিন সেজে সীতাকে বিভ্রান্তিতে ফেলেছে, সেটাকে ধরতে রাম চলেছেন, একপর্যায়ে রাক্ষসের আসল রূপের প্রকাশ এবং রামের সাথে যুদ্ধ। পাত্রপাত্রীদের চেহারা ও সাজ সজ্জায় প্রাচ্য ভাব প্রবল। ভারতীয় টেলিভিশনের কল্যানে আমাদের চেনা বিরাট মুকুট শোভিত গোলগাল চেহারার চরিত্রদের সাথে স্পষ্ট পার্থক্য। বৈদিক সভ্যতা ও সাংষ্কৃতির প্রভাব একসময় কতদূর ছড়িয়ে পড়েছিল তা এখানে এলে বেশ বোঝা যায়। এখানে মানুষের নামে ও ভাষায় সাংষ্কৃত শব্দের ছড়াছড়ি। আর স্থাপত্যের নিদর্শন তো সারা দূরপ্রাচ্যে ছড়িয়ে আছে- যেমন আংকরভাট, বরোবদুর ইত্যাদি। ভোজনপর্বে ছিল আঞ্চলিক রান্না, স্বাদে চমৎকার, পরিবেশনায় শৈল্পিক।

ফেরার পথে দলছুট হয়ে পড়েছিলাম। সেই সুযোগে ক’জন ছাত্রছাত্রী এসে তাদের আনুষ্ঠান ও খাবার কেমন লেগেছে খুব আগ্রহের সাথে জানতে চায়। এরা নিশ্চই অনেক পরিশ্রম করেছে। রামায়ন নৃত্যনাট্য ভাল লেগেছে শুনে খুব খুশি। একজন উৎসাহী জানায়, এই শহরেই একটা রঙ্গমঞ্চে সপ্তাহে দু’দিন এটি পরিবেশন হয়, আরো বড় আকারে এবং পেশাদার শিল্পীদের দিয়ে। আমি চাইলে ওরা সানন্দে ওখানে নিয়ে যাবে। একে পেশায় শিক্ষক, ছাত্রছাত্রীদের এম্নিতেই আপন মনে হয়। তার উপর, যদিও যবদ্বীপ থেকে আমার দেশ অনেকটাই দূরে, রামায়নের কাহিনীর সুত্রে যেনো এরা আরো কাছের হয়ে ঊঠে।

হোটেলে ফিরে দেখি সবাই যে যার মত নিজ কামরায় চলেগেছে। আমি একাকি নেশাগ্রস্থের মত হেঁটে বেড়াই অনেক রাত অবধি, সঙ্গী হয়ে থাকে সেই গন্ধটি।

৪. অচেনা শহর

এই দেশে দ্বিতীয় সকাল। জাভা কফির স্বাদ নেবার পর হঠাৎ করেই ঝোঁক চাপে শহরটা ঘুরে দেখার। একাই হেঁটে ক্যম্পাসের পাশে বড় সড়কে চলে আসি। একটু এগিয়ে যেতেই একটা বাস স্টপেজ দেখি। আমার ইচ্ছেটা প্রকাশ করতেই কয়েকজন সাহায্যে এগিয়ে আসে। হাতে শহরের একটা ম্যাপ ধরিয়ে দিয়ে বেশ সুন্দর ভাবে বুঝিয়ে দেয় যে ঘন্টাখানেকের মধ্যেই এক চক্কর দিয়ে ঠিক এখানেই ফিরে আসা যাবে। আবশ্য কথাবার্তা হয় ভাঙ্গা ইংরেজী ও হাতের ইশারায়। টিকিটও খুব সস্তা, কাজেই কোন দ্বিধা না করে নির্দিষ্ট বাসে উঠে পড়ি।

সকালের আলোয় আচেনা শহর দেখি। দুপাশে ঘরবাড়ী দোকানপাট, চলমান যানবাহন ও মানুষ। তেমন উঁচু দালান কোঠা চোখে পড়ে না, বেশীর ভাগই দোতলা তিন তলার বেশি না, লাল টালির ঢালু ছাত। গাছ পালার স্বাভাবিক উচ্চতা ছাড়িয়ে যায়নি, ফলে প্রকৃতি ও আবাসনের মধ্যে বেশ একটা সামঞ্জস্য রক্ষা হয়েছে। যানবাহনের মধ্যে মোটর সাইকেলের সংখ্যাই বেশি, নারী-পুরুষ সবাই তাতে চেপে ছুটছে। লাইন ভেঙ্গে আগে যাওয়া, আকারন তাড়াহুড়ো, আর শ্রবন ইন্দ্রিয় বিধ্বংশী হর্ন বাদন- এসব নেই। বাসের যাত্রীদের মধ্যেও কেমন একটা শান্ত সৌম্য ভাব ও সহজাত সৌজন্য লক্ষ্য করি। তবে পশ্চিমা কোন উন্নত শহরের চাকচিক্যময় রূপের সাথে এর তুলনা করা যাবে না। এটি নিতান্তই তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশের এক শহর, আমাদের ঢাকাও হয়তো কখনো এরকম ছিল। এই দেশ মুসলিম প্রধান, তাই অনেক মসজিদ থাকা স্বাভাবিক। তবে মসজিদের স্থাপত্যরীতি প্রাচ্য, সামনের সাইনবোর্ড না দেখলে চট করে চেনা যায় না, বরং প্যাগোডার কথাই মনে করিয়ে দেয়। বানিজ্যিক আবাসিক ধনী গরীব সব রকম এলাকার মধ্যে দিয়ে বাস চলছে। আশ্চর্য্য ব্যাপার, কোথাও ময়লা আবর্জনার স্তুপ দেখলাম না। সবকিছু পরিপাটি ছিমছাম- একধরনের রূচির ছাপ স্পষ্ট। এটা পৌরসভার কৃতিত্ব, নাকি মানুষের সহজাত অভ্যাসের ফল তা জানিনা। একটি বড় খেলার মাঠের চারদিক ঘেরা পাঁচিলে প্রচুর চিত্রকর্ম দেখি। এই ধরনের দেয়াল চিত্র বা ‘গ্রাফিটি’ আমেরিকার বড় বড় শহরগুলোতে ইতিমধ্যে রীতিমত শিল্প হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। কৌটা থেকে সরাসরি রঙ ছিটিয়ে দেয়ালে এই ধরনের ছবি আঁকা সম্ভবতঃ গরীব মহল্লার ছেলে ছোকড়াদের হাতেই শুরু হয়েছিলো। ‘র‍্যাপ’ ঘরানার সঙ্গীতের মতই এর বিকাশ মূলতঃ এই শ্রেনীর হাতেই।

ফেরার পথে ভুল জায়গায় নেমে বিপত্তি। দোকানদার ও ফেরিওয়ালাদের সাহায্য নিয়ে হাঁটতে থাকি- এও কম মজা নয়। আমার ধারনা, একটা অচেনা জায়গা নিজের অনুভবে আনতে চাইলে কয়েকটি কাজ করতে হয়। নাপিতের দোকানে ক্ষৌরকর্ম, ফুটপাতের দোকানে চা খাওয়া, এবং পায়ে হেঁটে ঘোরা। কিন্তু আমার সময় কম, এখানে ঢাকার মত রিক্সার প্রাচুর্য নেই, আর আছে ভাষা বিভ্রাট। ভাগ্য সহায়, একটা রিক্সা পেয়ে যাই এবং তাতে চেপে ক্যাম্পাসে ফিরে আসি। নয়তো খানিক পরে বৃষ্টির কবলে পড়তাম।

সেমিনারের কথামালা ছপিয়ে এক সময় বিপুল বিক্রমে নামে বৃষ্টি। আহা! এমন বৃষ্টি কতদিন দেখিনি। বাইরে এসে তৃষ্ণার্ত চোখে সেই বর্ষন দেখি। ময়ুরেরা এইরকম বর্ষনেই পেখম মেলে নাচতে থাকে। ধ্রুপদী সঙ্গীতের মতই সেই বৃষ্টি চলে সন্ধ্যে অবধি। সেমিনার বেশ আগেই শেষ, সবাই বাইরে যাবার জন্য উশখুশ করছে। বৃষ্টির তেজ দেখে ভরসা পাচ্ছে না। সন্ধ্যে নাগাদ বৃষ্টি থামতেই ট্যক্সি নিয়ে দলে দলে সবাই বের হয়ে পড়ে- গন্তব্য মালিওবরো নামে এক জায়গা। অমন ঘোরতর বর্ষনের পরও রাস্তায় কোন পানি জমে নেই দেখে বাস্তবিক অবাক হই। ঢাকায় কোথাও এরচেয়ে কমে হাঁটুজল হয়ে যায়!

মালিওবরো এই শহরের প্রানকেন্দ্র, পর্যটকদের মূল আকর্ষন। রাস্তার দুধারে সারি সারি দোকান ও রেস্তোঁরা। স্থানীয় শিল্পকর্ম থেকে নামী দামী ব্রান্ডের সামগ্রী- সবই এখানে পাওয়া যায়। কাজেই মেলার ভীড়। ইন্দোনেশিয়ার ছাপচিত্রের কাপড় বিশেষ বিখ্যাত, অনেকেরই কেনাকাটার তালিকায় শীর্ষে। এখানেও এদের সহজাত সৌজন্যের কিছু নিদর্শন পাই। খদ্দের ধরার জন্য দৃষ্টিকটু ভাবে চেঁচামেচি বা টানাটানি করে না। বরং হাশিমুখে নমঃষ্কারের ভঙ্গিতে হাত জোড় করে। দোকানের কর্মচারী আপনার হাতের ঝুড়িটি বহন করে পেছন পেছন আসবে, এবং কিছু কিনুন আর নাই কিনুন, তাদের ভাষায় ধন্যবাদ সূচক কথা বলে আবারো নমঃষ্কারের ভঙ্গিতে বিদায় জানাবে।

ক্যাম্পাসে ফিরে হোটেলের বারান্দায় বেশ কিছুক্ষন আড্ডা চলে। তারপর আমার নৈশভ্রমন- অনেক রাত অবধি একাকি হেঁটে বেড়াই, সঙ্গী হয়ে থাকে সেই অদ্ভুত নেশাময় গন্ধটি।

৫. বেলা শেষের গান

আজকের আনুষ্ঠান একটু আগেই শেষ হয়। আয়োজক কর্তৃপক্ষ দু’একটি দর্শনীয় জায়গা দেখানোর ব্যবস্থা করেন। বিশ্ববিখ্যাত তীর্থ বরোবদুর এখান থেকে ঘন্টা খানেকের পথ, কিন্তু সেখানে পরের দিন যাওয়া স্থির হয়। আপাততঃ আজকে আমরা চলেছি পেরামবানান মন্দির দর্শনে- এটিও যথেষ্ঠ বিখ্যাত।

যাবার পথে আবারো জোর বৃষ্টি, তখন একটা মজার ব্যাপার দেখি। কয়েক মিনিটের জন্য সব চলাচল থেমে যায়। মোটর সাইকেল, রিক্সার আরোহী এবং পথিকের দল সবাই অতিশয় শান্তভাবে ছাতা ও বর্ষাতি বের করে। কোন অস্থিরতা হৈচৈ দৌড়াদৌড়ি নেই। শুধু ক্ষনিকের স্তব্ধতা। এরপরই সবাই আগের মতই আপন গন্তব্যে ছুটে চলে।

রামায়ন পালার কথা আগেই বলেছি। রাস্তার পাশে উঁচু স্তম্ভের উপর ধনুর্বান হাতে রামের এক বিরাট মুর্তি দেখলাম। আমাদের পরিচিত ভারতীয় সাজসজ্জা মুকুট ইত্যাদি এখানে অনুপস্থিত। ঝাঁকড়া চুলে পেশীবহুল রাম অত্যন্ত বীরোচিত ভঙ্গীতে আকাশ পানে ধনুক তুলে আছেন।

মন্দিরের মূল প্রাঙ্গন থেকে আলাদা প্রকান্ড জায়গা জুড়ে গাড়ী রাখার ব্যাবস্থা, একপাশে সারি সারি স্যুভেনির ও খাবারের দোকান- যে কোন পর্যটন কেন্দ্রের আবশ্যিক অনুষঙ্গ। বাস থামতেই জনা পঞ্চাশেক ছত্রিসেনা আমাদের ঘিরে ধরে। অর্থাৎ এরা ছাতা ভাড়া দেয়- বৃষ্টি বাদলের দেশে এটি প্রতিষ্ঠিত ব্যাবসা। সামান্য মূল্যে একটা ছাতা নেই, ওটি ছাড়া এই খেয়ালী বৃষ্টিতে অতবড় এলাকা ঘুরে দেখা সম্ভব না। দর্শনীর বিনিময়ে অবশেষে মূল প্রাঙ্গনে প্রবেশ করি। গভীর বিস্ময় নিয়ে সামনের দৃশ্যটি আত্মস্থ করার চেষ্ঠা করি। কালো পাথরের বিশাল চত্বর ধাপে ধাপে উঠে গেছে। তার উপরে কালো পাথরে নির্মিত পাঁচটি বড় মন্দির। আমি শিল্প বোদ্ধা নই, মন্দিরের বিষয়ও তেমন কিছু জানিনা। তবু, এতো অসংখ্য পাথরের উপর এতো যত্নে খোদাই করা কারুকাজ, দেব-দেবী ও পৌরানিক প্রানীদের মুর্তি ইত্যাদি দেখে বাস্তবিক অবাক হই। দু’একটি চরিত্র যেন চিনতেও পারি।

প্রত্নতাত্বিক নিদর্শনের সামনে আমার এক ধরনের ঘোর লাগে। আমি চোখ বুঁজে, এবং চোখ মেলে, পুরো ব্যপারটা কল্পনায় আনার চেষ্ঠা করি। কতকাল আগে এইখানে একদল মানুষ এমন গহীন জঙ্গলে ঘেরা বন্য হিংস্র জন্তু ও ম্যলেরিয়ার মারন ঘাতী মশাদের আক্রমনের মুখে, আসীম কষ্ট স্বীকার করে, কিসের তাড়নায় কিভাবে এই বিরাট কর্মযজ্ঞ চালিয়েছিল! কেমন ছিল তাদের সময়, তাদের জীবন? কারা সেই শীল্পি ও কারিগরের দল, কে সেই উদ্যমী পুরুষ যার নেতৃত্বে এসব হয়েছিল?

একসময় এখানে নিয়মিত পুজারীদের সমাগম হতো। দেঊলে দেঊলে প্রতিধ্বনিত হতো পুরোহিতের গুরুগম্ভীর মন্ত্রোচ্চারন, প্রাঙ্গনে ভক্তদের কন্ঠে প্রার্থনা সঙ্গীত। এরপর সাতটি শতাব্দি পেরিয়ে গেছে। আজ আর সেসব কিছুই নেই, শুধু কৌতূহলী মানুষদের বিস্ময় জাগিয়ে, অনেক ঝড় বাদল ও ভুমিকম্প সয়ে আজো দাঁড়িয়ে আছে তাদের কীর্তি। বিশেষ করে ভুমিকম্পের ফলে এগুলো বেশ ঝুঁকিপূর্ন, এখন শুধু দুটি মন্দিরের ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়া হয়। ঝুঁকিটা কতটুকু বাস্তব বোধকরি সেটি প্রাঞ্জল করার জন্য সাম্প্রতিক কালে ধ্বসে পড়া একটি চূড়ার কলস মন্দিরের ঠিক পাশেই ফেলে রাখা হয়েছে। এছাড়া চারপাশে অনেক কটি ধ্বংসস্তুপ আছে।

শতাব্দীর স্মৃতি মোড়ানো এই স্থান বহুক্ষন আমাকে আচ্ছন্ন করে থাকে, যা একই সাথে বিস্ময় ও বেদনার। আসলে যে কোন পরিত্যাক্ত স্থান, কিংবা মেলা ভেঙ্গে যাবার পর শূন্য মেলাঙ্গন- এসব আমার মধ্যে একরকম বিষন্নতা জাগিয়ে তোলে। এর কারন কি জগৎ সংসারের অনিত্যতা নিয়ে এই বোধ- সবকিছুই শেষ হয়ে যায় একদিন, মহাকালের কাছে আমরা সবাই সমর্পিত! একদিন আজকের আমরা কেউ থাকব না, এই চেনা পৃথিবীটাও বদলে যাবে অনেক খানি।

৬. স্বর্গের কিনারায়

এবারে ফেরার পালা। বিমানের জানালা পথে গাঢ় নীল সমুদ্রের মাঝে ছড়িয়ে থাকা পান্না সবুজ দ্বীপ গুলো দেখি- এর প্রটিটি যেন আপন রহস্যের ঝাঁপি নিয়ে অপেক্ষা করছে। ইন্দোনেশিয়া হাজার দ্বীপের দেশ, প্রশান্ত মহাসাগরের অনেকটুকু জুড়ে ছড়িয়ে আছে। বিজ্ঞানী কি পর্যটক, সবার জন্যই এখানে আছে বহুবিধ আকর্ষন। বহু দ্বীপ বলে ভাষা ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্টও তেমনি বহুমুখী- একজন সমাজ বিজ্ঞানী বা নৃতাত্বিকের সারা জীবন কেটে যাবার মত যথেষ্ট উপাদান এখানে আছে। এখানে মানুষের আদি পুরুষ ‘জাভা মানব’এর সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল। ভূবিজ্ঞানীদের জন্য প্রধান আকর্ষন অগ্নিগিরি। আর জীববৈচিত্র! আর যেন কোন শেষ নেই। এখানে আছে বিশ্বের বৃহত্তম ফুল, আছে ভয়ঙ্কর সরিসৃপ কমোডো ড্রাগন- হয়তো বিলূপ্ত কোন ডাইনোসরের বংশধর। এমন বিশাল বৈচিত্রপূর্ন দেশ নিয়ে কিছু লেখা, তাও আবার তিন দিনের সেমিনারে এসে- ধৃষ্টতাই বটে। তবু, ঝড়বাদলের রাতে বিদ্যুৎ চমকে মুহুর্তের জন্য প্রকৃতির এক অপার্থিব রূপ ফুটে উঠে যা মগজের মধ্যে গেঁথে যায়, দিনের আলোয় তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। এই লেখাটি আসলে সেই রকম এক ঝলকের দেখাকেই ফুটিয়ে তোলার চেষ্ঠা।

মধ্যযুগে ইয়োরোপের পন্ডিতসমাজ বলতেন “ইডেন ইজ ইন দ্য ইষ্ট”। সেকালের মানচিত্রেও পৃথিবীর পূর্ব কোনে নন্দন কাননের অবস্থান দেখানো হত। আমার হঠাৎই মনে হয়, তাঁরা হয়তো খুব ভুল কিছু বলেন নি। হতে পারে এই হাজার দ্বীপের একটি থেকে কোন এক ধুসর আতীতে মানুষের আদিপুরূষ বের হয়ে এসেছিলেন। মর্ত্যের বিভিন্ন স্থানকে মানুষ স্বর্গ বা দেবস্থান বলতে দ্বিধা করে নি। সেই অলিম্পাস পর্বত, এমন কিছু উঁচু বা দূর্গম নয়, যদি গ্রীক দেব দেবিদের লীলাভূমি হতে পারে, তবে হিমালয় বা আন্দিজ পর্বত তো আবশ্যই দেবস্থান হবার যোগ্য।

তাই, মনে হল, ক্ষনিকের জন্য হলেও, যেন ঘুরে এসেছি একেবারে স্বর্গের কিনারায়।

১,২৬৮ বার দেখা হয়েছে

৬ টি মন্তব্য : “স্বর্গের কিনারায়”

  1. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    মাহবুব ভাই,
    খুব আগ্রহ আর তৃপ্তির সাথে আপনার লেখাটা পড়লাম। সব চোখের সামনে ভাসছে যেন।
    এ-বর্ণনার সঙ্গে ছবির প্রয়োজন হয়না।
    হাত খুলে লিখতে থাকুন প্লিজ। (সম্পাদিত)

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : সাবিনা (৮৩-৮৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।