আগন্তুক

আমি জন্মমুহূর্ত থেকেই আগন্তুক পরিচয় ধারন করে চলছি এই পৃথিবীতে, যখন আমার জৈবিক বাবা মা হয়ত দরিদ্র্যজনিত(যেহেতু সমাজবাস্তবতায় এই একটি কারনেই মানুষকে নামিয়ে দেয়া যায় অনেক নীচে, ভাত পেটে গিয়ে না গুতো মারলে খ্রীষ্টের সম্মান হয়ত চাইবে না কেউ)কারনে আমাকে ফেলে গিয়েছিলেন এবং গল্পের মত কোন সোনার চামচ মুখে দেবার মত সন্তানহীন পরিবারে আমার ঠাই হতে পারত এরকম সুযোগ তৈরী করেছিলেন তখন থেকেই আমার এই পরিচয় বহন করছি। যদিও গল্পের মত আমার ভাগ্যটি সেভাবে সেদিন দুলে ওঠে নি এবং আমার ভবিষ্যতে অবসরে ঐশ্বর্যের মাঝে বসে হারানো বাবা মাকে নিয়ে দিবাস্বপ্ন দেখারও সুযোগ হয়ে উঠে নি। বরং নিজেদের হেলতে দুলতে ভাগ্যের সাথে কানামাছি হয়ে চলা সন্তানে পরিপূর্ন একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে অধস্থন হয়ে বেড়ে উঠেছি। আমার আসল পরিচয় কেউ আদরের অজুহাতে লুকিয়ে রাখে নি আমার কাছ থেকে, অথবা কেউ আমার আসল বাবা মার অভাব ভুলিয়ে দেয়ার আশ্বাসও দেয় নি। আমি আগন্তুক ছিলাম সেটাই একমাত্র এবং গুরুত্বপূর্ণ পরিচয় চিরকালের মত নির্ধারিত হয়ে ছিল এবং আমি ভাবতে চাই পরিচিত বলয়ের থেকে আগন্তুক পরিচয় আকর্ষণীয়। যদিও পুনরায় একই কথা ঘুরে ফিরে আসে, যেমন পেটে ভাত না গুতো মারলে রোমাঞ্চের রেশ প্রসব করে না, এমনকি প্রসববেদনার নিশানাও খুজে পাওয়া যায় না।

আমার মেয়েটির সাথে আমি দীর্ঘসময় ধরে কথা বলছি না, যদিও না বলার মত তেমন কিছু হয়ে উঠে নি। তারপরও আমি এড়িয়ে যাচ্ছি তাকে, সে যখন কাপড় গুনে বাণ্ডিল বাধছে লন্ড্রীর জন্যে, এবং বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছে। আমি জানি সে বলে উঠবে কিছুটা কিছুক্ষণের মধ্যেই। আমি অবশ্য মনোযোগ দিয়ে অদৃশ্য কিছু খুজতে লাগলাম। আমি যদিও সাধারন সামাজিকতার হিসেবে আগন্তুক নই এই পরিবেশে, আমার শার্ট ঝুলছে আনুবীক্ষণিক বারান্দার তারে, আমার ফেসবুক পেজ ওপেন করা ময়লা মনিটরের পর্দায়, আমার চিহ্ন দেয়া বইগুলো এলোমেলো পরে আছে টেবিলে, বিছানায় এবং মেঝেতে ইত্যাদি অনেক দৃশ্যকল্প আমাকে বাস্তু বানাতে চেষ্টা করে। তারপরও আমি নিজেকে কেন অন্তর্ভুক্ত মনে করতে পারি না আমি জানি না। কাপড় গোনা শেষ হলে মেয়েটি আমার দিকে এগিয়ে আসে এবং আমি অপেক্ষা করেছিলাম যে কথাগুলোর জন্যে সেগুলো না বলে আমাকে জড়িয়ে ধরে। যদিও আমি কোন উষ্ণতা অনুভব করি না। তারপরও আমার মনে পরে যায় আমার অফিসের বসের কথা, “ইউ নো ইটস প্রটোকল দ্যাট প্রিভেন্টস আস ফ্রম এনার্কী”। আমি প্রটোকল পালন করি। আমি হাতটা আস্তে তার পিঠে রাখি। এভাবে অনেক প্রটোকলের গাথুনিতে বেধে জীবন পার করে দেই হয়ত। এভাবে একদিন রাস্তার ওপাশে বড় বাড়িটার বাগানে সর্বক্ষণ বসে থাকার প্রটোকল পালন করা বুড়োর সাথে পরিচয় হয়। তিনি পাখির কথা বলতেন আর চক দিয়ে শ্লেটে আকিবুকি করতেন। আমি সেদিন আবিষ্কার করি শ্লেট প্রেমিকার বুকের মত সুন্দর। অপেক্ষায় থাকে কেবল এমন কিছু দাগ ধারন করার যারা আগের দাগের চেয়ে ভিন্ন। বুড়ো মানুষটি প্রটোকল ভাঙ্গেন এই শ্লেটে। আমি বুড়োর সাথে তিনগুটি খেলায় ক্রমাগত হারতে থাকি আর ঐ বাড়ির ভেতর থেকে উকি মারা একটি ছিমছাম মুখ কে উপেক্ষা করতে থাকি। মাঝরাতে একদিন ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ায় আমি মেয়েটির পাশ থেকে সরে বারান্দায় দাড়িয়ে ছিলাম হঠাৎ শুনতে পেয়েছিলাম নীচের বারান্ডা হতে নীচু মেয়ে স্বর। কান পেতে সেই কন্ঠের ফোনালাপ শুনলাম অনেক্ষণ। আমি জেনে গেলাম অনেক কিছু। মেয়েটির দুটি প্রেমিক। এবং মেয়েটি কাউকেই ভালবাসে না। আমি তারপরও প্রায়ই বিছানায় শোয়া মেয়ের কাছ থেকে সরে গিয়ে বারান্দায় দাড়াতে থাকি আর শুনতে থাকি নীচু স্বরের কারসাজি। একদিন আমি বুড়ো লোকটির কাছে হেরে গিয়েছিলাম এবং এবং ভালো করে দেখেছিলাম ভেতর থেকে উকি মারা ছিমছাম মুখটিকে। এরপর বুড়োমানুষটাকে আর দেখতে ইচ্ছে করত না, ঐ ছিমছাম মুখটিকে যদিও দেখতাম অনেক।

যে মধ্যবিত্ত পরিবারে আমি আগন্তুক হয়ে একদিন উঠেছিলাম সেখান থেকে পালানোর সময় আমি ঐ ছিমছাম মুখটিকে নিয়ে পালিয়েছিলাম। আমি জানি না এটা ভালোবাসা কিনা অথবা আগন্তুক হবার কারনে এই বোধ সম্পর্কে আমার গভীর কোন বোধগম্যতা নেই তারপরও ছিমছাম মুখটিকে নিয়ে যাবার সময় আমার ভালো লেগেছিল। আমি সমাজ এবং তার সাথে ঘুর্ণায়মান সুত্র সমুহকে বিশেষ বুঝি না। তাই সেই ছিমছাম মুখের সাথে আমি সমাজনিয়ন্ত্রিত কোন অভিনয় করতে চাইনি। যদিও তার উপস্থিতি আমার ভালো লাগে, তার শান্ত ভঙ্গীতে আমাকে ঘিরে রাখার প্রবনতায় আমি শান্তি পাই, তার শরীর পেতেও ভালো লাগে তাই আমরা একসাথে থেকে দুবার রান্না করার ঝামেলা বাচাই। আমি অবশ্য আমার মালিকানায় থাকা বিভিন্ন জিনিস চোখে দেখেও , আমাকে মেয়েটি জড়িয়ে রাখার পরেও , আমার মনে হয় আমি সব দুর থেকে দেখছি বা শুনছি। যেমন শুনি নীচতলার কন্ঠ। সেই মেয়েটির একটি নতুন প্রেমিক হয়েছে যার বেশ টাকাপয়সা আছে। আমি বাসে যখন বসে অফিসে যাই প্রতিদিন অসংখ্য নতুন মুখ দেখি যাদের আর কখোনো দেখবো না দ্বিতীয়বার। আমাকে এই অনুভুতি শান্তি দেয় তাই আমি নিরাপদ বোধ করি বাসের মধ্যে। অন্যান্য সবাইকেই আবার দেখতে হবে, এমন আমাকে জড়িয়ে রাখা মেয়েটিকেও এবং ভবিষ্যতের সম্ভাবনা মানেই প্রটোকল মানা। এনার্কী শব্দটা আমার দিনদিন প্রিয় হয়ে উঠতে থাকে।

আমি একদিন মেয়েটিক অনেক আদর করে কাছে টেনেছিলাম এবং চুমু দিয়েছিলাম, তার শরীরের ঘ্রাণ নিয়েছিলাম , এসবকিছুই আমার কাছে প্রতিবারেই কিছুটা নতুন লাগে, প্রতিবারই তাকে উন্মুক্ত করার সময় আমার মাঝে কৌতুহল জেগে উঠে। কিন্তু তারপরও সেদিন সে ঘুমিয়ে যাবার পর আমি পুনরায় তার পাশ থেকে সরে আসি এবং ফোনালাপীর কথা শুনতে থাকি। তাদের মাঝে ঝগড়া চলছিল , ঝগড়ার বিষয় সম্ভবত তার কোন একটি প্রেমিকের অন্য প্রেমিকা থাকার সম্ভাবনা। আমি কান পেতে শুনি মেয়েটি সেই আগন্তুক মেয়েটির প্রতি তীব্র ঘৃণা প্রদর্শন করছে। আমার হাসি পায় আমি দৌড়ে গিয়ে বিছানায় শুয়ে থাকা মেয়েটিকে ডাকি এবং বলি যে তাকে আমি অনেক ভালোবাসি। ছিমছাম মুখের মেয়েটি অবাক হয় কারন আমি এমন করে বলি না, তবে সে খুশি হয় সে আমাকে জড়িয়ে ধরে আমি তাকে জড়িয়ে ধরতে গিয়েও ধরি না। আমি ভাবতে থাকি ভালোবাসা শব্দটির বুৎপত্তি কি।

আমি যে ভিখারীকে নিয়মিত টাকা দিতাম সে যেদিন মরে গেছে বলে অন্য আরেকজন ভিখারীর কাছে শুনলাম সেদিন আমি তার জানাযায় শরীক হই নি। আমার কাছে ঈশ্বর অত্যন্ত অর্থহীন একটি ধারনা, তারপরও তারউপর চটে যাবার মত কিছু বলতে ভালো লাগে না। কিন্তু সেদিন আমি তারউপর চটে গেলাম। চটে যাবার ফলস্বরুপ বাসায় ফিরে আমি মেয়েটিকে অনেক বকলাম। জোড় করে সম্ভোগ করলাম পরে জড়িয়ে ধরে কাদলাম। সেদিন রাতে ফোনালাপী মেয়েটির স্বর শুনতে পাই নি, আমি হঠাৎ করে আমার জীবনের আগন্তুক দের হারাবার ভয় পেতে শুরু করলাম।

তবে আমার জীবনে নতুন আগন্তুক আসলো একজন এবং আমি বুঝতে পারলাম মানুষের জন্মের সময় কত কষ্ট হয়। মেয়েটি সারাক্ষণ চিৎকার করল, আমার হাতে নখের দাগ বসিয়ে দিল এবং আগন্তুকটিকেও আমার খুব নোংরা ময়লা মনে হলে। আমি মেয়েটির কষ্টে বুঝতে পারলাম যে আমাকে ফেলে গিয়েছিল সোনার চামচহীন পরিবারে তারও অনেক কষ্ট হয়েছিল মেয়েটির মতই। আমি হঠাৎ যেন বাধা পরে গেলাম। আমার জন্যে কষ্ট পাওয়া সেই মা এর ঋণের বোঝা ভারি ঠেকল খুব। আমি দমবন্ধ হয়ে আসছিল খুব, মেয়েটি বাসায় এসেছে ততদিনে কিন্তু তারপরও ক্লান্ত, সে ঘুমাচ্ছে। শুধু নীচের ফোনালাপী সিউডোসেক্সুয়াল কথা বলে যাচ্ছে তার পঞ্চম প্রেমিকের কাছে। আমি সবজি কাটার ছুরি নিয়ে একটা আঙ্গুল বিচ্ছিন্ন করলাম আর যন্ত্রনাটুকু ফিরিয়ে দিলাম আমাকে ঋণী বানানো মায়ের উদ্দেশ্যে। পলিথিনের ব্যাগে আঙ্গুলটা ভরে ফেলে দিলাম বারান্দা দিয়ে এবং চিৎকার করে উঠলাম সেই ঋণপরিশোধের ব্যাথায়। ঘুমোনো মেয়েটি উঠে গেল আর তারস্বরে নতুন আগন্তুক কান্না শুরু করল। আমি বলে উঠলাম “শেকড় গাড়লাম আজ” ।

৯৯৭ বার দেখা হয়েছে

৭ টি মন্তব্য : “আগন্তুক”

মওন্তব্য করুন : রাব্বি (১৯৯৮-২০০৪)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।