গল্প : বৃত্ত

একবছর দুইমাস সাতদিন আগে রফিক শ্যামলী সিনেমা হলের সামনের ফুটপাথে দাড়িয়ে সিনেমার কুৎসিৎ পোস্টারটি পড়ার চেষ্টা করেছিল আর পোস্টারে প্রদর্শিত বিশাল স্তনের একস্ট্রার জন্যে তার পাকস্থলীতে জমা হয়েছিল ঘৃণার পর্বতস্তুপ। তখন দুপুরের সূর্যটা হঠাৎই অসহ্য হয়ে ওঠায় রফিক কাছের একটা টং এর সামনে মেলে দেয়া তেলচিটচিটে কাপড়ের আড়ালে নিজেকে গুটিয়ে ফেলেছিল আর খেতে চেয়েছিল একগ্লাস ঠান্ডা পানি। পকেট হাতড়িয়ে সে একটাকার কয়েন খুজে পায় নি সেদিন এবং ঐ দোকানের চা টাও বিস্বাদ ঠেকেছিল কাঁচা পাত্তির কারনে, তবে দোকানের মালিক সাড়াক্ষণ দাঁত বেড় করে হাসছিল দেখে রফিক আর কিছু বলে নি সেদিন। তার ক্ষিদে পাচ্ছিল খুব এবং শ্যামলী সিনেমাহলের ব্যানারের বিশাল স্তন প্রদর্শনীর দিকে তাকিয়ে মনে মনে মিলির সাথে ঝগড়া করার একটা পূর্ব প্রস্তুতি নিয়েছিল। ভবিষ্যতের কোনদিন হয়ত মিলির বুকে মাথা গুজে রাখবে রফিক আর মিলির কানে কানে নীচু নরম কন্ঠে বলবে ভালোবাসি, পুরোনো ঢাকার কোন বিরিয়ানী হাউজে তৃপ্তির ঢেকুঁর তুলবে কোনদিন, রিকশায় শক্ত করে মিলির নরম শরীর জড়িয়ে রাখবে, বিব্রতভঙ্গিতে ফার্মেসীতে খুজবে স্ট্রবেরী ফ্লেবারের ডটেড সেনসেশন। শাহবাগের ফুলের দোকানে যখন রফিক যায় ইদানিং ,ফুলের দোকানীরা তাকে দেখে চিনতে পারে আর ভেবে খুশী হয় যে রফিককে বেশী দামে গছিয়ে দেয়া যাবে কিছু গোলাপ। সেইগোলাপ পাপড়ির শুকনো রুপটা একদিন মিলির একাউন্টিং বইএর পাতা থেকে গড়িয়ে নীচে পড়বে। মিলির সারা শরীর ভেঙ্গে কান্না আসবে সেই কান্না শোনার কেউ থাকবে না কারন ছোট্ট আদিবা সেদিন স্কুলে তার ম্যাম এর সামনে বসে ভবিষ্যতে এমন একটা পৃথিবীর প্রার্থনা করবে যে পৃথিবীতে আইসক্রীম আর পুতুল ছাড়া আর কিছুই থাকবে না। যে পৃথিবীতে তার বান্ধবীদের স্কুল শেষে বাবাদের বাড়ানো হাতের দিকে সে তাকিয়ে থাকবে না।

রফিক ইদানিং খুব ভুলে যায় সবকিছু। তার শার্টের পকেট থেকে হঠাৎ একটা ভিজিটিং কার্ড বেড় হলে সে মনে করতে পারে না কেন এই কার্ডটা তার পকেটে আসন গেড়েছে। তবে অন্যান্য কিছুর মধ্যেও তার অবসাদ বোধ হয় এবং সে দ্রুতগতিতে গোল্ডলীফ টানতে থাকে, তার বুক গোল্ডলীফের নিকোটিনে জ্বলে যায় ,সে কাশে এবং ভবিষ্যত গোল্ডলীফের মাথায় বিশুদ্ধ আগুন লাগায়। এরকম প্যাচপ্যাচে গরমের কোন একদিনেই রফিক ভেবেছিল জীবনটা খুব সুন্দর এবং সেদিন সকল অকাব্যিক পারিপার্শ্বিকতা তার কাব্যবোধকে ধ্বংস করতে পারে নাই। রফিক একদিন যখন মিলির নগ্ন স্তনের দিকে তাকিয়ে পংক্তি রচনা করেছিল এবং পৃথিবীর সকল কবিতার শব্দ শুনতে পেয়েছিল, তখন ভবিষ্যতের সেদিনের কথা সে ভাবতে পারে নি যেদিন মহাখালী বাসস্ট্যান্ডের পাশে সে তার সেলফোন টা ফেলে দিবে এবং নর্দমার নরম ময়লায় সেলফোনটার ডুবে যাওয়ার দৃশ্যে পুলক অনুভব করবে। সেদিন আন্ত:জেলা বাস টার্মিনালের পাশে সাড়ি সাড়ি বাস দেখে সে মনে করতে পারবে এরকম একটা বাসেই মিলির ডিম্বাকার চেহারার উপর স্তব্ধ ঝিলের উপর ভাসতে থাকা পদ্মের মত চোখগুলোর সাথে পরিচয়।

রফিক মিস্টার টুইস্ট চিপস খুব পছন্দ করে, কড়মড় করে সেগুলোকে শাস্তি দেয়, কনসান্ট্রেশন ক্যাম্পের বন্দীর মত নির্যাতন করে ধর্ষকামী আনন্দ অনুভব করে। গলির মোড় থেকে চারটা গোল্ডলীফ আর একটা জনাব টুইস্ট কিনে যখন রফিক শূন্য দৃষ্টিতে মোড়ের নাড়িকেল গাছের উপর বাদামী গুচ্ছের নাড়িকেল সম্ভারের দিকে তাকিয়ে থাকে তখন রফিকের জীবনের কোন কিছুই ভালো বলতে ইচ্ছে করে না। রফিক কমবয়সে যে ২৫০ টাকার বেশ্যার সাথে একবার শুয়েছিল সেই সময় পর্যন্ত রফিক জীবনের কোন কিছুকেই ভালো বলতে পারে নাই। যখন ভাবলেশহীন পতিতার নগ্ন বুকের উপর চড়ে বসেছিল সে তখন শুধু তার মনে হচ্ছিল মেয়েটা তার নীচে শুয়ে থাকলেও সেখানে সে নেই। সেই নিরানন্দ যৌনক্রীয়ার আগে মেয়েটার সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছিল রফিক কিন্তু মেয়েটা এই দেহবিক্রী পার্ট টাইমে করে থাকে এই তথ্য ছাড়া আর কিছু উদ্ধার করতে পারে নাই। তবে নিশ্চিত হয়েছিল মেয়েটার ছোট ভাইএর নাম সাজু কারন একটু পরেই মেয়েটার কমদামী ব্যাগের ভেতর থেকে সশব্দে সনুনিগম গেয়েওঠার কারনে মেয়েটা ব্যাগ খুলে চৈনিক সেলফোন বের করে সেখানে সাজুকে নরম কন্ঠে বলা শুরু করেছিল সে এখন অফিসে এবং ব্যস্ত। ফোনে মেয়েটার নরম কন্ঠ আর বাতির রাজা ফিলিপ্সের অরাজকীয় আলোর মাঝে একটি নিরাভরণ নারী শরীর নিদারুন কৌতুকের জন্ম দিয়েছিল আর রফিক সেই কৌতুকের সাক্ষী সস্তা হোটেলের চার দেয়ালের, সস্তা কনডমের ছেড়া প্যাকেট , অন্তর্বাস সালোয়ার কামিজ, একটা পোলো সার্ট ইত্যাদি সকলের সম্মিলিত হাসি শুনতে পেয়েছিল। রফিকের মনে আছে রফিক যখন বেড়িয়ে এসেছিল হঠাৎই তখন মেয়েটা দীর্ঘশ্বাসের শব্দ রফিকের শরীরের সাথে মিশে গিয়েছিল। এমনকি মহাখালী বাস স্ট্যান্ডের ধুলাবালি আর ” আমাদের সময়” ফেরি করা লোকটার তাড়াহুড়া করে বন কলা খাওয়ার অবকাশেও রফিক সেই তীব্র দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শুনতে পাবে একদিন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে একদিন মিলি রফিক কে দেখবে গলা ফুলিয়ে বিমূর্ত আলোচনা করতে কিন্তু সেদিন মিলির শরীরে অবসাদ এসে ভর করবে। তার কড়ে আঙ্গুল ধরে হাটতে থাকা আদিবা অবশ্য খুশি হবে অনেক মানুষ দেখে। তাদের ঘর অনেক শূন্য। তার ভালো লাগে না। বাগসবানি আর রোডরানারের শব্দ দেয়ালে দেয়ালে প্রতিধ্বণিত হয় তাতে আদিবা ভয় পায়। আদিবার তখন ইচ্ছা করবে আইসক্রীম খেতে তবে মিলি রফিকের গলায় ফুলে থাকা রগের দিকে তাকাতে চাইবে না কিন্তু চোখ সরিয়েও রাখতে পারবে না। মিলির পড়াশোনাটা আবার চালু করতে হবে। আমজাদের কোলে বসে হাস্যজ্জ্বল কমবয়সী মেয়ের ছবিটার কাছ থেকে পালাতে হবে। যেদিন চৈতীর বাসায় বিভিন্ন মেয়েলি আলোচনা করে মিলি ফিরেছিল বাসায় একটু আগে সেদিন রোমশ আমজাদের কোলে নগ্ন বসেছিল মেয়েটা, আর তার চোখে মুখে মৈথুনের সুখ উপচে পরছিল। এরও অনেক আগে মিলি যখন বসেছিল রফিকের কোলে কিংবা রফিকের ভারী নি:শ্বাসের ছোয়া পেয়ে মিলি দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছিল সেদিন মিলির চোখে এমন দৃষ্টি দেখেছিল রফিক।

রফিক বৃত্ত দেখতে পেয়েছিল সস্তা হোটেলের সেই কামড়ায়, যে বৃত্ত ক্রমাগত ব্যাসার্ধ বাড়িয়েই চলে আর গ্রাস করে নেয় শ্যামলী সিনেমা হলের পোস্টার থেকে শুরু করে পাবলো নেরুদার কবিতা পর্যন্ত। বৃত্তের খিদে মেটায় মানুষরা ক্রমাগত বৃত্তবন্দী জীবন যাপন করে। ভবিষ্যতে যেদিন রফিক চাকরীর অবসরে বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে মেতে উঠবে তর্কে সেদিন হঠাৎ চোখে পরবে তার ছোট্ট একটি মেয়ে তার মায়ের কড়ে আঙ্গুল ধরে আছে একটি ধ্বংসস্তুপের আর তার মনে পরবে সকল কবিতার চেয়ে সুন্দর মনে হত এমন একটি শরীরের কথা। রফিক বৃত্তের ভেতরের অর্থহীনতার বোধ নিয়ে খেলা করতে ভয় পাবে। তার মনে পরবে শামসুর রাহমানের আত্নহ্ত্যার আগে কবিতাটির কথা। বৃত্তের পরিসীমা বরাবর হাসঁফাস করতে থাকবে সে এবং আনন্দ অনুভব করবে নর্দমায় তলিয়ে যাওয়া সেলফোনের দিকে তাকিয়ে।

“আপনি কোথায় যাইবেন?”
“যেখানে আগে যাই নাই”।

১,৭৯৭ বার দেখা হয়েছে

১৩ টি মন্তব্য : “গল্প : বৃত্ত”

  1. অনেকক্ষণ চেষ্টা করলাম কেমন লেগেছে তা প্রকাশ করার, পারলাম না; হয়তো আমিও বৃত্তবন্দী বলে! নিজস্বতার ঘেরাটোপে একেকজন আউটসাইডার আমরা। সবকিছুই বড্ড এবসার্ড! মাথার ভেতরে তবু স্বপ্ন, শান্তিহীন সেই বোধের কারুকাজ! রক্তের অন্তর্গত বিপন্ন বিস্ময়ে আলোড়িত মানবতা কিংবা যৌনতা। আমাদের আসাযাওয়ার ফাঁক আজ বুঁজে দেয় মুঠোফোন, নাগরিক স্বমেহন, লোকাল বাসের তীব্র সংগীত! তবুও বেঁচে থাকা, সুখ শোঁকা, তবুও নিয়ে আসা, নতুন সে ভালোবাসা! বৃত্ত ভাঙতে বৃত্তের বাইরে বেরোনো, নির্বাণ কিংবা বিবশ আত্মসমর্পণ!

    জবাব দিন
  2. জিহাদ (৯৯-০৫)

    একটানে পড়লাম। মাঝে মাঝে দুয়েকবার নি:শ্বাস নেয়ার জন্য থামসি অবশ্য। ভালো লেগেছে, অসাধারণ লেগেছে টাইপের কথা যথাসম্ভব এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি আমি সবসময়। তবে তোর লেখা পড়ে আমি কি বলবো খুঁজে পাইনা। সেই জন্য বেশির ভাগ সময়ই তোর লেখা পড়ে নিশ্চুপ থাকার সিদ্ধান্ত নেই। তোর কলেজে থাকতে লেখা গুলো অনেক অপরিণত ছিল হয়তো, কিন্তু ঐ গল্পগুলার কথা এখনো খুব বেশি মনে পড়ে।

    আরো বেশি বেশি গল্প লিখিস।


    সাতেও নাই, পাঁচেও নাই

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।