আজহার উদ্দিনের মিষ্টি খাওয়া

রাতের চাদরে ঢাকা ঘুপচি গলির ভেতর একটা নিয়ন লাইট মৃত্যু যন্ত্রনায় কাপছে। ঘোলাটে আলো একবার জ্বলে উঠেই আবার নিভে যায় আর কিছুক্ষণের জন্যে আশে পাশের সরু রাস্তা, প্লাস্টারবিহীন নগ্ন ইটের খোপের মত টিনশেড, আর থকথকে নর্দমা নির্লজ্জের মত এই সামান্য আলোটুকু চুষে চুষে খেতে থাকে। দরিদ্র এলাকার ইট পাথরও হয়ত নিজ নিজ সমাজে শ্রেনী বৈষম্যের শিকার হয়ে ছোটজাত হয়ে যায়।

আজহার উদ্দিন আস্তে আস্তে প্যাডেল মারতে মারতে গলির প্রবেশ মুখের কাছে চলে এল। একটা ছোট মিস্টির দোকান। কমদামি অপুস্টিতে ভোগা কতগুলো রঙ্গীন মিস্টির উপর মাছিরা তাদের প্রতিশ্রুত আবাসভুমি খুজে পেয়েছে। দোকান মালিক তার বিশাল ভুড়িটাকে প্রদর্শনীর বিষয় হিসেবে উপস্থাপন করছে । আজহার উদ্দিনের জিভে হঠাৎই স্রোতের মত জল চলে আসল। কতদিন মিস্টি খেয়ে দেখেনি। ছোট বেলায় গায়ে গণেশ ময়রার দোকানে একটা রসগোল্লা পাওয়া যেত। সেটা এত বড় ছিল যে মিস্টির প্রাবল্যে মুখ মরে আসত। আজহার কোনদিনই শেষ করে উঠতে পারে নাই। তার বাপ খাবার নষ্ট করা পছন্দ করতেন না। কতদিন টেবিলের নীচ দিয়ে ফেলে দিয়েছে রসগোল্লার না খেতে পারা অংশগুলো। বাপের মাথায় গোলমাল ছিল। অবশ্য খারাপ গোলমাল না। পূর্ণিমার সময়ে আনন্দে অধীর হয়ে যেতেন। আকাশের নক্ষত্রের সাথে তার পাতানো দোস্তি ছিল। সেচকাজে ধানী জমিতে দীর্ঘরাত কাটাতে হত তাকে। সেইসময় গুলোতে আশে পাশের অনন্ত শূন্যতা আর পরিস্কার আকাশে হাজার হাজার নক্ষত্র। তাই আকাশের প্রেমে পড়াই বরং সম্ভাব্য ছিল বেশী। বাপের সাথে পূর্নিমায় ক্ষেতে রাত কাটিয়েছে আজহার। বাপ বলতেন ঐ আকশের নক্ষত্রগুলো বসে থাকে মানুষের জন্যে। যখন তাদের প্রিয় কোন মানুষ মরে যায় তখন নক্ষত্ররা তুলে নেয়।

নদী ভাঙ্গন আর মহাজনের চাপে অবশ্য শেষকালে বাপের নক্ষত্র ছাড়া কোন স্বজন ছিল না। হাপানী রোগিটা হাপাতে হাপাতেই একদিন হাপানো বন্ধ করে দিয়েছিল।

ফেলে দেয়া রসগোল্লাগুলোর কথা ভুলতে চেয়েও ভুলতে পারল না। সেগুলো যেন আজহারের আশেপাশেই ঘুরতে লাগল।

রিকশা জমা দিয়ে বাড়ির পথ ধরল সে। কাছেই তার এককামড়ার ঝুপড়ি। আর এটার ভাড়া যোগাতেই তার নি:শ্বাস বন্ধ হবার দশা হয়। কুপির নিশানা দুর থেকে চোখে পড়ে তার। ঘুনে ধরা দরজাটাকে বার কয়েক চিৎকার করিয়ে বাসায় ঢোকে সে। কুপির সামনে ঝিম মেরে আসিয়া বসে আছে। বসে থাকার ভঙ্গী দেখেই বুঝল কিছু একটা অভিযোগ করবে সে। সারাদিন রিকশা ঠেলে প্যান প্যান শুনতে হবে ভেবে তার ভীষণ মেজাজ খারাপ হল।

“আমার শইলডা ভালো না।”

আজ হারের সারাদিন করা পরিশ্রমগুলো তার মাঝে একরকম অমানবিকতা জন্ম দেয়ার চেষ্টা চালায় যার ফলে সে কিছুটা বিরক্ত হয়ে যায়। কিন্তু তাও সে জিজ্ঞাসা করে

“ক্যান কি হইছে”
“বুকের চিনচিনা ব্যাথাডা আবার বাড়ছে, আর অনেক সময় ধইরা হইছে”
আজহার চিন্তায় পরে যায়। দুইসপ্তাহ আগেই সে হাসপাতাল থেকে ইনজেকশান দেয়ানো হয়েছে। এততাড়াতাড়ি আবার ব্যথা শুরু হওয়ার কথা না।
“আরেকখান কথা”
“কও”
“পাশের বাড়ির মজিদ হারামজাদাডা সারাদিন বাড়ির আশেপাশে ঘুরঘুর করছে। আমি গোসল করতে গেছি তখন বেড়ার ঐ পাশে আওয়াজ শুনলাম। বাইর হইয়া দেখি খানকীর পোলাডা দৌড়াইয়া পালাইতেছে”

আজহারের ক্লান্তি তাকে এবারও ভাবলেশহীন রাখার চেষ্টা করল। তারপরও আজহার দরজা থেকে বের হল একটা ঝগড়া করার জন্যে ।যদিও সে ঠিক জানে না ঝগড়ায় সুবিধা করতে পারবে কি না। তার মস্তিস্ক থেকে শুরু করে সকল ঐচ্ছিক পেশীর প্রানোদনা সারাদিনের রিকার্সিভ প্যাডেল আর ভাড়ার দরকশাকশির প্রতিক্রীয়ার নাক ডাকিয়ে ঘুমানোর পায়তাঁরা করছে। তবে এটাও ঠিক যে প্রবনতার বিপরীতে অনুভুতি অনেক সময় জিতে যায়। স্ত্রীর নগ্ন শরীরে নিক্ষেপিত দৃষ্টির মালিকের প্রতি জমা হওয়া ক্রোধ হয়ত সেই ঘুমন্ত নিউরনেও আগুনের ছ্যাঁকা দিতে পারে।

লাগোয়া কবুতরের খুপড়িটার পাশে গিয়েই আধখোলা জানালায় উঁকি দেয়া ,রাজনৈতিক নেতৃত্বের ওয়াদা করা বিদ্যুতের অনুপস্থিতি জনিত জ্বালানো হারিকেনের আলোর উদ্দেশ্যে খেঁকিয়ে উঠল আজহার উদ্দীন,
“খানকীর পোলা মজিদ বাইরে আয়, তর হাড্ডি আইজকা কুত্তারে খাওয়ামু”
দিনের অবসান ঘটায় এই দিনমজুর শ্রেনীর আবাসিক এলাকায় সমস্ত ইট কাঠ কড়িবর্গা, আলো অন্ধকারে রাক্ষুসে খিদে নিয়ে নেমেছে ক্লান্তির সুতিক্ষ্ণ দাঁত। তাই নীরবতার মাঝে আফসোস আর নিজস্ব অবস্থানের জন্যে মুন্ডুপাত করা পরিবেশে এই উচ্চগ্রামের চিৎকার তরবারির মত ঝিমানো নৈ:শব্দ কে কেটে ফালাফালা করল। জানালা সপাটে খুলে গিয়ে দেয়ালে বাড়ি খেল মরচে ধরা পাল্লা। গ্যালভানাইজিং বিহীন লৌহ পাল্লা আঘাতের ফলে রোয়া ওঠা কুত্তার মত চিৎকার করে উঠল। জানালায় উঁকি দিল একটা শক্ত আর দারিদ্র্যের চিহ্নের ব্যনার সাঁটানো একটা মুখ।
মজিদের মা এর চেহারা দেখেই, আজহার অনুভব করল তার ঘুমন্তপ্রায় স্নায়ু জেগে উঠছে আড়মোড়া ভেঙ্গে।
“মজিদ শালায় কই”
মজিদের মা তার বহুল ব্যভৃত ঝগড়াটে কন্ঠ উপস্থাপন করল
“ছোট লোকের ছাও আমার পোলারে গাইলাস ক্যান”
মজিদ গলায় আরো জোড় এনে আশে পাশের দরিদ্র শ্রেনীর গাছপালা বা পাখি গুলোকে ঘুম থেকে ডেকে তুলল।
“তর পোলায় আমরার গোসলখানায় নজর দেয়, আমরার পরিবার দেখছে, পোলারে কি এইসব বাইনচোদগিরি শিখাইছস?”
“আমার পোলার দোষ কি, তর বউ ছিনাল মাগী, গতর লইয়া ব্যবসা করে জানি না মনে করছস, বেশ্যার দালাল হইয়া আবার বড় গলায় কথা”

আছিয়া দরজার পাশে ঘাপটি মেরে ঝগড়া শুনছিল আর আর ক্রমাগত সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছিল। ঝরঝর করে তার অশ্রু অষ্টআশির বন্যার মত মুখের অসমান জমিন ভাসিয়ে দিচ্ছিল। তার মনে আছে অষ্টআশির বন্যার কথা। দিনের পর দিন ঘরের চালে আটকে থাকা আর ক্ষিদে ফাকি দিতে না না ফন্দীর কথা। আছিয়ার মনে হত লাগল সেই বানের তোড়ে তাদের যেই দুধেল গাইটা ভেসে গেছে সেটার সাথে ভেসে যেতে পারলেই হত। সেইযে জীবন ধারন কারী মাটি ছেড়ে আছিয়া চালায় উঠেছে, সারাজীবনেও সেখান থেকে নামতে পারল না। আছিয়া তাই আশ্রয়ের জন্যে মাটিকে জড়িয়ে ধরল। মাটির গভীরে গিয়ে এই অশ্রুর পানিকে পুঁতে ফেলতে ইচ্ছা করল তার।

আজহার ঝগড়াঝাটি করে কখন ঘরে ফিরেছে আছিয়া খেয়াল করে নাই। হঠাৎ তার পিঠে কোমল স্পর্শ পেয়ে বুঝল আজহার ফিরেছে। পরম মমতায় আজহার, আছিয়াকে কাছে টানল। তার ঘাড়ের কাছে চুম্বন করে জানান দিল এই পৃথিবীর ময়লা নোংরা পথঘাটের পরও আরেকটি পৃথিবী রয়ে গেছে যেখানে ‘বেশ্যা মাগী’র মত অনেক শব্দ উচ্চারিত হয় না।
“আর কয়টা দিন রে বউ, আর কয়টা দিন। তোর বুকের অসুখ সাইরা যাইব। আমি স্কুটার চালানো শিখুম। তরে স্কুটারে কইরা ঢাকা শহরের রং দেখামু। তর বুকের অসুখ না সারলে আমি কারে রঙ দেখামুরে বউ ”
আছিয়া তার পিঠে আজহারের অশ্রুর স্পর্শ টের পেল। আজহারকে পৃথিবীর একমাত্র অবশিষ্ট আশ্রয়ের মত জড়িয়ে ধরল। এই দেহে অনেক দু:খ আর পাপ হয়ত বাসা বাধে তার। ঘুনপোকার মত তারা নিয়মিত খেয়ে চলে আছিয়ার জীবনরস একটু একটু করে। তারপরও আজহারের কাছে বেদনারস্তুপ সদৃশ শরীরটা আশ্রয় খুজল। আজহারের শরীরের ভেতরে ঢুকে যেতে চাইল। আছিয়া ব্লাউজ খুলে ফেলল। অপুষ্টি আর দারিদ্র্যের নিয়মিত আক্রমনের পরও নিটোল সৌন্দর্যের একটুকরা ঘন রুপ হিসেবে কুপির আলোয় তার স্তনদুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল। জীবনভর কষ্টের পাথর ঠেলার ক্লান্তির হাত থেকে বাচার জন্যে আকুল আছিয়ার স্তনবৃন্ত দুইটি যেন ভালোবাসার স্পর্শ পাবার জন্যে উদগ্রীব হয়ে উঠল। আছিয়া আজহারের হাত দুটো তার আলোআধারির মাঝে খেলা করা স্তনে স্থাপন করে দু:খের বায়ুমন্ডল হতে পলায়নের জন্যে আজহাররের গলা জড়িয়ে ধরে সৌন্দর্যের সাগরে ডুবসাঁতাড় দিল।

ঘরের বাইরে পা ফেলতেই দরজাটা সপাটে আজহারের পেছনে বন্ধ হয়ে গেল। আজহার কান পেতে খটখট শব্দ শুনল। সিল্কের পান্জাবী পরা মধ্যবয়স্ক সুঠাম লোকটা, যার প্রতিটি কথার পর বাধ্যতামূলক হাসি থাকে, সম্ভবত আজহারের ঘরের স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়ায় মরচে পরা ছিটকিনি লাগাতে চেষ্টা করছে।

আজহার দেয়ালে ঠেঁস দিয়ে দাঁড় করানো একটা মোটা লাঠি তুলে নিয়ে দুইধাপের ক্ষয়িষ্ণু সিঁড়ির গোড়ায় বসে পড়ল। পকেট হাতিয়ে একটা বিড়ি বের করল। এইসব সময়ে সবসময়েই সে বাসার খুব কাছে থাকে। কোন বিপদ হলেই যাতে দরজা ভেঙ্গে ঢুকতে দেরী না হয়। মানুষে বিশ্বাস নেই। এই জীবনে মানুষের অনেক বিষঁদাত দেখেছে সে। বিড়ি ধরিয়ে আকাশের দিকে ধোয়া ছাড়ল। ধোয়াগুলো সাপের মত আকাশকে ছুতে এগিয়ে যাচ্ছিল। মেঘহীন আকাশে নক্ষত্ররা মেলা বসিয়েছে। কবে তারা আসবে তাদের প্রিয়জনকে তুলে নিতে? আজহার কি নক্ষত্রদের প্রিয়জন?

ছোটবেলায় গনেশ ময়রার দোকানে রসগোল্লা খেয়ে শেষ করতে পারত না আজহার। টেবিলের নীচ দিয়ে ফেলে দেয়া রসগোল্লাগুলো তীব্র হাসি আজহার আজও শুনতে পায়।

আজহারের হঠাৎ খুব মিষ্টি খেতে ইচ্ছা করল।

২,২৯৮ বার দেখা হয়েছে

৩০ টি মন্তব্য : “আজহার উদ্দিনের মিষ্টি খাওয়া”

  1. আদনান (১৯৯৪-২০০০)

    কি ব্যাপার এত সুন্দর একটা গল্পে এমন আবোল-তাবোল সব কমেন্ট ! হোসেন গল্পটা খুব ভাল হয়েছে । জানিনা কতটুকু কাছে থেকে সমাজের এ অংশের মানুষগুলোকে দেখেছ ? তাদের জীবন নিজের চোখ দিয়ে দেখে আবার আমাদেরকেও দেখালে । সত্যি ভাল হয়েছে । আরো লিখতে থাক । :clap:

    জবাব দিন
  2. আহ্সান (৮৮-৯৪)

    অসাধারণ কিছু অনুভূতির প্রাঞ্জল প্রকাশ...

    এই পৃথিবীর ময়লা নোংরা পথঘাটের পরও আরেকটি পৃথিবী রয়ে গেছে যেখানে ‘বেশ্যা মাগী’র মত অনেক শব্দ উচ্চারিত হয় না।
    তর বুকের অসুখ না সারলে আমি কারে রঙ দেখামুরে
    এই দেহে অনেক দু:খ আর পাপ হয়ত বাসা বাধে তার। ঘুনপোকার মত তারা নিয়মিত খেয়ে চলে আছিয়ার জীবনরস একটু একটু করে। তারপরও আজহারের কাছে বেদনারস্তুপ সদৃশ শরীরটা আশ্রয় খুজল। আজহারের শরীরের ভেতরে ঢুকে যেতে চাইল।

    খুবই ভালো লিখেছো হোসেন...। ঈর্ষা করি তোমাকে, তোমার এই লেখাটির জন্য...

    জবাব দিন
  3. সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

    হোসেন, তুমি মানুষটা কেমন জানি না, তবে তোমার লেখার ভক্ত হয়ে আছি শুরু থেকেই। গল্পটা দারুণ লিখেছো। অল্প কথায় এতো কিছু! আজহারউদ্দিনের জীবনবোধ, জীবন-যাপন মনে হয়- একটা পুরো মানুষকে একটা গল্পেই ধরে ফেলেছো। আবারো বলি দারুণ। লিখতে থাকো। এটা কখনোই ছাড়বে না।


    "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : জামান (০০-০৬)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।