শুন্যতার রং

প্রিয় আহসান,

ব্লগে মামুনের কথা বলার জন্য তোমাকে কেন বেছে নিলাম এই প্রশ্ন তুমি আমাকে করতেই পারো। আমার কাছে সুনির্দিষ্ট কোন উত্তর কিন্তু নেই। একটা কারন হতে পারে, ব্লগে তুমিই একমাত্র, যার সংগে মামুনের যোগাযোগ হবার ক্ষীন হলেও একটা সম্ভাবনা আছে। আমার হিসাবে তুমি ৩৫ অথবা ৩৬ লংকোর্সের, ৩৮ এর পরে না নিশ্চয়ই, মামুন ছিল ৩৪ লংকোর্সে, আদি বাড়ি ময়মনসিংহ, ফর্সা, লম্বা করে, দুলিয়ে দুলিয়ে হাটত মামুন, মনে করতে পারো ওকে? কোম্পানীর কথা জানতে চেও না, আমি জানি না মামুন কোন কোম্পানীতে ছিল।

ক্লাস নাইনে ইলিয়াস যখন নতুন রূমমেট হিসাবে মামুন কে পছন্দ করল, ব্যাপারটা আমার একদম মনের মত হয়নি। “কি দেখে পছন্দ করলি ওকে?” জানতে চেয়েছিলাম। “খুব ভাল মন, খুব রসিক।” পরবর্তী দীর্ঘ চারটি বছর মামুন তার রসিকতা আর ভালমানুষি দিয়ে মাতিয়ে রেখেছিল আমাদের। আমার কাছে যদি কেউ জানতে চায় যে কোন সময়, কলেজে আমার প্রিয় সময় ছিল কোন গুলো, আমি অবশ্যই উত্তর দিব, অন্য আরও কিছুর সংগে, যে সময়টুকু আমরা রুমে আড্ডা মেরে কাটাতাম, অথবা রুমে ক্রিকেট খেলতাম, কিংবা স্কোয়াশ। এ রকম আড্ডা প্রিয় রসিক মানুষ খুব একটা দেখিনি। সবকিছু ব্যাখ্যা করার একটা নিজস্ব পদ্ধতি ছিল মামুনের এবং অবশ্যই সেটা হত খুব মজার একটা ব্যাপার আমাদের জন্য।

ইলিয়াস যে ফিজিক্সের জনপ্রিয় একজন স্যারের মেয়ের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে, এটা মামুনই প্রথম বলে আমাকে। ছুটিতে গোপনে গোপনে যে তাদের উপহারের আদান প্রদানও হয় এইটাও জানতে পারি তার মাধ্যমেই। ইলিয়াস ছিল বিখ্যাত প্রেমিক, বন্ধুর বোন থেকে শুরু করে, হিন্দি ছবির নায়িকা, বাদ যেত না কেউই। তাই ওতে আমরা অবাক হইনি, বরং কষ্ট লেগেছিল জবার কথা ভেবে, ইলিয়াসের নতুন প্রেমিক, তাও আবার স্যারের মেয়ে, কি এক কেলেংকারী অবস্থা।
পড়াশুনা নিয়ে সদা সর্তক মামুন বলেছিল, ডাক্তার হবে। ওর আর্মিতে চান্স পাওয়া শুনে আমরা বেশ অবাকই হয়েছিলাম। ফিজিক্যালি এত ফিট মনে হত না ওকে। এরপর অনেকদিন কোন খবর নেই, যে যার ধান্দায় ব্যাস্ত আমরা তখন। তথন তো আর কোন মোবাইল ছিল না, ছিল না কোন গ্রুপ মেইল আইডি। তবে খবর পেতাম, এর ওর কাছে, সবার, মোটামুটি ভাবে, মামুনের খবর আলাদা করে চোখে পড়ার মত কিছু না। আছে মোটামুটি, মোটামুটি মানের অফিসাররা যেমন থাকে।

এর মাঝে আমারও কিছু পরিবর্তন হল, ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করলাম, চাকুরি শুরু করলাম, বন্ধুদের পাত্তা পেতে শুরু করলাম একে একে। গ্রুপ মেইল আইডি হল, মোবাইল হাতে উঠল, প্রিয় প্রিয় নামের পাশে নাম্বার সেভ হতে লাগল একে একে। একটু টাকা খরচ করলেই কথা বলা যেত, যোগাযোগ সহজ হয়ে গেল অনেকটা।

সেদিন অফিসে খুব ব্যাস্ত, বসের খুব তাড়া ছিল একটা কাজ নিয়ে, হঠাত ইলিয়াসের ফোন, “বল তাড়াতাড়ি বল”? “দোস্ত, আমার বিয়ে।“ “কি বলিস এইগুলা, মেয়ে দিল কে” এইসব হাবিজাবি কথা সেরে আবার কাজে মন দিলাম। একটু পরে আবার ফোন, এইবার রেজা, “হুমম, ইলিয়াসের বিয়ে, এছাড়া নতুন কি বল” আমি তাড়া দেই।
“ফয়েজ, মামুনের অসুখ, লিভার সিরোসিস, ঢাকা সি্, এম, এইচে, অবস্থা খুব খারাপ, আজ রাতে সিংগাপুর যাবে”। একটানে বলে রেজা। “তোমার অফিস থেকে তো খুব কাছে, দেখো, দেখা করতে পার কিনা”।

বসের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে দৌড়ে যাই সি,এম, এইচে, অই তো মামুন, বিছানায় শুয়ে আছে। আশেপাশে এত লোকজন কেন? “কিরে মামুন, শুয়ে আছিস কেন, কি হইছে তোর”। মামুন আসলেই খুব ক্লান্ত, কথা বলতে পারে না, একটুকু কি হাসে আমাকে দেখে। ইশারায় বসতে বলে। আমি এ কোন মামুনকে দেখছি আজ এতদিন পর!!

মামুনের হাত ধরে বসি কিছুক্ষন, ইলিয়াসের কথাটা জানাই ওকে। “জানিস, একটু আগেই ইলিয়াস ফোন করেছিল, বিয়ে করছে ও”। “কাকে, জবাকে?”। ক্লান্ত মুখে তার হাসির রেখা ফুটে উঠে, মৃত্যুর হাতে হাত রেখে রসিকতা, মামুনই পারে। আমার বুকে উঠে আসে দলা পাকানো কান্না।

এরপরের ঘটনা একদম সংক্ষিপ্ত, মাউন্ট এলিজাবেথ মামুনের অপারেশন করতে অস্নীকার করে, শতকরা ৮০% লিভার নষ্ট হয়ে গেছে মামুনের, অপারেশন করা মানেই মৃ্ত্যুকে কাছে ডেকে আনা। সিংগাপুর থেকে ফেরার সাত দিনের মধ্যে মারা যায় মামুন।

বছর ঘুরে, আমরা আবার আড্ডায় মাতি, বউ বাচ্চা নিয়ে ঘুরি, এটা ওটা করি। মাঝে মাঝে মামুনের কথা মনে হয়। বেচে থাকলে আড্ডায় আসত, বিয়ে করত, বউ নিয়ে ঘুরত। আমি যেভাবে আদর করি আমার মেয়েকে, ও হয়ত সেইভাবেই আদর করত, বুকে জড়িয়ে ধরত। আমাদের বয়স বাড়ে, মামুনের বাড়ে না, মামুন তার বয়স বেধে ফেলেছে তিরিশের আশেপাশে।
যান্ত্রিক আমাদের অনুভুতিতে আঘাত করে আর এক যন্ত্র। প্রতি বছর এপ্রিলের ১৪ তারিখে মেইল বক্সে ডুকলেই একটা মেইল দেখি

Title: Death Anniversary of Mamun (586)

Date: April 14
Time: All Day
Repeats: This event repeats every year.
Notes: Lets mourn for our friend Mamun on this very date.

মরে তো আমরা যাবই, তাই বলে এই সময়, এভাবে?

শুন্যতার রং কি তুমি জান আহসান।

ভাল থেকো।

ফয়জুর।

১,৬০৬ বার দেখা হয়েছে

১২ টি মন্তব্য : “শুন্যতার রং”

  1. সায়েদ (১৯৯২-১৯৯৮)

    ফয়েজ ভাই,
    আপনার লেখা দেখেই মন কেমন করা একটা লেখা পাবার আশা মনের মধ্যে উঁকি দিয়েছিল। আমার অনুমান মিথ্যা হয় নাই। আবারও হৃদয়টা হু হু করে উঠল।

    আচ্ছা, মামুন ভাই'র ঠিকানা কি সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্ট, এমআইএসটি, মিরপুর ক্যান্টনমেন্ট ছিল(২০০৩ এ)?


    Life is Mad.

    জবাব দিন
  2. আহ্সান (৮৮-৯৪)

    ফয়েজ ভাই,
    নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছি চিঠি লিখতে আমাকে বেছে নেবার জন্য। আপনার চিঠি পড়ে নিজের চোখ বাধনহারা হয়ে গিয়েছে। আপনি এমন একজনের কথা লিখেছেন, যাকে আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি।

    আপনার চিঠির জবাব আমি ব্লগ আকারে দিচ্ছি।

    জবাব দিন
  3. তৌফিক (৯৬-০২)

    ক্যাডেট কলেজের বন্ধু অকালে হারানো খুব কষ্টকর। আমার নিজের বয়স যেন ধপ করে ১০ বছর বেড়ে গিয়েছে ওইদিন থেকে। আল্লাহ যেন আমাদের মামুন ভাইকে ভালো রাখুন।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : কামরুল হাসান (৯৪-০০)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।