সিসিবিরে তুই ঠিক হ, মনরে তুই ঠিক হ

১।
মোটামুটি দূর সম্পর্কের চাচাতো বোন আমার প্রেমে পড়ে গেল। আমি তখন ক্লাস টেনে, ছুটিতে ঘাড় টেনে শহরে, গ্রামে ঘু্রি। ভাইয়া আমার কলেজের ঠিকানা চায়, কারন কে একজন চেয়েছে। ঠিকানা দিয়েছি বলে মায়ের আবার খুব রাগ। কারন আমার মা গ্রামে বেড়াতে গেলে সেই বোন নাকি মাকে চা বানিয়ে খাওয়ায়, এটা সেটা কাজ করে দেয়। ক্যাসেট আর ডাইরী তুলে দিয়েছিল আমার মায়ের হাতে সরল বিশ্বাসে, যাতে নিরাপদে তা আমার হাতে পৌছে যায়। ভুল পিয়নের হাতে দিয়েছিল সে ওগুলো। চিঠি মেরে দিয়েছিল হাউস ডিউটি মাষ্টার, প্রেমিক হয়ে গেছি বলে বিরাট ভৎর্সনা খেলাম পোলাও খাওয়ার পর পর। বৃহস্পতি বার। যদিও বুঝতে পারিনি, আমার প্রেমিকাটা কে।

সব গুলো ঘটনা মেলাতে পারলাম অনেক পরে। কত পরে? তার বিয়ে হয়ে যাবার পর, মা একদিন রসিয়ে রসিয়ে বললেন তার বিরহী কাহিনী। আহারে, প্রেমিকের কাছে বানী পৌছল না তার।

মনরে তুই ঠিক হ।

২।
তখন মনে হয় ক্লাস এইটে। মঞ্জুর মোর্শেদ স্যারের ক্লাস শুরু হবে একটু পরে, পাচ মিনিট ব্রেক। শুনেছি স্যার আগে সেনাবাহিনীতে ছিলেন, পরে কি এক বাটে পরে আমাদের মানুষ করার মহান ব্রত হাতে নিয়েছেন। ঠান্ডা রাগী রাগী চোখ। এডজুটেন্ট পর্যন্ত তাকে সম্মান করে কথা বলে, আর তো ক্লাস এইট। সেদিন আমার ভীষন মাথা ব্যাথা, ডেক্সে মাথা লাগিয়ে শুয়ে আছি। আমার ডেক্স আবার একদম জানালার পাশে। একটু দূরে কলেজের সীমানা প্রাচীরের বাইরে কিছু ছেলে প্রাচীরে উপরে উঠে লুঙ্গী তুলে রেখেছে, তার সেটা দেখে পুরা ক্লাস জুড়ে হই চই। মোত্তালেব চিৎকার করে ডাকছে “আখতার দেখ দেখ আবার খুলছে” বলেই বিদিক অট্টহাসি। এমন সময় ক্লাসে ডুকলেন এডজুটেন্টের বস। সরাসরি আমার কাছে, কারন আমি জানালার পাশে।
“ফয়েজ এখানে কি হচ্ছে?”
“স্যার জানি না।“
প্রথম চড়ে উড়ে গিয়ে পড়লাম দুই ডেক্স পরে বসা জাহিদের ঘাড়ে। দ্বিতীয় চড়ে আবার ফিরে আসলাম নিজের জায়গায়। স্যার বসতে বললেন এরপর ক্লাসকে। বসলাম। ক্লাস করলাম। স্যার কি একটা প্রশ্ন করলেন গ্রীন হাউজ এফেক্ট নিয়ে। কেউ উত্তর দিতে পারল না, আমি আবার উত্তরটা দিলাম।

৩।
ছোটবু খুব ক্ষেপে গেলেন আমার উপর। তখন বনানী থাকি, গুলশান-১ এ অফিস। অফিস থেকে বাসায় এসে দেখি আমার বয়োবৃদ্ধ বাবা আর মা হাজির। ছোটবুর ধারনা তারা আসবেন আমি জানি, সাক্ষী মানলাম আব্বাকে, আব্বা বললেন খবর না দিয়ে এসেছেন। পরদিন আব্বার কাছে দোয়া নিয়ে অফিসে গেলাম, যদিও চাকুরী করছি বছর দুই/আড়াই, তবু অফিসে যাবার আগে বাবার হাত বুলিয়ে দেয়া সেই প্রথম। অফিস থেকে ফিরে দেখি বাবা নেই, বড় বুর বাসায় গেছেন উত্তরা।

রাত দুটোর দিকে দুলাভাই এর ডাকে ঘুম থেকে উঠলাম। বোন, দুলাভাই, আমি পড়ি- মরি করে গাড়ি নিয়ে ছুটলাম সিএমএইচ। গিয়ে দেখি বাবাকে ডুকিয়ে রেখেছে ফ্রোজেন রুমে।

বাবাকে দেখলাম পরদিন বিকালে। সবকিছু রেডি, যাব রংপুরের পীরগঞ্জ, বাবাকে শুইয়ে দিতে।

৪।
ভাইয়া ফোন করে বললেন মা পড়ে গেছে বিছানা থেকে, তেমন কিছু নয়, তবে যেন আসি একটু। তখন চিটাগাং এ থাকি, অফিসে বিরাট ঝামেলা লেগে গেছে, জি,এম ব্যাটার ভিসা ক্যান্সেল করেছে বাংলাদেশ সরকার। দেশ ছেড়ে যেতে হবে। এর মাঝেও ফেয়ার-অয়েল ডিনার সেরেই বউ বাচ্চা সহ রংপুর। শুনলাম মা হাসপাতালে, সিসিইউ। যেখানে আবার আমার ঢুকা মানা।
টানা সাত দিন অচেতন মায়ের পাশে রাত জাগলাম, এই আমার মা, আমাকে কলেজে নিয়ে যেত ক্লাস টুয়েল্ভ এর সময়ও। আমার কি লজ্জা তখন জুনিয়র আর ক্লাস মেটদের সামনে। প্যারেন্টস-ডে তে সবার সামনে কপালে চুমু দিত, আমি বকতাম, “শুধু শুধু লজ্জা দাও কেন?” রাত একটা/ দুটো/তিনটে ঢাকা বা চিটাগাং থেকে যখনই বাসায় গিয়েছি, একবার কড়া নাড়া শুনেই দরজা খুলে দিয়েছেন, চলে আসার সময় থাকিয়ে থেকেছেন যতদূর পর্যন্ত আমাকে দেখা যায়, আর আজ, কত অসহায় হয়ে শুয়ে আছেন বিছানায়। মা একটু সুস্থ হন, আশা বাড়ে, ঢাকায় নিতে চাই, ডাক্তার মানা করেন, বলেন, লাভ নেই। না থাক, তবুও।

ঢাকায় আনার সাতদিন পরে মা চলে গেলেন। আবার সেই কফিন, সেই গাড়ি, সেই রাস্তা বেয়ে মাকে শুইয়ে দিয়ে আসা রংপুরের পীরগঞ্জে।

৫।
বাবা বলে গেছেন ছোটবু কে আমার বিয়ের সমস্ত অয়োজন করতে। বোনের শুরু হল মেয়ে খোঁজা। কিন্তু মেয়ে আর মিলেনা। এটা আছে সেটা নাই, সেটা আছে এটা নাই। বিরক্ত হয়ে একদিন বললাম আমার এক বন্ধুর কথা, ও নাকি ওর বোনের জন্য ছেলে খুঁজছে। দেখেন তো পছন্দ হয় কিনা।
দেখল, পছন্দ হল। শালার বন্ধু ছিল, হলে গেল সম্মন্ধী। আর আমি একটা আস্ত মেয়েমানুষ নিয়ে কমিউনিটি সেন্টার থেকে বাসায় ফিরলাম।

সিসিবিরে তুই ঠিক হ,
মনরে তুই মানুষ হ।

কত আর রাগ দেখাবি তোর নিজেরে। রাগের বেইল নাই। ঘর ঠিক রাখতে হইব।

১০,০৩৮ বার দেখা হয়েছে

১১৪ টি মন্তব্য : “সিসিবিরে তুই ঠিক হ, মনরে তুই ঠিক হ”

  1. রবিন (৯৪-০০/ককক)

    ধুর ভাইয়া, লিখলেন তাও মন খারাপ করা লেখা। এম্নিতেই মেজাজ খারাপ সিসিবি নিয়া। আজকেও তানভীরের সাথে অনেক খন কথা হইছে সিসিবি এর অনেক কিছু নিয়ে। কি করব? তুই জনের মতের মিল হয় না।ও আমাকে বুঝায়, আমি অন্য কিছু বুঝি। আর কেউ নাইও সিসিবি এর যে সমর্থন চাইবো। শেষ পর্যন্ত দুই জন ই আশাবাদী না সিসিবি ঠিক হয়ে যাবে আগের মতো।

    যেই আমি ছবি ব্লগ ছাড়া কিছু দেয়ার কতাহ চিন্তা করলেই কষ্ট লাগে, ব্লগ লেখার জন্য টাইপিস্ট বিয়ে করার কথা চিন্তা করি, সেই আমি এতো বড় একটা সিরিজ লিখতেছি, শুধুমাত্র সিসিবি এর আগের পরিবেশ এর আশায়। আশায় থাকি আমার লেখা নিয়ে কামরুল পিরা যাইবো এতো বড় লেখসি বইলা, কাইয়ুম ভাই বলবে তাড়াতাড়ি পরের পর্ব দে। তাইফু ভাই পচাইবো, রহমান ভাই কবো রবিন লেখা ভালো হচ্ছে।
    কিছুই হিসাব মিলতেছে না। ধুর কিছুই ভালো লাগতেছে না।
    অ.টঃ সরি ভাইয়া কি লিখতে গিয়ে যে কি লিখলাম। ধুর, আমার ব্যান চাই।

    জবাব দিন
  2. সাকেব (মকক) (৯৩-৯৯)

    বস,
    ভালো না, ভালো না...মনটা খারাপ করে দিলেন...
    আপনার লেখা বলেই হয়তো আরো বেশি মন খারাপ করা...


    "আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
    আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস"

    জবাব দিন
  3. সামি হক (৯০-৯৬)

    ফয়েজ ভাই জুনিয়ররা কমপ্লেন করে কিন্তু সিনিয়রদের ইডি লাগাইতে পারে যদিও তাতে জুনিয়রগুলার খবর হয়ে যায় তারপরও আমি আপনার নামে ইডি ইস্যু করনের ব্যবস্থা করব 😀 মন খারাপ করানোর জন্য, একটা মন ভালো করা লিখা কবে লিখবেন বলেন?

    ভালো থাকবেন

    জবাব দিন
  4. ইমতিয়াজ (৮৭-৯৩)

    দোস্ত,
    গত মাসে সিসিবি তে যখন প্রথম আসলাম তখন তো অনে ক কেদেছিলাম এবার যখন আসলাম আবার মন খারাপ করে দিলি ...কই তোর সিক্রেট প্রেমিকার কথা ত আগে বলিসশ নি ।।

    জবাব দিন
  5. কাইয়ূম (১৯৯২-১৯৯৮)

    আঙ্কেল আন্টির জন্য স্রষ্টার কাছ প্রার্থনা করছি।
    একই সাথে মন খারাপ এবং ভারি মন হালকা করার লেখা।

    ফয়েজ ভাই, কি খবর এইবার বলেন 🙂


    সংসারে প্রবল বৈরাগ্য!

    জবাব দিন
  6. মন্ঞ্জুর মোর্শেদ স্যারের ছেলে তওহীদ আমার ক্লাসমেট ( সিসিআর: ১৯৯৮-২০০৪ ) ছিল..... ও এখন জাপানে.... আঙ্কেলের সাথে কথা হয়নি কখনো তবে চুপচাপ টাইপের মানুষ মনে হয়েছে

    জবাব দিন
    • ফয়েজ (৮৭-৯৩)

      তাই নাকি, স্যারের ছেলে তোমাদের ব্যাচ মেট? বাহ বেশ তো।

      হ্যা স্যার খুব চুপচাপ ছিলেন, একটা গাম্ভীর্য নিয়ে চলতেন। মজার ব্যাপার কি জান, পরে আমি স্যার কে বুঝাতে পেরেছিলাম, আমি এই ঘটনায় ছিলাম না, এর ফলে পরবর্তীতে হাতে নাতে একটা বড় ধরা খাওয়ার পরও স্যার আমাকে কিছু বলেন নি। মুচকি হাসি দিয়েছেন শুধু।


      পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

      জবাব দিন
  7. জিহাদ (৯৯-০৫)
    মোটামুটি দূর সম্পর্কের চাচাতো বোন আমার প্রেমে পড়ে গেল। আমি তখন ক্লাস টেনে

    ব্যাপারটা ঠিকই আছে। তবে আমার ক্ষেত্রে মামাতো বোন ছিল। 😛


    সাতেও নাই, পাঁচেও নাই

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।