ধূলোমাখা শহর, ধূলোমাখা স্মৃতি – ০৪

সমস্ত দিনের শেষে ক্লান্ত হয়ে বিশ্রাম খুঁজি রাতের আঁধারে। হয়ত জানালার গ্রীলে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখা, সিনিয়র ব্লকের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কুয়াশার দৌড়, মধ্যরাতে দল বেধে এক কিলোমিটার হেটে দুধ চা খেয়ে আসা, কান পেতে শুনতে চাওয়া বাতাসের শব্দ, পূর্নিমার চাঁদ (কেমন আছ তুমি ঈদানীং), পুকুরের পারে বসে গিটারের টুংটাং শব্দে তিতাসের গান, কিংবা আবৃত্তি, অথবা বৃষ্টির ঝিমঝিম শব্দে গায়ের উপর পর্যন্ত টেনে নেয়া কম্বল, (বৃষ্টির ফোটা গুনতে চাওয়া, এটা কি ঠিক) কিংবা, অন্য আর কোন কিছু নয়। শুধুই টানা ঘুম।

মধ্য রাতের তারারা, কেমন আছ তুমি, জায়গা বদলে ফেলেছ আবার, নাকি এখনও সেই আগের জায়গায় আছ, আগের মতই মিটমিটে?

ইন্টার পরীক্ষার আগে আগে, টাল-মাটাল সময়টাতে, ইনসমনিয়া পেয়ে বসল আমায়।

নানা জটিলতায় কেটেছে কলেজের ভিতরের শেষ দুটো বছর। হয়ত এগুলো কোন জটিলতাই নয়, হবে হয়ত। কিন্তু আমি সাক্ষী, আমার রুমমেট সাক্ষী, সাক্ষী আমাদের ভাইস প্রিন্সিপাল স্যার, দুটো বছর প্রায় কিছুই পড়িনি আমি। প্রি-টেষ্ট রেজাল্ট দেখে ঘুম সেই যে উড়ে গেল, পরবর্তী দেড় বছর রাতগুলো কাটল প্রায় নির্ঘুম। পরীক্ষার আগের সারা দিন পড়তাম, সারারাত রিভাইজ করতাম, ঘুম ঘুম চোখে পরীক্ষা দিয়ে আসতাম। ফলাফল, কি আর, অশ্বডিম্ব। এখনো শুনতে পাই ফোনের অপর প্রান্ত থেকে ভেসে আসা প্রিন্সিপাল লেঃ কর্নেল ওবায়েদ স্যারের কন্ঠ “আর ইউ হ্যাপী উইথ ইউর রেজাল্ট?“ “নট অ্যাট অল স্যার” এছাড়া কি বলব আমি আর।

চর্তুভূজ প্রেমে জড়িয়ে পড়েছিলাম। অথবা চর্তুভূজ প্রেম ছিল না সেটা, ছিল নিছকই বন্ধুত্ব, যেমন করে অন্যরা বলেছিল আমাকে, অন্যরা মানে মাস্কেটিয়ার্স টিমের সদস্যরা। ভুলটা আমার, বুঝিনি আমি, প্রেম আর বন্ধুত্বের মাঝের দেয়ালটা এত ধুসর কিংবা অস্পষ্ট হতে পারে। অনেকটা থ্রী মাস্কেটিয়ার্স টিমে মশিয়ে ডি আঁরাতনা নয়, মাদাম ডি আঁরাতনা যোগ দিলে যা হতে পারত, অনেকটাই তেমন। এক অসাধারন জটিল পরিস্থিতি। আলেকজান্ডার দ্যুমা সে জটিলতায় যাননি। আমাকে যেতে হল, আমার ভূলের প্রায়শ্চিত্ত, আমাকেই করতে হল। হারিয়ে ফেললাম নিজের একটি শিক্ষা-বছর। নিজেকে গুটিয়ে পরের বছর চলে গেলাম খুলনায়, প্রতিজ্ঞা করলাম, গ্রাজুয়েশন শেষ না করা পর্যন্ত কোন দিকে তাকাবো না। নারীময় শৈশব আর কৈশোর পেরিয়ে নারীহীন যৌবনের গান বাধলাম।

তবে এসময় অর্জন যে কিছুই হয়নি তাই বা বলি কি করে। অনেক কষ্টের দামে বুঝেছি “কোন কিছু আশা করতে নেই কারও কাছে”। এ এক অনেক বড় “বুঝতে পারা” আমার কৈশোরের জীবনে ।

ইনসমনিয়ার সেই সময়ে শুয়ে শুয়ে কত কিছু যে গুনতাম। আকাশের তারা, ভেড়ার পাল, ডাইরীর পাতা। কাজ হত না কিছুতেই। এক অনেক বড় সাইক্রিয়াটিষ্ট (সম্পর্কে আমার আত্মীয় যদিও) এর সংগে কথা বললাম। তিনি বললেন “গুনে তো ঘুম আসে না, তুই চোখ বন্ধ করে শুবি, আর নিজেকে অটো সাজেস্ট করবি, বলবি আমি এখন ঘুমাবো। ব্যাস, এরপর ঘুমিয়ে পড়বি।“ আমি চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়লাম, নিজেকে অটো সাজেস্ট করলাম, সবই হোল, কিন্তু ঘুমটা হোল না।

রাজ্যের ক্লান্তি নিয়ে ঘুমালাম খুলনার ভর্তির রেজাল্ট দেবার পরে। ততদিনে আমরা সবাই অনেক, অনেক বড় হয়ে গেছি। একজন হলে তার বেডের নীচে রামদা নিয়ে ঘুমায়, আরেকজনের কোমড়ে থাকে পিস্তল, ডিএমসির সাদ’ত প্রেমে পড়ল রাজশাহীর এক মেয়ের, প্রেমের খরচ জোটাতে পড়াশুনা বাদ দিয়ে খুলে বসল ফাস্ট ফুডের দোকান, বুয়েটের প্রথম সেমিস্টারে খুব ভালো করল আরিফ, স্ট্যান্ড করা রকিবুলের নিজস্ব যুদ্ধ শুরু হল মফস্বল শহর উলিপুরে, হঠাৎ বিয়ে করে ফেলল একজন প্রেমিক, হুজুর হয়ে গেল শান্ত-শিষ্ট রেজা, আহমেদিয়া গ্রুপে যোগ দিল একজন, নেভাল ট্রেনিং এর ফার্ষ্ট টার্ম খুব ভালো করা শামস স্কলারশীপ ট্রেনিং এ যাবে মালেশিয়া, খুব যত্ন আর ভালবাসায় চিঠি লিখল আমাকে, ভরসা না হারানো গান শুনিয়ে, আর স্যান্নসীর ব্রত নিয়ে আমি চড়ে বসলাম রূপসায়, গন্তব্য খুলনা, নির্বাসনে।

কত দিন হয়ে গেল এসবের, পনেরটি বছর?!

জীবনের গতি এখন কত পালটে গেছে, পালটে গেছে আমার রাত কাটানোর ধরন। তবে এখনো অনুভব করি সেই সময়ের চাপা বেদনা, কষ্ট আর হাহাকারের জায়গাগুলোকে।

৫,৭৬৪ বার দেখা হয়েছে

৬৬ টি মন্তব্য : “ধূলোমাখা শহর, ধূলোমাখা স্মৃতি – ০৪”

  1. রাশেদ (৯৯-০৫)

    ফয়েজ ভাই কি সাধারণ ভাবেই না তুলে ধরলেন পুরান সময়ের সেই কাহিনি। লেখাটা পড়ে কেন জানি মনে পরে গেল কলেজের সেই সময়। ভাল থাইকেন বস 🙂


    মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

    জবাব দিন
  2. শরিফ সাগর (৯৭-০৩)
    বুঝিনি আমি, প্রেম আর বন্ধুত্বের মাঝের দেয়ালটা এত ধুসর কিংবা অস্পষ্ট হতে পারে।

    এটা বুঝি কেউই বুঝতে পারে না যারা এর মধ্য দিয়ে যায়। ~x(

    ইনসমনিয়ার সেই সময়ে শুয়ে শুয়ে কত কিছু যে গুনতাম। আকাশের তারা, ভেড়ার পাল, ডাইরীর পাতা।

    এত কিছু থাকতে ভেড়ার পাল..... :(( :(( :((
    না জানি এই সময়গুলাতে মানুষ আরও কত কি গুইনা ফালায়... 😡

    তবে এখনো অনুভব করি সেই সময়ের চাপা বেদনা, কষ্ট আর হাহাকারের জায়গাগুলোকে।

    এইসব ফাউল জিনিস অনুভব কইরেন না। এইগুলা মনে আইলে খুব জোর দিয়া :gulti: মাইরা চিম্বুক পাহাড়ের উল্টা পাশে ছুড়ে মারবেন। 😕

    লেখা জটিল লাগছে। বরাবরের মতো ফয়েজীয় হইছে। :hatsoff:

    জবাব দিন
  3. রায়হান আবীর (৯৯-০৫)

    ফয়েজ ভাইয়ের যেকোন লেখা আমি যে কতবার করে পড়ি ... প্রতিটা লেখার পর হাজারো কথা মনে ভিড় করে ...

    এই জন্যই লোকটারে আমি এতো ভালো পাই। অথচ সে বলে কিনা তেলের দাম কম x-(

    জবাব দিন
  4. মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)
    স্যান্নসীর ব্রত নিয়ে আমি চড়ে বসলাম রূপসায়, গন্তব্য খুলনা, নির্বাসনে

    বস, এই লাইনটা কি ভাবী'র উদ্দেশ্যে? 😛

    তয়, পুরা লেখাটাই পাংখা হইছে। :boss: :boss:


    There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

    জবাব দিন
  5. এহসান (৮৯-৯৫)

    হুমম!
    খুলনায় গিয়া ভালো করেছেন!!!
    আরো ভালো করেছেন এখন চট্টগ্রাম এসে।
    লেখা আগের গুলার মত বেশি ভালো লাগে নাই। শুধু সিম্পল ভালো লাগসে। পরে আরেকবার পড়তে হবে।

    জবাব দিন
  6. মুহাম্মদ (৯৯-০৫)

    জীবনে এত নস্টালজিয়া নিয়েও আপনি এত স্বচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করেন ক্যাম্নে? আমার হইলে তো তো থাইমা যাইতাম। অবশ্য এগুলা নিশ্চয়ই সবসময় মনে হয় না। মনে হওয়া মাত্রই লিখে ফেলেন, কিংবা লেখার জন্য মনে করেন। নইলে এত চমতকার লেখা হয় কি করে। চোখ বন্ধ করে পাঁচ তারা।

    জবাব দিন
    • ফয়েজ (৮৭-৯৩)

      এগুলো সব জীবনের অংশ। মেনে নিয়েছি।

      তোমরাও থামতে না। ক্যাডেট কলেজের ট্রেনিং তো হারতে শিখায় না, বরং লড়তে শিখায়। লড়ছি।

      মনে হওয়া মাত্রই লিখে ফেলেন, কিংবা লেখার জন্য মনে করেন।

      সেভাবে ভাবিনি। তবে মনে হয় প্রায় সময়। আর সবচেয়ে মজার ব্যাপার, সবার সংগেই যোগাযোগ আছে এখনো। তবে অনুভূতিটা মরে গেছে।


      পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

      জবাব দিন
  7. তানভীর (৯৪-০০)

    ফয়েজ ভাইয়ের আরেকটা লেখা! অসাধারণ!
    দেরী হয়ে গেল কমেন্ট করতে। লেখাটা মোবাইলে পড়েছি আগেই, কিন্তু মোবাইল দিয়ে কমেন্ট করতে ইচ্ছা করে না।

    অনেক কষ্টের দামে বুঝেছি “কোন কিছু আশা করতে নেই কারও কাছে”।

    জীবনের একটা পর্যায়ে আমাকেও এই সত্যটা শিখতে হয়েছে। তারপর থেকে আমি অনেক সুখী।

    জবাব দিন
  8. শহীদ (১৯৯৪-২০০০)

    লেখাটা পড়ে মন ভরে প্রশংসা করতে চেয়েছিলাম। তারপর কমেন্টগুলো পড়তে পড়তে উপলদ্ধি করলাম - কোন কমেন্ট দিয়েই এই লেখাটাকে মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়।
    ৫ তারা ফয়েজ ভাই :salute:

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : ফয়েজ (৮৭-৯৩)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।