ধূলোমাখা শহর, ধূলোমাখা স্মৃতি – ০৩

তার একটা নাম দেয়া দরকার, দিলে ভাল হয়।

রংপুরে যে এলাকায় আমরা থাকতাম, সেই এলাকার নামের আগে “মিস” বসিয়ে আমার মহা রাশভারী বাবা তাকে ডাকতেন। সত্তর দশকের শেষের দিকের কথা বলছি। “মিস ওয়ার্ল্ড” তখন একটা অবাক করা অনুষ্ঠান বড়দের কাছে, আর আমরা কি ছাই তখন বুঝি এতসব।

আমাদের বাসার যতটুকু অংশে ঘর-দোর-উঠোন করেছিলেন বাবা, তার চেয়ে অনেক বেশি অংশই ছিল গাছে ভরা। বাসার পিছনে ছিল মাঝারী আকারের একটা বাশ বাগান, কত নাম না জানা পাখি বসত সেখানে, কত “ভো-কাট্টা” ঘুড়ী। সামনে দিকে ছিল খড়ির গুদাম, আমরা খড়ি বিক্রী করতাম তখন। আশেপাশের নানা বাসা থেকে খড়ি কিনতে আসত লোকজন, ৫ সের, ১০ সের, ১ মন। আমরা দৌড়ে যেতাম পাল্লায় খড়ি মাপতে। হিসাব অবশ্য আমার মা রাখতেন। সেই খড়ির গুদামে মাঝে মাঝে বন-বিড়াল (স্থানীয় ভাষায় “গারোয়া”) সংসার পাততো। এগুলো আবার সুযোগ পেলেই মায়ের পোষা মুরগী দিয়ে নিজেদের উদর ভরাত। বেজীর উৎপাত ছিল সাংঘাতিক। বাবা মাঝে মাঝে বন্দুক নিয়ে তাড়া করত ওগুলোকে, গুড়ুম গুড়ুম গুলির শব্দে কেপে উঠত সারা এলাকা।

আর ছিল সার বাধানো সুপারী গাছ। পাশাপাশি দুটো সুপারী গাছে দড়ি দিয়ে দোলনা বেধে দিয়েছিল পাশের বাসার খুশি-সাথী আপারা। আমি আর মিস ওয়ার্ল্ড সময় পেলেই সেই দোলনায় পাশাপাশি বসে থাকতাম। একটু দোলও কি দিতাম তখন দোলনায়? মনে পড়ে না।

পৈত্রিক সুত্রে বাবা অনেক জমি পেয়েছিলেন গ্রামে। মাঝে মাঝে কোমড়ে অটোমেটিক রিভলভার পেঁচিয়ে বাবা চলে যেতেন গ্রামে। থাকতেন অনেক দিন। মা তখন মনে হয় ভয়ই পেতেন একা বাসায় আমাদের নিয়ে থাকতে। হতে পারে। মা আমাদের কখনো বলেননি সেটা। কিন্তু বাবা গ্রামে চলে গেলেই পাশের বাসার পারভীন আপা চলে আসতেন আমাদের বাসায়। রাতে থাকার জন্য। তার সংগে আসত “মিস ওয়ার্ল্ড”। বিশাল বিছানার দুই পাশে মা আর পারভীন আপা ঘুমাতেন। আর মাঝখানে থাকতাম আমরা। জড়াজড়ি করে কত যে ঘুমিয়েছি এভাবে, আংগুলের কড় গুনে এই হিসাব দিতে পারবেনা কেউই, না মা, না পারভীন আপা।

বাসায় কাঠাল গাছ ছিল দুটো, একটার কাঠাল ছিল একটু আলাদা স্বাদের, টক টক, কিন্তু খুব মজার। পরিচিত স্বজনদের দিয়ে-থুয়ে খুব বেশি থাকত না আমাদের জন্য। অন্য কাঠালের জাতটা ভাল ছিল না, সহজে পাকতেও চাইত না। ঐ গাছের নীচে কিছু কাঠাল চাপার গাছ পুতেছিলাম। বাসার সামনে ছিল হাস্লা-হেনার ঝাড়। রাতের বেলা কি সুন্দর ঘ্রানে ভড়ে যেত পুরো বাড়ি। হাস্নার ঝাড়ে নাকি সাপ থাকে? মা কখনো কাছে যেতে দিতে চাইতেন না। বড় বড় শেফালী আর কামীনি গাছ ছিল একটা করে। পিছনে একটা মাঝারী সাইজের একটা আম গাছ (আম ধরেনি কখনো)। বাশ ঝাড়ের পাশে একটা বাতাবী লেবু (আমরা জাম্বুরা বলতাম)। দুটো নারিকেল গাছও ছিল, ইয়া বড়। পাতা ঝরার সময়টাতে বাসার উঠোন-পিছন ভরে যেত। সেইসব পাতা কুড়িয়ে আমরা মেতে উঠতাম পিকনিকে। এ বাসা ও বাসা মিলে অনেক কজন, রান্না হত ভাত, গোস্ত আর ডিম সিদ্ধ।

বেশ ছিল ছেলেবেলাটা, সব মিলিয়ে।

প্রেমটা জমেনি, যদিও জমে উঠার অনেক প্রেক্ষিত ছিল। কারন হতে পারে, শৈশব-কৈশোরের সন্ধিক্ষনে “মিস ওয়ার্ল্ড” বাসা বদল করে চলে যায় একটু ভিতরে, আমার চোখের আড়ালে। চিরদিনের চঞ্চল আমার কাছে, চোখের আড়াল মানেই যেন মনের আড়াল। তবে তার যাওয়া আসা ছিল, খুব ভালবাসতেন আমার মা-বাবা তাকে। তাদের সংগেই হয়ত দেখা করতে আসত, কারন আমি তখন অনেক দূরের একজন, ক্যাডেটে পড়ি, বছরের নয় মাস থাকি না, যেটুকু সময় থাকি, বাসায় থাকি না, হয়ত বুবু বাড়ি, দাদা বাড়ি, এখানে, ওখানে।

আমার গ্রাজুয়েশনের টাল-মাটাল সময়ে তার বিয়ে হয়, মা বলেছিলেন আমাকে, তার জন্য ছেলে দেখা হচ্ছে, কিন্তু এটা নিয়ে ভাবার মত অবসর আমার তখনও হয়নি। আর যখন তার কথা ভাবার সময় হল, তখন সে এক সন্তানের জননী।

গল্পটা এখানে শেষ হতে পারত,হলেই বরং ভাল হত, কিন্তু হল না। সে চলে এলো তার সংসার ছেড়ে, নিজের সন্তানকে নিয়ে। যখন সে ফিরে আসল, তখন আমি আবার এক সন্তানের জনক।

আমার হার-না-মানা খেলার সাথীটি অবশ্য ভেংগে পড়েনি। নিজের একটা ব্যবসা দাড় করিয়েছে, রংপুরে গেলে হঠাৎ দেখা হয়, স্মিত হাসি আমি, হাসে সেও। কথা হয়, “কেমন আছ”, “ভাল আছি” “চলে যাচ্ছে দিন” এই রকম টুকিটাকি।

আমার বাবা-মা দুজনেই চলে গেছেন পৃথিবী ছেড়ে। তারা বেচে থাকলে হয়ত সে আসত আমাদের পুরানো বাসাটায়, কথা বলত তাদের সাথে। আমি কোলে নিতাম তার সন্তানকে, আর আমার বাচ্চা ছুটে যেত তার কোলের কাছে।

৪,৯৯১ বার দেখা হয়েছে

৮৪ টি মন্তব্য : “ধূলোমাখা শহর, ধূলোমাখা স্মৃতি – ০৩”

  1. তৌফিক (৯৬-০২)

    এখন কথাটা হচ্ছে গিয়ে দাদা, ভাবী কি দেখবে আপনার এই লেখা? :-B

    না, সিরিয়াসলিঃ স্মৃতিকাতর করে দিলেন, কত কিছু মনে পড়ে গেল! শেষ প্যারাটা পড়ে বহুজায়গায় শোনা একটা কথা মনে হল। সত্য মিথ্যা জানি না, অভিজ্ঞতা হয় নাই এখনো। কথাটা হলো গিয়া, অপত্য প্রেমই নাকি শ্রেষ্ঠ প্রেম। 🙂

    জবাব দিন
  2. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)
    চিরদিনের চঞ্চল আমার কাছে, চোখের আড়াল মানেই যেন মনের আড়াল।

    কেম্নে মানি!!! 😛
    আমাদের কতজনের সাথে আপনার দেখা হয়েছে???? কিন্তু আপনি কি মায়ার বাঁধনে জড়িয়ে যান নি???? :-B


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন
  3. শরিফ সাগর (৯৭-০৩)

    অসাধারন স্মৃতিচারন। বড় বড় নারিকেল গাছ, সুপারির বিশাল বাগান, জাম্বুরা গাছের নিচে বাঁশ দিয়ে বানানো বসার জায়গা , আরও অনেক কিছু মনে করায়ে দিলেন ফয়েজ ভাই। আমার নানাবাড়ির দিনগুলা এমন ছিল। শহুরে জীবন থেকে ওইসব কল্পনাও করা যায় না। সময় পেলে লেখার ইচ্ছে আছে।

    জবাব দিন
  4. কামরুল হাসান (৯৪-০০)

    শুধু এই সিরিজের বেস্ট না, হৃদয়ে তার অবিরাম বৃষ্টির শব্দ আর একটু শুনবেন গল্পটা'র পাশাপাশি এটাও সিসিবিতে ফয়েজ ভাইয়ের সেরা লেখার তালিকায় রাখতে হবে।
    যথারীতি ফয়েজীয় লেখা। এরচেয়ে যোগ্য প্রশংসা আপাতত খুঁজে পাচ্ছি না।
    (এডু স্যারের কাছে 'ফয়েজীয়'র একটা ইমো দাবি করছি। )

    প্রিয়তে।

    আপনার নারীময় শৈশব আর কৈশর দেখে হিংসা হচ্ছে মাইরি।
    নাদের আলি, আমি কবে ফয়েজ ভাই হবো ?


    ---------------------------------------------------------------------------
    বালক জানে না তো কতোটা হেঁটে এলে
    ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনো কালে।।

    জবাব দিন
  5. এহসান (৮৯-৯৫)

    ফয়েজ ভাইয়ের নারীময় শৈশব আর কৈশোর, শওকত ভাইয়ের নারীময়(আকর্ষণীয়া, সুন্দরী, চঞ্চলা 😛 ) ছাত্রজীবন আর লাবলু ভাইয়ের নারীময় কর্মজীবন.......সব.... সব.... হিংসা হচ্ছে :((

    আল্লাহ যাদের দেয়..... উফ্..... 🙁

    জবাব দিন
  6. রহমান (৯২-৯৮)

    অসাধারণ স্মৃতিচারণ। :boss: দারুন লাগল ফয়েজ ভাই।

    অনেক কিছু মনে পড়ে গেল। আমার একেবারে শৈশবকাল কেটেছিল রংপুরে। আমার প্রথম স্কুল রংপুর ক্যান্ট পাবলিক। ক্লাস টু পর্যন্ত ছিলাম ওখানে। এরপর আর ওদিকে যাওয়া হয়নি। এখন নাকি রংপুর অনেক সুন্দর শহর। যাওয়ার খুব ইচ্ছা আছে।

    অফ-টপিকঃ আমার শেষের লেখাটায় আপনার কমেন্টের উত্তর দিয়েছি।

    জবাব দিন
    • ফয়েজ (৮৭-৯৩)

      রংপুর এখন আগের মত সুন্দর নেই, গত বিশ বছর কোন কাজই তো হয়নি। দেখা যাক এবার কিছু হয় কিনা।

      অফটঃ দেখেছি রহমান, কিন্তু শোক কাটিয়ে উঠতে হবে, তা না হলে ষড়যন্ত্রের অংশ হয়ে যাব সবাই।


      পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

      জবাব দিন
  7. মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)

    গাছেরটা খাওয়ার পাশাপাশি তলারটার জন্য আফসোস করার কারনে ফয়েজ ভাইয়ের ব্যান চাই। :grr:

    তবে লিখাটা হয়েছে জব্বর। :salute:

    আপনার গাছময় জীবনের সাথে আমারও গাছময় জীবনের অ-নে-ক মিল, কিন্তু "আপা" আর "মিস"রা থাকল না ক্যান? :(( :((


    There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

    জবাব দিন
  8. কামরুলতপু (৯৬-০২)

    অসাধারণ ফয়েজ ভাই স্পেশাল। ভাইয়া আপনার লেখা পড়লেই খালি মনে হয় ইশশ আমারো এইরকম শৈশব থাকলে ভাল হত। আপনার ছোটবেলার বাড়িটা কি এখনো এরকমই আছে? থাকলে একবার পিকনিক করতে যাইতাম আমরা ।

    জবাব দিন
  9. সাকেব (মকক) (৯৩-৯৯)

    বস,
    ... ... ...
    বরাবরের মত নির্বাক করে দিলেন...
    আপনার লেখা আমি সবসময় তিনদিন ধইরা 'তারায়া তারায়া' পড়ি...


    "আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
    আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস"

    জবাব দিন
  10. এহসান (৮৯-৯৫)

    ফয়েজ ভাই,

    অফিসে তাড়াহুড়ো করে পড়েছিলাম। এখন বাসায় ফিরে আরেকবার পড়লাম। নতুন করে আবার মুগ্ধ হলাম। দেখলাম অনেক ফাইন ডিটেইলস আগেরবার চোখ এড়িয়ে গিয়েছিলো। একবার মনে হলো একটু সম্পাদনাও করেছেন নাকি আসলেও মিস করেছিলাম। জানি না। যাই হোক ফয়েজীয় ভঙ্গিতে সহজ ভাষায় সহজ কথা গুলো দারুন ভাবে লিখার জন্য :boss:

    অফটপিকঃ অনেকগুলো চন্দ্রবিন্দু বাদ পড়ে গেছে। এত আলসেমী করলে কি হয়!!!!!

    জবাব দিন
  11. আদনান (১৯৯৪-২০০০)

    মন ছুঁয়ে যাওয়া লেখা, অনেক ধন্যবাদ । আমার শৈশব পুরোপুরি ঢাকা কেন্দ্রিক, তাই নিজের সাথে কোন মিল পেলাম না, কিন্তু অনেক গভীরে ছুঁয়ে গেল । প্রেম তো মনে হয় একটা সময় পরে অভ্যাস হয়ে যায় :dreamy: ।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : ফয়েজ (৮৭-৯৩)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।