ধুলোমাখা শহর, ধুলোমাখা স্মৃতি – ০১

দৃষ্টি একটি মেয়ের নাম। লম্বা, একহাড়া গড়ন, যতটুকু কালো হলে উজ্জ্বল শ্যামলা বলা যায়, ততটুকু কিংবা তার কাছাকাছি কালো। অসম্ভব শান্ত চোখ। ক্লাসে মেয়েদের মধ্যে সে ছিল সবচেয়ে লম্বা। মেয়েরা সবাই যখন একসাথে দাঁড়াতো, দৃষ্টির চোখ ওদের সবার মাথার উপরে থাকতো। ওর দাঁড়ানোর ভংগিটা ছিল ঋজু, যদিও তাকে যখন শেষ দেখি, তখনও এই “ঋজু” শব্দটার সংগে আমার পরিচয় হয়নি। কতইবা বয়স, নয় কিংবা দশ। কিন্তু পরে যখন এই শব্দটার মানে বুঝতে পারলাম, তখন কেন জানি মনে হয়েছিল “দৃষ্টিটা ঋজু ভংগিতে দাড়াতো”।

প্রাইমারী স্কুলে সবাই দল বেধে চলাফেরা করে। স্কুলে বসা, খেলা, এমনকি টিফিন খাওয়াটাও এই গ্রুপের সাথে। কো-এডুকেশন সিসষ্টেমের পুলিশ প্রাইমারী স্কুলে আমার গ্রুপে কিছু মেয়ে থাকলেও দৃষ্টি ছিল না। কারন দৃষ্টির কোন গ্রুপ ছিল না। মেয়েটা একা একা থাকত, কথা তেমন একটা বলত না কারও সাথে। স্কুলের ঠিক পাশে, একটা সরকারী বাংলোয় দৃষ্টি তার এক বোন আর বাবা সহ থাকত। সেটাও জানতে পারি যখন ওই বাসার পেয়ারা চুরি করে, বাসায় পানি খেতে গিয়েছিলাম। দরজা খুলেছিল দৃষ্টি। আমি তখন জানতে পারি এটা ওদের বাসা।
ওর মা যে অনেক আগেই মারা গিয়েছেন এটা জানি আরও অনেক পরে। খুব মায়া লেগেছিল ওর জন্য। আহারে, ওর মা নেই, বাসায় ফিরে মায়ের হাতের মাখানো ভাত ও খেতে পায়না। একটা অপার্থিব মায়ায় আমার ছোট্ট মনটা ভরে উঠেছিল। বাসায় ফিরে মাকে বলেছিলাম, “দৃষ্টির মা নেই”। মা তাকে দেখতে চেয়েছিলেন। ব্যাস এইটুকুই।

প্রথম শ্রেনীর অপরাধ করার কারনে একদিন বিশাল পিটুনী দিলাম লাকিকে। বল দিয়ে মেরে বসলাম ওর পেটে। অপরাধ? আমাদের ফুটবল খেলার একটা গোল পোষ্টে সে “ছিঃবুড়ি” খেলার বউ বসিয়েছে। অবশ্য এর প্রায়শ্চিত্ত করতে হল একগাদা খামছি খেয়ে। সব মেয়ের দল একসাথে আচ্ছা মত খামছি দিল আমার পিঠে। “মেয়েদের কাছে মার খাচ্ছি” এই অপমানে কোন ছেলেবন্ধু আমাকে বাচাতে আসল না সেদিন। সবাই খামচি মারলেও দৃষ্টি দিল না। কিন্তু না দেয়ার কোন গ্রহনযোগ্য কারন ছিল না। কেন দেয়নি খামছি সেদিন ও আমাকে?

দৃষ্টির দিকে প্রথম সমীহ করে তাকালাম সম্ভবত ক্লাস ফাইভের প্রথম সাময়িক পরীক্ষার পর। ক্লাসে আমার রেজাল্ট সব সময় প্রথম দিকেই থাকত। অবাক হলাম যখন দেখলাম সব স্যার এসে দৃষ্টির নাম ধরে ডাকছেন, আর লম্বুটা মেয়েদের মাঝে থেকে টুপ করে দাড়াচ্ছে। স্যারেরা সবাই তার প্রশংসা করছে, আর মেয়েটা কেমন একটা লজ্জা লজ্জা হাসি দিচ্ছে। বুঝলাম এবার ভাল করেছে এই মেয়েটা। কত ভাল বুঝলাম পুরো রেজাল্টের পর, যতদুর মনে পড়ে ৪র্থ কিংবা ৭ম হয়েছিল সে।

একদিন সন্ধ্যায় বাসায় পড়ছি, হঠাৎ আম্মা বললেন দৃষ্টি আমার সংগে দেখা করতে এসেছে বাসায়। মা মিটিমিটি হাসছিলেন। দৃষ্টি খুব সাবলীল ভাবে বাসায় ঢুকল, সংগে আর কেউ একজন ছিল, মনে নেই এতদিন পরে, তবে তার বাবা নয়। মায়ের সংগে জড়তা ছাড়াই কথা বলল সে, বাসা ঘুরল, আর এই আমি, স্কুলের মাস্তান, নিজের বাসায় সহপাঠিনীর সামনে লজ্জায় লাল হয়ে গেলাম, ভাষা হারিয়ে ফেললাম।

পরদিন স্কুলে গিয়ে শুনলাম দৃষ্টির বাবা বদলি হয়ে গেছেন। দৃষ্টি শেষ দেখা করতে গিয়েছিল আমার বাসায়, এবং শুধু আমারি বাসায়, আর কোথাও নয়।

এর পর অনেক বার গিয়েছি ওর বাসার আশেপাশে। যখন জিলা স্কুলে পড়তাম, ক্যাডেটে পড়তাম। কি জন্য যেতাম তাও এক রহস্য, কিন্তু যেতাম।

দৃষ্টির বাসা সহ পুরো জায়গা ঘিরে এখন রংপুর চিড়িয়াখানা। বাসাটা নেই, শুধু বেচে আছে পেয়ারা গাছগুলো।

৫,২৩৮ বার দেখা হয়েছে

৭৮ টি মন্তব্য : “ধুলোমাখা শহর, ধুলোমাখা স্মৃতি – ০১”

  1. এক ঝটকায় ছোটবেলার কুমিল্লা শহরে ফিরে গেলাম যেনো। আহা! আমার ছেলেবেলা, প্রাইমারী স্কুলের বন্ধুরা, বাসার পাশের ধর্মসাগর আর আমার শহর।
    ফয়েজ ভাই , আপনার লেখা নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নাই। এই সিরিজ যেনো চলে অনেকদিন।
    আপনার জন্যে একটা গান... কেমন লাগলো জানাবেন।

    ডাউনলোড লিঙ্ক
    আমার শহর-চন্দ্রবিন্দু

    জবাব দিন
  2. সাকেব (মকক) (৯৩-৯৯)

    ফয়েজ ভাই,
    আপনার লেখা সম্পর্কে আসলেই কিছু বলার নাই :hatsoff:
    বস,আপনি সিসিবি'র সাকীব আল হাসান...(বাংলাদেশ দলের সাথে পার্থক্য শুধু এই যে, আমাদের এইখানে আরো কিছু নির্ভরযোগ্য পারফর্মার আছে...)

    ঢাকা শহরে জন্মানো এবং লালিত-পালিত হওয়ার জন্য আজীবন কিছু দুঃখ থেকে যাবে...আপনার এই লেখা এবং ঋজু ভঙ্গিতে দাঁড়ানো 'দৃষ্টি'টা আমার দুঃখ আরো বাড়ায়ে দিলো :((


    "আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
    আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস"

    জবাব দিন
  3. এহসান (৮৯-৯৫)

    ফয়েজ ভাই,

    মজা লাগসে আপনার গল্পটা। ছোট্ট বেলার প্রেম আমার সেই... 🙂

    এক ঝটকায় ছোটবেলার কুমিল্লা শহরে ফিরে গেলাম যেনো। আহা!

    অনুভূতিটুকুও কামরুলের মতোই। গান গুলো সুন্দর। সুন্দর চাঁদ ধন্যবাদ তোমাকে।

    জবাব দিন
    • ফয়েজ (৮৭-৯৩)

      ছোট্ট বেলার প্রেম গুলা কেমন জানি আলাদা, আলাদা, নিষ্পাপ নিষ্পাপ অনুভুতি তাই না।

      অফটপিকঃ তোমার জন্য খারাপই লাগল কালকে রাতে, ভাবছিলাম ম্যান ইউ ড্র করবে। লাষ্ট মিনিটে লম্বা চুলের পোলাটা গোল দিল।


      পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

      জবাব দিন
  4. টিটো রহমান (৯৪-০০)
    এর পর অনেক বার গিয়েছি ওর বাসার আশেপাশে। যখন জিলা স্কুলে পড়তাম, ক্যাডেটে পড়তাম। কি জন্য যেতাম তাও এক রহস্য, কিন্তু যেতাম।

    পুরো লেখা আসলেই হিট। :hatsoff:
    এ লেখা থামলে ফয়েজ ভাইর খবর আছে

    অফটপিক: ভাবীর দিকে দৃষ্টি আছে তো??? 😉


    আপনারে আমি খুঁজিয়া বেড়াই

    জবাব দিন
  5. কামরুলতপু (৯৬-০২)

    ইশশ আমিও আমার ছোটবেলা সিলেটে চলে গেলাম। ছোট্ট শহরের মজা গুলা সেইরকম হয়। সেটা বেশি বুঝার আগেই আব্বুর বদলি হয়ে ঢাকায় চলে আসার জন্য আব্বুর বসের ব্যঞ্চাই।
    ফয়েজ ভাই কঠিন ভাল লাগল। চোখের সামনে যেন পেয়ারা গাছ গুলা দেখতে পারছি।

    জবাব দিন
  6. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

    ফয়েজ ভাই,
    আপনার লেখা পড়ার পর একটা কবিতা লিখে ফেললাম..

    দৃষ্টি, প্রদীপ জ্বেলে খুঁজেছি তোমায়
    ফেলে আসা দিনগুলো মনে পড়ে যায়
    এ জীবনে তুমি ছাড়া আর কেহ নাই
    হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি- ফিরে পেতে চাই..

    *'দৃষ্টি' র পর কমা ইচ্ছে করেই দিয়েছি.. B-) 😉
    * কবিতাটা কেমন জানি আগেও শুনেছি টাইপ হয়েছে.. :-B
    জন্মাতে মনে হয় দেরী করে ফেলেছি.. :bash:


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন
  7. তাইফুর (৯২-৯৮)
    আর এই আমি, স্কুলের মাস্তান, নিজের বাসায় সহপাঠিনীর সামনে লজ্জায় লাল হয়ে গেলাম, ভাষা হারিয়ে ফেললাম।

    ক্যামুন মাস্তান বুঝছি ... মাইয়াগো খামচি খাওয়া মাস্তান। 😀

    দৃষ্টির বাসা সহ পুরো জায়গা ঘিরে এখন রংপুর চিড়িয়াখানা।

    আর দৃষ্টি ম্যাডামের রুমটা ... হরিণি'র খাচা। (বড় ভাইয়ের ছোট বেলা'র প্রেম ।। ম্যাডাম না বইলা উপায় আছে ??)

    ফয়েজ ভাই, লেখাটা পড়ার পর থেকে, বুকের মধ্যে কেমন খালি খালি লাগতেছে।


    পথ ভাবে 'আমি দেব', রথ ভাবে 'আমি',
    মূর্তি ভাবে 'আমি দেব', হাসে অন্তর্যামী॥

    জবাব দিন
  8. শরিফ সাগর (৯৭-০৩)
    ছোট্ট বেলার প্রেম গুলা কেমন জানি আলাদা, আলাদা, নিষ্পাপ নিষ্পাপ অনুভুতি তাই না।

    খুউউবি আলাদা, খুউবি নিষ্পাপ, একদম ইনোসেন্ট। 😉

    ভাইয়া, জাপান থাইকা এক্কেবারে রংপুরে বাসার পাশে চইলা গ্যাছিলাম কিছু সময়ের জন্য। অনেক কিছু মনে করায়ে দিলেন। থ্যাঙ্কু থ্যাঙ্কু 😉

    জবাব দিন
    • সাকেব (মকক) (৯৩-৯৯)
      জাপান থাইকা এক্কেবারে রংপুরে বাসার পাশে চইলা গ্যাছিলাম কিছু সময়ের জন্য।অনেক কিছু মনে করায়ে দিলেন।

      কষ্ট করে এতোদূর বাসার পাশে যখন চইলাই গেসো, তাইলে পাশের বাসার কোন কোন মেয়ের কথা মনে পইড়া গেল- সেইটাও যদি একটু বইলা যাইতা... :grr:


      "আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
      আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস"

      জবাব দিন
  9. জিহাদ (৯৯-০৫)

    আহা! এক দৃষ্টির কথা বলে কয়েক ডজন দৃষ্টি কে দৃষ্টির সামনে এনে হাজির করিয়ে দিলেন। :dreamy:

    তাদের মধ্যে প্রথমজন ছিল আমার চেয়ে দুই ইঞ্চি লম্বা 🙁

    চলুক সিরিজ। রইলাম অপেক্ষায়। :awesome:


    সাতেও নাই, পাঁচেও নাই

    জবাব দিন
  10. সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

    ফয়েজ, তোমার সিরিজ চলুক। আর এই সুযোগে আমরাও টাইম মেশিনে যার যার অতীতে ফিরে যাই। ইন দ্যা ইয়ার ..............

    কি করবো বলো, বুড়াদের এই এক দোষ!! :bash: :bash: :bash:


    "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

    জবাব দিন
  11. কাইয়ূম (১৯৯২-১৯৯৮)

    হায়, ফয়েজ ভাই কত্ত লাকি আছিলেন :bash: :bash:
    ইশ, কি যে কপাল নিয়া আইলাম দুইন্যাতে ~x( দৃষ্টি, বৃষ্টি, সৃষ্টি, মিষ্টি কারো ধারে কাছে যাইতামপার্লামনা :khekz: :khekz:

    বাসাটা নেই, শুধু বেচে আছে পেয়ারা গাছগুলো।

    আহারে পেয়ারা গাছ ;)) ;))


    সংসারে প্রবল বৈরাগ্য!

    জবাব দিন
  12. তানভীর (৯৪-০০)

    ফয়েজ ভাই, আপনার লেখনী নিয়ে কিছু বলব সেই দুঃসাহস আমার নেই।

    আমরা যারা মফঃস্বল শহরে বড় হয়েছি তাদের জীবনে কত ছোট ছোট ঘটনা থাকে। ইমোশনাল করে দিলেন রে ভাই!

    খুব, খুব ভালো লাগল। পরের পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম।

    জবাব দিন
  13. তৌফিক (৯৬-০২)

    আমার বাল্যবেলার প্রথম প্রেমকে দেখছিলাম অনেক বছর পর ধানমন্ডি লেকপাড়ে। একটা হোদল কুতঁকুতঁকে নিয়া বইসা আছে। x-(

    তৎকালীন প্রেমিকা, বর্তমান বউ সাথে ছিল। তারে দেখায়া বললাম, বাচ্চাকালে এই মাইয়াটারে আমি খুব ভালা পাইতাম। 😀

    বউ মাইন্ড খায় নাই। খালি বলছে, তোমার চয়েজ তো বাচ্চাকাল থাইকাই ভালো। 😉

    অনেক কথা মনে করায়া দিলেন ফয়েজ ভাই।

    জবাব দিন
  14. ফয়েজ (৮৭-৯৩)
    তোমার চয়েজ তো বাচ্চাকাল থাইকাই ভালো

    বাহ, কুটনৈতিক ডায়লগ দিছে তো। নিজেই ক্যামুন সুন্দর কইরা নিজেরে ভাল কইল। :salute:


    পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : ফয়েজ (৮৭-৯৩)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।