খ্যাপ

আর কেউ বুঝে কিনা কে জানে, তবে অন্ধকারের যে একটা নিজস্ব আলো আছে তা রুস্তম শেখ বেশ ভালো মতই বুঝে। আলোটা ধরতে পারে বলেই ঘোর অমাবস্যায়ও পচিশ তিরিশ হাত দুরের জিনিস সে স্পষ্ট দেখতে পায়। এই যেমন এখন। ডাকাতিয়া নদীর যে জায়গায় সে গলা পানিতে দাঁড়িয়ে আছে, একটা শত বছরের পুরনো পাকুড় গাছের আড়ালে, তা একহাত দূর থেকেও কোন মানুষ বুঝতে পারবে না। অথচ রুস্তম শেখ তিরিশ হাত দূরে খালের ওপারে বড় একটা বন বিড়ালকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। বন বিড়ালটি অনেকক্ষন সময় নিয়ে তার দিকেই তাকিয়ে আছে, কি জানি তার হাবভাব জানার চেষ্টা করছে কিনা। আজকে এক অমাবস্যা, আষাঢ়ের শেষ, ভাটার টান আসার বাকি আরো ঘন্টা দুই, আজ বা কালকের মধ্যে কাজ না হলে সুযোগ আছে আরো দুইটা, শ্রাবনের মাঝামাঝি একদিন, যদিও র্পূণিমার আলোতে একটু অসুবিধা হতে পারে, আর হচ্ছে শ্রাবনের শেষের অমাবস্যার দুদিন। এই সময় গুলোতেই জোয়ার-ভাটার টানটা বেশি। রুস্তম শেখের পছন্দের সময় বছরের এই দুই মাস।

ডাকাতিয়া নদীর যেখানে পাকুড় গাছটা, তার আধা মাইল উজানে বসাকের হাট। নদীটার উতপত্তি বিল ডাকাতিয়া থেকে। ডাকাতিয়া বিল থেকে ডাকাতিয়া খাল নামে বের হয়ে, তিন মাইলের মত ভাটিতে, বসাকের হাটের কাছে এসে মিলেছে রুপমুখি নদীর সাথে। রুপমুখি রুপসার একটি শাখা। রুপমুখি নদী আর ডাকাতিয়া খালের মিলিত নাম ডাকাতিয়া নদী। সোজা পনের মাইল দক্ষিনে সাগর, হাট আর সাগরের মাঝে পুরোটাই সুন্দরবন। বড় বড় অনেক বেপারী এই নদী দিয়েই সাগরে যায়, কেউ যায় মাছ ধরতে, আর কেউ যায় ব্যবসার কাজে, ভারতে। ব্যবসার আড়ালে মুলত চোরাকারবার। মাঝে মাঝে চোরাই কাঠ, বন্য প্রানীর নৌকাও দেখা যায়। বসাকের হাটটার বয়স স্বাধীনতার কাছাকাছি। প্রথম এখানে দোকান দেয় মতি বসাক। নৌকা আর বজরা মেরামতির কাজ। সাগর পেরিয়ে যেসব নৌকা মাছ নিয়ে খুলনা কিংবা চালনার দিকে যেত, তাদের একটা বড় অংশ ডাকাতিয়া নদী দিয়ে ঢুকে বাংলাদেশে। সেসব নৌকার টুকটাক মেরামতির কাজ করত মতি বসাক। মহাজনরা এক-দুদিন বিশ্রাম নিত মতি বসাকের দোকানে। তাদের বিশ্রামের জন্য আলাদা একটা ঘর করেছিল মতি বসাক। বেপারীরা খাওয়া-দাওয়া হিসাবে পেত মতি বসাকের বউয়ের রান্না করা খিচুড়ি আর মাছ ভাজা, নির্দিষ্ট টাকার বিনিময়ে। সব মিলে আয় ভালই হত মতি বসাকের। তিন চার বছরের মধ্যে আরও কিছু দোকান বসে জায়গাটায়, রুস্তম শেখের বাবা একটা চুল কাটার দোকান দেয়, মিষ্টি বিক্রি শুরু করে তহুরার বাপ। বিশ বছরের মধ্যে মোটামুটি পাচশ লোকের মত বসত হয়, নাম দেয়া হয় বসাকের হাট, প্রথম বসত মতি বসাকের নামে। কিছু মহাজন জমিতে জোয়ারের পানি আটকিয়ে ঘের তৈরী করে শুরু করে চিংড়ি চাষ, কিছু মহাজন সুদে টাকা ধার দেয়া শুরু করে ছোট ছোট মাঝিদের, আর কিছু মহাজন বড় আকারে শুরু করে শুটকির কারবার। তবে তলে তলে প্রায় সব মহাজনেরই আছে কিছু অন্য রকম ব্যবসা, কাঠের চোরাকারবার, বন্য পশু বিক্রি কিংবা নিদেন পক্ষে ভারতীয় পন্যের কারবার। গত দশ বছরে চোখের সামনে অনেককে টাকা বানাতে দেখেছে রুস্তম শেখ। প্রথম প্রথম বেশ অবাক হত সে, যখন দেখত হঠাত কেউ পয়সা বানিয়ে খুলনা বা পাশের সাতক্ষীরায় বড় ব্যবসায়ী হয়ে যেত। এটা কিভাবে হয়, তাদের হয় না কেন, প্রায়ই চিন্তা করত সে। কোন কুল কিনারা করতে পারত না।
পরে পুরো ব্যপারটা তাকে বুঝিয়ে দেয় জমির শেখ, তার বাবা।
“বুঝলি বাপ, সুযোগ সব সময় আসে না। তয় আসে। সবার জীবনেই আসে এক দুইবার। সবাই সুযোগটা নিতে পারে না।“
“বাপজান, তোমার জীবনে আসে নাই?”
“আইছিলরে, আইছিল, বুঝতে পারি নাই। হারান আর আমি তখন বন্ধু, তুই তোর মায়ের প্যাটে। সুযোগ আমি নেই নাই, মন সায় দেয় নাই। হারান নিছিল। এখন কই হারান আর কই আমি” বাবার চাপা দীর্ঘশ্বাস বেশ বুঝা যায়।
হারান এখন খুলনার বেশ বড় ব্যবসায়ী, এম,পি ইলেকশন করেছিল গতবার, হেরে গেছে যদিও। প্রথম জীবনে কিছুদিন মুদি দোকান চালিয়েছিল বসাকের হাটে, এরপর কাঠের ব্যবসা করে পাচ বছরের মধ্যে কপাল ফিরিয়ে দশ বছর আগে স্থায়ী ভাবে চলে গেছে খুলনায়। মাঝে মাঝে আসে বসাকের হাটে, অনেক লোকজন সাথে থাকে, সময় হলে শখ করে চুল কাটায় পুরনো বন্ধুর দোকানে।

রুস্তম শেখ বাবার কষ্টের জায়গাটা বেশ ধরতে পারে।

বাবার সংগে পৈত্রিক কাজ শিখার সময় সে প্রথম খুন হওয়া লাশ দেখে। অচেনা মানুষ। কয়েকদিন খুব হইচই হল এলাকায় এ নিয়ে। পুলিশ খুব হম্বিতম্বি করল কয়েকদিন। একে ধরে তো তাকে মারে। হুলুস্থুল অবস্থা। কিন্তু মামলা নেয় না কোন দারোগা। নলকাডাংগা থানা বলে খুন হয়েছে উজানে, লাশ ভেষে এসেছে রুপমুখি দিয়ে, তাই ভাংগুরা থানার উচিত মামলা নিয়ে তদন্ত করা। ভাংগুরা থানা বলে প্রমান ভেষে গেছে নলকাডাংগায়, ভাংগুরার কিছু করার নেই।

খুনের মামলা হলইনা শেষ পর্যন্ত, অপমৃত্যুর মামলা হল দুই থানায়। লোকজন সেই খুনের কথা ভুলেও গেল চার মাসের মাথায়। সর্বহারাদের দাপটে তখন অস্থির দুই থানা। অচেনা লাশ নিয়ে সময় কাটানোর সময় কই?

অবস্থান গত কারনেই হোক কিংবা অন্য কিছু, বসাকের হাটে বেশ টাকাওয়ালা পরিবার তৈরী হয়েছে বেশ কয়েকটি। কোরবানীর ঈদে বড় বড় গরু কোরবানী দেয় সেইসব পরিবারের লোকজন। পুরো হাটে কসাই আছে মাত্র একজন, সে পুরোটা কুলিয়ে উঠতে পারেনা। নিতান্ত শখের বশে বছর পাচেক আগে মিন্টু মহাজনের গরুটা তৈরী করে দেয় রুস্তম শেখ। দেড় ঘন্টার মধ্যে কাজটা শেষ হয় দেখে বড্ড অবাক হন মিন্টু মহাজন।
“শেখের ব্যাটা, তুমি কি এই কাজ করছ আগে?”
“না মহাজন, করি নাই, তয় মনে কইতেছিল কাজটা সহজই হইব।”
“তুমি তো ভালু কসাইয়ের চেয়ে ভালো করছ, গত বছর ভালু এর চেয়ে ছোট গরু অনেক বেশি সময় নিয়া করছিল।“
দাত বের করে হেসেছিল রুস্তম শেখ “কাজটায় কিন্তুক ব্যাপক আনন্দ পাইলাম, মহাজন।”
“তুমি আনন্দ পাইছো গরু কাটতে?” মিন্টু মহাজন অবাক হন।

কোরবানী ঈদের বিশ দিন পরে মিন্টু মহাজন তাকে প্রথম কাজ দেন। এক লাখের চুক্তি, অর্ধেক কাজের আগে দিবেন তিনি, এক মাসের মধ্যে কাজ শেষ করতে হবে, প্রমান রাখা যাবে না, কাজ ভাল হলে আরও কাজ দিবেন, পারিশ্রমিকও বাড়বে।
বাবার কথাটা মনে পড়ে রুস্তম শেখের, “সুযোগ বারবার আসে না, তয় আসে, সবাই ধরতে পারে না।“
নিজস্ব কিছু হিসাব করে ফেলে রুস্তম শেখ। থানার ব্যপারটা তো আছেই, কাজটা করতে হবে এমন ভাবে যাতে দারোগা বুঝতে না পারে মামলা হবে কোন থানায়, আর সবচেয়ে ভাল হয় যদি কাজটা করা হয় ভাটার টান শুরুর সময়। পানি টানে লাশ ভেষে যাবে সাগরে। তহুরাকে নিয়ে সাতক্ষীরা বেড়াতে গিয়ে একটা মাছের ঘের দেখে খুব পছন্দ হয়েছিল তার, লাখ পাচেক টাকা হলেই হয়ত কিনা যাবে, ছোয়া যাবে স্বপ্নটা। প্রতিমাসে অন্ততঃ দুই রাত সে কাটায় ঘরের বাইরে, জরিনার কাছে, তহুরা মেনে নিয়েছে ব্যাপারটা, রাত বাইরে কাটালে ভাববে জরিনার কাছেই ছিল। জীবনের প্রথম পনেরটি বছর সে কাটিয়েছে ডাকাতিয়া নদী আর সুন্দরবনের আনাচে কানাচে, সব কিছু তার তালুর মত চেনা। কঠিন হবে না কাজটা। নিমেষেই হিসাব করে ফেলে রুস্তম শেখ। বাবার মত সুযোগের হাতছাড়া সে করতে চায় না। ধরতে চায় স্বপ্ন গুলো।

কতদিন আগের কথা এইগুলো, বছর চার নাকি পাচ? কোন কোন মহাজনের কাজ করেছে সে এই পর্যন্ত? গলা পানিতে ডুবে ডুবে চিন্তা করে সে। গত বছর ঘেরের বায়নার টাকা দিয়ে এসেছে। পা ঘেসে ঠান্ডা পিচ্ছিল একটা লতানো শরীর চলে যায়, পানি সাপ মনে হয়, পানিতে পাড় ঘেষে একটা ময়লা ভেষে আসছে তার দিকে। মনে মনে গালি দেয় একটা রুস্তম শেখ। পিছনে শক্ত দড়ি দিয়ে কোমড়ে বাধা ভোজালিটা ছুয়ে দেখে। আকাশের তারা দেখে বুঝতে চায় রাত কত। পাকুড় থেকে সর সর শব্দে উড়াল দেয় একটা রাত জাগা পাখি।

অনেক দূরে বিন্দুর মত একটা আলো দেখে রক্তে নাচন উঠে রুস্তম শেখের। মনটাকে ঠিক করে নেয় শেষ বারের মত।

কাজটা আজকেই করতে হবে এমন কথা নেই, আরও দু-তিনটা সুযোগ আসবে সামনে। চোখটা শিকারী বিড়ালের মত শরু হয়ে গেছে তার। আরও কিছুক্ষন পরে নৌকার পিছনে পিছনে সাতরাতে শুরু করে সে। কালো শরীর থেকে পিছলে পিছলে সরে যেতে থাকে ডাকাতিয়া নদীর কালো পানি।

ভাটার টান শুরু হয়ে গেছে, পানি নেমে যাচ্ছে দ্রুত।

(যতটা নিখুত হবে ভেবেছিলাম, তত নিখুত হলোনা কাজটা। সংলাপগুলো খুলনা/সাতক্ষীরার আঞ্চলিক ভাষায় দিতে পারলে ভাল হত। ভাষাটা ভুলে গেছি বলে দিতে পারলাম না। কোন পাঠক মন্তব্য আকারে দিলে গল্পে জুড়ে দিব।)

৩,৪৩৮ বার দেখা হয়েছে

৩১ টি মন্তব্য : “খ্যাপ”

  1. তৌফিক (৯৬-০২)

    ধন্যবাদ ফয়েজ ভাই। রাত্রে বাসায় ফিরা ফ্রোজেন ডিনার গরম কইরা খাইতে খাইতে লেখাটা পড়লাম। আপনের লেখা ছিল বইলা রক্ষা না হইলে এই অখাদ্য (আল্লাহ মাফ করুক) খাইতে বড়ই কষ্ট হইত।

    আল-মাহমুদের "জলবেশ্যা" গল্পটার মতো স্বাদ পাইছি এখানে।

    গল্প নিয়া কোন কথা নাই, মতি বসাকের নাম নিয়া আছে।

    মতি নামটা সাধারণত মতিয়ার বা মতিউর - এর সংক্ষিপ্ত সংস্করণ হয়, আর বসাক তো হিন্দু নাম। আমার কাছে কেমন যেন লাগল নামটা।

    গল্প সরাসরি প্রিয়তে।

    জবাব দিন
    • ফয়েজ (৮৭-৯৩)

      😀 যাক, খ্যাপ টা একটা কামের কাম করছে, তা এই ডিনারের নাম কি দিছিলা?

      ঠিকই আছে তোমার কথা, আবার উল্টাও আছে। যেমন ধর "মজুমদার" হিন্দু, মুসলমান কমন নাম। বসাক নামটা কেন জানি মনে ধরছে লেখাটার সময়। তাই নিয়েছি। এত কিছু ভাবিনি।


      পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

      জবাব দিন
  2. মুসতাকীম (২০০২-২০০৮)

    খুবই ভালো হইছে :clap: :clap: :clap: :clap: :clap:
    :boss: :boss: :boss: :boss: :boss: :boss:


    "আমি খুব ভাল করে জানি, ব্যক্তিগত জীবনে আমার অহংকার করার মত কিছু নেই। কিন্তু আমার ভাষাটা নিয়ে তো আমি অহংকার করতেই পারি।"

    জবাব দিন
  3. তাইফুর (৯২-৯৮)

    খ্যাপের জন্য প্রতীক্ষার পালা শেষ হইল।
    ফয়েজ ভাই, গল্প বর্ণনা অসাধারণ হইছে। দারুন ফিনিশিং। সার্থক ছোট গল্প।


    পথ ভাবে 'আমি দেব', রথ ভাবে 'আমি',
    মূর্তি ভাবে 'আমি দেব', হাসে অন্তর্যামী॥

    জবাব দিন
  4. কামরুলতপু (৯৬-০২)

    দুর্দান্ত বর্ণনা। ভাইয়া ঐ দিকের সব কিছু এইভাবে জানেন কিভাবে? সার্থক ছোটগল্প কারণ আমার এখন খালি মনে হচ্ছে পরে কি হইল কারে মারল কেমনে মারল পারল নাকি শেষ পর্যন্ত ...

    জবাব দিন
  5. সায়েদ (১৯৯২-১৯৯৮)
    আরও কিছুক্ষন পরে নৌকার পিছনে পিছনে সাতরাতে শুরু করে সে। কালো শরীর থেকে পিছলে পিছলে সরে যেতে থাকে ডাকাতিয়া নদীর কালো পানি।

    ভাটার টান শুরু হয়ে গেছে, পানি নেমে যাচ্ছে দ্রুত।

    তারপর? তারপর??
    অসাধারণ ফিনিশিং :clap: :clap: । অন্য কোনরকম হলে এত ভালো লাগত না মনে হয়।


    Life is Mad.

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : ফয়েজ (৮৭-৯৩)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।