এলোমেলো কথা

মাঝে মাঝেই দিনগুলি যাচ্ছেতাই রকমের বিরক্তিকর ঠেকে আমার কাছে। এই যেমন আজকে। এর পর সর্দি লেগেছে আবার, সাথে মরার উপরে খড়ার ঘা এর মত কোল্ড এলার্জিটা।

কোন সন্দেহ নেই, চট্টগ্রামের সবথেকে বিরক্তিকর আবহাওয়া এই জুন-জুলাই-অগাষ্ট মাসটাতেই। বিরক্তিকর মানে বিরক্তিকর, মহা বিরক্তিকর। সবচেয়ে খারাপ লাগে আর্দ্রতাটা। সহজে ঘাম শুকাতে চায় না। আমার চেয়ে বেশি কষ্ট শারমীন আর জিহানের, কারন দিনের বেশির ভাগ সময়টাতেই আমি অফিসে থাকি, এসির ঠান্ডা হাওয়া ছাড়াও, আর্দ্রতার রেশ টুকু নেই এখানে।

ভাইয়ার খুব ইচ্ছে ছিল বাবার রুমে একটা এসি লাগিয়ে দিবে। কিন্তু আমার বাবা তো নিজের জন্য কোন পাকা বাড়ি করেননি, সেমি পাকা টিনের একটা ঘরে তিনি আমাদের রেখেছিলেন, নিজেও থাকতেন ওখানে। অজস্র ফুটো ছিল বাবার ঘরটাতে এখানে সেখানে, ছাদে, লোহার গ্রীলের পাশে কাঠের জানালাটায়। এসির জন্য ঘরটাকে বায়ু-নিরোধক করতে হবে শুনেই বাবা আপত্তি করেছিলেন, তার আর এসি রুমে থাকাটা হয়ে উঠেনি। হয়ত নিজের ঘরে কিছুদিন পরেই এসি লাগাতে হবে আমার, বাবার কথা কি মনে হবে না একটুও তখন? বাবা জীবনে অনেক কিছুই করতে পারতেন, বড় চাকুরীও পেয়েছিলেন কলকাতায়, কিন্তু তার নিজের ভাই-বোন আর সন্তানদের কথা চিন্তা করে চলে গিয়েছিলেন গ্রামে, এরপর রংপুরে একটা বাসা। সেই অর্থে বাবা সফল ছিলেন বলা যায়, তার ভাইয়েরা, সন্তানেরা ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর অনেক জায়গায়।

যদিও তিনি শুনে আছেন সেই পোড়ো গ্রামের বাড়িটাতেই।

আমরা হয়ত অনেক বড় হয়েছি সবাই, কিন্তু বাবার মত হতে পারিনি কেউই। আমার বাবা ছিলেন বিরাট একটা বটগাছের চেয়েও অনেক বড়, যার ছায়া আমি এখনো দৌড়ে শেষ করতে পারিনি।

কোল্ড এলার্জি বলে যে একটা জিনিস দুনিয়াতে থাকতে পারে এটা জেনেছি খুলনায় গিয়ে। মাঝে মাঝে হঠাৎ কোন কারন ছাড়াই চোখ খুব চুলকাত আমার, লাল হয়ে যেত, অনবরত পানি পড়ত। ফুলবাড়ী গেটের ৫০ টাকা ভিজিটের এমবিবিএস ডাক্তার আমাকে বলেছিল কোল্ড এলার্জির কথা, নিষেধ করেছিল হাত পায়ে ঠান্ডা লাগাতে, মুজা পড়তে, পড়ে এটা কাজে লেগেছিল খুব, হোকনা ভিজিট মাত্র ৫০।

জীবনে প্রথম যে মৃত্যুটি দাগ কেটেছিল মনে, তা ছিল “বিজু”র মৃত্যু। আগের দিন বিকালেও মসজিদের ফুটবল মাঠটাতে আমরা একসংগে ফুটবল খেলেছিলাম। বিজু গোল-কীপার ছিল, আমি একটা গোলও করেছিলাম। মসজিদের মোয়াজ্জিন কলিম চাচাকে দেখে পালিয়েও গিয়েছিলাম মাঠটা থেকে। কলিম চাচা খুব চিৎকার করে বকত আমাদের ওই মাঠে খেলতে দেখলে। পরদিন সকালে আকাশে খুব মেঘ করে এল, স্কুলে যেতে হয়নি, পাড়ার সবাই দেখলাম বিজুর বাসার দিকে ছুটছে, শুনলাম সকালে উঠে তাকে নাকি বিছানায় মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে, রাতে পেটের ব্যাথা হয়েছিল, ওর মা ওকে বলেছিল ঘুমিয়ে পড়তে।

বিজু খুব ভালো ছেলে ছিল, আমাদের সবার মধ্যে সবথেকে ভদ্র। আমার মা তখন বলেছিলেন, ভালো ছেলেরা মরে গেলে আকাশ নাকি এভাবেই কাঁদে।

সেইথেকে আকাশ কালো হয়ে এলেই আমার বিজুর কথা মনে পড়ে।

জীবনটা আসলে গড়পড়তা। একটু উঠা-নামা হয়তো আছে, আর আছে বেঁচে থাকা। চোখ ধাঁধাঁনো অনেক কিছুই হয়ত আছে এখানে, কিন্তু সব গুলোর পিছনেই লুকিয়ে আছে অজস্র পরিশ্রম, ঘাম আর হাসি-কান্নার গল্প।

ভালো আছি নীলাকাশ, ঝুলে যাওয়া ইউক্যালিপটাসের খোলস, নতুন ফসল।
লম্বা ঘোমটার নীচে লালে মাখা সিঁথি, মধ্য রাতের নতুন শিৎকার।

ভালো আছি হারিয়ে ফেলা ঝিনুক, সাগরের বাতাস, কুড়িয়ে পাওয়া পাথর।
সোডিয়ামের ভূতুড়ে আলো, ফ্যাকাশে চাঁদ।
ভালো আছি কলমীর ঝাড়, লাল পদ্ম, পানকৌড়ি, ঘাসের শিশির।

চায়ের টেবিলে তুখোর আড্ডা, রাত করে ঘরে ফেরা, প্রিয়ার ভ্রুকুটি।

ভালো আছি অজস্র কথা, ধীর পায়ে হেঁটে চলা, হাতলে ঝুলে পরা।
সিএনজির পোড়া ঘ্রান,
ভালো আছি মেরী-গো-রাউন্ড।

৬,১৬৫ বার দেখা হয়েছে

৫৩ টি মন্তব্য : “এলোমেলো কথা”

  1. মুসতাকীম (২০০২-২০০৮)

    বস বস :boss: :boss: :boss: :boss:


    "আমি খুব ভাল করে জানি, ব্যক্তিগত জীবনে আমার অহংকার করার মত কিছু নেই। কিন্তু আমার ভাষাটা নিয়ে তো আমি অহংকার করতেই পারি।"

    জবাব দিন
  2. মইনুল (১৯৯২-১৯৯৮)
    ভালো আছি নীলাকাশ, ঝুলে যাওয়া ইউক্যালিপটাসের খোলস, নতুন ফসল।
    লম্বা ঘোমটার নীচে লালে মাখা সিঁথি, মধ্য রাতের নতুন শিৎকার।

    ভালো আছি হারিয়ে ফেলা ঝিনুক, সাগরের বাতাস, কুড়িয়ে পাওয়া পাথর।
    সোডিয়ামের ভূতুড়ে আলো, ফ্যাকাশে চাঁদ।
    ভালো আছি কলমীর ঝাড়, লাল পদ্ম, পানকৌড়ি, ঘাসের শিশির।

    চায়ের টেবিলে তুখোর আড্ডা, রাত করে ঘরে ফেরা, প্রিয়ার ভ্রুকুটি।

    ভালো আছি অজস্র কথা, ধীর পায়ে হেঁটে চলা, হাতলে ঝুলে পরা।
    সিএনজির পোড়া ঘ্রান,
    ভালো আছি মেরী-গো-রাউন্ড।

    অসাধারন ফয়েজ ভাই ...... :clap: :clap:

    জবাব দিন
  3. কামরুল হাসান (৯৪-০০)

    বাহ! চমৎকার লেখা।
    কবিতাটা আরো সুন্দর হয়েছে।


    ---------------------------------------------------------------------------
    বালক জানে না তো কতোটা হেঁটে এলে
    ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনো কালে।।

    জবাব দিন
  4. এহসান (৮৯-৯৫)

    ফয়েজ ভাই,

    আপনি ফর্মে ফিরছেন, চিন্তা করেই ভালো লাগছে। লেখাটা ভালো লেগেছে। :clap: লেখাটায় মন খারাপ ভাব থাকলেও শেষের দিকে এসে মন ভালো হয়ে গেছে। কবিতাটাতো সেইরকম হয়েছে। পাথরায় আরকি!! 🙂

    আর বানানগুলো মডারেটর ঠিক না করে এখানে কমেন্ট হিসাবে দিলে আমাদেরও/পাঠকদেরও বানানটা শেখা (মানে মনে পড়ে যায়) হয়ে যায়।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : তানভীর (৯৪-০০)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।