হাহাকার

দুপুর হলেই সময় যেন স্প্রিং এর মত লম্বা হতে শুরু করে। আনইন্সটাইনের সময় সংকোচনের একটা সুন্দর উদাহরণ পাওয়া যায়। পাখি আর ডাকতে চায় না, শুধু গাছের ডালে বসে বসে ঝিমোয় আর অবাক বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকে পথিকের দিকে। গাছগুলো যেন জড়সড় হয়ে দাড়িয়ে থাকে রাস্তার পাশের এক কোনায়। দুষ্ট দমকা বাতাস এসে নাড়িয়ে দেয় তাদের আর তারা যেন পুরোনো চুলের মত শুকনো পাতাগুলো ঝেড়ে ফেলে দেয়। টিনের চালে একা শালিকটা পায়চারি করে, যেন কারো আসবার কথা ছিলো,কেউ তো আসে না। শালিকের দুঃখ তার ডানায় ভর করে আর উড়ে চলে যায় দূর দিগন্তে। মুখ দিয়ে তার তীব্র হাহাকার ধ্বনি বের হয় আর প্রকৃতি হয় সচকিত।

রোমেল শুয়ে শুয়ে এসব দেখে। সে একজন পেশাদার আর্টিষ্ট, জানালার বাইরে আকাশটার দিকে তাকিয়ে দেখে সে একলা একটা চিল। চিলটাকে সে টেলিপ্যাথির সাহায্যে নানান সংবাদ পাঠায়, কিন্তু চিলটার বয়েই গেলো এসব শোনার। রোমেল ভাবে চিলের রাডারে নিশ্চই কোনো সমস্যা আছে। তার জানালার কাছে একটা মেহগনি গাছ আছে। মেহগনি গাছে একটা বিচিত্র বীজের মতো ধরে। দেখতে অনেকটা পাতার মতো। বাতাস এলে তা গাছ থেকে খসে পড়ে আর ঘুরতে ঘুরতে উড়ে যায় অনেক দূরে। বীজটা যেখানে পড়ে, সেখানেই মেহগনির চারা জন্মায়। রোমেলের মনে হয়, মানুষও বুঝি এমনিভাবে পৃথিবীতে এসেছে আর এমনিভাবে ছড়িয়ে পড়ে। জানালা দিয়ে অচেনা মানুষদের হাত-পা নাড়া, কথা-বার্তার বিভিন্ন অঙ্গগভঙ্গি খেয়াল করে রোমেল। তার একটা সিরিজ পেইন্টিং শুরু করার ইচ্ছা আছে এটা নিয়ে।

রোমেল এখন তাকিয়ে আছে ঘড়ির একটা নিদির্ষ্ট জায়গায়। অপেক্ষা করছে সে, যে কখন মিনিটের কাটা সেখানে পা ফেলে। এই ব্যাপারটা নিয়ে সবসময় একটা উত্তেজনা কাজ করে তার মধ্যে, কাউকে সে বলেনি এ কথাটা। সিগারেটে টান দিতে ভূলে গিয়ে সে তাকায় জানালার ঐ কোনাটার দিকে, যেখানে সে কিছু বিস্কিট ফেলে রেখেছে। আজ সে রং, তুলি, পেপার সব নিয়ে প্রস্তুত। কাকটা আসলেই সে ছবি আঁকা শুরু করবে। বার কয়েক সে চেষ্টা করেছিলো ছবি তুলে রাখার। কেন জানি কাকটা ক্যামেরাকে ভয় পায়, ছবি তুলতে গেলেই বারবার দূরে গিয়ে বসে। চা খাওয়াবার সময় কাকটার ছবি তোলার অনেক চেষ্টা করেছে সে, কিন্তু একবারের জন্যেও সে পারেনি।

সময় তো পেরিয়ে যায়, আর কাকটার যেন আসবার কথা মনেই নেই, ধীরে ধীরে গলার কাছে জমে ওঠা কষ্টটা সে নিশ্বাসের সাথে বের করে দেয়। কাকটার ব্যাপারে সে অনেক চিন্তা করে, কী হতে পারে কাকটার, কী কারণে সে আসেনি, কী হয়েছে তার, হয়তো অনেক কিছুই। হয়তো, কাকটার স্রেফ ইচ্ছা করেনি ডানা মেলতে। শুন্য চোখে রোমেল তাকিয়ে থাকে জানালার বাইরের আকাশের দিকে, যেখানে মেঘগুলোকে সব বিভিন্ন মানুষের প্রতিচ্ছবির মত লাগে। রোমেল তাকিয়ে থাকে আর হাসে। হয়তো এমনটাই হবার কথা ছিলো, এমন হওয়াটাই সহজ, স্বাভাবিক ও নিয়ম-মাফিক। সবাই কথা রাখবে, এমন তো কোনো কথা ছিলো না। এমনিতো হয় সবাই, হর হামেশাই।

পুনশ্চঃ কাকটা আর কখনো ফিরে আসেনি। আজ থেকে ছয় বছর পরে “পাখি” শিরোনামে একটা প্রদর্শনির সময় রোমেলের মনে পড়ে যাবে সেই কাকটার কথা আর তার দুই চোখ ভরে উঠবে নোনা পানিতে।

৯০৯ বার দেখা হয়েছে

১২ টি মন্তব্য : “হাহাকার”

  1. রকিব (০১-০৭)

    ভালো লাগাটুকুর জানান দিয়ে গেলাম।
    অফটপিকঃ মন্তব্যের ঘরগুলো খালি দেখে আবার হতাশ হয়ে যেও না। যতদূর টের পাচ্ছি, সিসিবিয়ানরা সব শহরবাসী হয়েছেন ব্লগ ছেড়ে; লোকজনের আনাগোণা বাড়লেই মন্তব্য বাড়বে বলেই আশা রাখি 😀 ।


    আমি তবু বলি:
    এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..

    জবাব দিন
  2. রাশেদ (৯৯-০৫)

    বাহ, তোমার বর্ণনার স্টাইলটা তো দারুণ। আর বেশি বেশি লিখ :thumbup:
    গল্পে কী থাকবে আর থাকবে না সম্পূর্ণ লেখকের ইচ্ছে তাও পাঠক হিসেবে একটা কথা মাথায় আসল, মনে হয় গল্পের পুনশ্চ অংশটা না থাকলেও হত 🙂


    মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : samiur (2002-2008)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।