দ্য গ্রেট মিরাজ ভাই ১/২

১. নীতু

মিরাজ ভাইকে আমি চিনতাম নীতুর কারণে। নীতুকে চিনতাম ন্যাংটাকাল থেকে। উনিশ শ একানব্বই এর যে রাতে বঙ্গোপসাগরের ঢেউ পোয়াতি নারীর তলপেটের মত ফুলে উঠেছিল, দশ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসে চট্টগ্রাম শহর ডুবে গিয়েছিল, সেই রাতে রাবেয়া ক্লিনিকের গাইনি ওয়ার্ডে নীতুর মায়ের সাথে আমার মায়ের পরিচয়। রাত দেড়টার সময় দুইজন নার্স নিচতলা থেকে পাঁজাকোলা করে তুলে এনে নীতুর মাকে আমার মায়ের বিছানায় শুইয়ে দিয়ে যান। আসমা আন্টির বয়স তখন তেইশ। পেটের বাচ্চার বয়স নয় মাস আঠারো দিন। প্রথম বাচ্চা। আমার মায়ের বয়স তখন সাতাশ। পেটের বাচ্চার বয়স সাত মাস উনিশ দিন। বাসায় দুটো মেয়ে আছে। ফজরের আজানের ঠিক আগে নীতুর জন্ম হয়। আমি জন্মাই আজানের ঠিক পরপর। গল্পের শুরু সেখান থেকেই।

একরাতের পরিচয়ে দুই মহিলা, মানে আমার মা এবং নীতুর মা নিজেদের মাঝে ‘ধর্মবোন’ সম্পর্ক পাতিয়ে ফেলেন। সারারাত জেগে জলোচ্ছাসের পানিতে ভেসে আসা রূপচাঁদা মাছ ধরেছিলেন আমার বাবা। স্ত্রীর নির্দেশে তিনি তার অর্ধেক শিকার পাঠিয়ে দেন নীতুদের বাসায়। একমাসের ব্যবধানে নীতুদের গোটা ফ্যামিলি আমাদের বাসায় উঠে আসে সাবলেট হয়ে। দুই বোন আসমা-সেতারা সারাদিন গুটুর গুটুর গল্প করেন আর বাচ্চার কাঁথা বদলান। নীতু ভালো বাচ্চা ছিল, কাঁদত কম, খেত বেশি, হাগত কাঁথা ভরে। আমি খেতাম কম, কাঁদতাম বেশি, হেগে কাঁথার এক কোণাও ভেজাতে পারতাম না। আমার মা মন খারাপ করে বলতেন, দেখিস আসমা আমার ছেলেটা তালপাতার সেপাই হবে। আসমা আন্টি মুচকি হেসে ব্যাপক গর্ব নিয়ে নীতুর ভেজা কাঁথার দিকে ইশারা করতেন।

এদিকে রোগাপটকা স্বাস্থ্য নিয়ে ছয়মাস বয়সে আমি হামাগুড়ি দেয়া শিখে গেলাম। নীতুর মায়ের চোয়াল ঝুলে পড়ল। আমার বড় বোন দুটো ব্যস্ত হয়ে পড়ল নীতুকে হামাগুড়ি দেয়াতে। দশ মাস পূরণ হবার এক সপ্তাহ আগেই আমি দুলে দুলে হাঁটা শিখলাম। নীতু তখনও হামাগুড়ি দিয়ে আমাদের সবগুলো রুমের ফ্লোর পরিষ্কার করছে। আমার মা দাঁত কেলিয়ে নীতুর মায়ের দিকে তাকান। নীতুর মা বালতিভরা কাঁথা নিয়ে বাথরুমে ঢুকে দরজা চাপান। দুই মাস পর নীতুর মূত্রের উপর পাড়া দিয়ে আমি ধুপধাপ আছাড় খাই। নীতুর মা তার ধর্মবোনের দিকে তাকিয়ে চোখ টেপেন।

কুড়ি মিনিট আগে জন্মানোর জন্যই হোক কিংবা আসমা আন্টির নিরলস প্রচেষ্টাতেই হোক, নীতু আমার আগেই পরিষ্কার কথা বলা শুরু করে। তার সবচেয়ে পছন্দের শব্দ ‘বুবু’ আর ‘টিপ’। ফলে বড় বোন দুটোর কাছে আমার আদর আশংকাজনক হারে হ্রাস পেতে থাকে। এদিকে বিকেলবেলা অফিস থেকে ফেরার পর সে আমার বাবার কোলে চড়ে বসে। ঘাড়ে মাথায় তো ওঠেই এমনকি বিটিভির রাত আটটার খবর দেখার সময় পর্যন্ত বাবার গোঁফ ধরে টানাটানি করে। পৃথিবীতে জন্ম নেয়ার মাত্র বারো মাসের মাথায় আমি টের পাই নীতু নামের এই মেয়ে সারাজীবন আমার হাড় মাংস জ্বালিয়ে খাবে।

নীতুর প্রতি সবার এই মাত্রাছাড়া মমতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান শুধু আমার মা। এতে আমার হিতে বিপরীতই হয়। হাতের কাজ সেরে সময় পেলেই তিনি অ আ ক খ শেখাতে বসে যান। নীতু হাত নেড়ে নেড়ে দশ লাইনের ছড়া মুখস্ত বলে, আমি বলি ‘বল’ আর ‘গাড়ি’। তার পুতুল কেড়ে নিয়ে আমি আমার গাড়ির উপরে বসাই, গাড়ি চালাই ভোঁওওও… পিপ পিপ…পিপ পিপ…। মুহূর্তের মধ্যেই নালিশ চলে যায় বোনদের কাছে। ধমক খেয়ে আমি পুতুল ফিরিয়ে দেই ঠিকই কিন্তু প্রতিশোধের দাবানল নেভে না।

সেই দুপুরে লক্ষ্মী মেয়ে নীতু ঘুমিয়ে গেলে আমি তার পুতুল বউটাকে অপহরণ করি। চুপচাপ সিঁড়ি বেয়ে নেমে লাল টুকটুক বউটাকে ফেলে দিই বিল্ডিঙের পেছনের বড় ড্রেনে। আকাশে বাতাসে আনন্দ, ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজছে আমার প্রিয় ঝুনঝুনির সুর। এমন সময় হঠাৎ ক্রিং ক্রিং… ক্রিং ক্রিং…। পেছনে অফিস ফেরত আমার বাবা সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে।

 

 

২. তাজিন

পাঁচ বছর বয়সে আমাদের দুজনকে একই কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি করা হয়। সাথে বাসা থেকে এই মর্মে কঠোর নির্দেশ প্রদান করা হয় যে ক্লাসরুমে আমি এবং নীতু সবসময় পাশাপাশি বসব, একসাথে পড়াশোনা করব, একদম শয়তানি করব না। সর্বশেষ নির্দেশটি শুধুমাত্র আমার জন্য। ততদিনে নীতুর একটা ছোট ভাই হয়েছে।আমার ছোট কেউ হয়নি। নীতুর বাবার প্রমোশন হয়েছে, বেতন বেড়েছে, অফিস থেকে কোয়ার্টার দিতে চেয়েছে। কিন্তু তারা আমাদের বাসাতেই সাবলেট থেকে গেছে। তার কারণ হচ্ছে দুই ধর্মবোন সেতারা আর আসমা। আমার মা এবং নীতুর মা।তারা ঠিক করেছেন সারাজীবন একই বাসায় থাকতে চান, এখানেই নাতি-নাতনির মুখ দেখতে চান, এখানেই পটল তুলতে চান। কর্তা দু’জন, মানে আমার এবং নীতুর বাবা, দু’জনেই ভেজিটেবল টাইপের মানুষ। তাই গিন্নির কথায় আপত্তি তোলেন নি কেউ। নিপীড়িত জনতার ওপর চাপিয়ে দেয়া এই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বিরুদ্ধে শুধু একা আমিই প্রতিবাদ করেছিলাম। সারাদিন যখন যেখানে সুযোগ পেতাম, নীতুর চুলের ঝুঁটি ধরে টান দিতাম। নীতু চিৎকার করে বুবুদের ডাক দিত। বড় বুবু আর ছোট বুবু দু’জনে আমার দুই কান ধরে হিড়হিড় করে টেনে বাইরে নিয়ে যেত। আর আমি মনে মনে ভাবতাম, এরা আমার বোন নাকি নীতুর বোন!

আশা ছিল স্কুলে বুবুদের নজর এড়িয়ে নীতুর চুল ধরে টানা যাবে। প্রথমদিন তাই করেছিলাম। কিন্তু নীতু বড় ত্যাঁদড় মেয়ে। সে সোজা গিয়ে নালিশ দিল ক্লাসটিচার তাহমিনা ম্যাডামের কাছে। এবার শুধু কানমলাতে মাফ হয় না। দু’হাতে দু’টো করে গুণে গুণে মোট চারটে বেতের বাড়ি পড়ে হাতের তালুতে। এই ঘটনার পর থেকে ব্যাপক ভয়ে ভয়ে দিন কাটতে লাগলো। ক্লাসে নীতুর পাশে বসি, পড়ালেখা করার বৃথা চেষ্টা করি, ভোলাভালা চেহারার আড়ালে নিজের বিরাট শয়তানি মেধা লুকিয়ে রাখি।

প্রথম মাসে কোনোরকমে নিজেকে মানিয়ে নিলেও পরের মাস থেকেই আমি ক্লাসের সবচেয়ে মিষ্টি মেয়ে তাজিনের পাশে বসা শুরু করি। তাজিনের বাবা বিশাল ব্যবসায়ি। কথায় কথায় দেশের বাইরে যান। গাদা গাদা চকলেট নিয়ে ফেরেন। আমি আর তাজিন ক্লাসের ফাঁকে চকলেট খাই। টিফিনে তার বার্গার ভাগাভাগি করে খাই। তাজিন আমার বাংলা বইয়ের মলাটে ক্যাপ্টেন প্ল্যানেটের স্টিকার লাগিয়ে দেয়। আমি মসজিদের পেছনের গাছ থেকে ওর জন্য কাঁচা আম পেড়ে আনি। ব্যাডমিন্টন খেলার র‍্যাকেট দিয়ে হলুদ ফড়িং ধরে আনি। স্কুল ছুটির পরে সাদা রঙের টয়োটা আসে তাজিনকে নেয়ার জন্য। টয়োটা চলে গেলে আমি স্কুলভ্যানে নীতুর পাশে গিয়ে বসি। নীতু কোন কথা বলে না। আমি কনুই দিয়ে গুঁতো দিই। নীতু তাও কোন কথা বলে না।

দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষার ছুটি শেষে আমরা স্কুলে ফিরি। তাজিন ফেরে না। একদিন। দু’দিন। তিনদিন। তাজিন ফেরে না। এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলে আমি কাঁচুমাচু মুখে ক্লাস টিচার তাহমিনা ম্যাডামের কাছে গিয়ে জিগ্যেস করি, ম্যাডাম তাজিন ক্লাসে আসে না কেন? ম্যাডাম ঠাণ্ডা গলায় বলেন, ওরা ঢাকায় চলে গেছে, তাজিনের বাবা এসে টি.সি. নিয়ে গেছেন। হঠাৎ আমার চোখের সামনে ধুঁ ধুঁ মরুভূমি জেগে ওঠে, পায়ের নিচে সিমেন্টের ফ্লোর ফেটে দু’ভাগ হয়ে যায়। তাহমিনা ম্যাডাম আরও কীসব যেন বলতে থাকেন। আমি কিছুই শুনতে পাইনা। ম্যাডামের কথা শেষ হলে মাথা নিচু করে ক্লাসরুমে ফিরে আসি। প্রচণ্ড ঝড়ে ছাদের ট্যাংকিতে বাঁশের মাথায় বাধা অ্যান্টেনা কাত হয়ে পড়ে গেলে টিভির পর্দা যেমন ঝিরঝির দেখায়, একটানা অসহ্য রকমের ঝি ঝি… ঝি ঝি আওয়াজ করতে থাকে, আমারও নিজেকে তেমন এক সাদাকালো টিভি বলে মনে হয়। টিভির তো তাও অ্যান্টেনা উপড়ে ছাদেই পড়ে, আমার অ্যান্টেনা যে উড়ে একেবারে ঢাকায় চলে গেছে!

এদিকে তাজিনের প্রস্থানের সাথে সাথে আমার জীবনে নেমে আসে ঘোর অমানিশা। ক্লাসে আমার পাশে এখন আর কেউ বসেনা। শেষ বেঞ্চে আমি একা বসি। বাসা থেকে আমার আর নীতুর টিফিন একই বক্সে দিত প্রথম থেকেই। টিফিন বক্স দেয়া হত নীতুর ব্যাগে। রুটি-আলুভাজি, কখনও ন্যুডলস, কখনও পাউরুটি। তাজিনের বার্গারের কারণে এর আগে হাতে গোনা কয়েকবার মাত্র রুটি খেতে হয়েছে। তাজিন চলে যাওয়ার আগে যে নীতু আমাকে কখনও কথায় মারেনি, সেই নীতু এবার আমাকে রুটিতে মারা শুরু করে। আগের অভ্যাসমত দুজনের টিফিন এখনও সে একাই চেটেপুটে খেয়ে ফেলে। আমি চাইতে গেলে ঘাড় ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে বলে, তাজিনের কাছে যা। এবার আমি একটু কুঁই কুঁই করতে গেলেই দেয় ধমক, দ্যাখ ছোটন, আর একবার এদিকে আসিস তাহলে আন্টিকে বলে দেবো তুই এতদিন বাসার টিফিন না খেয়ে মিথ্যা কথা বলতি যে সব খেয়েছিস।

আমি আর কথা বাড়াই না। ধুলোয় মাখামাখি হওয়া জুতার ফিতার দিকে তাকিয়ে শেষ বেঞ্চে ফিরে আসি। প্রিয়তমা বান্ধবী যে নিদারুণ দাগা মেরে চলে গেছে, সেই দাগা বুকে নিয়ে আমি বেঁচে থাকি। সকালে নীতুর সাথে স্কুলে আসি। তাজিনের ফেলে যাওয়া শূন্য বেঞ্চে বসে ক্লাস করি। টিফিন পিরিয়ডে লাল ফড়িং ধরে দেয়ার বিনিময়ে তুহিনের টিফিনের অর্ধেকটা খাই। পরীক্ষার হলে বসে গ্রেট ওয়াল পেন্সিলের পাছা কামড়াই। এভাবেই আমার দিন কাটে। রাত কাটে। একদিন কিন্ডারগার্টেন পার হই। তাজিন ফেরে না। ওয়ান-টু-থ্রি-ফোর পার হই। তাজিন তাও ফেরে না। ক্লাস ফাইভের বৃত্তি পরীক্ষা দিই। তাজিন এবারও ফেরে না, তবে তার চেয়েও বড় ঘটনা আমার জীবনে ঘটে যায়। বৃত্তি পরীক্ষার পর শীতের ছুটিতে আমাদের দোতলার বারান্দার পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে নীতু আমাকে নতুন একজনকে চিনিয়ে দেয়।

তিনি মিরাজ ভাই। দ্য গ্রেট মিরাজ ভাই।

 

(চলবে)

১,৮৪২ বার দেখা হয়েছে

১২ টি মন্তব্য : “দ্য গ্রেট মিরাজ ভাই ১/২”

  1. মোকাব্বির (৯৮-০৪)

    এই পুরান লেখা বারবার পড়া যায়। যাক তাও অবশেষে একটা ব্লগ প্লাটফর্মে আসছে লেখা গুলা। :thumbup: :thumbup: :thumbup:


    \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
    অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মোকাব্বির (১৯৯৮-২০০৪)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।