চারাগাছের পাতা ৭

কেউ একজন আমার সাদাকালো জীবনে আগুনরঙা কৃষ্ণচূড়া ফুলের মতন। আমার মন খারাপের একাকী মধ্যরাতে শুক্লপক্ষ চাঁদের মতন। কেউ একজন আমার ডান হাতের তর্জনী ছুঁয়ে দেয় গভীর মমতায়। ইউটিউব ঘেঁটে মেসি-রোনালদোর তুলনা করতে পারে কেউ। জীবনে একবারের জন্যও ফুটবল খেলতে না নামা কেউ একজন ঠিক আমার মতই ম্যারাদোনা-পেলে-রোনালদিনহো কে সরিয়ে ইতিহাসের সেরা হিসেবে মেনে নেয় এক ফরাসি ভদ্রলোককে। কেউ একজন আমার মতই ল্যাপটপের ওয়ালপেপারে ঝুলিয়ে রাখে টাক মাথার এই ভদ্রলোকের ছবি। জিদান। জিনেদিন ইয়াজিদ জিদান।

প্রীতিলতা কিংবা মাধবীলতার অবিশ্বাস্য সংগ্রামের গল্প আমাকে শোনায় কেউ। শোনায় হোমারের গ্রীক উপকথা, শীর্ষেন্দুর নতুন উপন্যাসের ভূমিকা, আনিসুল হকের উদার চাপাবাজি। কারো মুখে আমি কখনো শুনি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান, কখনো শুনি অনুপমের গান, আবার কখনো জন ডেনভারের বিদায়ের সেই বিখ্যাত সুর~ “হোল্ড মি লাইক ইউ নেভার লেট মি গো”। কারো বিষণ্ণ মুখের দিকে তাকিয়ে আমি অতল মহাসমুদ্রের জলে ডুবে যেতে থাকি। বুকের মাঝে চিনচিনে ব্যথা হয়। কী জানি কিসের লাগি প্রাণ করে হায় হায়।

কেউ একজন আমার নোংরা অগোছালো রুমের মানচিত্র কল্পনায় আঁকে নিউরনে নিউরনে। নিখুঁত হিসাব নিকাশে মেপে দেয় অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশ, খুঁজে দেয় সঞ্চয়িতা, খুঁজে দেয় জহির রায়হানের উপন্যাসসমগ্র। একলা বালকের নিরন্তর সাথী ভেনটোলিন ইনহেলার হাতে বসে থাকে ফুটবল মাঠের কিনারে। কেউ একজন মধুর কথা বলে সরিষার তেল খাওয়ায় বালককে , পাঞ্জাবির হাতা ইস্ত্রি করতে ভুলে যায়, আবার সেই কুচকে থাকা হাতার জন্য উল্টো বালককেই দোষ দেয়। কেউ একজন আমাকে কথায় কথায় হাসায়, চোখের ভাষায় কাঁদায়, বাঁ হাতের উল্টো পিঠে নোনতা জল মুছে দেয়। ফোনের অপর পাশ থেকে মায়াবি গলায় বলে ওঠে কিছু আমি করিনি গোপন, যাহা আছে সব আছে তোমার আঁখির কাছে প্রসারিত অবারিত মন, দিয়েছি সমস্ত মোর করিতে ধারণা, তাই মোরে বুঝিতে পারনা?

প্রতিদিন নতুন করে অবাক করে দিতে পারে কেউ। এক ঘণ্টার ভেতরেই সাইকেল চালানো শিখে যেতে পারে কেউ, দু’বার চিন্তা না করেই নেমে যেতে পারে পিচের রাস্তায়। পনিটেইল চুল আর জিন্সের সাথে পায়ে কেডস গলিয়ে ক্রিং ক্রিং বেল বাজিয়ে রাস্তা দাপিয়ে বেড়াতে জানে কেউ, আবার জানে কলাপাতা রঙের জামদানি জড়িয়ে দু’চোখে ঘন কাজল মেখে কাচের চুড়ির টুংটাং সুর তুলতে। নন্দিনীর দীর্ঘশ্বাস দেখেছে কেউ, দেখেছে হঠাৎ এক সন্ধ্যায় কেন ডাকাত হয়ে উঠতে চেয়েছিল শুভঙ্কর। জন্মাবধি বুকের ভেতর এক রঙিন পাখি কেঁদেই গেল, তার ধ্রুপদি ডাক শুনেছে কেউ একজন। জেনেছে, কেউ একজন অবশ্যই জেনেছে কতটা পথ হেঁটে এলে বালকের ফেরার পথ নেই, থাকেনা কোনো কালে।

কেউ একজন হৃদয়ের গোপন ঝর্ণার কিনারে একতলা কাঠের বাড়ি তুলেছে। সে জেনেছে প্রায়ই জেগে ওঠা হৃদয়ের রিখটার স্কেলে মহাবিপদজনক মাত্রার ভূমিকম্পের কেন্দ্র তার একতলা কাঠের বাড়ি থেকে কত দূরে।

২৮/২/২০১৪

 

প্রিক্যুএল~

http:// www.cadetcollegeblog.com/ferdous-zaman-rifat/40040

 

 

১,০৩৪ বার দেখা হয়েছে

১০ টি মন্তব্য : “চারাগাছের পাতা ৭”

  1. রেজা শাওন (০১-০৭)

    দারুণ।

    ফোনের অপর পাশ থেকে মায়াবি গলায় বলে ওঠে কিছু আমি করিনি গোপন, যাহা আছে সব আছে তোমার আঁখির কাছে প্রসারিত অবারিত মন, দিয়েছি সমস্ত মোর করিতে ধারণা, তাই মোরে বুঝিতে পারনা?

    বয়স কত তোমার? বাইশ না? ঠিকাছে। একালে এমনটা আসে। চলুক।

    জবাব দিন
  2. সামিউল(২০০৪-১০)
    কেউ একজন হৃদয়ের গোপন ঝর্ণার কিনারে একতলা কাঠের বাড়ি তুলেছে। সে জেনেছে প্রায়ই জেগে ওঠা হৃদয়ের রিখটার স্কেলে মহাবিপদজনক মাত্রার ভূমিকম্পের কেন্দ্র তার একতলা কাঠের বাড়ি থেকে কত দূরে

    ভাইরে ভাই...
    যে একজন আছে তোমার, তুমিতো খুবই ভাগ্য নিয়ে এসেছে দুনিয়ায়। সে একজনের ও ভাগ্য অনেক ভাল।


    ... কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে!

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।