জাঙ্গিয়া নাম্বার ওয়ান

১.
আজ আকস্মিকভাবে নিজ হস্তে ক্রয়কৃত প্রথম জাঙ্গিয়ার কথা স্মরণ করিয়া স্মৃতিকাতর হইয়া পড়িলাম। তাহার সহিত আমার ঘনিষ্ঠতা অধিক দিনের ছিল না। তবে অতি অল্প দিনেই সে আমার মন জয় করিয়া নিয়াছিল। আজ তাহাকে ক্রয় করিবার বৃত্তান্ত লিখিতে মন চাহিতেছে।

সপ্তম শ্রেণি অতিক্রম করিয়া সবেমাত্র অষ্টম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হইয়াছি। ক্যাডেট কলেজ জীবনের কেবলমাত্র প্রথম বৎসরটি সমাপ্ত হইয়াছে। এমতাবস্থায় সপ্তাহ দুয়েকের ছুটি পাইয়া পিত্রালয় চট্টগ্রামে আগমন করিলাম। শৈশব হইতে কৈশোর অবধি কলোনির মাঠেঘাটে ক্রিকেট ব্যাট হাতে দমাদম ছক্কা পিটাইয়াছি এবং কদাচিৎ বল হাতে ব্যাটসম্যানের নিদারুণ আক্রোশের শিকার হইয়া পুস ইন বুটসের ন্যায় কাচুমাচু মুখমণ্ডলে গৃহে ফিরিয়াছি। তবে ফুটবল লইয়া এহেন জারিজুরি দেখাইবার অধিক সুযোগ মেলে নাই।

তথাপি ক্যাডেট কলেজের সবুজ শ্যামল খোলা মাঠ এবং চকচকা সাদাকালো বল পাইয়া আমার ফুটবল প্রতিভা লম্ফ দিয়া খাম্বার মাথায় গিয়া উঠিল। শয়নে স্বপনে আর রাত্রি জাগরণে ফুটবলের প্রতি নিদারুণ প্রেম আমার কিশোর হৃদয়ে স্থায়ী আসন গাড়িয়া লইল। বাঘা বাঘা সিনিয়র ক্যাডেট ভ্রাতার দুর্দান্ত পারদর্শিতা এবং প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় আমি ধীরে ধীরে ফুটবলের নেশায় চুবিয়া গেলাম।

যাহা বলিতেছিলাম, অষ্টম শ্রেণির অতি প্রাক্কালে ছুটিতে আগমন করিয়া পুরানো বিদ্যালয়ের তাবৎ বন্ধুগণকে আমার ফুটবল পারঙ্গমতা দেখাইতে ব্যাকুল হইয়া পড়িলাম। অবশেষে এক বৈকালে সকলে মিলিয়া বাটাবাটি করিয়া ফুটবল ক্রীড়ায় ঝাপাইয়া পড়িলাম। ইতিপূর্বেই আমার ফুটবল প্রেম এবং ব্যক্তিগত ঢোলের গগণবিদারী আওয়াজ শুনিতে শুনিতে কর্ণ পচাইয়া ফেলা বন্ধুগন তাহাদের ক্যাডেট কলেজ প্রবাসী সহচরের এলোপাতাড়ি ক্রীড়া দেখিয়া অতি কষ্টে হাসি চাপিল। দেশি ছাগলের তৃতীয় সংখ্যক শাবকের ন্যায় আমার হাঁসফাঁস দৌড়াদৌড়ি তাহাদের পূর্ণ এক সপ্তাহের বিনোদনের জন্য যথেষ্ট হইয়াছিল। তথাপি ঢোলের আওয়াজ এবং ব্যক্তিগত সম্মান পুনরুদ্ধার করিতে মরিয়া হইয়া আমি ততোধিক আগ্রহে ক্রীড়ালীলায় মনোনিবেশ করিলাম।

এমতাবস্থায় হাওয়ায় ভাসিয়া আসা একটি বল আন্তর্জাতিক মানের দক্ষতায় আয়ত্ত করিবার প্রয়াস চালাইতে গিয়া আমার পরিধান করা কালো রঙের ট্রাউজার উরুসন্ধিস্থল হইতে দিকবিদিক ছিঁড়িয়া চৌচির হইয়া গেল। অতি সন্তর্পণে মাঠ হইতে প্রস্থান করিয়া, হাঁটু অবধি ফাটিয়া যাওয়া ট্রাউজার এক হস্তে প্রাণপণ চাপিয়া ধরিয়া, নর্দমার কিনারা মাপিতে মাপিতে গৃহে অবতরণ করিলাম।

মাগরিবের নামায সমাপ্ত করিয়া ফিরিয়া আসিবামাত্রই পিতার নিকট জাঙ্গিয়া ক্রয় বাবদ বিপুল অঙ্কের অর্থ দাবি করিলাম এবং এহেন দুর্বল পাজামা উপহার প্রদান করিয়া আমার জীবনে ঘোর অমানিশা ডাকিয়া আনার সকল দায়দায়িত্ব ভগ্নিপতির ঘাড়ে চাপাইয়া দিলাম। উপরন্তু আমার অতি আদরের ভগ্নির কাছে মুঠোফোনের বার্তা মারফত এই নির্দেশ প্রদান করিলাম যাহাতে পরবর্তীতে আরও উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন পায়জামা ডাকযোগে প্রেরণ করা হয়।

পরবর্তী দিবসে অতি প্রত্যুষেই পিতার ঘনিষ্ঠ বন্ধুর কাপড়ের দোকানে গিয়া হাজির হইলাম। কাকা কহিলেন, কী চাহিতেছ কাকু? আমি লজ্জায় কংক্রিটের মেঝেতে মিশিয়া গিয়া অতি মৃদু কণ্ঠে কেবল কহিতে পারিলাম…

“আন্ডারওয়্যার” 🙁

অতঃপর পিতার বন্ধু কাকা আমার সম্মুখে তাহার দোকানের তাবৎ জাঙ্গিয়া উপুড় করিয়া ফেলিলেন। তাহার সহিত যোগ দিয়া তাহার দোকানের কর্মচারীও সমধিক উৎসাহে বাছিয়া বাছিয়া বেঢপ আকৃতির এক একটি জাঙ্গিয়া দুই হস্তে টানিয়া আমার মুখমণ্ডলের সম্মুখে মেলিয়া ধরিতে লাগিলেন। আমি কিছু বলিবার উপক্রম হইবামাত্র কাকা কহিলেন, সাইজ কত হইবে কাকু? আমি বেমক্কা প্রশ্ন শুনি তাজ্জব হইয়া কহিলাম, জানিনা। অতঃপর কাকা তাহার শকুনের ন্যায় দৃষ্টি আমার ক্ষুদ্র তলপেট বরাবর তাক করিয়া কিছু একটা আন্দাজ করিয়া লইলেন। এবং একইসাথে গুদাম হাতড়াইয়া হলুদ এবং কমলা বর্ণের অতি কুৎসিত দুইটি জাঙ্গিয়া বাহির করিয়া আনিয়া বলিলেন, এই যে বাছা পাওয়া গিয়াছে!

আমি বেকায়দা পরিমাণে নাক মুখ কুচকাইয়া স্মরণকালের বৃহত্তম উষ্মা প্রকাশ করিলাম। এইবার কাকা কহিলেন, তাহলে কাকু দামি জিনিস লইতে হইবে। আমি সানন্দে তাহার প্রস্তাবে সায় প্রদান করিলাম। অতঃপর চকচকে প্যাকেটে মোড়ানো খয়েরি বর্ণের একখানি এবং ধুসর-নীল বর্ণের আরেকখানি জাঙ্গিয়া উপযুক্ত মূল্য পরিশোধ বাবদ খরিদ করিলাম।

সফল ক্রয় অভিযান সমাপ্ত করিয়া গৃহে প্রত্যাবর্তন মাত্রই ঝাপাইয়া স্নানাগারের অভ্যন্তরে প্রবেশ করিলাম। অবর্ণনীয় পুলকে খয়েরি বর্ণের ছোট বস্তুটি পরিধান করিবামাত্রই নিজেকে ব্র্যাড পিট বলিয়া ঠাহর হইতে লাগিল। পরবর্তী কয়েকখানি মাস ধরিয়া উহা আমার অতি প্রিয় সহচরে পরিণত হইল। অবশেষে কেমন করিয়া তাহার সহিত আমার বিচ্ছেদ ঘটিল সেই বৃত্তান্ত আরেকদিন হইবে।

২.
ফেইসবুকে এই লেখাটি পড়িয়া মাহমুদুর রহমান মামুন ভাই (ঝকক/১৯৯৯-২০০৫) নিম্নোক্ত মন্তব্যটি করিয়াছেন। তাহা এইখানে হুবহু তুলিয়া দেয়া হইল 😀

একদা আমার বন্ধুর একটি জাঙ্গিয়া (আদুরে নাম- আণ্ডি) হারানো গিয়াছিল। কয়েকদিন পরে আবিষ্কৃত হইল যে, উক্ত আন্ডি খানা জনৈক সিনিয়রের কাবার্ডের শোভা বর্ধন করিতেছে। উক্ত সিনিয়র আমাদের চরম অপছন্দ হওয়ায় কাল্লু মামা উপাধি পাইয়াছিলেন। যাহাই হউক, আমার বন্ধু সে শোক ভুলিতে পারে নাই। শোককে শক্তিতে পরিণত করিয়া বন্ধুর কাব্যপ্রতিভা জাগিয়া উঠিল। ফলাফল হিসাবে নিম্নোক্ত প্যারোডি কবিতাখানি জন্মলাভ করে। (কবিতাটিতে অসংখ্য উপাধি ব্যবহার করা হইয়াছে, কাহারো সাথে কাকতালীয় ভাবে মিলিয়া গেলে কমেন্টদাতা দায়ী নহেন।)

ক্যাডেট কাল্লু কাঁদিয়া ফিরিছে নিদ নাহি চোখে তার
প্রিফেক্টশীপ তার যাইতেছে বুঝি টেকে না এবার আর,
চারিধারে তার ঘনায়ে আসিছে মরণ অন্ধকার।

হাউসের যত বিজ্ঞ ফ্রেন্ড নেড়ী গ্যাদা আরো বেশ,
এসেছে সবাই পোদেলের ঘরে চলিছে আলাপ বেশ,
প্ল্যান প্রোগ্রামের বিধিবিধানের ত্রুটি নাহি এক লেশ।

তবু তার কোনো প্ল্যান প্রোগ্রাম টিকিতেছে নাকো হায়,
যতদিন যায়, দুর্ভোগ তার ততই বাড়িয়া যায়,
প্রিফেক্টশীপ তার নিভিয়া আসিছে অস্তরবির প্রায়।

শুধালো পোদেল ব্যগ্রকন্ঠে কাল্লু মামারে ডাকি,
বল বল আজি সত্যি করিয়া দিও নাকো মোরে ফাকি,
আবার তুমি কোন জুনিয়রের আন্ডি মেরেছো নাকি?

নত মস্তকে রহিল কাল্লু, কহিল না কোন কথা,
মুখর হইয়া উঠিল তার সে নিষ্ঠুর নীরবতা,
হঠাৎ করিয়া গাভী কহিল, তাইতো, আমার আন্ডি কোথা?

টের পেয়ে গাভী কহিয়া উঠিল, ইবলিশ শয়তান!
আন্ডি ফেরত দিয়ে তাড়াতাড়ি ধরে ফেল তোর কান,
খুশি হয়ে পরে করিব তোরে নতুন আন্ডি দান।

শুনিয়া সে কথা কাল্লু কহিল শঙ্কা নাহিকো মানি,
তাই যদি হয় প্রস্তুত আমি দিতে সে আন্ডিখানি,
না হলে প্রিফেক্টশীপ রসাতলে যাবে, জানি তাহা আমি জানি।

এতেক বলিয়া, কাবার্ড খুলিয়া নিরিবিলি গৃহতল,
গভীর কষ্টে ব্যথিত কাল্লু, শান্ত অচঞ্চল,
আন্ডি ফেরত দেবার দুঃখে নয়নে অশ্রুজল।

কাল্লু আসিয়া কহিল, হে পোদেল, গেল মান সম্মান,
মোর জীবনের সবচেয়ে প্রিয় USED আন্ডিখান,
তাই নিয়ে মোর প্রিফেক্টশিপ খান কর মোরে প্রতিদান।

স্তব্ধ নিরব গৃহতল, মুখে নাহি কারো বাণী,
গভীর কষ্টে ব্যথিত কাল্লু, সিক্ত নয়নখানি,
Staff Lounge চলিতেছে যেন গোপন কি কানাকানি।

সহসা পোদেল ফুকারি উঠিল, নাহি ভয় নাহি ভয়,
প্রার্থনা তোর কবুল করেছে কালা বাবা দয়াময়,
প্রিফেক্টশীপ তোর পাইবি ফেরত, খোয়াবে না নিশ্চয়।

ঘুরিতে লাগিল পুলকে কাল্লু পোদেলের চারিপাশ,
নিরাশ হৃদয়ে সে যেন আশার দৃপ্ত জয়োল্লাস,
তিমির রাত্রে কাবার্ডে কাবার্ডে আন্ডি মারার আশ।

তারপর হতে নতুন বিপদ শুরু হল হাউসের,
হৃষ্টচিত্তে মারিত লাগিল আন্ডি জুনিয়রের,
USED আন্ডিতে ভরিয়া উঠিল কাবার্ড কাল্লুদের।

USED আন্ডি, না না ভুল কথা, আন্ডি কে তারে কয়,
পরিতে পরিতে ছিড়িয়া গিয়াছে, হইয়াছে শত ক্ষয়,
আন্ডি চোরের কাছে হইয়াছে তোরাবের পরাজয়।

(পুরো কাহিনিটা কাল্পনিক। তবে উপাধিপ্রাপ্তরা কাল্পনিক নহেন। নিতান্ত স্মরণ শক্তির উপর ভরসা করিয়া কমেন্ট করিতে হইল, তাই কিছু বিচ্যুতি হইতে পারে)

১,৭৫৮ বার দেখা হয়েছে

১০ টি মন্তব্য : “জাঙ্গিয়া নাম্বার ওয়ান”

  1. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    দারুন :))

    আচ্ছা যতদূর মনে পড়ে সেভেনে কলেজে যাওয়ার সময়ই তো আন্ডারওয়্যার নিয়ে যেতে হয়ে ছিল (জিনিষপত্রের লিস্টে দিয়ে দিয়েছিল), তোমাদের সময় কি এটা বদলে গিয়েছিল :-/


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মোস্তাফিজ (১৯৮৩-১৯৮৯)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।