মা, আম্মা কিংবা আম্মু

১.

প্রবাদবাক্য : পরিবর্তন চিরস্থায়ী।

প্রমাণ : একটি প্রেমের গান…… ”তোমারে লেগেছে এতো যে ভালো চাঁদ বুঝি তা জানে…… রাতেরও বাসরে দোসর হয়ে তাই সে আমারে টানে…… আ আ আ…… চাঁদ বুঝি তা জানে……”

আরেকটি প্রেমের গান…… ”যেভাবে জলদি হাত মেখেছে ভাত……নতুন আলুর খোসা আর এই ভালোবাসা……আমার দেয়াল ঘড়ি কাঁটায় তুমি লেগে আছো……”

উপসংহার : প্রেমিক-প্রেমিকার ভালোবাসার ধরণটা খুব দ্রুত বদলাচ্ছে…… কিন্তু মা -কে নিয়ে গাওয়া ভালবাসার গানগুলা কিন্তু খুব একটা বদলায়নাই……

গায়ক সমাজ কে ধন্যবাদ।

________________
১৫ অক্টোবর ২০১২

২.

গত কয়েকদিন ধরে বেশ ঠাণ্ডা-সর্দি লেগে আছে। অনির্দিষ্টকালের জন্য নাক বন্ধ। একটু আগে আম্মুর ফোন,

– আব্বু, তোমার ঠাণ্ডা কমসে?
– না, কমতেসে না।
– (রাগের সাথে) কমবে ক্যামনে?? ফুটবল খেলতে গেলে ঠাণ্ডা কমে নাকি???

আম্মুগো, ফুটবল খেলতে আমি ঢাকা ভার্সিটিতে গেসিলাম, অ্যান্টার্কটিকায় যাইনাই !!

______________
২৭ নভেম্বর ২০১২

৩.

আমার প্রাক্তন রুমমেট আধা বাঙালি, আধা আমেরিকান। প্রথম প্রথম বাঙলা ভালো বলতে পারতোনা। ভাত খাইতেও পারতোনা। ৩ বেলা মেরিডিয়ান চিপস খাইতো। আমি একদিন জিগাইলাম,

– আচ্ছা, শুধু চিপস খাইয়া তোমার পেট ভরে? খিদা লাগে না?
– লাগে।
– কখন?
– প্রচণ্ড রাতে !

আমারো ইদানিং প্রচণ্ড রাতে গভীর খিদা লাগে। তখন আম্মুর বানানো আমের আচার দিয়া কড়কড়া ঠাণ্ডা ভাত আর জমে যাওয়া ডাল বেহেশতী খাবারের মতো লাগে।

______________
৩ ডিসেম্বর ২০১২

৪.

ক্লাস ওয়ানের ভর্তি পরীক্ষায় আমি পাঁচ মার্ক ছেড়ে এসেছিলাম। প্রশ্নটা আমার চোখেই পড়েনি। সেই প্রশ্নটা ছিল, মা তোমার কি কি কাজ করে দেয়? বাসায় ফিরে আম্মু বলল, ইস এটা কত সুন্দর করে লিখতে পারতা! লিখতে পারতা আম্মু আমাকে ভাত খাওয়ায় দেয়, গোসল করায় দেয়, চুল আঁচড়ায় দেয়, ঘুম পাড়ায়ে দেয় ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি বললাম, মোটেও না, আপনি আমার কোনও কাজ করে দেন না। সব ডালিয়া (আমার ছোট খালা) করে দেয়। আমার কথা শুনে সবার সে কি হাসি! ক্লাস টু-থ্রির পর বাসায় শুধু আমি, আব্বু আর আম্মু থাকতাম। আমি পুরোপুরি একা বড় হয়েছি। নিজের পড়া, নিজের খাওয়া, নিজের প্রত্যেকটা দিন। নিজের সবকিছু।

আমার জন্মের পর থেকে আম্মু কখনো সুস্থ থাকেন নাই। হাই ব্লাড প্রেশার, অ্যাজমা, হার্টের সমস্যা সাথে আরও অনেক কিছুর কারণে তার যতটা কষ্ট হয়েছে, তার অনেকখানি প্রভাব পড়েছে আমার বেড়ে ওঠায়। সম্ভবত অসুস্থতার কারণেই আম্মুর মেজাজ সবসময় কড়া হয়ে থাকতো। কাছে যেতে ভয় পেতাম। কারণে অকারণে মার খেতাম। সারাদিনে একবারও আমার সাথে হাসিমুখে কথা বলেনাই আম্মু, এরকমও হত। বেশিরভাগ দিন শুধু দুপুরে রান্না হত। রাতে আর পরদিন সকালে ঠাণ্ডা ভাত ঠাণ্ডা তরকারি খাওয়া হত। এক রান্নায় টানা দুই তিনদিন। আমাকে ক্যাডেট কলেজে পড়াবার ইচ্ছা আম্মুর ছিল না। এমনকি চান্স পাবার পর আব্বু বলেছিল, থাক দরকার নাই যাওয়ার। আম্মু এখন আমাকে মাঝে মাঝে খুব মন খারাপ করে বলে, তোকে ক্যাডেটে দিসিলাম শুধু ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করতে পারবি তাই, আমিতো রান্নাও করতে পারতেসিলাম না।

যখন কাছের বন্ধুদের দেখি মায়ের কাছে এখনও ছোট বাচ্চার মতো আদর পাচ্ছে, তখন খুব ভালো লাগলেও বুকের ভেতর কোথায় যেন হাহাকার করে ওঠে। আমি নিশ্চিত আম্মুর বুকের ভেতরের হাহাকার আরও বেশি। পরীক্ষার প্রচণ্ড চাপের ভেতরেও আম্মুর কাছ থেকে মানসিক সাপোর্ট পাচ্ছিনা। অসুখ আবার বেড়েছে। ডাক্তার কথা বলতে মানা করেছে। তিনমাস আম্মুকে দেখিনা। এসবে আমি অভ্যস্ত হয়ে গেছি।

আমার যা হবার হয়েছে। আর কারো মা যেন এমন অসুস্থ না থাকে এই প্রার্থনা করি। সবার জীবন কাটুক মায়ের অসীম আদরে। অন্তত শৈশব কৈশোর যেন সেই আদরে কাটে। মায়ের স্নেহটুকু কেউ যেন না হারায়।

_____________
৮ জানুয়ারি ২০১৩

৫.

উত্তপ্ত কপালজুড়ে আমি এখন জলপট্টি খুঁজে পাইনা। মাথার নিচে খুঁজে পাইনা ট্রান্সপারেন্ট অয়েল পেপার। চুলের গোঁড়া ভিজিয়ে যায়না প্লাস্টিকের মগ থেকে নেমে আসা চিকন জলের স্রোত। হাত পা কিংবা বুক পেটের প্রতিটি রোমকূপ থেকে তাপ শুষে নেয়না পাতলা তোয়ালে।

তেতো মুখে পছন্দের খাবারটা আর তুলে দেয়না কেউ। আঁচল দিয়ে মুছে দেয়না ঠোঁটের কোণগুলো। মধ্যরাত পর্যন্ত নির্ঘুম চোখে কেউ আমার মাথার কাছে বসে থাকে না। কারো আঙুল ঘোরাফেরা করেনা আমার চুলের অলিতে গলিতে। পরম মমতায় নকশীকাঁথা দিয়ে কেউ ঢেকে দেয়না আমার আজন্ম রোগা শরীরটা।

আমার কষ্টে এখন আর কারো চোখ ভিজে উঠতে দেখিনা। কাউকে দেখিনা শুকনো মুখে সারাটাক্ষণ আমার চারপাশে ঘুরঘুর করতে। ঘরের দরজায় দিকে তাকিয়ে থেকে অপেক্ষা করিনা তার ছায়ার জন্য। আমার চারপাশে কোথাও আমি এখন সেই মমতাময়ী মানুষটাকে দেখিনা। আমি কোথাও এখন সেই মানুষটার ছায়া দেখিনা। আমি কোথাও এখন কলাপাতা রঙের শাড়ির আঁচল দেখিনা।

আমি কোথাও আমার মাকে দেখিনা।
আমি কোথাও আমার মাকে দেখিনা।

__________
২ জুন ২০১৩

১,৭৯৩ বার দেখা হয়েছে

২০ টি মন্তব্য : “মা, আম্মা কিংবা আম্মু”

  1. নাফিস (২০০৪-১০)

    পোস্ট টা পড়া ঠিক হয় নাই 🙁 এড়িয়ে যেতে চেয়েছিলাম, কিন্তু কি মনে করে যেন পড়ে ফেললাম। আম্মুকে দেখিনা ৪৬৩ দিন ধরে.. আরো অনেক দিন হয়তো দেখবো না..

    জবাব দিন
  2. মোকাব্বির (৯৮-০৪)

    আমি সবসময় বলি আমি অনেক কিছু ফেলে বিদেশের মাটিতে এসেছি। এই অনেক কিছুর মাঝে "মা" একটি শব্দ। এজীবনে একগুঁয়েমি, আর ঝোঁকের বসে অনেক কিছুই করেছি। কিন্তু এই মানুষটার পিছু ছাড়তে পারি নাই। আমার তাঁকে বিরক্ত করতে শান্তি লাগে। দূরে থেকে বিরক্ত করা যায় না কিন্তু কষ্ট দেয়া যায়। যত দ্রূত সম্ভব বিরক্ত করা আবার শুরু করতে চাই! লেখাটা পড়ে থমকে ছিলাম অনেক্ষণ। তার জন্য ধন্যবাদ!


    \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
    অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মোকাব্বির (১৯৯৮-২০০৪)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।