ব্রেথলেস

১.
তরুণ স্বামীর বাড়ি ফেরার পথ চেয়ে নববিবাহিতা তরুণী স্ত্রীর অপেক্ষার মতন দম আটকে আসা ভালোবাসার উদাহরণ পৃথিবীতে খুব কমই আছে। সংসারের বয়স বাড়ার সাথে সাথে কমতে থাকে ভালোবাসা, আরও নির্দিষ্ট করে যাকে এইমাত্র বলা হল দম আটকে আসা ভালোবাসা। কিন্তু একইসাথে চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তে থাকে নির্ভরতা আর অভ্যস্ততা, এককথায় যাকে বলে মায়া-মমতা।

২.
প্রায় রাতেই ঘুমের মাঝে শারমিনের গলা চেপে ধরে কেউ। অন্ধকারে চোখ মেলে অদৃশ্য হাতজোড়া দেখতে পায়না সে। কয়েক সেকেন্ডের জন্য মনে হয় অসম্ভব শক্তিশালী কেউ তাকে পুকুরের পানিতে চুবিয়ে রেখেছে। মুহূর্তেই ঝটকা মেরে সেই হাতজোড়া সরিয়ে দেয় শারমিন। স্প্রিং এর মত লাফ দিয়ে উঠে বসে বিছানায়। বালিশের নিচ থেকে মুঠোফোন বের করে ফোন দেয় নাজমুলকে। পুরোটা রিং বেজে কেটে যায়। নাজমুল রিসিভ করেনা। আবার ডায়াল করে শারমিন। তৃতীয়বারে ফোন রিসিভ করে নাজমুল। এটা তার বরাবরের অভ্যাস। মাঝরাতে ফোন দিলে সে তৃতীয়বারেই সবুজ বাটন চাপবে। ঘুম জড়ানো কণ্ঠে একগাদা আদর ঢেলে বলবে, বোবায় ধরেছিল, শারমিন?

আজ রাতে এই ঘটনা হল না। একটা চুয়াল্লিশ মিনিটে প্রথমবার রিং বাজতেই ফোন ধরল নাজমুল। জেগে থাকা স্বাভাবিক কণ্ঠে জিগ্যেস করলো,
– ঘুমাও নি?
– না
– কী করো?
– অপেক্ষা করি
– আর কী করো?
– টেনশন করি
– আরে ধুর, এতো টেনশনের কিছু নেই
– তুমি এটা বুঝবে না
– আমার বোঝা লাগবে না
– তুমি ঘুমাচ্ছ না কেন?
– এমনি
– নাজমুল, মন খারাপ কেন?
– মন খারাপ নাতো
– তাহলে মন ভালো?
– খারাপ না
– সাবধানে থেকো
– আচ্ছা
– ঘুমানোর চেষ্টা করো
– আচ্ছা
– রাখি তাহলে?
– রাখো
– আই লাভ ইউ, নাজমুল
উত্তর এলো না। বিপ বিপ আওয়াজে শারমিন টের পেল তার শেষ কথাটা শোনার আগেই নাজমুল ফোন কেটে দিয়েছে।

৩.
নিঃশব্দে বিছানা থেকে নেমে যায় শারমিন। বারান্দার এক কোণে ছোট ছোট দুটো টব। দুটোতেই নিজ হাতে গোলাপ লাগিয়েছিল নাজমুল। একটা লাল, অন্যটা সাদা। দক্ষিণ কোণে টব দুটো সরিয়ে আনতে আনতে বলেছিল,
– লাল গাছটা তোমার, আর সাদাটা আমার
– মানে?
– মানে হল লাল গোলাপগুলো আমার পক্ষ থেকে তোমার জন্য, আর সাদা গোলাপগুলো তোমার পক্ষ থেকে আমার জন্য
– যদি লাল ফুল না ফোঁটে?
– অবশ্যই ফুঁটবে
– আর সাদা ফুল?
– সেটা তো না ফোঁটারই কথা
কথা শেষ না হতেই নাজমুলের পিঠে দমাদম কিল বসিয়েছিল শারমিন। আর হাসতে হাসতে তার গায়ের ওপর গড়িয়ে পড়েছিল নাজমুল।

৪.
সাদা গাছে একসাথে তিনটা কলি বেরিয়েছে দুদিন আগে। লাল গাছে কলি নেই। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের মাথায় সাদা আলো জ্বলছে। সেই আলোতে শারমিন আরেকবার গাছদুটোর দিকে তাকিয়ে দেখল। মসৃণ বাতাসে গাছদুটো হালকা কাঁপছে। মহল্লার শেষ প্রান্তে একটা কুকুর ডেকেই যাচ্ছে। পাশের বিল্ডিঙের পশ্চিম পাশের তিনতলায় একটা রুমে বাতি জ্বলছে। রুমাদের বাসা সেটা। রুমার ছোটবোন সীমা এবার ভর্তি পরীক্ষা দেবে। তাই ঈদের দুদিন আগের মাঝরাতেও তাকে জেগে থাকতে হচ্ছে। চারতলার বারান্দা থেকে আবছা আলোয় রুমাদের বিল্ডিঙের বাউন্ডারি দেয়ালের ওপর কিছু একটা হেঁটে যেতে দেখল শারমিন। খেয়াল করে দেখতেই বোঝা গেল ক্রমশ সরে যাওয়া আগন্তুক একটা বিড়াল। অন্ধকারে কালো বিড়াল দেখা খুব অস্বস্তিকর ব্যাপার।

৫.
– আবার ফোন দিলে যে? ঘুম আসছেনা?
– উঁহু
– টেনশন কোরো নাতো
– হুঁ
– আম্মা ঘুমিয়েছেন?
– হ্যাঁ, তুমি কী করো?
– গান শুনি?
– কী গান?
– ইংলিশ গান, গায়িকার নাম অ্যাডেলে
– দুই একটা লাইন বলো তো
– দ্য স্কারস অফ ইয়োর লাভ, দে লীভ মি ব্রেথলেস
– স্কার মানে ক্ষতচিহ্ন না?
– হ্যাঁ
– তোমার আছে?
– তোমার মত বউ পেলে পুরনো সব ক্ষত সেরে যায়, শারমিন!
– পরের লাইন কী?
– আই ক্যান নট হেল্প ফিলিং উই কুড হ্যাভ হ্যাড ইট অল, রোলিং ইন দ্য ডিপ
– রোলিং ইন দ্য ডিপ মানে কী?
– গর্তের ভিতর গড়াগড়ি করা মনে হয়
– গড়াগড়ি করতে চায় কেন?
– আল্লাহই জানে কেন! তবে শুনতে ভালো লাগে
– দিও তো, শুনে দেখবো
– আচ্ছা দিবো
– ঘুমায় যাও
– হুম, আমার এখন ঘুম আসছে
– তাহলে রাখি
– রাখো
এবার ইচ্ছে করেই ‘আই লাভ ইউ’ বলল না শারমিন। ফোন কেটে দিয়ে রুমে ফিরে এলো। লাল বাটনটা চাপতে কখনোই ভালো লাগেনা তার।

৬.
ঘড়ির কাঁটা বলছে রাত আড়াইটা বাজতে চলেছে। বাসার সবাই ঘুমাচ্ছে। শারমিন জানে আজ রাতে আর ঘুম আসবে না। প্রতিবারই এরকম হয়। নাজমুলের মতন গোনাগুণি করে তার ঘুম আসেনা। সেটা আকাশের তারাই হোক অথবা পশমওয়ালা ভেড়াই হোক। বারবার পানি খেয়ে তলপেটের ওপর চাপ বাড়ানোর কোনো মানে হয়না। গান শুনতেও ইচ্ছে করছেনা। তাই পুরনো ছবির অ্যালবাম ঘেঁটে নাজমুলের ছবি দেখতে থাকে শারমিন। ছবি বেশি নেই। তাই একই ছবি বারবার দেখে সে। তরুণ স্বামীর ছবি বুকে জড়িয়ে শুয়ে থাকে নিশ্চুপ। ঘড়ির কাঁটা টিক টিক শব্দ করে চলছে। ষাট মিনিট পরপর ঘণ্টার কাঁটা পনের ডিগ্রি পথ ঘুরে আসছে।

এভাবেই পেরিয়ে যাবে রাত। ভোরের আলো ফুঁটতেই আবার বারান্দায় এসে দাঁড়াবে শারমিন। গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে থাকবে কারো অপেক্ষায়। রাস্তার দূরতম যে বিন্দুতে চোখ যায়, ঠিক সেই বিন্দুতেই তাকিয়ে থাকবে অপলক। ফজরের নামাজ শেষ করে কাপড়ের কেডস পায়ে গলিয়ে স্ত্রীর সাথে হনহন করে হাঁটতে থাকবেন বাড়িওয়ালা কিবরিয়া সাহেব। ভোরের স্নিগ্ধ নরম আলোয় শারমিনের পিপাসার্ত চোখে হঠাৎ দেখা দেবে একটা রিকশা। দৌঁড়ে গিয়ে বাসার দরজা খুলে দাঁড়িয়ে থাকবে সে। কোনোভাবেই যেন নাজমুল কলিং বেল চাপতে না পারে। তাহলে যে আম্মা উঠে আসবেন! বাসার সবাইকে ডাক দেবার আগেই দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা নাজমুলের বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে শারমিন। সে জানে তার চেয়েও অনেক বেশি শক্ত করে জড়িয়ে ধরবে তার মানুষটা। শারমিন ফিসফিস করে বলবে, অ্যাঁই ছাড়ো প্লিজ, কেউ দেখে ফেলবে তো! নাজমুল বুকের আরও কাছে টেনে নেবে শারমিনকে। হাসতে হাসতে বলবে, দেখলে দেখুক, আমি ছাড়বো না!

৭.
রিকশাটা দেখা যাওয়া মাত্রই শারমিন সাদা গোলাপ গাছের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। টান দিয়ে ছিঁড়ে ফেলল একটা কুঁড়ি। আরেকটা কুঁড়ি। আরও একটা কুঁড়ি। এরপর ধীরপায়ে এগিয়ে গেল বাসার দরজার দিকে। নিঃশব্দে খুলে দিল দরজার ছিটকিনি। সারারাত বাস জার্নি করে কয়েকশো কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে কেউ একজন এখন সিঁড়ি বেয়ে চারতলায় উঠে আসছে। সে জানেনা তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য একটা মানুষ দরজার চৌকাঠ ধরে দাঁড়িয়ে আছে। সে জানেনা রান্নাঘরে ময়লা ফেলার ঝুঁড়িতে পড়ে আছে তার হাতে লাগানো সাদা গোলাপের তিনটা কুঁড়ি।

১,৬২৫ বার দেখা হয়েছে

১৮ টি মন্তব্য : “ব্রেথলেস”

  1. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    দারুন লিখেছো, বিবাহিত ব্যাচেলরদের পরিচিত জীবন 🙂


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  2. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

    ভালো হয়েছে... :thumbup:
    একটা ডাউট আছে...বোকার মতন হলে হাসাহাসি করবি না- শারমিন কুঁড়িগুলো ছিঁড়ে ফেললো কেন? :-/


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন
      • ফেরদৌস জামান রিফাত (ঝকক/২০০৪-২০১০)

        জুনায়েদ ভাই আর নূপুর দা, একসাথে উত্তর দিই, কিছু মনে করবেন না। আমি অনেক ছোট মানুষ। লেখায় ভুল থাকবেই। আপনাদের ডাউটের জবাব দেয়ার চেষ্টা করছি। আবারও ভুল হতে পারে। মাফ করে দেবেন।

        ১) প্রিয় মানুষের কাছে ইচ্ছা করে হেরে যাওয়া সম্ভবত খুব স্বাভাবিক আর পরিচিত ব্যাপার। শারমিনের ব্যাপারটাও এমনটাই হয়েছে। সে মনে মনে চাইতো লাল গোলাপটাই আগে ফুঁটুক। খুব হাস্যকর হতে পারে, কিন্তু ছেলেমানুষি ভালোবাসা হিসেবেই শারমিন চেয়েছে তার স্বামী যেন শুধু সাদা গাছে গোলাপ না দেখে। সে চেয়েছে দুটো গাছে একসাথে ফুল ফুঁটুক, অথবা লাল গাছে আগে ফুঁটুক। সে চায়নি তার স্বামী হেরে যাক। যদিও ব্যাপারটা লেইম :)) :))

        - লাল গাছটা তোমার, আর সাদাটা আমার
        - মানে?
        - মানে হল লাল গোলাপগুলো আমার পক্ষ থেকে তোমার জন্য, আর সাদা গোলাপগুলো তোমার পক্ষ থেকে আমার জন্য
        - যদি লাল ফুল না ফোঁটে?
        - অবশ্যই ফুঁটবে
        - আর সাদা ফুল?
        - সেটা তো না ফোঁটারই কথা

        ২) বানানের ব্যাপারে আপনি বলার পরেই খেয়াল করলাম, নূপুর দা।
        উঁহু, সিঁড়ি, ঝুঁড়ি, হুঁ...... এইসব বানানে চন্দ্রবিন্দু অযথাই দিসি। এরপর থেকে ভুল এড়ানোর চেষ্টা করবো। গাইড করার জন্য অনেক ধন্যবাদ আপনাকে 🙂 (সম্পাদিত)


        যে জীবন ফড়িঙের দোয়েলের- মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা

        জবাব দিন
  3. সামিউল(২০০৪-১০)

    ভাল লিখছিস দোস্ত।
    গোপনে বিয়া টিয়া করছিস নাকি একটা??

    যেমনে প্রেমের গল্প লিখিস মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়! 😛


    ... কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে!

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।