তরমুজ

শৈশবেই ছিঁচকে চুরিতে হাত পাকায়নি এমন ক্যাডেটের সংখ্যা বিরল। যদিও ক্যাডেটদের কাছে এগুলো কখনোই চুরি নয় বরং নিজেদের প্রাপ্য হক আদায় করা। সেভেন/এইটে খুব বেশি সুযোগ না থাকলেও  প্রতিভাবান ছেলেদের কখনোই দাবায়ে রাখা যায়না। আর ক্লাস নাইনে উঠে যাবার পর তো চুরির অঢেল সুযোগ। শুধু চোখ কান খোলা রাখলেই চলে।

আমার সমসাময়িক বেশিরভাগ ক্যাডেটের চুরির হাতেখড়ি পেয়ারা দিয়ে। সেভেনের শিশুরা কথায় কথায় হাসপাতালে ভর্তি হতে পারে( একবার এক জুনিয়রকে  মন ভালো না থাকার কারণে এক সপ্তাহ ভর্তি থাকতে দেখেছিলাম )। লাঞ্চের পর যখন অ্যাকাডেমিক ব্লক একদম ফাঁকা হয়ে যায় তখন তারা লাইব্রেরির পিছে পেয়ারা পাড়তে আসে। একবার ভয় ভেঙে গেলে আর পিছে ফিরে তাকাতে হয়না। নাগালের ভেতরের ও বাইরের কোনো গাছই রেহাই পায়না। পুকুরপাড়ের জাম আর খেজুর গাছ, ডাইনিং হলের জাম্বুরা গাছ, মসজিদের পেছনের আর ওয়ার্কশপের সামনের কাঁঠাল গাছ, বারবার শপের পিছে লেবু গাছ, বায়োলজি ডিপার্টমেন্টের বামপাশের গাবগাছ, লীজ নেয়া জমিতে চাষ করা গাজর-টমেটো আর সমস্ত কলেজ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য পেয়ারা আর আমগাছ…… সব সাফ করে দেয়। পুরনো দিনের ক্যাডেটরা নারকেল গাছেও উঠতেন। কিন্তু আমাদের সময় এতো ভালো কোনো গাছি ছিলনা। আসলেই ক্যাডেট কলেজের মান খারাপ হয়ে যাচ্ছে !

আজকে বরং অন্য একটা চুরির গল্প বলি। আমাদের ২ নাম্বার ফুটবল গ্রাউন্ড থেকে ক্যান্টিন কাছেই। আর ক্যান্টিনে যাবার পথেই সেই যায়গাটা পড়ে যেখানে প্রতিদিনের খাবার (গরু- মুরগি থেকে শুরু করে পেয়াজ-রসুন-আদা পর্যন্ত) ইস্যু করা হয়, ওজন করা হয় এবং সবশেষে ডাইনিং হলে চালান করে দেয়া হয়। এই ইস্যু করার কাজটি সাধারণত লাঞ্চের অনেক আগেই শেষ হয়ে যায় আর সারাটা দিন প্রকাণ্ড দাঁড়িপাল্লাটা শূন্য খাঁ খাঁ করে। তো একদিন গেমস টাইমে এই মাঠে ফুটবল খেলার সময় খেয়াল করলাম কয়েকটা তরমুজ দাঁড়িপাল্লার পাশেই রাখা। বুঝলাম সন্ধ্যার টি-ব্রেকে আজকে তরমুজ দিবে। খেলা শেষে ডাইনিং এ খেতে গেলাম। ও মা! এ তো আপেল!  আমাদের সাপ্লায়ার অশোক ভাই ছিলেন বিরাট মনের মানুষ। উনি প্রায়ই ডাবল জিনিস আনতেন। যেমন ধরেন ডিমান্ড অনুযায়ী কলা কেনার পর হঠাৎ বাজারে ভালো লিচু দেখলেন তো কিনে ফেললেন। সেদিন টি ব্রেকে আমরা লিচু খেতাম, পরের দিন কলা। আপেল-তরমুজের হিসাব মেলাতে গিয়ে চোরামনে একটা ক্ষীণ সম্ভাবনা উঁকি দিলো।

টি শেষ করেই কয়েকজন ছুটলাম ক্যান্টিনে। দু’য়ে দু’য়ে চার মিলে গেলো। আশেপাশে ভালো করে দেখে নিলাম। তারপর তিনজন পাঞ্জাবীর তলায় তিনটা তরমুজ লুকিয়ে ছোটখাটো দৌড়। স্টাফ, হাউস বেয়ারা, ডিউটি মাস্টার সবার নজর এড়িয়ে হাউসে পৌঁছলাম। আমার খাটের তলায় দুইটা তরমুজ রাখা হল। অন্যটা গেলো বদর হাউসে। এবার ভদ্র ছেলের মতো টুপি মাথায় মসজিদে চললাম।

নামাজের পরপরই প্রেপ (নিজের পড়ার সময়, অবশ্যই ক্লাসরুমে) যেতে হল। তরমুজ খাওয়ার সময় নাই। সিদ্ধান্ত হল ‘লাইটস অফ’ মানে পৌনে এগারোটার পর ড্রাইং রুমে (উন্মুক্ত গোসলখানা) সবাই মিলে খাওয়া হবে। সেদিনের প্রেপ আর শেষ হতে চায়না। অবশেষে অপেক্ষার প্রহর শেষ হল রাত দশটায়। হাউসে ফিরে আসলাম। টিভি রুমে ঝাকানাকা কিছু গান দেখে আরও চাঙ্গা হয়ে উঠলাম। রাত  বারোটা বাজতেই তরমুজ আর স্টিলের স্কেল নিয়ে উপস্থিত হলাম ড্রাইং রুমে। চারিদিকে সাজ সাজ রব। সবার চোখে মুখে উত্তেজনা। তরমুজের পেট বরাবর স্কেল চালাতেই  হইচই পড়ে গেলো। কাড়াকাড়ি করে খাওয়া শুরু করলো সবাই। তরমুজ দুইটা পাকাই ছিল। কিন্তু মিষ্টি ছিলনা একটুও। বরং মাঝখানটা কেমন যেন বালি বালি। বিজ্ঞের মতো সবাই বলল, জাত ভালোনা। তাতে কী ! ক্যাডেট সব খাইতে পারে !!

দুইটা বিশাল অথচ বিস্বাদ তরমুজ খেয়ে শেষ করাও আমাদের জন্য দুই মিনিটের ব্যাপার। কিন্তু সৌন্দর্য সচেতন আব্দুল্লাহ না খেয়ে তরমুজ মুখে ঘষতে লাগলো। এতে নাকি স্কিন (ওর ভাষায়, আমরা বলি চামড়া) সুন্দর হয় ! ওর দেখাদেখি অন্যান্য রূপবান ক্যাডেটদেরও (তানভীর, রিয়াদ, মামুন…… বাকি নামগুলা বলতে ভয় লাগে!) চামড়া প্রেম জাগ্রত হল। হাতে-মুখে-গলায় মাখা হল তরমুজ। আমরা খাদক পার্টি খোসা আর বিচি বাদে যতটুকু পারা যায় খেয়ে সাবাড় করলাম। সবশেষে এলাকা পরিস্কার করে রুমে ফিরে গেলাম। ফুরফুরে মনে সবার চমৎকার ঘুম হল রাতে।

এই কাহিনি এখানেই শেষ হতে পারতো। কিন্তু হয়নাই। ছয়-সাতদিন পরে অশোক ভাইয়ের সাথে আমার দেখা।

‘অশোক ভাই, কি দিচ্ছেন আজকের টি তে ?’

‘তরমুজ দিচ্ছি ভাই। কয়েকদিন আগেও একবার আনছিলাম। কিন্তু ইস্যু করার আগেই ওইগুলা কে যেন নিয়ে গেসে। ক্যাডেটরা হইলে তো কোনও সমস্যাই নাই কিন্তু অন্য কেউ নিলো নাকি বুঝতেসিনা।’

আমি সতর্ক হলাম। এদিক-ওদিক  দেখে নিয়ে তারপর গলা নামিয়ে হাসি হাসি মুখে ফিসফিস করে বললাম,

‘অন্য কেউই নিসে মনে হচ্ছে। আর এইচএসসি ক্যান্ডিডেটদের পরীক্ষা চলতেসে তো, উনারা সারাদিন হাউসেই থাকেন। উনাদের নেয়ার কথা না। আর নিলেও আপনি কিছু মনে কইরেননা অশোক ভাই !’

‘আরে নাহ, ক্যাডেটরা নিলে কিছু মনে করবো ক্যান ? আপনারে একটা কথা বলি কিন্তু আবার আপনি উনাদের বইলেননা, ওই তরমুজ গুলা পইচা গেসিলো  বুঝলেন, এইজন্য আমি পরে আবার আপেল আনছিলাম, হা হা হা ।’

আমি একটু আগের হাসি হাসি মুখটা যথাসম্ভব অপরিবর্তিত রাখার বৃথা চেষ্টা করে শুধু বলতে পারলাম,

‘আচ্ছা বলবোনা।’

২,৫৪৬ বার দেখা হয়েছে

৩২ টি মন্তব্য : “তরমুজ”

  1. তাজিন (২০০৫-২০১১)

    আসলেই ক্যাডেট কলেজের মান খারাপ হয়ে যাচ্ছে ! :just: :khekz:

    এতে নাকি স্কিন (ওর ভাষায়, আমরা বলি চামড়া) সুন্দর হয় !

    আমি মাইয়া হয়ে এখনো কিচ্ছু ঘষতে পারলাম্না মুখে!!!! বৃক্ষরা পারেও! 😛


    যখন চলে যাব দূরে...বহুদূরে...নৈশব্দের দূর নগরীতে

    জবাব দিন
  2. শাইখ (০৩-০৯)
    অন্য কেউই নিসে মনে হচ্ছে। আর এইচএসসি ক্যান্ডিডেটদের পরীক্ষা চলতেসে তো, উনারা সারাদিন হাউসেই থাকেন। উনাদের নেয়ার কথা না। আর নিলেও আপনি কিছু মনে কইরেননা অশোক ভাই !’

    অশোক ভাই কান্ডিডেট দের জন্য আলাদা ভাবে xট্রা ফ্রুট থাক্লে দিয়া যাইত।

    আর এখানে '' বৃক্ষরা পারেও! '' কহিয়া কবি কি বোঝাতে চাইলেন? :gulli2:

    রিফাত তুমি ত ভাল রকিব সার এর পাল্লাই পড় নাই, কাঠাল নিয়ে একবার জা হইল!! :duel:

    কাঠাল ব্লাঙ্কেটে পেচাইয়া কাবারডে রাখা ছিল। কখন পাকছে আল্লাহ মালুম, সার হাউস অফিস থেকে বাস্না পাইছে, মাছি মিরজাফর গিরি করছিল , সার রে দেখাইদিছে কোন কাবারডে কাঠাল আছে, আম্রা সবাই তখন ব্লকে ছিলাম :bash: :bash:

    জবাব দিন
  3. ফেরদৌস জামান রিফাত (ঝকক/২০০৪-২০১০)

    ভাই এই তরমুজ আপনাদেরও অনেকে খাইসিল 😀
    রাজু ভাই মুখেও মাখসিল :goragori: :goragori: :goragori:


    যে জীবন ফড়িঙের দোয়েলের- মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা

    জবাব দিন
  4. রিয়াদ(২০০৪-১০)

    অনেক দিন পর অনেক হাসলাম ............। :khekz: :khekz: :khekz: :khekz: :khekz: :khekz: jotil ........... dost........
    আব্দুল্লাহ এবং তানভীর কে কিন্তু বুদ্দি টা আমি দিছিলাম ..................। =)) =)) =)) =))


    দয়ারি

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : ফেরদৌস জামান রিফাত (ঝকক/২০০৪-২০১০)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।