পরানের গহীন ভিতর

বহু বছর আগে, একটা সময় ছিলো যখন আমাদের অনেকেই সিসিবিকে নিজের ঘরবাড়ি বানিয়ে ফেলেছিলাম। যার যার নিজস্ব জীবনের গন্ডীতে থেকেও দিনের একটা বিরাট সময় আমরা অদ্ভুত ভাবে সিসিবিতে ঢুকে বসে থাকতাম। শুধু চুপচাপ বসে থাকাই নয়, হাসি কান্না হাউ কাউ ঝগড়া ফ্যাসাদ খাওয়া দাওয়া, এরকম প্রাত্যহিক সবগুলো কাজ যেন সবাই মিলে এই একটা জায়গাতেই করতাম। কেন করতাম কিভাবে করতাম এখন হয়তো পুরোপুরি বলতে পারবেনা কেউই, কিন্তু করতাম এটা নিশ্চিত। একজন কোন পোস্ট করলে প্রায় সবাই একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়তাম সেখানে। একজন কোন কমেন্ট করলে সেই কমেন্ট ধরেই দেখা যেত আরো একশটা কমেন্টের বন্যা বইয়ে দিতাম। প্রায় প্রত্যেকটা দিনই পান্থপথে সিসিবিয়ানদের জটলা লেগে যেতো। সেই জটলা রাস্তার পাশেই ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিতো। কারোই যেন নিজ নিজ বাসায় ফেরার ইচ্ছা হতোনা।

বহু বহু বছর আগে, শুধুমাত্র ক্যাডেট কলেজের স্মৃতিচারণের জন্য তৈরি করা একটি ব্লগ কিভাবে কিভাবে যেন দুর্দান্ত সব লেখার আধার হয়ে উঠেছিলো। কী থাকতোনা তখন সিসিবিতে! নানান রকমের লেখায় প্রতিদিনের সিসিবি ঠাসা থাকতো। হোম পেইজে একটা লেখা দেয়ার কিছুক্ষণের ভেতরেই দেখা যেত সেই লেখা টুপ করে নীচে নেমে যাচ্ছে আরো নতুন পোস্টের আড়ালে। একটা কমেন্ট দিয়ে সাথে সাথে রিফ্রেশ দিয়ে দেখা যেতো আরো দশটা কমেন্ট চলে এসেছে। একজন ফ্রিজ খুলে মিষ্টি খাওয়া শুরু করতে না করতেই দেখা যেত আরো বিশজন লাইন দিয়ে ফ্রিজ খুলছে, আর মিষ্টি খাচ্ছে!

বহু বহু বছর আগে কদিন পর পরই সিসিবি মাহফিল নামের অদ্ভুত এক আয়োজন হতো। কোথায় হয়নি সিসিবি মাহফিল! রেস্টুরেন্ট, বাসা, হলিডে রিসোর্ট, মার্কেট, এফএম রেডিও অফিস আর শমরিতা হাসপাতালের সামনের পান্থপথের সেই বিখ্যাত ফুটপাত তো আছেই! সেই মাহফিল শেষেই প্রায় প্রত্যেকে দৌড়ে চলে যেতো ছবি আর পোস্ট দিয়ে হোমপেইজ ভর্তি করে দেয়ার জন্য। লাইভ ব্লগিং তো ছিলোই! এরপর শুরু হয়ে যেতো সেই বিখ্যাত অসুস্থ প্রতিযোগিতা, কমেন্ট কমেন্ট খেলা। যদিও সিসিবি কোন খেলার জায়গা নয়, এরপরেও খেলা চলতেই থাকতো, চলতেই থাকতো।

অনেক অনেক দিন আগে, ডিসেম্বর মাস আসলেই সবাই তক্কে তক্কে থাকতো সিসিবির জন্মদিনের পোস্টটা নিজের করে নেয়ার জন্য! সেই সাথে জন্মদিন প্রিফেক্টরা নিজের দায়িত্ব পালন করে যেতো তারকা সিসিবিয়ানদের জন্মদিন টার্গেট করে পোস্ট আর কমেন্ট দিয়ে খাওয়া আদায় করে নেয়ার জন্য। মেডিক্যাল অফিসার আর ব্লগএডজুট্যান্ট শুরু করে দিতো জন্মদিনে আর নতুন বছরে সিসিবির থিম পরিবর্তনের কাজে। মডুরা ঘুরে বেড়াতো দুষ্টু ক্যাডেটদের পাঙ্গা দেয়ার জন্য।

খুব কি বেশিদিন আগের কথা এগুলো? হয়তো। হয়তো না।

অভিমানী কিংবা ক্যাচালকারী সিসিবিয়ানরা সুযোগ পেলেই সিসিবি ছেড়ে চলে যাওয়ার চেষ্টা করে যেতো। একটা কথা আমরা খুব বলতাম তখন, সিসিবি কাউকে মিস্‌ করে না, যারা সিসিবি ছেড়ে চলে যায় তারাই সিসিবিকে মিস্‌ করে। করবে। কিন্তু এখন কেন জানি মনে হয়, সিসিবিকে আমরা কেউই তেমন মিস্‌ করিনা। সেই প্রথম থেকে এখন পর্যন্ত প্রত্যেকটা সিসিবিয়ানকে আমাদের প্রিয় সিসিবি খুব মিস্‌ করে। প্রতিনিয়তই মিস্‌ করে সেই দুর্দান্ত আনন্দময় দিনগুলোকে।

দেশের অবস্থা, দেশের মানুষগুলোর অবস্থা এই মুহুর্তে ভালো নয়, আমরা সবাই জানি। কারণ মনে হয় সেটাই, আমরা দেশের মানুষরা দেশটাকে খুব একটা মিস্‌ করিনা। কিন্তু আমাদের দেশটা দেশের মানুষগুলোকে খুব মিস্‌ করে। সেই মানুষগুলো, যারা সবকিছুর পাশাপাশি দেশটাকে একেবারে নিজের মনে করে, একদম নিজের একটা অংশ মনে করে। পরানের একদম গহীনে, খুব সামান্য হলেও ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা নিয়ে অপেক্ষা করে নতুন দিনের।

নতুন বছরের শুভেচ্ছা সবাইকে।

৩,৪৬২ বার দেখা হয়েছে

৪০ টি মন্তব্য : “পরানের গহীন ভিতর”

  1. কামরুলতপু (৯৬-০২)

    জাস্ট নস্টালজিক।
    আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এর কথা মনে পড়ল। লেখালেখির সংখ্যা অনেক কম কিন্তু ইম্প্যাক্ট ফ্যাক্টর প্রায় ইনফিনিটির কাছাকাছি।
    কাইয়ূম ভাইর আবেগ মন ছুঁয়ে গেল।

    জবাব দিন
  2. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    নতুন বছরের সবচেয়ে সারপ্রাইজ পেলাম সকালে সিসিবি খুলে কাইয়ূম ভাইয়ের লেখা দেখে। অনেক উত্তেজনা নিয়ে পড়ছিলাম কিন্তু আস্তে আস্তে মন খারাপ হয়ে গেল। নতুন বছরে সেই দূর্দান্ত আনন্দময় দিনগুলো আস্তে আস্তে হলেও ফিরে আসুক।

    কি বলেন কাইয়ূম ভাই? 😉


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  3. মোকাব্বির (৯৮-০৪)

    সিসিবিতে শুরুর দিকে লেখা দিতাম তিমি মাছের মত করে। একটা দিয়ে ৮-৯ মাস গায়েব। আবার হঠাৎ ৩-৪টা তারপরে আবার বছর দেড়েকের জন্য গায়েব। ঐসব হাবিজাবি লেখাগুলোতে যে পরিমাণ কমেন্ট কমেন্ট খেলা হত তা দেখবার মত। সর্বশেষ গায়েব হবার পরেই ভূতের গলি হয়েছে সিসিবি। এরপরে পানির উপরে মাথা তুলে কিছু বুঝি নাই। কিছু একটা ঠিক নাই এইটা নিশ্চিত ছিলাম। তারপরে মোটামুটি জানতে পারলাম কারণে-অকারণে অনেকে হারিয়ে গিয়েছে। এখন একটা লেখা দিলে কমেন্ট দাতা সব usual suspect ফেবুতে শেয়ার দিলে কিছু নতুন মুখ এসে পড়ে যায় কিন্তু দুটো কথা লিখে পোস্ট করে না অথবা করার সময় পায় না অথবা করার প্রয়োজন মনে করে না। এদিকে সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর পর থেকে তো অনেকে ব্লগ লেখা, পড়া ব্যাপারটাকেই খারাপ দৃষ্টিতে দেখে। বিনোদন কাহাকে বলে! যাই হোক। লিখে যাব। পড়ুক আর না পড়ুক। লিখে গেলে অন্তত যা ভাবছি তা কোথাও পাবলিশড ফর্মে আছে এটা নিশ্চিত হবে। ভবিষ্যতে যখন খুব বিখ্যাত :goragori: হয়ে যাব তখন দরকার পড়বে! B-) 😀


    \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
    অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

    জবাব দিন
  4. টিটো মোস্তাফিজ

    পরানের গহীনের ভিতর থেকে উঠে আসা কথাগুলো খুব ভাল লাগলো কাইয়ূম
    ::salute:: :hatsoff:
    সেই সোনালী সময়টা মিস করেছি 🙁 :bash:

    ফেসবুকের পরশে বোধ করি এই অবস্থা :-B


    পুরাদস্তুর বাঙ্গাল

    জবাব দিন
  5. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

    কাইয়ূম ভাই এর একাউন্ট হ্যাক হইছে নাকি???
    ভোলাভালা কাইয়ূম ভাই এর একাউন্ট হ্যাক করে, পোস্ট দিয়ে তাঁর লেখা দেবার পঞ্চ-বার্ষিক পরিকল্পনাকে ভন্ডুল করার তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি... 😛


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন
  6. হারুন (৮৫-৯১)

    আমি মেলা থেকে তালপাতার এক বাঁশি কিনে এনেছি ,বাঁশি কই আগের মত বাঁজে না ,মন আমার তেমন কেন সাজে না, তবে কি ছেলেবেলা অনেক দূরে ফেলে এসেছি...


    শুধু যাওয়া আসা শুধু স্রোতে ভাসা..

    জবাব দিন
  7. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)
    অভিমানী কিংবা ক্যাচালকারী সিসিবিয়ানরা সুযোগ পেলেই সিসিবি ছেড়ে চলে যাওয়ার চেষ্টা করে যেতো। একটা কথা আমরা খুব বলতাম তখন, সিসিবি কাউকে মিস্‌ করে না, যারা সিসিবি ছেড়ে চলে যায় তারাই সিসিবিকে মিস্‌ করে। করবে। কিন্তু এখন কেন জানি মনে হয়, সিসিবিকে আমরা কেউই তেমন মিস্‌ করিনা। সেই প্রথম থেকে এখন পর্যন্ত প্রত্যেকটা সিসিবিয়ানকে আমাদের প্রিয় সিসিবি খুব মিস্‌ করে। প্রতিনিয়তই মিস্‌ করে সেই দুর্দান্ত আনন্দময় দিনগুলোকে।

    :clap: :clap: :clap:


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
  8. মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)
    কিন্তু আমাদের দেশটা দেশের মানুষগুলোকে খুব মিস্‌ করে। সেই মানুষগুলো, যারা সবকিছুর পাশাপাশি দেশটাকে একেবারে নিজের মনে করে, একদম নিজের একটা অংশ মনে করে। পরানের একদম গহীনে, খুব সামান্য হলেও ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা নিয়ে অপেক্ষা করে নতুন দিনের।

    প্রতিদিনই সিসিবিতে ঢুকি। আমার মনে হয় আরো অনেকেই আমার মতো সিসিবিতে নিঃশব্দে বেড়িয়ে যায়। অবস্থা যত খারাপই হোক, সিসিবি আপন বাড়ির মতো, যেমন বাংলাদেশটা।

    নতুন বছরে নতুন দিনের অপেক্ষায় থাকলাম।


    There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : কাইয়ূম (১৯৯২-১৯৯৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।