হে আল্লাহ,আমাদের সুফিকে তুমি দেখে রেখো……

“আমরা গাজীপুর পৌঁছাই ১১টার কিছু আগে। জহিরকে রাখা হয়েছিলো বাসায় ঢোকার আগের খোলা জায়গাটাতে। কেউ একজন এসে কাফনের কাপড়টা সরিয়ে ওর মুখটা দেখালো। চোখের কাছটায় সুরমা দেয়াতে কিছুটা নীলচে হয়ে আছে মনে হলো। এছাড়া অন্যকোনো অস্বাভাবিকতা নেই। প্রথম দেখাতে কোনো অনুভূতিই হলোনা। কিভাবে হবে? আমাদের সুফির লাশ কাফনে মুড়ে খাটিয়াতে শুয়ে আছে আর আমরা ভীড় করে দেখছি, এটা কোনো কথা নাকি?তাই ওই সময়ে ভাবলেশহীন মুখে আমরা দেখে বাড়ির বাইরে এসে দাড়িয়ে থাকলাম। সমস্যা শুধু সিদ্দিকীটাকে নিয়ে, চোখ দিয়ে পানি পড়ছে তো পড়ছেই।
জানাজা হলো জোহরের পর। জানাজাতেও কিছু অবিশ্বাস্য কথাবার্তা বললো অনেকে। এই যেমন জহিরুল হক মারা গেছে, কবর দেয়া হবে, দোয়া করবেন সবাই মৃত জহিরের জন্য…….তখনো আমার তেমন একটা ভাবান্তর হলোনা। জানাজা শেষে ওকে গাজীপুর কেন্দ্রীয় কবরস্থানে নেয়া হচ্ছে। রাজিব গিয়ে খাটিয়া ধরলো, আর আমরা পেছনে মিছিলে মিশে গেলাম।
কবরে শোয়ানোর পর রাজিবকে দেখলাম কবরের উপরে বাঁশের চাটাই বানাচ্ছে। আমার বুকটা ধ্বক করে উঠলো সেই সময়টাতে। প্রায় তিন হাত মাটির নীচে আমাদের জহির, আমাদের শাহ সুফিকে রেখে দেয়া হচ্ছে। চিরতরে। কে যেনো পাশ থেকে বলে উঠলো কবর দিয়ে চল্লিশ পা হেঁটে যাবার পরপরই কবরে আল্লাহর আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়ে যাবার কথা। আমার কানে তেমন কিছুই ঢুকছিলোনা। যে হুজুর দাফনের কাজকর্ম তদারকি করছিলেন তার বিভিন্ন সুরা ও দোয়া পড়ার একের পর এক নির্দেশনা একটাও কানে ঢুকছিলোনা। আমাদের এতদিনের চেনা জহিরকে মাটি দিয়ে ঢেকে দেয়ার সময় আর কিছুই মাথায় আসছিলোনা। এর আগে কখনো কবর দিতে দেখিনি সামনা সামনি। হে আল্লাহ, আমাদের জহিরকে কবর দেয়া হচ্ছে, এটিই দেখতে হলো প্রথম অভিজ্ঞতায়!
কলেজের শেষদিকে এসে পোলাপাইনকে দিয়ে ডায়েরি লেখানোর একটা চল শুরু হলো। আমিও যথারীতি একটা ডায়েরি নিয়ে পোলাপানের কাছে যাওয়া শুরু করবো করবো করছি। জহির এসে সবার আগে প্রথম পৃষ্ঠায় লিখলো, তোকে নিয়ে কি আর লিখবো, প্রায় অর্ধেক কলেজ জীবন পাশের বিছানায় কাটালাম আর বিভিন্নসময় তোদেরকে কষ্ট দিলাম….আমাকে মনে রাখবি তো?
তুই সারা জীবন কি কষ্ট দিলি সেটা অনেক চেষ্টা করেও মনে করতে পারলামনা। কিন্তু সেদিন মরে গিয়ে কাজটা একদম ঠিক করলিনা। একেবারেই না। দিন পাঁচেক আগে রাজিব আর আজিজের সাথে দেখা করে গেলি। আজিজের কাছ থেকে আমার মোবাইল নাম্বার নিলি। রাজিবের অফিসে বসে তোর কথা শুনে তোকে কল দিতে গিয়েও দিলামনা রাতে বাসায় এসে কল দিবো বলে। কথা বলা হলোনারে, কথা বলা হলোনা ।
হে আল্লাহ, কখনো যদি একটা হলেও ভাল কাজ করে থাকি, সেটার বিনিময়ে হলেও আমাদের সুফিকে তুমি দেখে রেখো……. “

**গত ১৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বইমেলাতে রক্তদান করে বাসায় ফিরে হঠাৎ অসুস্হ হয়ে পড়ে আমাদের জহির। রাতেই মারা যায় সে। কেন, কেউ জানেনা।এই লেখাটি আমাদের মেইল গ্রুপ থেকে তুলে দিলাম।
সবাই আমাদের বন্ধুটার জন্য দোয়া করবেন।

২,৮৩৯ বার দেখা হয়েছে

২১ টি মন্তব্য : “হে আল্লাহ,আমাদের সুফিকে তুমি দেখে রেখো……”

  1. রায়হান আবীর (৯৯-০৫)

    হায়রে কাছের কেউ এভাবে চলে গেলে একদম বিশ্বাস হয়নাই। মে মাসের ২৯ তারিখ আমার খুব কাছের এক বন্ধু এইভাবে চলে গেলো। এখনও বিশ্বাস হয়না। জহির ভাইয়ের কথাটা শুনে মনটা আরও খারাপ হয়ে গেলো।

    অফ টপিকঃ ভাইয়া আপনার নামটা বাংলা করে দিলে খুব ভালো হতো।

    জবাব দিন
  2. কাইয়ূম (১৯৯২-১৯৯৮)

    আমরা এফ সি সি ৩৯ তম ব্যাচ [৯২-৯৮ ব্যাচ]
    জহির ওয়ারিদে কর্মরত ছিল। সবাই পারলে ওর জন্য একটু দোয়া কোরো।

    আর লেখাটি আগে আমাদেরই একজন সামহোয়্যার-ইন এ দিয়েছিলো।


    সংসারে প্রবল বৈরাগ্য!

    জবাব দিন
  3. সাইফ (৯৪-০০)

    ঘটনাটা যেদিন ঘটে আমি সেদিন ঢাকা ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস এ ছিলাম।মান্নার কাছ থেকে শুনে ভেতরটা কেমন যেন করে উঠল।একটা ক্যাডেট এর চলে যাওয়া মানে একটা উজ্জল নক্ষত্রের আলো নিভে যাওয়া।ভাইয়ার স্মৃতি বেচে থাকুক সব ক্যাডেটের মাঝে।আল্লাহ ভাইয়ার আত্মাকে শান্তিতে রাখুন.........।।অবশ্যই রাখবেন।

    জবাব দিন
    • আলম (৯৭--০৩)

      একটা ক্যাডেট এর চলে যাওয়া মানে একটা উজ্জল নক্ষত্রের আলো নিভে যাওয়া।.... ঠিক কথা। ক্যাডেটগুলো হলো এই দেশের সম্পদ। তারাই পারে একটি সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ গড়তে।
      ভাইয়াকে হারিয়ে বাংলাদেশ একটা অপূরণীয় ক্ষতির মাঝে পড়লো। আসুন ভাইয়ার শোককে শক্তিতে পরিণত করে আমরা এগিয়ে যাই আমাদের সুপ্ত প্রতিভার বিকাশে।

      জবাব দিন
  4. নওরীন (৯৪-০০)

    " **গত ১৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বইমেলাতে রক্তদান করে বাসায় ফিরে হঠাৎ অসুস্হ হয়ে পড়ে আমাদের জহির। রাতেই মারা যায় সে। কেন, কেউ জানেনা। "

    এর মানে কী? তাহলে ওই রক্তদান কর্মসুচীর সুঁই দুষিত ছিলো না তো?!! কে জানে!! খুব খারাপ লাগলো। এত অল্প বয়সে মারা গেলো ছেলেটা!
    এই ঘটনাটা যারাই জানবে সবারই উচিত্‌ হবে কোথাও রক্ত দিতে গেলে নিজ দায়িত্বে প্যাকেট থেকে সুঁই বের করিয়ে তারপর ব্যবহার করতে বলা। নার্স অথবা যে ডিউটি তে থাকবে তাকে। পরে কি হইসিল? এর কি কনো ইনভেস্টিগেশন হয়নি? বিদেশ হলে অই গ্রুপ যারা রক্ত নিছে। সারা জীবনের জন্য ব্যান্‌ড্‌ হয়ে ্যেতোা আর প্রজেক্টের চীফ এর নামে কেইস হতো যে ওর গায়ে সিরিঞ্জ ঢুকাইসে অর জেল। আমাদের দেশে সাধারণ মানুষের জীবনের কী কোনোই দাম নাই! মন খারাপের পাশাপাশি খুব রাগ লাগতেছে ঘটনা টা শুনে।

    জবাব দিন
  5. ঘটনাটা নিয়ে আমরা সবাই কনফিউজড্ ছিলাম। জহির রেগুলার ডোনার ছিলো। ওদের ভার্সিটির কোনো ক্লাব [রেড ক্রিসেন্ট হতে পারে] এর মেম্বার হিসেবে বহুবার রক্ত দিয়েছে। এ ব্যাপারটা নিয়ে আমরা নিজেরা স্পেশালিস্ট ডাক্তারের সাথেও কথা বলেছিলাম। তারা প্রায় সবাই জানিয়েছেন সিরিন্জ সংক্রান্ত কোনো গন্ডগোল থাকলেও এভাবে মারা যাওয়ার কথা না। ও রক্ত দিয়েছিলো দুপুরের দিকে, আর মারা গিয়েছিলো রাত দেড়টার দিকে। আসলে পুরো ব্যাপারটাই এতটা অবিশ্বাস্য লেগেছে আমাদের কাছে যে তা বলে বোঝানো যাবেনা। ওর মতোন সুস্থ-সবল ফিজিকের একটা ছেলে [৬' লম্বা এবং ফিগারও সুঠাম] সিম্পলি রক্ত দিয়ে এসে ১০ ঘন্টার মধ্যে মরে যাবে এটি কল্পনা করাও কঠিন ছিল সবার কাছে। বই মেলায় সেসময় প্রচুর মানুষ রক্ত দিয়েছে। কিন্তু শুধু.....
    ওর এলাকার ডাক্তার জানিয়েছিলেন, রক্ত দিয়ে আসার পর বমি করায় ওর শরীরের প্রচুর ফ্লুইড বেরিয়ে যায়, আর এ থেকেই রাতের দিকে ওর হার্ট এটাক হয়।
    আমরা এখনো বিশ্বাসই করতে পারিনা যে আমাদের জহির আর নেই। চার মাস হয়ে গেছে, এখনো মনে হয় ওয়ারিদের সেই পরিচিত নম্বরটা থেকে যে কোনো মুহুর্তে কল আসবে সেই চির পরিচিত হাসিটা সাথে নিয়ে........

    জবাব দিন
  6. এভাবে চলে যাওয়াটা মেনে নেয়াটা খুব কষ্টের। আমাদের বেশ কয়েকটা কাছের বন্ধু আমাদের ফাকি দিয়ে চলে গেছে। একদিন আমরাও যাব। তবু মেনে নিতে ইচ্ছে করে না।

    ভালো থাকুন উনি।

    জবাব দিন
  7. সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

    জহিরের মৃত্যুর ব্যাপারটা জানতাম না। ব্লগে পড়ে খুব খারাপ লাগছে। তোমাদের সবার জন্য ভালোবাসা। ভালো থেকো সবাই।

    আশির দশকে সাংস্কৃতিক সংগঠন উদীচী শিল্পী গোষ্ঠি করতাম আমরা। এক বন্ধু (ক্যাডেট নয়) ভালো ঢোল বাজাত। রূপেশ বড়ুয়া। এলিফ্যান্ট রোডে একটা পোশাকের দোকানে কাজ করতো। একদিন একজন ক্রেতাকে প্যাকেট থেকে শার্ট খুলে দেখাতে গিয়ে একটা সুই তার আঙ্গুলে ঢুকে কিছুটা রক্ত বের হয়। রক্ত দেখে মাথা ঘুরে মাটিতে পড়ে সেখানেই মারা যায় রুপেশ। জহিরের মৃত্যুর কাহিনী শুনে রুপেশের কথা মনে হলো।

    এটা কোনো মৃত্যু হলো? এভাবে কেউ যায়? যেতে হয়?


    "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : তৌফিক (১৯৯৬-২০০২)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।