কিংবদন্তি’র কথা-১

লে. কর্নেল সোহরাব আলি তালুকদার নামটা আমাদের ,মানে সিলেটের ক্যাডেটদের কাছে প্রায় কিংবদন্তির মতো। কিংবদন্তি সাধারনত ইতিবাচক অর্থে বলা হয়। এই ক্ষেত্রে অবশ্য উল্টা। তিনি এমন একজন ছিলেন যে তার সময়ে প্রিন্সিপাল হিসাবে তিনি একাই কলেজ দাবড়িয়ে বেড়াতেন আর বাকি সব প্রাণী ছিল সাধারণ দর্শক মাত্র। কামরুল ভাই যেমন আগেই বলেছেন তার নাম শুনলে ক্যাডেটে-স্যারে এক ঘাটে জল খেতো।
কিন্ত ভুলে গেলে চলবে না আমরা ক্যাডেট। স্যারদের মধ্যে যেমন কিংবদন্তি থাকতে পারে তেমনি আমাদের মাঝেও কিছু মহান (!!!) ক্যাডেট থাকে। যারা তাদের স্বীয় মহিমায় নিজেকে কিংবদন্তির পর্যায়ে নিয়ে যান। পুংটামিকে যারা শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন সেই ইতিহাসে তাদের নাম মেটাল পালিশ করে লেখা থাকবে।

তেমনি একজন ক্যাডেট হলেন এষান ভাই।
আজ আমি তার গল্প বলবো।

আমি তখন ক্লাস ৭ এ। এক মাসের একটু বেশি হবে জয়েন করেছি। ক্লাস ৮ এর ভয়ংকর ভাইয়াগুলা ছাড়া কাঊকেই তেমন চিনি না। ক্লাস ১২ তো স্বপ্নের মত। চেনার প্রশ্নই আসে না। সন্ধ্যার প্রেপের সময় হাসপাতালে গিয়েছিলাম। সম্ভবত জ্বরের ওষুধ আনতে। আসার পথে প্রিন্সিপাল সোহরাব আলি স্যারের সাথে দেখা। তিনি ডাকলেন-
এই ছেলে! Come here . নাম কি?
-স্যার ফরিদ
-ক্লাস সেভেন না?
-জ্বী স্যার
-হাসপাতালে গেছিলা ক্যান?
-স্যার জ্বরের ওষুধ আনতে
-তোমারতো জ্বর নাই (কপালে হাত দিয়া দেখলেন)
-স্যার দুপুর থেকেই জ্বর জ্বর লাগছিল
-তোমাকে নিয়া তো আমি বিপদে পড়ে যাব। ১২ ক্লাস এ উঠে তো তুমি এষান এর মত মাস্তান হইয়া যাবা। চিন ? ক্লাস ১২ এর এষান কে চিন?
-না স্যার
-আচ্ছা যাও।
-স্লামুয়ালাইকুম স্যার।
আমি হাটতে হাটতে ভাবতে থাকলাম, ক্যাডেট কলেজে মাস্তান? এইটা কিভাবে সম্ভব? আর কে এই এষান ভাই?
খুব তাড়াতাড়ি জানা দরকার।

কয়দিন পরেই জানলাম। আমার গাইড ভাইয়ার মুখে।

আন্ত; ক্যাডেট কলেজ এথলেটিস প্রতিযোগিতা চলছিল রপুরে। কোন কারণে তখন প্রিন্সিপাল সোহরাব আলি স্যারও আমাদের কলেজ টিম এর সাথে রপুরে গিয়েছিলেন। সাথে ছিল তার ছেলে জিসান।
পোলভোল্ট ইভেন্টে আমাদের কলেজের প্রতিযোগি ছিলেন এষান ভাই। তো একদিন এষান ভাইকে দেখা গেল গলায় মাফলার, চোখে সাগ্লাস লাগিয়ে বেশ ফুরফুরে মেজাজে রংপুর ক্যাডেট কলেজের চারদিক ঘুরে বেরাচ্ছেন। এমন সময় কোথা থেকে যেন আচমকা প্রিন্সপাল সোহরাব আলি মহোদেয়র আবির্ভাব। এষান ভাই’র এই গেটআপ দেখেই তার মাথা খারাপ হয়ে গেল। তিনি ডাকলেন
এই ছেলে Come here.
সামনে যাওয়ার সাথে সাথেই তিনি তার বিখ্যাত একটা চড় বসিয়ে দিলেন এষান ভাই’র গালে।(তিনি সাধারণত কথা শুরু করতেন চড় মেরে। আর এত দ্রুত এবং জোড়ে তিনি চড়টা দিতেন যে প্রস্তুতি নেয়ার সময়ও কেউ পেত না। ) তারপর বললেন
তোমার নাম কি?
স্যার এষান
এইটাকি ?(গলার মাফলার দেখিয়ে)
স্যার মাফলার।
এইটাকি মাফলার পরার জায়গা?
এষান ভাই নিশ্চুপ
মাফলার পড়ছ ক্যান?
সরি স্যার
Put off your maflar.
জ্বী স্যার
এষান ভাইকে নিজের হাতে আর মাফলারটা খুলতে হয়নি। স্টাফ এসে নিজ দায়িত্বেই ওটা খুলে নিয়ে চলে যান। যাবার আগে অবশ্য বলে যান যে তোমার নামে ১০ টা ইডি বরাদ্দ হইল। Next term এ কলেজে এ আস।
পরদিন সকাল বেলা। সবাই নাস্তা সেরে ground এর দিকে যাচ্ছে। হঠাৎ দেখা গেল মাফলার গলায় একটা ছেলে হেটে আসছে। পোষাক এবং সাইজ দেখে মনে হছে না সে ক্যাডেট। এষান ভাই বেশ আগ্রহ নিয়ে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর প্রিন্সিপাল তাকে গতকাল যেভাবে ডেকেছিল তিনি একই স্বরে ডাকলেন
এই ছেলে ! এই দিকে আয়
ছেলেটি থতমত খেয়ে এগিয়ে এলো। বুঝা যাচ্ছে এমন ডাকের জন্য সে প্রস্তুত ছিল না।
তোর নাম কি?
জিসান
তুই কি আমাদের প্রিন্সিপাল সোহরাব আলি স্যারের ছেলে?
জি
শুন তোর নাম জিসান আর আমার নাম এষান। এইটাকি ?(গলার মাফলার দেখিয়ে)
মাফলার
এইটাকি মাফলার পরার জায়গা?
নিশ্চুপ
তাইলে মাফলার পড়ছস ক্যান?
ছেলেটা এইবার ইতস্ত করছে।
Put off your maflar তোর বাপেরে দিয়া আয়। আর শুন স্টাফরে বলবি তোরে ১০ টা ইডি দেয়ার জন্য। যাহ। বিদায় হ।
ছেলেটা মানে প্রিন্সিপাল এর ছেলে জিসান চরম অবাক হয়ে চলে গেল।

এর পরের ঘটনাটা আরেক বড় ভাইয়ের মুখে শুনা।

এষান ভাইদের ব্যাচ ক্যান্ডিডেটস লাইফের ছুটি শেষ করে মাত্র কলেজে এসেছে। ক্লাস ইলেভেন। প্রথম দিন ডাইনিং হলে দেখা গেলো গোঁফওলা এক ভাইয়া। যারা চিনে তারা তো আছেই ক্লাস সেভেনের যারা তাকে দেখে নাই তারাও অবাক। ওআইসি মেস রাউন্ড দেবার সময় ওই ভাইয়ার টেবিলের সামনে গিয়ে অবাক ।
এই ! এইটা কে, এষান নাকি?
জি স্যার
তুমি গোফ রাখসো কেনো?
স্যার কলেজে উঠসি এই জন্য গোফ রেখে দিলাম
হোপ, বেয়াদব ছেলে। ক্যাডেট কলেজে গোফ রাখে। আজকেই গোফ কাটবা।
আচ্ছা স্যার।

কাটবেন বললেও সেই গোফ নিয়ে এষান ভাই দিব্যি কয়েকদিন কলেজে ঘুরে বেড়ালেন। শেষে তাকে মনে হয় ধরে জোর করে গোফ কাটানো হয়েছিলো।

এর পরের ঘটনার সাক্ষী আমি নিজে…

এষান ভাই এর ছোট ভাই আতিক ভাইও আমাদের কলেজে পড়তেন। এষান ভাইয়ের এক বছরের জুনিয়র। ভীষণ ভাল ছাত্র আর শান্ত ছেলে হিসাবে তার খ্যাতি ছিল। মানে এষান ভাই এর পুরা বিপরীত। তো এষান ভাই ১২ থেকে কলেজ আঊট হয়ে যান।
এর ১৫/ ২০ম দিনের মাথায় আতিক ভাইদের ব্যাচে কি যেন একটা সমস্যা হয়। আতিক ভাইরা তখন ১১ এ । অনেকেরই পেরেন্টস ডাকানো হয়। এর মধ্যে আতিক ভাই ও ছিলেন। পেরেন্টস হিসাবে সবার বাবা / মা আসলো। প্রিন্সিপাল সোহরাব আলি সবার বাবা/মার সাথে কথা বলার পর আতিক ভাই এর পেরেন্টস কে ডাকলেন। দেখেন আতিক ভাইয়ের পেরেন্টস হিসাবে এসেছেন এষান ভাই।
প্রিন্সিপাল সোহরাব আলি স্যারের কি প্রতিক্রিয়া হয়েছিল বা তাকে তিনি কি বলেছিলেন সেটা অবশ্য আমরা জানতে পারি নাই ।

৪,১৬৫ বার দেখা হয়েছে

২৮ টি মন্তব্য : “কিংবদন্তি’র কথা-১”

  1. এহসান (৮৯-৯৫)

    মজা লাগলো। এষান আর জিশান এর কথাবারতা বেশি মজার ছিল। এই চোতরা হারামির একটা মহাদোষ ছিল কথা নাই, বারতা নাই,খালি পেরেন্টস ডেকে আনা। কিছুদিন আগে আমি চিন্তা করতে ছিলাম কারে আমি এই পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশী ঘৃনা করি। খুঁজে পেলাম এই মানুষটা হল সোহরাব আলী তালুকদার। আসলে এই ব্যাটা ছাড়া আমি কাউকে ঘৃনা করিনা। আজকে এত বছর পরেও এই ব্যাটার নাম মনে হইলে চ বরগিও একটা গালি চলে আসে।

    জবাব দিন
  2. আহ্সান (৮৮-৯৪)

    ফরিদ,
    হাসাইতে হাসাইতে মাইরা ফালাইলা ভাই... =)) =)) =))
    আমি ত এই এষান'র ফ্যান হইয়া গেলাম...।
    তোমার বর্ণনার ভঙ্গিটাও জটিল...। লেখাটা যেভাবে শেষ করছো তার তুলনা হয়না...।
    সাবাস বেটা...চালিয়ে যা...।
    নতুন পোস্ট তাড়াতাড়ি দাও...।

    জবাব দিন
  3. ১.
    আমি যখন ক্লাস সেভেনে এষান ভাই আমার টেবিল মেট ছিলেন। গোঁফের ঘটনা আমার সামনেই হইসিলো। :)) :))
    ২.
    একদিন কমন রুমে এষান ভাই টিটি খেলতেছিলেন। আমি একটু জোরে কথা বলায় আমারে টিটি টেবিলের নিচে হ্যান্ডস ডাউন করাইয়া রাখছিলেন। 😉 😉
    ৩.
    এইটা কি মহান (!!)ক্যাডেটদের নিয়া সিরিজ হবে যারা পুংটামিকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন? তাইলে আমারে নিয়াও একটা পর্ব লিখিস। ঘুষ দিমুনে। :grr: :grr:

    জবাব দিন
  4. সায়েদ (১৯৯২-১৯৯৮)

    এই লেখাটার শুরুতে সোহরাব আলীকে নিয়ে লেখা দেখে কেমন যেন লাগছিল।
    কিন্তু,

    পুংটামিকে যারা শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন সেই ইতিহাসে তাদের নাম মেটাল পালিশ করে লেখা থাকবে

    ....লাইনটা পড়ামাত্র নড়েচড়ে বসলাম 😛 ।
    খুব ভালো লাগল 😀 ।
    এখনও হাসতেছি :)) ।
    পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।


    Life is Mad.

    জবাব দিন
  5. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

    দোস্ত, সবার আগে তোমারে জরুরী একখান কথা কই- বর্তমানে সিসিবি'তে একটা ইশটাইল চলতেছে...ভাল ভাল সিরিয়াল গুলো সবাই ধুপ-ধাপ বন্ধ কইরা দিতেছে... x-(
    তরে তাই আগে থেকেই কইয়া রাখি, ৫০/৬০ টা পর্বের আগে যদি এই সিরিয়াল বন্ধ করার কথা চিন্তাও করিস...তাইলে পরের দিন তুই নিজেই কিংবদন্তি হইয়া যাবি... :gulli:

    লেখা পইরা হেবি মজা পাইলাম... :))


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন
  6. টিটো রহমান (৯৪-০০)

    এইটা কিছুই নারে বোকা।
    তুই যেমন ভেরিয়েশানের জন্য নিজের সুন্দর চেহারাখানা রাইখা হাতের রেখা দিয়া রাখছস তেমনি আমিও একটু সম্বোধনে ভেরিয়েশান আনলাম।

    গোপনে বলি...ব্লগে বসলে একটু আতলামি সবারই বোধহয় চলে আসে।dont take it seriously


    আপনারে আমি খুঁজিয়া বেড়াই

    জবাব দিন
  7. তৌফিক (৯৬-০২)

    ফরিদ ভাই, লেখাটা স্নৃতিকাতর কইরা ফেলছিল। এষান ভাইয়ের জন্য মনটা কেমন কেমন করতাছে। আসলে এষান ভাইরা হইল গিয়া ক্যাডেটদের একটা স্পেশাল জেনার, এরা কখনোই নিয়ম-কানুন মানতে পারে না। এবং এরা সাধারণত খুব ভালো মানুষ হয়।

    জবাব দিন
  8. এই চোতরা হারামির একটা মহাদোষ ছিল কথা নাই, বারতা নাই,খালি পেরেন্টস ডেকে আনা। কিছুদিন আগে আমি চিন্তা করতে ছিলাম কারে আমি এই পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশী ঘৃনা করি। খুঁজে পেলাম এই মানুষটা হল সোহরাব আলী তালুকদার।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।