ধুলোজমা সেই জীর্ণ ডায়েরী : ৬ জুন, ২০১৩ এর প্রহরান্তে

কঠোর ‘শৃঙ্খলা’ আর ‘নিয়মানুবর্তিতায়’ পরিচালিত ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজে সেদিন স্বাভাবিক আর সাতটা দিনের মতই সকালটা শুরু হল ক্যাডেটদের পিটি, স্টাফদের চিৎকার আর বাঁশির কর্কশ ধ্বনিতে। সবই স্বাভাবিক। শুধু ৪৭টা প্রাণ সেদিন সুদীর্ঘ নিঃশ্বাস বুকে এই নিত্য নৈমিত্তিক আনুষ্ঠানিকতার দর্শক মাত্র। ৪৪ তম ইনটেকের ৪৭ জোড়া ভেজা চোখ সেদিন শুধু সময়চোরা সূর্যের দিকে তাকিয়ে ব্যর্থ হাহাকাররত।

তারপর থেকেই দিনটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেদিন ব্রেকফাস্টের জন্য কোন তাড়া ছিল না। ডিউটি মাস্টার সেদিন একবারও বলে নি, ‘ফারহান, ক্লাস টুয়েলভ কই? আসে না কেন?’ …।। ঠিকই সময়মত হাজির হয়ে যায় নাজিবুর, সাদমান, মোস্তাফিজরা। তবু পাগলের মত গলা ফাটিয়ে সারজিলের চিৎকার ‘হারি আপ বয়েজ’ কারো কান পর্যন্ত পৌঁছানর আগেই শুন্যে মিলিয়ে যায় কোন এক অদ্ভূত শক্তিতে।

সমস্ত ডাইনিং হল যেন মরা বাড়ি। ভেবেছিলাম সেদিন এক ফোঁটা চোখের পানি ফেলব না। মুখে এক কৃত্রিম হাসি নিয়ে টেবিলে টেবিলে ঘুরতে গেলাম। আলম, সাদমান, ইকবাল, তাম্মাম, সারজিল, নাঈম, আব্দুল্লাহদের চেয়ে জুনিয়রদের চোখ বেশি লাল। অগত্যা ২-৩ জুনিয়রের মাথায় চাটি মেরে অনর্থক সান্ত্বনা দেওয়া। মুখে ২০০ ওয়াটের হাসি। হাহ!

ধীরে ধীরে ডাইনিং হলের ঘন্টার আমার প্রিয় সেই ছোট্ট হাতুড়িটা হাতে নিয়ে সাঙ্গ করে দিলাম সকল আনুষ্ঠানিক কর্মকাণ্ড। ভাবিও নাই শেষ ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলতে গিয়ে গলাটা এভাবে ধরে যাবে।

বারবার সেদিন মনে হচ্ছিল ২৩ মার্চ, ২০০৭ সালের সেই ডিনারের কথা। যেদিন চামচটা পর্যন্ত ধরা শিখিয়ে দিত অন্য কেউ। চারিদিকের সব নতুনের মাঝে ভয়ে কাতর সেই ছোট্ট পিচ্চিগুলো আজ কত বয়ষ্ক, জীর্ণ, আর ফেলে আসা দিনের টানে স্মৃতিকাতর।

হাউজে ফিরেই শেষবারের মত দেখে নেয়া আমার Dorm, Dorm-6, বেলকোনিতে ৫ মিনিটের জন্য বসা। আর… আর হাউজকে জানানো ‘শেষ বিদায়’…।

বাস্কেটবল গ্রাউন্ডে দাঁড়িয়ে শেষবারের মত সব স্মৃতিগুলো একটানে জোর করে চোখের সামনে টেনে আনা। সাভকাত, শাহাদাতের ডেমু। ৪৭জনের শেষ বারের মত এক ফ্রেমে আটকে রাখা…যেন সময়টাকেও বেধে রাখার মিথ্যে চক্রান্ত…।।

ফ্রেমে বাধা ৪৭টা প্রাণফ্রেমে বাধা ৪৭টা প্রাণ

 

 

ঠিক সেই মুহূর্ত আজীবন চোখের সামনে ভাসবে আমার। কলেজ ঘন্টার সামনে দাঁড়িয়ে আমি। সামনে ২৫০ ক্যাডেটের সারি পুরানোকে বিদায় জানানোর। পিছে বিদায়ের অপেক্ষায় থাকা ৪৭টা কম্পারটমেন্টের ট্রেন। বাজিয়ে দিলাম আমার বিদায় ঘন্টা।

মুহূর্তেই সব বরফ গলে নদী হয়ে গেল।

।

কান্নার সাত সাগর পাড়ি দিয়ে হকি মাঠের পাশের বেঞ্চে বসলাম। পাশে বসা শামীম এর শক্ত থাকার চেষ্টা ততক্ষনে বিফল হওয়ার পথে। সময় হল কলেজ বাসে উঠে পড়ার। ধীরে ধীরে পিছে ফেলতে লাগলাম ব্লক, প্রিন্সিপাল অফিস, কলেজ গেট; পিছে ফেললাম ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ।। সাঙ্গ হল আমার জীবনের এক স্বর্ণালী অধ্যায়ের। নিজেকে জানার, জীবনকে চেনার, বাস্তবতাকে বোঝার অধ্যায় পেরিয়ে ৪৭টা প্রাণের হৃদস্পন্দনকে সঙ্গী করে বরণ করে নিলাম ‘এক্স-ক্যাডেট’ উপাধী।

 

আরাপপুর বাস স্ট্যান্ডে নেমে যে দৃশ্যের সম্মুখীন সেদিন হয়েছিলাম, তা কোথাও বর্ণনা করতে পারব না। ওই সময়টা শুধু আমাদের। শুধুই আমাদের। ৪৭টা প্রাণের বাঁধনকে শক্ত করে বেধে ছড়িয়ে পড়া। শেষবারের মত একজায়গায় আমরা ৪৭ জন। হয়ত সারা জীবনের জন্য। এ বাঁধন বন্ধুত্বের না, এ বাঁধন প্রাণের। বন্ধুত্ব থেকেও বেশি।

 

আর হবে না প্রেপ টাইমের সেই ‘সব সময় ফান আর আজেবাজে গান’; ফর্মের এক কোণে সাক্ষরের ছোটখাট কোচিং সেন্টার।  তৌফিকের বইএর মধ্যে মুখ ডুবিয়ে পড়ার ধুম। বড় ভাই শাহাদাতের continuous পচানি খাওয়া, ভিজিটরস ডেস্কে সাভকাত আর পাশে আহসানের ধুমায়ে ডায়েরী লেখা, সাদমানের এক হাতে ম্যাথ করা আর মুখ দিয়ে আশপাশ মাতায়ে রাখা ( উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কিনা জানি না :p )। রিয়াজ দা সাইলেন্সার কাম র‍্যাঞ্চর :p , শাহারিয়া কোনদিন বই খুলসে কিনা কেউ দেখে নি। নাজিবুরের মুখ আর ইকবালের অত্যাচারে ( :p ) আমার মত নিরীহ প্রাণীদের বেঁচে থাকা দায়। মোহাইমিনের লাগাম ছাড়া মুখ, আসিফ-মির্জার ডেস্কের উপর বইএর স্তুপ, মাহমুদের ‘চু-বু-বু-বু-বু’, তমাল- সৈকতের সারা প্রেপ ধরে ফুটবলের টীম দাড় করানোর ব্যর্থ চেষ্টা। কিনানের হঠাৎ উত্তেজনা :p , সোহানের নায়ক নায়ক ভাব, মুহতাদীর ‘গুম পাইশশে’, ফুয়াদের অতিরিক্ত শীতলতা, সাদিক ভাইয়ের উদ্ভট কর্মকাণ্ড, রাকিবের নিরবতা,  ইমতিয়াজের ‘দরকার আছে’ …।।আর কোনদিনই একসাথে বসা হবে না।

 

হাউজের সেই মুহূর্তগুলো।। ছাদে, বেলকোনিতে, কমন রুমে, Dorm cricket, আড্ডা সব স্মৃতি হয়ে গেল এক নিমিষেই। সবাই একসাথে খেলা দেখা, পেয়ারা পাড়া, যখন তখন ফুটবল খেলতে নেমে পড়া। আর হয়ত টিভির রিমোট নিয়ে কাড়াকাড়ি হবে না। হাসিব আর বলবে না ‘হসপিটালে যাব করে যাওয়া হল না ( :p ), তালাতের রাগ, কিনানের যাত্রা, তোহফার বিদ্রোহী (!) ভাব, যদিও হেয়ার কাটের সময় সে-ই সবার আগে উপস্থিত ( :p ), হেফাজের কথা আর নাই বললাম। তাম্মাম, শাহারিয়ার সাথে আর হয়ত বেলকোনিতে বসে জীবন দেখা হবে না। হবে না পূর্ণিমা রাতে চাঁদের আলোয় গোসল।

 

ফুটবল মাঠের সেই নিয়মিত বাসিন্দাগুলো আজ সব কোথায় ছড়িয়ে…।। তমাল, নাহিদ, এমাজ, জাবির, মোস্তাফিজ, মোহাইমিন। সেই মাঠে আজও খেলা হয়, শুধু সেই চরিত্রগুলো অনুপস্থিত।

ফুটবল মাঠের চিরস্থায়ী বাসিন্দাফুটবল মাঠের চিরস্থায়ী বাসিন্দা

 

কলেজ স্টেজে সাক্ষর ও তার দলের সেই অত্যাচার, ‘অকাট প্রেম’…বড় ভাই, সাভকাতের ডেমু, ইকবালের অভিনয়…।। ‘প্রথম বারের মত’, ‘জোস তো’, ‘২০ মিনিট পর ফান’ আজীবন বেঁচে থাকবে তবু আমাদের মাঝে।

 

হয়ত অনেকের কথাই বলা হয় না। আলম,বায়েজিদ, আরমানের ভলিবল প্রেম, দীপনের কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না; ছবি আর মাউথ অরগান,আব্দুল্লাহ তো মাশাল্লাহ সব জানত ( :p ), নাঈমের ক্রিয়েটিভিটি, মেহেদীর স্পিরিট, জিফ্রুলের বাদরামতি, এমাজের ফুসফুস ঘাটতি, রুহানীর একাগ্রতা, রাব্বির ‘উউউউই ক্কোপ’, দিপাঞ্জনের পাঞ্জিগিরি ( :p ),শামীমের উদ্ভট ক্রিয়েটিভিটি। হয়ত অনেক কথাই থেকে যায় অন্তরালে। ফেলে আসা সেইসব হাজারো স্মৃতি। আজ একটি বছর পেরিয়ে গেছে সেই দিনের, যেদিন ফেলে এসেছি সেইসব দিনগুলি। ফেলে আসা ছয়টি বছর তবু আজও চোখের সামনে ঝড় তুলে যায় আজস্র স্মৃতির।

 

আর কখনো সেই চরিত্রগুলো একই ফ্রেমে আটকাবে কিনা সে প্রশ্ন সময়ের হাতেই ছেড়ে দিলাম। তবু আজ প্রহরান্তে এসে মন বারবার গায় সেই পুরনো গান নতুন করে-

 

‘দিনগুলি সব গেছে চলে, ধরে নিয়ে আয়’

 

১,৪২৪ বার দেখা হয়েছে

১১ টি মন্তব্য : “ধুলোজমা সেই জীর্ণ ডায়েরী : ৬ জুন, ২০১৩ এর প্রহরান্তে”

  1. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    আহ, দারুন লিখেছো, ছুঁইয়ে গেল। প্রতিটি এক্স ক্যাডেটেরই একই গল্প কিন্তু কখনোই পুরোনো হয় না :hatsoff:


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  2. রকিব (০১-০৭)

    গল্পগুলো বোধহয় আমাদের সবার খাতাতেই প্রায় এক রকম; নিজেদের কথাই যেন পড়া হয়ে যায় বারবার।
    নস্টালজিয়া ধরায়ে দিলা মিয়া।
    ভালো ছিল :clap:


    আমি তবু বলি:
    এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..

    জবাব দিন
  3. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

    আমরা যেদিন কলেজ থেকে বের হই সেদিন অন্য সবার ছুটি ছিল। সময় লাগে নি, ইমোশনাল হবার চান্সও বেশি পাই নি... 😀
    লেখা ভাল হয়েছে... :clap:

    তবে 'ধুলোজমা সেই জীর্ণ ডায়েরী' কেন? তুই গান্দা নাকি, এত তাড়াতাড়ি ধুলো জমে গেল কেন?? 😛


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : জিহাদ (৯৯-০৫)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।