একটি সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত

[আমার লেখা প্রথম গল্প ।]

আজ সকালের নাস্তাটা বেশ জম্পেশ ছিল – ব্রেড টোস্ট, বাটার, জেলী, ওমলেট, কলা আর অরেঞ্জ জুস । কিন্তু মায়ের শত পীড়াপীড়ি আর জিহবার আগা পর্যন্ত জল চলে আসা সত্ত্বেও টোস্টে দুটো কামড় বসিয়েই ১০০ মিটার স্প্রিন্ট দিয়ে বাড়ি থেকে বের হলাম । কেননা আমাদের গাড়ি দুটোর একটা আজ গ্যারেজে, অন্যটাতে আমার ছোট বোন গেছে ইউনিভার্সিটিতে । আমাকে এক্ষুণি এবং এক্ষুণি একটা ট্যাক্সি ক্যাব বা সিএনজি ম্যানেজ করতে হবে – এই মুহূর্তে !

ঘুম থেকে উঠতে দেরী যা হবার হয়ে গিয়েছে, পরের কাজগুলোতে আর দেরী করলে বিশাল অনর্থ ঘটে যাবে । কাজেই আমি ট্যাক্সি-ফ্যাক্সি কিছু একটা পাবার আশায় চাতকের দৃষ্টিতে আমাদের বিশাল অভিজাত বাড়ীটার সামনের রাস্তায় চেয়ে রইলাম । কিন্তু যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যা হয় – শালার সব ট্যাক্সি আর সিএনজিওয়ালা আজ বোধহয় আমার বিরূদ্ধে স্ট্রাইক করেছে !

মেইন রোড দিয়ে প্রায় আধ ঘন্টা হেঁটে যাবার পর যখন প্রায় দ্বিগুণ ভাড়া দিয়ে আমি একটা ট্যাক্সি ঠিক করতে সমর্থ হলাম ততক্ষ্ণে এই শীতেও আমার শরীরে ঘাম ছুটে গিয়েছে ! পরিশ্রমে নয়, টেনশনে । আজকের সকালটা যে আমার জন্যে খুব বেশী গুরুত্বপূর্ণ…

…’নাফিজ গার্মেন্টস’ । আমার বাবা ওয়াজেদ আলীর একক কৃতিত্বের ফসল এই গার্মেন্টসের নামকরণ বাবা কেন যেন আমার নামেই করেছেন; হয়তোবা তিনি আগেই আঁচ করতে পেরেছিলেন আমিই পারব এই গার্মেন্টসকে তাঁর স্বপ্নের কাছাকাছি পৌঁছে দিতে ।

বাবার মৃত্যুর পর মালিক হিসেবে আমার ওপরেই দায়িত্ব বর্তেছে এই গার্মেন্টসকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবার । সে লক্ষ্যে আমি পূর্ণোদ্যমেই কাজ করছি…এবং এখন পর্যন্ত ব্যর্থও হইনি !

যে কথা বলছিলাম – আজকের সকালটা আমার জন্যে অনেক গুরত্বপূর্ণ । আবুধাবীর আল-হাইথাম ইন্ডাস্ট্রীজ-এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর শেখ আব্দুল হাসান মুতা’আল্লীর সাথে সকাল ১১টায় আমার এ্যাপয়েন্টমেন্ট । ওই ভদ্রলোক আবার এ দেশে এসেছিলেন অন্য কোন কাজে । অন্য এক সূত্রে তাঁর আসার খবর পেয়ে আমিই অনেক দৌড়োদৌড়ি করি তাকে এই এ্যাপয়েন্টমেণ্টের জন্য আমার চিরচারিত মাখনগলা স্টাইলের অনুরোধ করি, এবং আমার তৈল গায়ে মেখে তিনি শেষ পর্যন্ত এই সাক্ষাতে রাজী হন, দুপুর ২টায় তাঁর রিটার্ন ফ্লাইট থাকা সত্ত্বেও !

মাত্র ১ ঘন্টার এ্যাপয়েন্টমেন্ট…আমার জন্যে যথেষ্ট । আমার প্রাথমিক উদ্দেশ্য, প্রথমেই তাকে তেলে ভিজিয়ে নরম করা, তাকে আমার গার্মেন্টসের বেস্ট কিছু স্যাম্পল প্রেজেন্ট করা আর তাঁর সাথে পরবর্তীকালে চলমান একটা সম্পর্ক সৃষ্টি করা । ভবিষ্যৎ এবং মূল উদ্দেশ্য- ব্যবসা । ওদেরকে আমাদের গার্মেন্টস থেকে কাপড় এক্সপোর্ট করা । আপাতদৃষ্টিতে আজকের মোলাকাত হয়ত সামান্য হালকা একটা বাত-চিত সেশন, কিন্তু ওপরে উঠতে হলে মইয়ের ধাপে ধাপে পা রেখেই উঠতে হয় । এটা হয়ত আমাদের গার্মেন্টসের জন্য আরেকটা মাইলফলকের সূচনা করবে ।

টাকা রে বাবা, টাকা ! অনেক টাকা বানাতে হবে আমাকে, অনেক ওপরে উঠতে হবে ! সাফল্যের অপর নাম অর্থ । অন্যের কথা জানি না- অন্তত আমার কাছে তাই । ……কিন্তু এদিকে ১১টা তো প্রায় বেজেই গেল !

মার্ফি’স ল যখন ফলে, ভালমতোই ফলে । রাস্তায় বেশ কিছু মানুষের জটলার কারণে ট্যাক্সিটা থামাতে হল । আমি মনে মনে ঢাকা শহরের রাস্তার সব মানুষের উদ্দেশ্যে খাঁটি বাংলায় একটা কুৎসিত গালি আওড়ালাম ।

ড্রাইভার ভিড় দেখে এসে ৩২টা দাঁত বের করে বলল ; “স্যার, একটা বাচ্চা পোলারে একখান মাইক্রোবাস ধাক্কা দিয়া ভাগছে । বাচ্চাডা বাঁইচা আছে, তবে পায়ের হাড্ডি ভাইঙ্গা গ্যাছে আর মাথা রক্তে ভাইসা যাইতাছে…”- তার হাবভাব দেখে মনে হল এমন মধুর দৃশ্য সে ইহজনমে দেখে নি !

শুনে মনে হল ব্যাপারটা একটু দেখা দরকার । গেল না হয় আরো দু’টা মিনিট । মানুষগুলোকে একপাশে সরিয়ে গাড়ি বের করতে সময় লাগবে না ।

একটু এগিয়ে ভীড় ঠেলে মাথাটা বের করতেই একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখলাম ।
ছেলেটা বয়স ১০-১১ হবে- কিংবা তারও কম । মাথার নীচটাতে রক্ত গড়িয়ে যাচ্ছে, একটা পা অদ্ভুতভাবে বাঁকানো, পরনে ছেঁড়া কাপড় আর সারা গায়ে ময়লা ; কিন্তু এসবের সাথে সম্পূর্ণ অসঙ্গতিপূর্ণ কী অসম্ভব মায়াকাড়া একটি চেহারা, কী অপূর্ব গভীর দুটি চোখ – যে চোখে দৃশ্যমান কেবল উপস্থিত সকলের কাছে একটু সাহায্যের আবেদন, এই পৃথিবীর কাছে প্রাণভিক্ষা…!

কে একজন বলল, “এরে এহনি হাসপাতালে নেওন দরকার । শালার হাসপাতালও এমুন দূরে ! কারও একটা গাড়ী থাকলে কাম হইত !”

ট্যাক্সি ড্রাইভার আমার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল- আমার দিকে সে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল ।
আমি দু’ সেকেন্ড ভাবলাম । তারপর বললাম, “গাড়িতে চল, সময় নাই।”
বলতে গিয়ে আমার গলাটা একটু কেঁপে গেল কি ?

… সে যাই হোক, আমার যা চিন্তা করার আমি চিন্তা করে ফেলেছি । এখন একে হাসপাতালে নেওয়া, ভর্তি করানো, তারপার আবার এ্যাপয়েন্টমেন্ট…নাহ্‌, এই ঢাকা শহরে অসম্ভব । ততক্ষণ ওই ব্যাটা শেখ এয়ারপোর্টে না গিয়ে আমার জন্যে অপেক্ষাও করবে না, আমারও একটা সম্ভাব্য বড় দাঁও হাতছাড়া হয়ে যাবে…সেটা আমার পক্ষে সম্ভব না ! আর আমাকেই কেন এই ছেলেকে নিতে হবে ? এখানে কি আর মানুষ নেই ?
গলা কাঁপল তো ? নো প্রবলেম, পরবর্তীতে যখন আরো প্রফেশনাল হব তখন আর গলা কাঁপবে না…
হ্যাঁ, আমাকে আরো প্রফেশনাল হতে, আরো আনেক উপরে উঠতে হবে, আনেক আনেক টাকা বানাতে হবে…

গাড়ি নিয়ে হুঁস করে বেরিয় যাওয়ার সময় এক ঝলকের জন্যে লোকগুলার বিস্ময় আর ঘৃণা মেশানো দৃষ্টি আমার চোখ এড়ালো না । সামনে বসা ড্রাইভারের চোখেও বোধহয় একই দৃষ্টি…

…আর ওসব দেখার বা ভাবার সময় আমার নেই- শেখ মুতা’আল্লী আমার জন্যে অপেক্ষা করছেন ।

২,৬৭০ বার দেখা হয়েছে

৪৭ টি মন্তব্য : “একটি সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত”

  1. আছিব (২০০০-২০০৬)

    🙁 ওরে ,দিলি তো মনটা খারাপ কইরা x-(
    কেবলই জুম্মার নামাজ পইড়া ফ্রেশ মাইন্ডে পড়তে বসলাম। ~x(

    যাউকগা...সময়োপযোগী গল্প লিখছস :clap: ,এইটা নিষ্ঠুরতা না,এইটাই বাস্তবতা 🙁

    জবাব দিন
  2. সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

    শেষ দিকটায় এসে আমি ভাবছিলাম, তুমি ওর মায়াকাড়া চেহারাটায় পটে যাবে। বলবে, গুল্লি মার টাকা-পয়সায়! ওকে তো আগে বাঁচানো দরকার!! কিন্তু পড়ে দেখলাম, আমার ধারণার সঙ্গে মিললো না, বিভ্রান্ত করেছ ভালোই। ঠিকই বলেচ ফারাবী, নিষ্ঠুর বাস্তবতা। এটাই ঘটে, এভাবেই আমরা নিজেদের রক্ষা করে চলি। ভালো লিখেছো। লিখতে থাকো। বই বের হলে খবর দিও। 😀


    "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

    জবাব দিন
  3. মিশেল (৯৪-০০)

    কি জানো, উপরে উঠতে গেলে নাফিজের ওই সিদ্ধান্তটাই সঠিক। নিষ্ঠুর হলেও এটাই বাস্তবতা। কিন্তু গল্প তো গল্পই। সেখানে একটু মানবিকতা দেখালে কি এমন ক্ষতি?

    মন খারাপ হয়ে গেলেও লেখা ভালো ছিল :thumbup:

    জবাব দিন
  4. রকিব (০১-০৭)

    ফারাবী ভাইইইই, গল্প ভালো হয়েছে।

    মার্ফি’স ল যখন ফলে, ভালমতোই ফলে ।

    মার্ফি'স ল টা কি?? :-/

    অফটপিকঃ এই লিঙ্কের লেখাটা পড়ে দেখতে পারেন। আপনার গল্পটা বোধকরি এর থেকে কিছুটা হলেও মানবিক।


    আমি তবু বলি:
    এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : ফারাবী (২০০০-২০০৬)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।