জীবনের জন্য ইন্টারনেট

বিশ্বব্যাংক গত বছর তাদের একটি গবেষণায় বলেছিল, বাংলাদেশে ৯০ ভাগ মানুষ এখনো ইন্টারনেট ব্যবহার করে না। নব্বই ভাগ অর্থ প্রায় ১৫ কোটির কাছাকাছি। ওদিকে বাংলাদেশ সরকারের হিসাবে ছয় কোটিরও বেশি মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন। এই দুই পরিসংখ্যান মিলছে না। বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্বব্যাংকের গণনার পদ্ধতি ভিন্ন, মতামত ভিন্ন। এই ভিন্নতা কেন হচ্ছে তা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। তবে এটুকু আশা করা যায় যে এই দুই পক্ষ একসঙ্গে কাজ করলে একটি চিত্র পাওয়া যেতে পারে।

ভাবছেন এ বিষয়টি কেন জানতে হবে? হ্যাঁ, কেনই-বা জানতে হবে? সঠিক পরিসংখ্যান না পেলে ইন্টারনেটকে সঠিক উপায়ে ব্যবহার করা যাবে বলে আমার মনে হয় না। এর ভবিষ্যত্ নিয়ে ভাবতে গেলেও এই পরিসংখ্যানটি জানতে হবে। তবে আজ আমি পরিসংখ্যান নিয়ে কথা বলতে বসিনি। ইন্টারনেট আমার নিজের জীবনে কিভাবে প্রভাব ফেলেছে, কতটা কাজে এসেছে, সে সম্পর্কে কিছু বলতে চাই। আমার সন্তানদের আমি এর কেমন ব্যবহার শিখিয়েছি, তা নিয়েও কিছু আলোচনা করতে চাই।

আমি ইন্টারনেট প্রথম ব্যবহার করার সুযোগ পাই ১৯৯৫ সালে। ডেইলি স্টার পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ করি। সে বছর কাগজটি তার অনলাইন সংস্করণ প্রকাশ করলো সারা বিশ্বে তখন ইন্টারনেটের ব্যবহার পুরোদমে চলছে। বিদেশি প্রায় সব পত্রিকারই অনলাইন সংস্করণ আছে। আমাদের পত্রিকার অনলাইন সংস্করণ ইন্টারনেটে পাঠায় একটি আই-টি কোম্পানি। আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হলো তাদের কাজ দেখাশোনা করতে। আমি ইন্টারনেট ব্যবহার শুরু করলাম। এটা আমার জন্য একটি অত্যন্ত ভালো সুযোগ ছিল।

এ কাজ করতে গিয়ে আমার এ অঞ্চলের অনেক সাংবাদিক এবং প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে গেল। সাংবাদিক হিসেবে আমার নেটওয়ার্ক অনেক বিস্তৃত হলো। এ পর্যায়ে আমি একজন পাকিস্তানি এবং একজন ভারতীয় সাংবাদিককে সাথে নিয়ে একটি আঞ্চলিক পোর্টাল প্রকাশ করলাম। নাম ছিল পিসমঙ্গার-ডট-কম। সময়টি ছিল ১৯৯৯ সাল। আমরা তিনজন তিন দেশে থাকি কিন্তু ঠিকই আমাদের পোর্টালের কাজ চলছে। আমরা চেয়েছিলাম এই অঞ্চলে শান্তির বার্তা ছড়িয়ে দিতে। যারা শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে যাচ্ছিলেন, তাদের লেখা ও খবর নিয়ে বেরুতো আমাদের পোর্টাল।

তখন থেকেই আমি ইন্টারনেট শুধুই নিজের জ্ঞান বাড়ানোর কাজে ব্যবহার করেছি। এখনো করে যাচ্ছি। মনে হয়েছে এটাই তো বিশ্বের সবচেয়ে বড় লাইব্রেরি। কী নেই সেখানে! বই, প্রবন্ধ, ভিডিও, অডিও সব। ২০০৪ সালে আমি বিবিসিতে কাজ করার সুযোগ পাই। এই সংবাদ সংস্থা যেভাবে ইন্টারনেট ব্যবহার করে খবর ও পর্যালোচনা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতো তা দেখে আমি মুগ্ধ। আমি আরো উত্সাহ পেলাম। বিবিসি আমায় শেখালো কী করে ইন্টারনেটে সঠিকভাবে সঠিক তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়, কী করে সার্চ-ইঞ্জিন ব্যবহার করতে হয়। তাদের এই শিক্ষা আমার কাজে যা সাহায্য করেছে তা বলে শেষ করা যাবে না। সত্যি বলতে কী, ১৯৯৫ সাল থেকে ইন্টারনেট আমাকে নানাভাবে, নানা বিষয়ে সাহায্য করে বিশ্বের সবচেয়ে বড় লাইব্রেরির কাছাকাছি এনে দিয়েছিল। আমার যা পড়ার প্রয়োজন তাই আছে ইন্টারনেটে। তারপর অনেক বছর কেটে গেছে। ইন্টারনেটের গতি ও ব্যপ্তি অনেক বেড়েছে। আমি আমার পড়াশোনা চালিয়েই গেছি।

কয়েক বছর আগের একটি গল্প বলি। আমার ছেলে তখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। একদিন সন্ধ্যায় দেখি সে ইংরেজি ব্যাকরণ নিয়ে কুস্তি করছে। জানতে চাইলাম কী হয়েছে। সে জানালো তার স্কুলের শিক্ষক ক্লাসে যা বলেছে তা সে বোঝেনি। আমি তাকে আমার ঘরে নিয়ে এলাম আমার ল্যাপটপের সামনে। ইউটিউব থেকে কয়েকটি ভিডিও বেছে তাকে দেখতে বললাম। আমি পাশে বসে রইলাম। সে সবগুলো দেখলো।

তার দিকে তাকিয়ে আবার জানতে চাইলাম। এবার সে বললো, ‘বাবা, বুঝে গেছি’।

তারপর থেকে আমার ছেলে তার অনেক পড়াশোনা এই ইউটিউবেই সারে। স্কুলে কিছু না বুঝলে ইন্টারনেট থেকে বুঝে নেয়।

পেছনের দিনগুলোর দিকে তাকালে দেখি আমার ও আমার পরিবারের সদস্যদের জীবনে ইন্টারনেটের অতল প্রভাব। শুধু আমরা নই, ইন্টারনেট সারা বিশ্বের কোটি-কোটি মানুষের জীবন বদলে দিয়েছে, জীবনের মানোন্নয়ন করেছে— পুরো সভ্যতার চেহারাকে বদলে দিয়েছে। এখন থেকে আরো ১০ বছর পরে কী হবে তা কি আমরা চিন্তা করতে পারি? আমরা ইন্টারনেট ব্যবহার করে এখন যেসব কাজ করি, সেখান থেকে ইন্টারনেট আমাদের আর নতুন কোন দিকে নিয়ে যাবে? তখন আমরা কি এখনকার আমাদের চিনতে পারবো?

এই ইন্টারনেট ব্যবহার করেই আমরা সবকিছুর খবরাখবর রাখতে পারবো। আমার সন্তান আমার অনুপস্থিতিতে কখন-কীভাবে স্কুলে যাচ্ছে, কখন স্কুল থেকে ফিরছে, কখন খেলতে যাচ্ছে। সময় আসছে যখন রোবট আমাদের বাড়ির ও অফিসের কাজে সাহায্য করবে, আমাদের বাজার করে দেবে, ঘর-দোর পরিষ্কার করবে, আমাদের গাড়ি চালাবে। আমাদের ঘড়ি কিংবা কলম আমাদের স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত সব তথ্য দিয়ে আমাদের খাওয়ার ব্যাপারে পরামর্শ দেবে, আমাদের ক্যালোরি মেপে দেবে।

এ কথাগুলো অনেকে ভবিষ্যতের ঘটনাবলি বলে আখ্যায়িত করে ইন্টারনেটকে খুব একটা মূল্য নাও দিতে পারেন। চিন্তা করে দেখলেই বোঝা যাবে যে এটি ভবিষ্যতের গল্প নয়। বিশ্বের অনেক দেশেই ইন্টারনেট মানুষের জীবনযাত্রার অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। দক্ষিণ কোরিয়ার কথাই ধরুন। মানুষ অফিসে বসেই ইন্টারনেটের মাধ্যমে জানছে তাদের ফ্রিজে কী কী খাবার আছে এবং কী কী নেই; আজ কী খাবার কিনে বাড়ি ফিরতে হবে। এটি কী করে সম্ভব হচ্ছে? ইন্টারনেটকে যন্ত্রের সাথে জুড়ে দিয়েই এ কাজ করা হচ্ছে। দিনে দিনে সব যন্ত্রের সাথেই ইন্টারনেট যুক্ত হচ্ছে, সব জিনিসের সাথেই ইন্টারনেট যুক্ত হচ্ছে; এক যন্ত্রের সাথে আরেক যন্ত্র ‘কানেক্টেড’ হয়ে যাচ্ছে। আমাদের টেবিল-চেয়ার থেকে শুরু করে চায়ের কাপ, থালা-বাসন, গাড়ি-সাইকেল— সবকিছুই ‘কানেক্টেড’ হয়ে যাচ্ছে। এক যন্ত্র আরেক যন্ত্র সম্পর্কে তথ্য পাচ্ছে। এ সবই হচ্ছে মানুষের কাজে সাহায্য করার জন্য। গুগল ও ফেসবুকের মতো কোম্পানিগুলো যন্ত্রের সাথে ইন্টারনেট যুক্ত করে যন্ত্রকে মানুষের ব্যক্তিগত সহকারীতে পরিণত করছে।

এই বাস্তবতায় আমার বাংলাদেশে ইন্টারনেট কোন পর্যায়ে রয়েছে? আমরা এ নিয়ে কী পরিকল্পনা করছি? আমরা কি সারা বিশ্বের ইন্টারনেটের যাত্রা ঠিকমতো দেখতে ও বুঝতে পারছি? ইন্টারনেটকে সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য যারা নীতিমালা তৈরি করেন তারা ঠিকমতো বিশ্ব-পরিস্থিতি বুঝতে পারছেন কী না তা ভেবে দেখা প্রয়োজন। এই ইন্টারনেট যন্ত্রের সাথে জুড়ে দিয়ে বাংলাদেশে এখন কী করা সম্ভব তা নিয়ে তারাও ভাবছেন কি না। ইন্টারনেট-ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ানোর জন্য আমরা কী কী পদক্ষেপ নিয়েছি বা নিতে চাই সেসব ভেবে দেখার প্রয়োজন রয়েছে। ইন্টারনেট সবার জন্য কী করে সহজলভ্য করা যায় তা ভেবে দেখার প্রয়োজন রয়েছে।

ইন্টারনেট ব্যবহারের আবার অনেক বিপজ্জনক দিকও আছে। হ্যাকাররা ওত পেতে আছে আপনার ব্যাংক একাউন্টে হামলা করার জন্য, মানুষ অযথা কাজের সময় নষ্ট করছে সামাজিক মাধ্যমে, অনেকে পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত হয়ে পড়ছেন, অনেকে আবার জঙ্গিবাদ শিখছেন। হ্যা, অবশ্যই অনেক অন্ধকার দিক আছে ইন্টারনেট-দুনিয়ার। কিন্তু এই দুনিয়া থেকে দূরে থাকার দিন বোধ হয় ফুরিয়ে গেছে। এখন দূরে না থেকে কী করে এর বিপজ্জনক দিকগুলো দূর করা যায়, তা ভাবার সময় এসেছে। এগুলো নিয়েও অনবরত কাজ চলছে, নিরাপত্তা বিধানের পথ খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে, পর্নোগ্রাফিক সাইটগুলো বন্ধ বা সরিয়ে ফেলার জন্যও বিশ্বব্যাপী কাজ হচ্ছে। ইন্টারনেট নিজের উন্নয়নে ব্যবহার করার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে ব্যবসায়ী ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো বেশ সজাগ। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান যারা ইন্টারনেট নিয়েই ব্যবসা করেন, তারা স্কুল-কলেজের ছেলে-মেয়েদের এর সঠিক ও নৈতিক ব্যবহার শেখানো শুরু করেছে। এই শিক্ষার প্রসার প্রয়োজন।

ইন্টারনেট-দুনিয়াকে আমরা যত বড় মনে করি এটা তার চেয়েও বড়। সে কারণেই মানুষ এখনো বুঝে উঠতে পারছেন না নিজেকে কীভাবে এই দুনিয়ায় বসবাসের যোগ্য করে তুলবেন। তবে আমরা এটুকু বুঝি যে এই ইন্টারনেট-দুনিয়াই আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যত্ পৃথিবী। ইন্টারনেট আমাদের জীবনের উন্নয়নের কাজে যত বেশি ব্যবহার করা যায়, ততই ভালো।

http://www.ittefaq.com.bd/print-edition/sub-editorial/2017/06/20/203787.html

৫,৫১৯ বার দেখা হয়েছে

১টি মন্তব্য “জীবনের জন্য ইন্টারনেট”

  1. খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

    এই ইন্টারনেট-দুনিয়াই আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যত্ পৃথিবী। ইন্টারনেট আমাদের জীবনের উন্নয়নের কাজে যত বেশি ব্যবহার করা যায়, ততই ভালো - অবশ্যই তা ভালো। শহরের ছেলেপুলেরা তাও ইন্টারনেট ব্যবহারে মোটামুটি সবাই অভ্যস্ত। গ্রামে গঞ্জে এর ব্যাপক প্রসার ঘটাতে হবে।
    তথ্যবহুল এবং প্রেষণামূলক এই পোস্টের জন্য ধন্যবাদ।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।