কলেজে গেলে ঘুমুতে ইচ্ছে করে না

আমাদের ক্যাডেট কলেজে গেলে আমার ঘুমুতে ইচ্ছে করে না। নাহ, যা মনে করছেন, তা নয়। না ঘুমিয়ে সারারাত গান শুনবো বা ডিজে’র সাথে সবার নাচ দেখবো সেকারণেও নয়। কলেজের আকাশে ফানুষ ওড়ানো দেখবো সেজন্যেও নয়।
শুধু মনে হয় ঘুমুলেই সময় নষ্ট হবে, কলেজটাকে মন ভরে দেখতে পারবো না। কবে সারা জীবনের জন্য ঘুমিয়ে যাই তার ঠিক নেই! তাই, না ঘুমিয়ে কলেজটাকে যত বেশি পারি দেখে নিতে চাই, কলেজের বাতাসের গন্ধ বুক ভরে নিতে চাই। যে বন্ধুদের সাথে বাল্যকাল কেটেছে, তাদের সাথে গল্প করে সম্য় কাটাতে চাই। আবার কবে একসাথে হব তার ঠিক নেই।
রিইউনিয়নে গেলে আমার একথাগুলোই মনে হয়। তাই, সবাই যখন গান শোনে, আমি সারা কলেজের পথ-প্রান্তরে হেঁটে বেড়াই। তাকিয়ে থাকি লাম্পপোস্টগুলোর দিকে, হাউসের সামনে কৃষ্ণচুড়া গাছগুলোর দিকে। মসজিদের বারান্দায় গিয়ে বসি, ভেতরে গিয়ে নামাজ পড়ি। অবস্ট্যাকল কোর্সের আর পিটি’র সময় দৌড়ানোর পুরো পথটা এক চক্কর দেই। জামা-কাপড়-যুতোর মাপ দেয়ার স্টোরের সামনে যাই। ডাইনিং হল, খায়বার ও হুনাইন হাউসের পেছনের দেয়াল যা টপকে রস পারতে আর ঝিনাইদাহ শহরে যেতাম সেটা দেখি। মাঠের তাকিয়ে দেখতে পাই সেই ১৯৭৮ সালের বালকেরা কেমন করে এই মাটিতে বিচরন করতো!
সবাই ক্যাডেট কলেজে যায় ক্লাস সেভেনে উঠে, প্রায় বারো বছর বয়ষে। আমি ঝিনাইদাহ ক্যাডেট কলেজে ঢুকেছি তিন বছর বয়ষে। তখন আমি ইশকুলেই পড়ি না। এটা সম্ভব হয়েছে আমার বাবার সুবাদে। তিনি ছিলেন আমাদের কলেজের শিক্ষক। আমার বন্ধু নাদীমের জন্মই হয়েছে আমাদের কলেজের কাম্পাসে। ক্লাস সেভেনে ভর্তি হওয়ার আগে ওর বাবাকে আমি ‘করিম চাচা’ বলে ডাকতাম।
এই কলেজে ক্যাডেট হিসেবে ভর্তি হওয়ার আগে কলেজের যে অঞ্চলে বসবাস করতাম সেই এলাকা আমার জন্য আরো বড় আকর্ষণ! এবারও রিইউনিয়নে গেলাম; প্রতিদিনই গেলাম।
আমরা যে বাড়িতে থাকতাম সেখানে এখন কে থাকেন জানি না। বাড়িতে ঢুকলাম। উঠোনে ঘুরে বেড়ালাম। আমার মায়ের লাগানো কয়েকটি গাছ এখনো আছে। তবে বেশির ভাগই নেই। এমন কোন শব্জি ছিল না যে আমার বাবা বাড়িতে চাষ করেন নি। গতবারেও আরো অনেক গাছ ছিল। এবার বাড়িটি একটু বেশি ন্যাড়া-ন্যাড়া লাগলো। সামনে গাড়ি বারান্দার দিকটা ফুলে-ফুলে ভরে থাকতো। এসবের কিছুই নেই। বাড়ির মধ্যে সবুজের পরিমান এ্যাতোই কমে গেছে যে বসবাসের যোগ্য মনে হল না। আমাদের আর হক চাচার [মিঃ আমিনুল হক, দশম ইনটেকের আশরাফ ও আফতাব ভাইয়ের বাবা] বাড়ি মাঝে একটি হেজ’গাছের সারি ছিল। সেখানে যায়গা পেয়েছে কাঁটাতারের বেড়া।
আমাদের বাড়ির পেছনে মাঠ। তার ওপারে নাদীমদের বাড়ি। ওদের বাড়ির সামনে গিয়ে বাড়িটা আরো ন্যাড়া লাগলো। করিম চাচী [নাদীমের মা] ছিলেন ফুলের বাগান করার ওস্তাদ। ওদের বাড়িতে যত ফুল ছিল তা বলে বোঝানো যাবে না। এমন কোন রঙ ছিল না যা ওদের বাড়িতে আমার চোখে পড়েনি। ছোটবেলায় ভাবতাম চাচী এ্যাতোগুলো ছেলে-মেয়ে নিয়ে এ্যাত্ত সুন্দর বাগান করার সময় কোথায় পান!
পাশেই মিঃ কামাল মাহমুদের বাড়ি। গেটের পাশেই ছিল কলেজের একমাত্র কাঁঠাল চাপার গাছ। গাছটি নেই। তার পাশেই ছিল নারকেল কুলের গাছ। তখন সারা কলেজে নারকেল কুলের গাছ ছিল এই একটাই। এই গাছটি আছে। মনটা ভরে গেল। কত খেয়েছি এই গাছের কুল। মৌসুম এলেই কামাল চাচা আমাদের সবাইকে ডেকে কুল খাওয়াতেন, সব বাড়িতেও পাঠাতেন।
মাঠের চারিপাশে কংক্রীটের বেঞ্চগুলো এখনো আছে। খালের পাড়ে নতুন বেঞ্চ বানানো হয়েছে। বসে থাকলাম প্রায় একঘন্টা। নাদীমকে ফোন করলাম; ও ধরলো না। অস্ট্রেলিয়ায় থাকে। আমার ছোট বোনের সাথে ফোনে চারিপাশের বর্ননা দিলাম।
তারপর হাঁটা দিলাম নাদীমদের আর পিটু ভাইদের [তেরো’তম ইনটেকের শাফাত রায়হান ভাই এবং মিঃ মুসলেউদ্দীন মন্ডলের ছেলে] বাড়ির মাঝ দিয়ে। পেছনে ছিল একটা খয়ের গাছের বন। পানের সাথে সবাই যে খয়ের খায় সেই খয়েরের বন। সেখানে আমার বাবা অনেকবার সাপ মেরেছেন। দু’একটা গাছ ছাড়া সেখানে বনের কোন চিহ্নমাত্র নেই।
তারপরদিন গেলাম মিঃ হান্নান আর আর মিঃ মুর্শেদের বাড়ির দিকে। মিঃ আল-ফারুক, মিঃ সিনহা ১৯তম ইনটেকের শাহেদ ফারুক সিনহার বাবা], মিঃ হাসান, মিঃ দেওয়ারী – এঁরা সবাই থাকতেন ওদিকে। মনের চোখে সবাইকেই দেখলাম। মন ভরে দেখলাম। যত খুশি তাকিয়ে থাকলাম এই বাড়িগুলোর দিকে। এই’তো পরদিনই ঢাকায় ফেরার সময় চলে আসবে। আর দেখতে পাবো না হয়’তো অনেকদিন।
এজন্যেই কলেজে গেলে আমার ঘুমুতে ইচ্ছে করে না।

৪,৬১১ বার দেখা হয়েছে

১০ টি মন্তব্য : “কলেজে গেলে ঘুমুতে ইচ্ছে করে না”

  1. অরূপ (৮১-৮৭)

    চমৎকার লেখা ইকরাম ভাই। একদম এই অনুভূতিটাই হয় কলেজে গেলে। :thumbup: :thumbup:
    এক মিনিট সময়্ও চোখ বুজে নষ্ট করতে ইচ্ছা হয় না। গত রি-ইউনিয়ানে একটা বাকেট লিস্ট নিয়ে গিয়েছিলাম।
    সবার ভিড়েও যাতে ঐ কাজগুলি ( জায়গা দর্শন) মিস না হয়।


    নিজে কানা পথ চেনে না
    পরকে ডাকে বার বার

    জবাব দিন
  2. তানভীর (২০০১-২০০৭)

    ভাই, স্মৃতির ভেলায় চড়ে বেড়িয়ে এলাম আর একবার.....সেই মাঠ, পিচঢালা সরু ছোট রাস্তা, হাউজ, টেইলরস শপ, আরো কতশত.... বলে শেষ হবে না, কারণ এই অনুভূতি কি শেষ হবার!!!!!


    তানভীর আহমেদ

    জবাব দিন
  3. লুৎফুল (৭৮-৮৪)

    মনের চোখে সবাইকেই দেখলাম। মন ভরে দেখলাম। যত খুশি তাকিয়ে থাকলাম এই বাড়িগুলোর দিকে।
    ~ সত্যিই। ওইটুকুন একচ্ছত্র নিজের।

    নস্টালজিক...
    কনটেজিয়াসলি নস্টালজিক ...

    জবাব দিন
  4. মাহবুব (৭৮-৮৪)

    মন্তব্য একটু দেরিতে দিলাম, বিষয়টা একেবারে মনের গভীরে না.ড়া দিয়ে গেছে
    কিছু জায়গা আছে যেখানে গেলে মনে হয় ঘুমাইলেই লস
    আর বাকী জায়গাগুলোতে ঘুম আসলেই বাঁচি

    অদ্ভুত সুন্দর লেখা, আরো ঘন ঘন চাই

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।