মানুষ যেনো কোরো না আমায়!

‘মানব’ ও ‘অধিকার’। এই শব্দ দু’টো কেন যেন আমায় টানে না। অনেকদিন ধরে মানবাধিকার নিয়ে প্রতিবেদন লেখা এবং বিশ্লেষন করার পরও ‘মানবাধিকার’ শব্দের কোন অর্থ মালুম হয়নি। আসলে মানবকে মানব না মনে করলে এই শব্দটির আভিধানিক অর্থ খোঁজার অর্থ আমি দেখি না। প্রায় সাতাত্তর বছর ধরে এ পৃথিবীর মানুষ অধিকারের কথা শুনে আসছে। মানবাধিকারের ঝান্ডাবাহী অনেক দেশ ও সংস্থা প্রতিনিয়তই শুনিয়ে আসছে যে মানুষের অধিকার থাকতে হবে এবং তা সমুন্নত রাখতে হবে। কিন্তু আমরা যখন একে-অপরের দিকে তাকাই, তখন কি মানুষ দেখি? বনের পশু দেখি আর একে-অপরকে শিকার করার জন্য ব্যাস্ত হয়ে যাই। জাতিসংঘের জন্য আমার করুনা হয়ঃ সেই আটচল্লিশ সাল থেকে চেষ্টা করে আসছে কিন্তু বিশ্বব্যাপী সাংগঠনিক প্রক্রিয়ায় চলমান মানবাধিকার ধর্ষনকে থামাতে পারছে না।
প্রায় চার বছর হতে চললো সিরীয়রা তাদের দেশ ছাড়ছে। প্রায় চল্লিশ লাখ মানুষ ঘরছাড়া হয়ে অন্য দেশে অনাকাংখিত হয়ে বসবাস করছে। কত মানুষ নিজের দেশেই খুন হয়েছে তা নাই বা বললাম। জাতিসংঘ নিজেই বলছে ‘প্রায় এক কোটি মানুষ সারা বিশ্ব জাতিসত্বাহীন হয়ে বসবাস করছে। অন্য দেশে জাতিসত্বাহীন মানুষের অধিকার? প্রশ্নই আসে না। রোহিঙ্গাদের জীবন কেমন কাটছে? তাদের প্রতি তাদের রাষ্ট্রের ব্যাবহার মনবতার প্রতি চরম অশ্রদ্ধা। ওদিকে ইসলামিক স্টেট দুই বালককে রোজা না রাখার জন্য ফাঁসী দিয়েছে! উত্তর ইরাকে মানুষ খুন চলছেই। পাকিস্তানে বোমা মেরে মানুষ খুন আরেক দল মানুষের জন্য শখে পরিণত হয়েছে। সৌদি আরবে গহকর্মীদের ঘুমের অষুধ খাইয়ে ধর্ষন চলছেই!
এসবই মানসিক বিকলাঙ্গতার নমুনা।
এক সময় আমরা উজ্জ্বল বর্নের মানুষ-আরোপিত দাসপ্রথার নিন্দা করেছি। দাসপ্রথার চেয়ে খারাপ মানবাধিকার লংঘন আর হতে পারে না। সেই দাসপ্রথা আনুষ্ঠানিক ভাবে শেষ হয়েছে বলে মনে করা হয় এবং একে মানুষের অন্যতম এক অর্জন বলে ভাবা হয়। কিন্তু আসলে কি মানুষ বিক্রি শেষ হয়েছে। আমরা কি দাসপ্রথা থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছি? দাসপ্রথার আসলে আধুনিকিকরন হয়েছে। আমরা মনে করতে পারি যে মানুষ হিসেবে আমরা শিক্ষিত হয়েছি, কিন্তু এই মুহুর্তেও প্রায় চার কোটি মানুষ এই নব্য দাসপ্রথার শিকার। দাসপ্রথা এখনো আছে। আইনের বাইরেও আছে, আইনের মধ্যেও আছে। মধ্যপ্রাচ্চ্যে বাংলাদেশী অভিবাষী শ্রমিকদের অবস্থা কেউ যদি জেনে থাকে তাহলে তাদের কর্মদাতাদের মানুষ ভাবতেই কষ্ট হবে। কাতারে ২০২২ বিশ্বকাপ উপলক্ষ্যে প্রচুর নির্মান কাজ চলছে। সেখানে বাংলাদেশী শ্রমিকদের পাসপোর্ট জোর করে রেখে দেয়া হয় যেনো তারা চাকরি ছেড়ে চলে যেতে না পারে। আর সমুদ্রপথে নৌকা চড়ে বর্মা হয়ে মালয়েশিয়া যাবার গল্প আর নাইবা বললাম।
দাসপ্রথার আরো দেখা মিলবে আফ্রিকার ঘানায় গেলে। সেখানে সোনার খনির শ্রমিকরা কোন আইনের আশ্রয় নিতে পারে না। নেপালে ‘কেবিন রেস্তোরাঁ’র’ নামে মেয়েদেরকে যৌনদাসত্ব করতে হয়। হিমালয়ে ছোট্ট বাচ্চারা পিঠে বড়-বড় পাথরের স্ল্যাব বহন করে ব্যাবসায়ীদের জন্য। ভারতের উত্তর প্রদেশে সিল্ক কারখানায় কাজ করে হাজারো দাস।
হতাশ হই যখন দেখি মানবাধিকার সমুন্নত রাখায় সারা বিশ্বজুড়ে যে সরকার সবচেয়ে বেশি সোচ্চার এবং বাকী সবাইকে মানবাধিকারের খোৎবা দিয়ে বেড়ায়, তারাই গুয়ান্তানামোতে অত্যাচার করে। তাদের পুলিশ বাহিনীই কোন কথা না বলেই মানুষ গুলি করে মারে। মানবাধিকারে চ্যাম্পিয়নরাই আবার আল-কায়েদা ও ইসলামিক স্টেটের মত জঙ্গীগোষ্ঠি তৈরী করে। তারা আজ পর্যন্ত কালো বর্নের মানুষের কাছে ক্ষমা চায়নি!
ইসলামিক স্টেটের জঙ্গীরা মানুষকে গলা কেটে মেরে ফেলা ছাড়া আর কিছু উদ্ধার করছে বলে’তো মনে হয় না। গত বছর নাইজেরিয়ায় বোকো হারাম জঙ্গীরা ২৭৬ মেয়েকে এক স্কুল থেকে তুলে নিয়ে যায় যাদের খোঁজ এখনো মেলেনি। নাইজেরিয়ায় শুধু ২০১৪ সালেই ৫,১০০ মানুষ খুন হয়েছে। তারপরও মানবাধিকারের ঝান্ডাধারীদের অস্ত্র বিক্রি সেখানে চলছেই।
আমেরিকার সিআইএ’র কথাই ধরা যাক। নাইন-ইলেভেন’এর পর থেকে আল-কায়েদা সন্দেহে কত সাধারন মানুষের ওপর যে তারা অত্যাচার চালিয়েছে তার হিসেব নেই। তাদেরই স্টেট ডিপার্ট্মেন্টের প্রতিবেদনই এ কথা বলা আছে। অপরাধ কমাতে কি এতোটা অত্যাচারী হতে হয়? এমন একটা দিন নেই যে মানুষের গলা কাটা হচ্ছে না এবং মানুষ বর্নবাদের শিকার হচ্ছে না। মেক্সিকো দেখেছে গলা কাটার উৎসব আর ইউরোপ দেখেছে বর্ণবাদের হুঙ্কার!
মানুষ হলেই অধিকার থাকতে হবে সেদিন বোধহয় শেষ। মাঝে মাঝে মনে হয় আল্লাহ বোধহয় মাদক-দস্যুদের সৃস্টি করেছেন সাধারণ পাপীদের শাস্তি দিতে। নাহলে মাদক-দস্যুরা সারাক্ষন মানুষ মারছে কেনো? আমাদের কি করার আছে? আমরা শুধু আমাদের পাপের জন্য আল্লাহ কাছে ক্ষমা চাইবো আর অমানুষের অত্যাচারগুলোকে আল্লাহ-প্রেরিত শাস্তি বলে মেনে নেবো।
মানুষ হয়ে না জন্মালে কি হোত? শিকার করতাম, খাওয়া-দাওয়া করতাম, সঙ্গম করতাম, বাচ্চা পয়দা করতাম এবং ভবিষ্যতের কোন চিন্তা না করেই একদিন মরে যেতাম
এখনো কি তাই করছি না?
সম্ভবতঃ সময় এসেছে “মানুষ” শব্দটির সঠিক অর্থ খোঁজার। তবেই আমরা অধিকারের কথা ভাবতে পারবো। তাকিয়ে তাকিয়ে শুধু দেখি সারা বিশ্বে কত মানুষ অভুক্ত থাকছে, কত মানুষের গলা কাটা হচ্ছে, কত মানুষ খোলা আকাশের নিচে বাস করছে, কত মানুষ অত্যাচারিত হচ্ছে! এই বিজ্ঞ্যানের যুগে প্রতিদিন ২৫,০০০ মানুষ না খেয়ে মারা যাচ্ছে। তাহলে কি তারা কম-মানুষ?
কেনো যেন খোদা’কে বলতে ইচ্ছে হচ্ছেঃ “এর পরের জনমে আমায় মানুষ কোরো না; মেঘ কোরো; না হয় পাখি কোরো”।

২,০৭৯ বার দেখা হয়েছে

১৩ টি মন্তব্য : “মানুষ যেনো কোরো না আমায়!”

  1. পারভেজ (৭৮-৮৪)

    একটা কথা কিন্তু ঠিক যে, সেই সময় থেকে মানবাধিকার নিয়ে আলাপ শুরু হয়েছিল বলেই আজ তুই এসব কথা বলার ও ভাবার সুযোগ পাচ্ছিস।
    সেদিন তা না হলে, আজ থেকে সত্তর পচাত্তর বছর পর তোর নাতি-পুতিরাই কেবল এসব নিয়ে কথা বলার সুযোগ পেতো।
    সাতাত্তর বছর আগে মানবাধিকারের যে অবস্থা ছিল, মানবাধিকার মানবাধিকার চিতকারে তা কিছুটা হলেও কিন্তু এগিতেছে।
    তবে "দূর্জনের ছলের অভাব হয় না"।
    তারা নতুন নতুন ছল-চাতুরি করে যাচ্ছে, যাবে।
    কিন্তু কত?
    একদিন তা শেষ হবেই।
    নরিয়েগার হয়েছে। পিনোশের হয়েছে। সাদ্দামের হয়েছে।
    অন্যদেরও হবে।
    কিছু সময় লাগছে। কিন্তু হবে যে, সেটা এখন নিশ্চিত।

    যতই দিন যাবে, মানবয়াধিকার পরিস্থিতি উন্নতি ছাড়া অবনতি যে হবে না, সে ব্যাপারে আমি আশাবাদি............


    Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

    জবাব দিন
  2. লুৎফুল (৭৮-৮৪)

    আমার কেবলি মনে জাতিসংঘের নামে মানবাধিকারের উসিলায় যে সংগঠনটির জন্ম হয় । তার জন্মের মধ্য দিয়েই সত্যিকারের মানবাধিকারের মৃত্যু হয়েছে । কারণ সংগঠনটির নিয়ম নীতি সব গোড়া থেকেই চরম বৈষম্যমূলক । যে সংগঠনের গঠনতন্ত্রেই মানুষকে বিভাজিত কতা হয়াছে বৈষম্যের ছকে, স্তরে স্তরে, সেই সংগঠন কি করে মানবাধিকারের সত্য ঝান্ডাধারী হতে পারে !
    মোড়লীপনা হলো শোষণের আদিতম কাঠামোর সূত্র । সেই মোড়লীপনায় চৌকষ থেকে চৌকষতর হয়ে উঠবার লক্ষ্যে নতুন মন্রে নতুন ক্যামোফ্লেজে শোষণের হাতিয়ার নয় একবারে কারখানাই তৈরী হয়েছিলো জাতিসংঘের গোড়াপত্তনের ভেতর দিয়ে ।
    আজ তাই সেই সংগঠনের অগ্রসৈনিক দেশটি গোটা পৃথিবীর সর্বত্র মানবাধিকারের একমাত্র সোল এজেন্ট হিসেবে আবির্ভূত ও প্রতিভাত । আর সেই সেই প্রদীপের নীচটুকু হচ্ছে সবচেয়ে অন্ধকার ।
    তাই মানব আজ পণ্য আর মানবাধিকার তার ঝা চকচকে বিপণন মোড়ক বই অন্য কিছু কোনোভাবেই নয় ।

    পূর্ণ সহমত লেখাটির সাথে । সলিডারিটি (দ্যা অনলি থিং দ্যাট উই পজেস) ।

    জবাব দিন
  3. ড. রমিত আজাদ (৮২-৮৮)

    নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক হ্যারল্ড পিন্টারের নোবেল বক্তৃতার একটি অংশ উদ্ধৃত করতে চাই -
    “আমার বিশ্বাস ব্যাপক বিরুদ্ধাচরণ সত্ত্বেও নাগরিক হিসাবে অনঢ় অবিচলতায় দৃঢ়তার সাথে সত্যের অনুসন্ধান এবং আমাদের জীবন ও সমাজে তাকে সংজ্ঞায়িত করা আমাদের পরম দায়িত্ব। প্রকৃতপ্রস্তাবে অবশ্য কর্তব্য। এই দৃঢ়তা আমাদের রাজনৈতিক জীবনে যুক্ত না হলে আর কোনোদিনই আমরা ফিরে পাব না যা প্রায় হারিয়েছি- মানুষের সম্মান।“

    জবাব দিন
  4. খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

    আজকের দিনে মানবাধিকারের ফাঁকা বুলিগুলো যেন প্রদীপের নীচের অন্ধকারের কথাই মনে করিয়ে দেয়।
    যুগোপযোগী একটা বিষয়ে চমৎকারভাবে আলোকপাত করার জন্য ধন্যবাদ।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : ড. রমিত আজাদ (৮২-৮৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।