বাংলাদেশ কি মোদিকে ভয় পাচ্ছে?

ভারতে নরেন্দ্র মোদি নির্বাচনের আগে তার সম্ভাব্য ভোটারদের, বিশেষ করে উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোতে, প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে তিনি নির্বাচিত হলে ‘অবৈধ’ বাংলাদেশিদের তাড়িয়ে দেবেন। তিনি জিতেও গেলেন এবং তার পরপরই ঘোষণা দিলেন তার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ে বাংলাদেশিদের বিতাড়িত করার জন্য একটা বিশেষ বিভাগ গঠন করবেন। বাংলাদেশের নেতা-নেত্রীরা কেমন যেন একটা অস্বস্থিতে পড়ে গেলেন। মোদি যে বাজপেয়ী নন এটা বুঝেই তিনি জেতার সঙ্গে-সঙ্গেই সবাই একযোগে তাকে অভিনন্দন জানালেন। এতে করে আমাদের কাছে বাংলাদেশি রাজনীতিকদের উদ্বেগ প্রকাশ পেয়েছে। কেউ-কেউ যে একেবারেই আনন্দিত হতে পারেন নি তা বোঝা গেছে। এমন কি এখানকার ডানপন্থিরাও বুঝে উঠতে পারছেন না কিভাবে বাংলাদেশ মোদিকে সামলাবে।
ওদিকে, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যেও মোদিকে নিয়ে উৎকন্ঠা ও রাগের বহির্প্রকাশ দেখা গেছে। সামাজিক মাধ্যমে মোদি-বিরোধী ঝড় বয়েছে। টুইটারে বলা হয়েছে, ‘হাসিনা বা খালেদা, কেউই মোদিকে সামলাতে পারবে না’। আরেকজন বলেছেন, ‘বাংলাদেশিদের ভারত থেকে বের করার আগে, পাঁচ লাখ ভারতীয় যারা টুরিস্ট ভিসা নিয়ে এখানে কাজ করছে তাদের নিয়ে যাও’। অনেকে ভারতীয় ফার্স্ট লেডি শুভ্রা মুখার্জির কথা মনে করিয়ে দিয়ে বলেছেন, ‘তাকে ভারত থাকে বের করতে পারবে? তিনিও’তো বাংলাদেশি!’।
সব মিলিয়ে এটা পরিস্কার হয়েছে যে মোদি এবং তার দল বাংলাদেশের নেতা-নেত্রী ও জনগনের মধ্যে একটা সন্ত্রস্ত ভাব তৈ্রী করেছে। সবাই মনে করছে এখন থেকে মোদির ভারত বাংলাদেশকে পিঁষতে শুরু করবে। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যায় এমন সব সিদ্ধান্ত বিজেপি নেয়া শুরু করবে।
তবে আসলেই কি গুজরাটের সেই দাঙ্গাকারী মোদি আর প্রধানমন্ত্রী মোদি একই ভাবে চিন্তা করবেন। প্রধানমন্ত্রীর পদে থেকে তিনি কি ২০০২ সালের সেই পুরোনো চিন্তায় সময় ব্যয় করতে পারবেন? স্থানীয় পর্যায়ে পেশী দেখানো আর জাতীয় পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়ার মধ্যে বিস্তর তফাৎ আছে। আজ তিনি গুজরাটের দাঙ্গাবাজ নন, আজ তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী। আজ তিনি ক্ষমতার দখলদার নন, আজ তিনি ভারতের ১২২ কোটি মানুষের ভাগ্যন্নয়নের দ্বায়ীত্ব পেয়েছেন।
বাংলাদেশের বিরুদ্ধে তিনি যে সিদ্ধান্তই নেন না কেনো, তা নির্ভর করবে রাষ্ট্র হিসেবে ভারত কি চাইছে তার ওপর। রাষ্ট্রই তাকে বলে দেবে কি করতে হবে, রাষ্ট্রযন্ত্রই তাকে বাতলে দেবে কিভাবে চলতে হবে। তিনি আর ‘স্থানীয়’ মানসিকতা নিয়ে বসে থাকবেন না। রাষ্ট্রযন্ত্র তাকে নতুন চিন্তাশক্তি দেবে তহন তিনি সবকিছুই কুটনীতির মাধ্যমে করার চেষ্টা করবেন যেখানে একক সিদ্ধান্তের কোন স্থান নেই। আর ভারত তেমন রাষ্ট্র নয় যে সরকার বদলের সাথে-সাথেই রাতারাতি রাষ্ট্রনীতি বদলে যাবে।
বাংলাদেশে বিএনপি যেমনটা মনে করছে যে মোদি সরকার এসেই এদেশে আওয়ামী লীগ সরকারকে সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করবে কারণ, বিএনপির মতে, আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আসতে সাহায্য করেছিল তাদের বিরোধী দল কংগ্রেস। আমাদের’তো মনে হয় কংগ্রেস যে কারণে বিএনপিকে সমর্থন দিতে রাজি হয়নি, ঠিক সেকারণেই বিজেপিও সমর্থন দেয়া থেকে বিরত থাকতে পারে। আওয়ামী লীগও কিছুটা এমন চিন্তা করেছে বলেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মোদিকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাংলা্দেশ সফরের আমন্ত্রন জানিয়েছেন।
নির্বাচনের আগে বাংলাদেশ-বিরোধী শ্লোগান দেয়া আর নির্বাচনের পর রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেয়া, দু’টো দু’রকম ব্যাপার। মোদি হয়তো নির্বাচনের আগে বাংলাদেশ-বিরোধী বক্তৃতা দিয়ে উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোতে সুনাম কুড়িয়েছেন, কিন্তু আদতে ‘অবৈধ’ বাংলাদেশিদের সেখান থেকে বের করে দেয়া কতটা সহজ? ভারতীয়রাই বলছেন কে ভারতীয় বাংলা ভাষাভাষী আর কে বাংলাদেশি বাংলা ভাষাভাষী তা বোঝা খুবই দুঃস্কর, যখন বিশেষ করে তাদের বাশিরভাগের কাছেই ভোটার ও রেশন কার্ড রয়েছে।
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল এখনো সমস্যা-মুক্ত নয় এবং সেখানে দিল্লি-বিরোধী অনেক শক্তির কার্যক্রম এখোনো অব্যাহত রয়েছে। সেখানকার সমস্যাগুলো কেন্দ্রীয় সরকার রাতারাতি সমাধান করতে পারবেন বলে মনে হয় না। উত্তর-পূর্বে বিচ্ছিন্নতাবাদের কারণে এই রাজ্যগুলো ভারতের জন্য বড় মাথাব্যাথার কারণ। বিচ্ছিন্নতাবাদীরা তাদের ধ্যান-ধারনা সেখানকার সব মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারেনি বটে, কিন্তু কেন্দ্রের জন্য সমস্যা তৈরী করে রেখেছে অনেক বছর ধরে। ধারনা করা হয় সেখানকার বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সাথে চীন, মিয়ানমার এবং বাংলাদেশের সম্পৃক্ততা রয়েছে বেশ অনেকদিন ধরেই, যা ভারতের জন্য একেবারেই স্বস্থিকর নয়। বাংলাদেশ গত পাঁচ বছরে এ ব্যাপারে ভারতকে বহুভাবে সাহায্য করেছে। ঢাকা এই সাহায্যটুকু থামিয়ে দিলে কি হতে পারে সেই বিষয়টি দিল্লি স্পষ্ট করেই বোঝে। ঢাকা নিস্পৃহ থাকলে সমস্যা বাড়তে পারে সেখানে।
নরেন্দ্র মোদি ইতিমধ্যেই ইঙ্গিৎ দিয়েছেন যে তিনি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তিস্তা পানি বন্টন চুক্তি বাংলাদেশের সাথে মিটিয়ে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে ফোন করে ঢাকায় আসার জন্য আমন্ত্রন জানিয়েছেন এবং তার কাছ থেকে আশাপ্রদ সাড়া পাওয়া গেছে বলে এদেশের গনমাধ্যমে খবর হয়েছে। তবে তিস্তা চুক্তি করতে গিয়ে পশ্চিম বাংলার নেতা মমতা ব্যানার্জীর কাছ থেকে যে বিরোধীতার মূখোমূখি তিনি হবেন তা মেটাতে তাকে বেশ বেগ পেতে হবে। এক্ষেত্রে ঢাকার সাহায্য মোদির দরকার হবে।
আবার আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের দিকে যদি নজর দেয়া যায়, দেখা যাবে সন্ত্রাসের কারণে ভারত বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। নিরাপত্তার দিক দিয়ে তথাকথিত আল-কায়েদা ভারতকে ভিষনভাবে ক্ষতি করেছে এবং এখনো করে যাচ্ছে। একটা হিন্দুত্ববাদী সরকার ক্ষতায় এলেই যে আল-কায়েদার সন্ত্রাস থামিয়ে দিতে পারবে তা নয়। এক্ষেত্রেও দিল্লির বাংলাদেশের সাহায্য প্রয়োজন হবে। কারণ বাংলাদেশে এখনো এমন অনেক সংগঠন, ব্যক্তি ও উপাদান রয়েছে যাদের না ঠেকালে ভারতের তথাকথিত ইসলামিক মৌলবাদকে উস্কে দেয়ার পেছনে কাজ করতে পারে বলে ভারতে অনেকে ধারণা করেন।
এবার আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে যদি তাকাই, বাংলাদেশের সাথে মার্কিনী নিরাপত্তা ও সামরিক সংলাপ বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদ দমন মানবিক সাহায্য, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা ও বঙ্গোপসাগরের নিরাপত্তায় তার অংশগ্রহন বাড়াতে চায়। এদেশের নৌবাহিনীর সাথে তারা একসাথে কাজ করতে চায়। ঢাকার পররাষ্ট্রনীতিতে আগে যা ছিল ‘পূর্বমুখী কুটনীতি’ এখন তা ‘রিজিওনাল কানেকটিভিটি’। ফলে চীন ও মিয়ানমার বাংলাদেশের কাছাকাছি আসার একটা সমুহ সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। ওদিকে, চীনও বাংলাদেশের সাথে সামরিক সম্পর্ক বাড়াতে নানা ধরনের নতুন উদ্যোগ নিচ্ছে। তারাও বঙ্গোপসাগরে তাদের উপস্থিতি চায় বলে জানা যাচ্ছে। মিয়ানমারে পরিবর্তিত রাজনৈতিক পটভূমিতে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন চাইছে বাংলাদেশের মত ছোট রাষ্ট্রগুলোর সাথে ইয়াংগনের সম্পর্ক বাড়ুক তা চাইছে। মিয়ানমার ও আসিয়ান দেশগুলোর সাথে ঢাকার ভালো সম্পর্ক দিল্লির পক্ষে স্বাগত জানানোর প্রশ্নই আসে না। আবার, বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীনের আগ্রহ ও নৌবাহিনীর সাথে মার্কিনীদের সহযোগিতা ভারত ভালোভাবে নেবে না। ভারত বাংলাদেশের সাথে এবিষয়ে কাজ করবে বলেই আমাদের মনে হয়।
এসব বিষয়গুলো চিন্তা করলে মনে হয় না যে মোদি সরকার পুরোপুরি কাজ শুরু করলেই বাংলাদেশ-বিরোধি কার্যক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়বে। বরং তারা বুঝে-শুনে, বিশ্লেষণ করেই ঢাকার সাথে সম্পর্ক আরো জোরদার করার চেষ্টা করবে বলেই মনে হয়। অন্তত ‘অবৈধ’ বাংলাদেশিদের তাড়িয়ে দেয়ার আগে এদেশ থেকে যে পরিমান রেমিট্যান্স সেদেশে যায় তার কথা’তো মাথায় রাখবেনই।

৭৪৮ বার দেখা হয়েছে

৫ টি মন্তব্য : “বাংলাদেশ কি মোদিকে ভয় পাচ্ছে?”

  1. মাহমুদুল (২০০০-০৬)

    চমৎকার লেখা। :thumbup:

    ঢাকা এই সাহায্যটুকু থামিয়ে দিলে কি হতে পারে সেই বিষয়টি দিল্লি স্পষ্ট করেই বোঝে।

    ঠিক বলেছেন। আমরা যে শুধু ভারতের মুখাপেক্ষী তা নয়। ভারতেরও অনেক কিছুই আমাদের কাছে ধরা। কিন্তু এই জিনিসগুলিই মনে হয় আমাদের রাজনীতিবিদরা বোঝেন না। তাদের ভারতের সাথে বন্ধুত্বের নামে যা প্রদর্শন করে তা একজন বাংলাদেশীর জন্য লজ্জাজনক। ভারতের মোদী কিংবা তাঁর সরকারকে 'ট্যাকল' করার মত অনেক হাতিয়ার আমাদের হাতে রয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, এগুলির কিছুই আমরা ব্যবহার করতে পারব না। কেন পারব না তা বলার মনে হয় প্রয়োজন নেই।

    লেখার শেষ দুই প্যারার সাথে কঠিনভাবে একমত। :thumbup:

    এমন আরো লেখা আশা করছি ভাই 🙂


    মানুষ* হতে চাই। *শর্ত প্রযোজ্য

    জবাব দিন
  2. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    ভালো লেখা।

    ভারতকে আমরা নয় বরং ভারতের উচিত আমাদের ভয় পাওয়া।

    সাদ্দাম - গাদ্দাফি অনেক তো আমরা দেখেছি। আসলে যতো গর্জে, ততো বর্ষে না।

    তবে আমি মনে প্রাণে চাই মোদি তার কথা রাখুক। উদা

    * বাংলাদেশে গরু রপ্তানি।
    * সীমান্তে চোরাকারবারি বন্ধ বা নজরদারি বৃদ্ধি।

    নদীর পানি নিয়া আমি চিন্তিত না। যদিও সেটাই বড়ো চিন্তার বিষয়। আন্তর্জাতিক আদালতে একটা কেস ঠুকে দিয়ে আমাদের উচিত সেই চিন্তা করা কিভাবে পানি নিজেদের জন্য ধরে রাখা যায়।
    আর অবৈধ বাঙলাদেশি থাকলে ওরা তো বের করে দিতেই পারে, তাই না।

    তবে এসব করার আগে মোদি তার ভাইদের জন্য টয়লেটের ব্যবস্থা করুক এতেই বেশই প্রীত হবো।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
  3. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    আপনার লেখায় রাজনৈতিক বিশ্লেষণের পাশাপাশি একই সাথে অবৈধ বাঙলাদেশিরা যাতে ভারতে থাকতে পারে সেই আকুতি দেখতে পাচ্ছি।
    এইখানে কিন্তু এই হিসাবটা মাথায় রাখতে হবে, উলফা-টুলফা বাদে বাঙলাদেশে বসবাসকারী অবৈধ ভারতীয় কতো?
    ওরা যারা এদেশ থেকে টাকা নিয়া যাচ্ছে, মানে টুরিষ্ট ভিসায় এসে কাজ করছে ট্যাক্স ফাকি দিচ্ছে তাদের চুরিতে কিন্তু আমরা সাহায্য করছি। আমাদের আয়কর, কাষ্টমস যদি সারা বছর গাঞ্জা খাইয়া ঘুমায়, আমি নিজে যদি আমার কোম্পানিতে নিয়মের মার প্যাচে ভারতীয় দের কাজে নিই তাহলে দোষটা কাকে দিবো?
    _ চোট্টা ভারতীয়দের
    _ মোদীকে
    _ আমাদের নিজেদের কে?

    আবার বলবো আমাদের যারা অবৈধ তোমাদের দেশে আছে তাদের কে রেখে দাও।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।