দিন যায় কথা থাকে-৩

মহাশয় হাউজ কাঁপিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠেন “চিয়ারের পাইয়া ধরে শুয়ে পড় বাপু ” অগত্যা হারাধনের তিন ছেলে নীল রঙা স্লিপিং ড্রেসে রঙ চটা সবুজ কার্পেটের জমিনে নিজের বুক বিছিয়ে দেয়, শক্তহাতে চেয়ারের পায়া ধরে দাঁত চেপে অপেক্ষা করে, শাল কাঠের বেতের বাড়ি খাওয়ার জন্য। ঘাস পোকাকে আমরা শয়তানের ঘোড়া বলতাম, গরমকালে যখন শয়ে শয়ে শয়তানের ঘোড়া আমাদের নাগালে এসে ধরা দিত, ধরে ধরে আমরা ভার্জিনের ক্যান ভর্তি করতাম। সময় বুঝে-বন্ধুর মশারীর ভিতর ছেড়ে আনন্দলাভ করতাম। সেই আনন্দলাভে আগুন জ্বেলে হারাধনের বাপ আজকে আমাদের কয়েক হাত দেখে নিচ্ছেন । তখন ছোট বাচ্চা আমরা ক্লাস সেভেনে পড়ি। এমনিভাবে মহাশয় ডেকেছেন আমাদের কত-শতবার। সেবার যখন একাদশ শ্রেণীতে আমরা পড়ি, ঘড়ি দেখার দায় কাঁধে নিয়ে নিজের সেই দামী স্যান্ডেল জোড়া হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল নিজেকে ব্যাচের প্রথম ক্যাডেট বলে ভাব নেয়া ছেলেটির। অথবা সেবার যখন মহাশয় ঝিনাইদহ কলেজের ক্যাডেটদের উপর রাইফেল চার্জের কথা বলছিলেন, সাধ্যের সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করেছিলাম হাসিটা চাপিয়ে রাখতে। পারলাম কই না হেসে? সহসাই যখন মহাশয় হাসির হেতু জিজ্ঞাসিলেন, নিজের অজান্তেই বলে দিলাম স্যার আমার দাঁতের ব্যাথা। দাঁতের ব্যাথায় মানুষ কিভাবে হাসতে পারে সেটা মহাশয়ের বোধগম্য হয় নাই, আমারও না, এখনও হয় না।
একাদশের বি ফর্মের ডান দিকের কোণায় খানিকটা ইউ শেপ নিয়ে আমাদের অবস্থান ছিল। পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষকের অভিশাপ মাথায় নিয়ে যেবার আমরা ফেইল করেছিলাম এই বিদ্যায়। যিনি আমাদের একটু একটু মানুষ করে তোলার চেষ্টায় প্রতিদিনের প্রেপেই চলে আসতেন। মাঝে একদিন বাদ পড়ে গেলে-আমরা গলা ছেড়ে গান তুলতাম “তুমি এসেছিলে পরশু, কাল কেন আসনি”, টার্ম শেষে পদার্থবিদ্যায় উত্তীর্ণের আবেদন নিয়ে স্যারের নত মাথায় গাঁড়িয়ে থাকলে উপায় বলেছিলেন স্যার। পিছনের তাসনীম, সামনের রাজন এবং তার পাশে মহিউদ্দিন, নিহাদের সঙ্গে কথা বললেই সহজে পদার্থবিদ্যায় উত্তীর্ণ হওয়া যাবে বলে উনি মনে করেন। স্যারের চেষ্টা বৃথা যায়নি, এখনো আমরা প্রতিদিন একটু একটু মানুষ হয়ে ওঠার চেষ্টা করি।
ডেস্কের উপর বই দিয়ে বাঙ্কার বানিয়ে ঘুম দিত মহিউদ্দিন। ঘুমে ব্যাঘাত ঘটিয়ে স্যার ডেকে তুলে কৈফিয়ত চাইলে ঘাড় ঘুরিয়ে অস্বীকৃতি জানাত উদ্দিন । এবং সে বিষয়ে আমাদেরও সমর্থন কামনা করত। আমরাও তাই বলি, ঘুম থেকে উঠেই কেউ মিথ্যা বলতে পারে নাকি!
জিল্লুর স্টাফ নাম লেখেন সেটাই স্বাভাবিক, তাই স্বপ্নেও দেখতে হবে তাকে? স্বয়ং রুমে ঢুকে নাম নোট, তাও ঘুম থেকে তুলে? স্বপ্ন আর কই? ঘুম কাটতেই বাস্তবে ফিরে শুনি এডজুএডেন্ট স্যার ডাকেন। সেবার ক্রিকেট চলে, খেলোয়াড় কোটায় স্পেশাল লাঞ্চ করে আর মাঠে যেতে মন চাইল না, সেদিন খেলাও ছিল না আমাদের। কিন্তু হাজিরা তো দিতেই হবে, আর না হলে এডজুডেন্ট স্যার ডাকতেই পারে। ঘর থেকে বেরিয়ে সবসময়ের সঙ্গী মহিউদ্দীনকেও চোখ ফুলিয়ে বের হতে দেখি। ঘুম পার্টি যখন প্যারেড করে এডজুডেন্টের কাছে যাচ্ছিল জামাল স্টাফ তখন একেকজনের বলস ছেঁচে দেওয়ার হুমকী দিচ্ছিলেন। এত বড়ো বিপদ সেবার হয় নি। সবার ৫০০ টাকা জরিমানা। বন্ধু উদ্দিন এবং আমার ১০০০ টাকা। ওয়ার্নিং লেটার আর জরিমানার চিঠি দুজনের নামে একসাথেই ইশ্যু হত। ওরা এগারোজনেও আমরা ছিলাম, হাতে নাতেই ধরেছিলেন পদার্থবিদ্যার সেই শিক্ষক।
বিকালে চা খাওয়ার সময় হলে, সারা হাউজ যতক্ষণে খালি হয়ে গেছে। পায়জামার ফিতা লাগাতে লাগাতে কাঁধে পাঞ্জাবী ঝুলিয়ে দৌড় দিতাম, কিছু ভাল লাগার স্মৃতির মধ্যে এটাও একটা। আর বাথরুমের গান তো কিছু ছিল এর মধ্যে পূর্ণ আবেগ নিয়ে গাওয়া বন্ধুবরের “নিঃসঙ্গ বসে একটি মেয়ে শুধু বকে,শুধু বকে” ছিল এপিক।
প্যাচাল মেলা হল, লাইনে আসি। একজনের গতকাল ছিল। আরেকজনের আগামীকাল, একটু পরেই। হাইড কেন হে শুধালে একজন উত্তর দিয়েছে “কিছু কথা থাক না গুপন”, আরেকজনও এমন কিছুই বলবে হয়তো। সে যাই হোক, দুইজনকে একসাথেই শুভেচ্ছা জানায়ে দিলাম। কিছু কিছু দিন উপলক্ষ্যে কিছু কিছু স্মৃতিকে সামনে নিয়ে আসি। স্মৃতি এখন সুন্দরী, ছলনাময়ী, ছেড়ে যাওয়া দূর সম্পর্কের প্রেমিকা। হাসায়, কাঁদায় আবার ভাবায়। জন্মদিনের শুভেচ্ছা ডিরেক্ট বলতে লজ্জা লাগে রে, কি আর করা, কিছু কথা নাই বা বলি, তারপরও বলি, জন্মদিনের শুভেচ্ছা-মহিউদ্দিন, জন্মদিনের শুভেচ্ছা তাসনীম

১,৬২৫ বার দেখা হয়েছে

৭ টি মন্তব্য : “দিন যায় কথা থাকে-৩”

  1. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    কলেজের স্মৃতিকথার এই একটা মজা, পড়ার সময় মনে হয় নিজের কথাগুলোই যেন পড়ছি। দারুন করে লিখেছো :thumbup:

    তাসনিম আর মহিউদ্দিনকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  2. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

    আমার কাছে কলেজের স্মৃতিচারণগুলোই সিসিবি'র মূল আকর্ষণ মনে হয়... 😀
    জন্মদিনের শুভেচ্ছা পৌঁছে দিস... :party:


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন
  3. মহিউদ্দিন (২০০২-২০০৮)

    আমার মতো অধমের জন্মদিন এত বড় মাপের লেখকের লেখনির বিষয়বস্তু হতো না যদি ক্যাডেট কলেজ নামক হতচ্ছাড়া জায়গায় না পড়তাম। কান্তিকে ধন্যবাদ দিব না। সে আমার ভাই। 😀 😀 😀 ভাইয়া, আপু আর ছোটরা সবাইকে অনেক অনেক ধন্যবাদ এত কষ্ট নিয়ে আমাদের ঢিলামির গল্প পড়ার জন্য। বন্ধুত্ব চিরতরুণ। :boss: :boss: :boss:


    Prisoner of Own Mind

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।